যোগাযোগ–৩২ তম অংশ– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

সিঁড়ির তলা থেকে মধুসূদন ফিরল, বুকের মধ্যে রক্ত তোলপাড় করতে লাগল। একটা কোন্‌ রুদ্ধ ঘরের সামনে কেরোসিনের লণ্ঠন জ্বলছিল। সেইটে তুলে নিয়ে চুপি চুপি তেলবাতির কুঠরির বাইরে এসে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে দরজা ঠেলতে গিয়ে দেখলে দরজা ভেজানো; দরজা খুলে গেল। সেই মাদুরের উপর গায়ে একখানা চাদর দিয়ে কুমু গভীর ঘুমে মগ্ন— বাঁ হাতখানি বুকের উপর তোলা। দেয়ালের কোণে লণ্ঠন রেখে মধুসূদন কুমুর মুখের দিকে মুখ করে বাঁ পাশে এসে বসল। এই মুখটি যে মনকে এমন প্রবল শক্তিতে টানে তার কারণ, মুখের মধ্যে তার একটি অনির্বচনীয় সম্পূর্ণতা। কুমুর আপনার মধ্যে আপনার কোনোদিন বিরোধ ঘটে নি। দাদার সংসারে অভাবের দুঃখে সে পীড়িত হয়েছে কিন্তু সেটা বাহ্য অবস্থাঘটিত ব্যাপারে, সেটাতে তার প্রকৃতিকে আঘাত করে নি। যে সংসারে সে ছিল সে সংসার তার স্বভাবের পক্ষে সব দিকেই অনুকূল। এইজন্যেই তার মুখভাবে এমন একটি অনবচ্ছিন্ন সরলতা, তার চলাফেরায় তার ব্যবহারে এমন একটা অক্ষুণ্ন মর্যাদা। যে মধুসূদনকে জীবনের সাধনায় কেবল প্রাণপণ লড়াই করতে হয়েছে, প্রতিদিন উদ্যত সংশয় নিয়ে নিরন্তর যাকে সতর্ক থাকতে হয়, তার কাছে কুমুর এই সর্বাঙ্গীণ সুপরিণতির অপূর্ব গাম্ভীর্য পরম বিস্ময়ের বিষয়। সে নিজে একটুও সহজ নয়, আর কুমু যেন একেবারে দেবতার মতো সহজ। তার সঙ্গে কুমুর এই বৈপরীত্যই তাকে এমন প্রবল বেগে টানছে। বিয়ের পরে বধূ শ্বশুরবাড়িতে প্রথম আসবামাত্রই যে কাণ্ডটি ঘটল তার সমস্ত ছবিটি যখন সে মনের মধ্যে দেখে তখন দেখতে পায় তার নিজের দিকে ব্যর্থ প্রভুত্বের ক্রুদ্ধ অক্ষমতা, অন্য দিকে বধূর মনের মধ্যে অনমনীয় আত্মমর্যাদার সহজ প্রকাশ। সাধারণ মেয়েদের মতো তার ব্যবহারে কোথাও কিছুমাত্র অশোভন প্রগল্‌ভতা দেখা গেল না। এ যদি না হত তা হলে তাকে অপমান করবার যে-স্বামিত্ব তার আছে সেই অধিকার খাটাতে মধুসূদন লেশমাত্র দ্বিধা করত না। কিন্তু কী যে হল তা সে নিজে বুঝতেই পারে না; কী একটা অদ্ভুত কারণে কুমুকে সে আপনার ধরাছোঁয়ার মধ্যে পেলে না।

মধুসূদন মনে স্থির করলে, কুমুকে না জাগিয়ে সমস্ত রাত্রি ওর পাশে এমনি করে জেগে বসে থাকবে। কিছুক্ষণ বসে থেকে থেকে আর কিছুতেই থাকতে পারলে না— আস্তে আস্তে কুমুর বুকের উপর থেকে তার হাতটি নিজের হাতের উপর তুলে নিলে। কুমু ঘুমের ঘোরে উস্‌খুস্‌ করে হাতটা টেনে নিয়ে মধুসূদনের উলটো দিকে পাশ ফিরে শুল।

মধুসূদন আর থাকতে পারলে না, কুমুর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললে, “বড়োবউ, তোমার দাদার টেলিগ্রাম এসেছে।”

অমনি ঘুম ভেঙে কুমু দ্রুত উঠে বসল, বিস্মিত চোখ মেলে মধুসূদনের মুখের দিকে অবাক হয়ে রইল চেয়ে। মধুসূদন টেলিগ্রামটা সামনে ধরে বললে, “তোমার দাদার কাছ থেকে এসেছে।” বলে ঘরের কোণ থেকে লণ্ঠনটা কাছে নিয়ে এল।

কুমু টেলিগ্রামটা পড়ে দেখলে, তাতে ইংরেজিতে লেখা আছে, “আমার জন্যে উদ্‌‍বিগ্ন হোয়ো না; ক্রমশই সেরে উঠছি; তোমাকে আমার আশীর্বাদ।” কঠিন উদ্‌‍বেগের নিরতিশয় পীড়নের মধ্যে এই সান্ত্বনার কথা পড়ে এক মুহূর্তে কুমুর চোখ ছল্‌ ছল্‌ করে উঠল। চোখ মুছে টেলিগ্রামখানি যত্ন করে আঁচলের প্রান্তে বাঁধলে। সেইটেতে মধুসূদনের হৃৎপিণ্ডে যেন মোচড় লাগল। তার পরে কী যে বলবে কিছুই ভেবে পায় না। কুমুই বলে উঠল, “দাদার কি চিঠি আসে নি?”

এর পরে কিছুতেই মধুসূদন বলতে পারলে না যে চিঠি এসেছে। ধাঁ করে বলে ফেললে, “না, চিঠি তো নেই।”

এই ঘরটার মধ্যে রাত্রে দুজনে এমন করে বসে থাকতে কুমুর সংকোচ বোধ হল। সে যখন উঠব-উঠব করছে, মধুসূদন হঠাৎ বলে উঠল, “বড়োবউ, আমার উপর রাগ কোরো না।”

এ তো প্রভুর উপরোধ নয়, এ যে প্রণয়ীর মিনতি, আর তার মধ্যে যেন আছে অপরাধীর আত্মগ্লানি। কুমু বিস্মিত হয়ে গেল, তার মনে হল এ দৈবেরই লীলা। কেননা, সে যে দিনের বেলা বার বার নিজেকে বলেছে, ‘তুই রাগ করিস নে।’ সেই কথাটাই আজ অর্ধরাত্রে অপ্রত্যাশিতভাবে কে মধুসূদনকে দিয়ে বলিয়ে নিলে।

মধুসূদন আবার তাকে বললে, “তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছ?”

কুমু বললে, “না, আমার রাগ নেই, একটুও না।”

মধুসূদন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল। ও যেন মনে মনে কথা কইছে; অনুদ্দিষ্ট কারও সঙ্গে যেন ওর কথা।

মধুসূদন বললে, “তা হলে এ-ঘর থেকে এসো তোমার আপন ঘরে।”

কুমু আজ রাত্রে প্রস্তুত ছিল না। ঘুমের থেকে জেগে উঠেই হঠাৎ মনকে বেঁধে তোলা কঠিন। কাল সকালে স্নান করে দেবতার কাছে তার প্রতিদিনের প্রার্থনা-মন্ত্র পড়ে তবে কাল থেকে সংসারে তার সাধনা আরম্ভ হবে এই সংকল্প সে করেছিল। তখন ওর মনে হল, ‘ঠাকুর আমাকে সময় দিলেন না, আজ এই গভীর রাত্রেই ডাক দিলেন। তাঁকে কেমন করে বলব যে, “না।” মনের ভিতরে যে একটা প্রকাণ্ড অনিচ্ছা হচ্ছিল তাকে অপরাধ বলে কুমু ভয় পেলে। এই অনিচ্ছার বাধা তাকে টেনে রাখছিল বলেই কুমু জোরের সঙ্গে উঠে দাঁড়ালে, বললে, “চলো।”

উপরে উঠে তার শোবার ঘরের সামনে একটু থমকে দাঁড়িয়ে সে বললে “আমি এখনই আসছি, দেরি করব না।”

বলে ছাদের কোণে গিয়ে বসে পড়ল। কৃষ্ণপক্ষের খণ্ড চাঁদ তখন মধ্য-আকাশে।

নিজের মনে মনে কুমু বার বার করে বলতে লাগল, ‘প্রভু, তুমি ডেকেছ আমাকে, তুমি ডেকেছ। আমাকে ভোল নি বলেই ডেকেছ। আমাকে কাঁটাপথের উপর দিয়েই নিয়ে যাবে— সে তুমিই, সে তুমিই, সে আর কেউ নয়।’

আর-সমস্তকেই কুমু লুপ্ত করে দিতে চায়। আর-সমস্তই মায়া, আর-সমস্তই যদি কাঁটাও হয় তবু সে পথেরই কাঁটা, আর সে তাঁরই পথের কাঁটা। সঙ্গে পাথেয় আছে, তার দাদার আশীর্বাদ। সেই আশীর্বাদ সে যে আঁচলে বেঁধে নিয়েছে। সেই আঁচলে-বাঁধা আশীর্বাদ বার বার মাথায় ঠেকালে। তার পরে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করলে। এমন সময় হঠাৎ চমকে উঠল, পিছন থেকে মধুসূদন বলে উঠল, “বড়োবউ, ঠাণ্ডা লাগবে, ঘরে এসো।” অন্তরের মধ্যে কুমু যে বাণী শুনতে চায় তার সঙ্গে এ কণ্ঠের সুর তো মেলে না! এই তো তার পরীক্ষা, ঠাকুর আজ তাকে বাঁশি দিয়েও ডাকবেন না। তিনি রইবেন আজ ছদ্মবেশে।

গল্পের ৩৩ তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!