হারানো নদির স্রোত-সপ্তম অংশ।

 

 

ঠাকুরদাস মিত্তির বলল, মুকুন্দদার মাথায় গোলমাল হয়ে গেছে, আমাকে আপনি বলবে কেন, ইংরিজি পড়তে বসে মুকুন্দদার হাতে চড়চাপড়ও খেয়েছি কম না, আমার বাহাত্তর হল।

খবর দিল কে? আমি জিজ্ঞেস করেছি।

দিল কে? একজন, তার সঙ্গে গোবরডাঙা ষ্টেশনে আলাপ, বিকেলবেলা, সে বাংলাদেশ থেকে আসছে।

সিকান্দার আলি?

হবে হয়তো, মনে পড়ছে না, খুব লম্বা, যাবে মসলন্দপুর, ওপার থেকে ভোটের পর যারা পালিয়ে এসেছে, তাদের নিয়ে যেতে এসেছে।

নীল পাঞ্জাবি?

না, প্যান্ট শার্ট, হ্যাঁ নামটা মনে পড়ছে-জাফর মণ্ডল, সেই কিনা একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল, তাতে তোমার মা বাবার নাম লেখা, কোথায় থাকেন খোঁজ নিল।

সেই জাফর কোথাকার লোক?

কাটিপাড়া, তোমার মামার বাড়ির দেশ।

কত বয়স?

বেশি না বছর পঞ্চাশ।

কিন্তু বাবার অসুখের খবর দিল কে?

কেউ দেয়নি রে, ওই কাগজটায় মুকুন্দদা আর বউদির নাম দেখে আমার বুক হু হু করে উঠল, মন টানল, তোর কাকিমাকে বললাম, চলো মুকুন্দদাকে দেখে আসি, তিনি আমাদের বড়ভাই-এর মতোন। তিনি না থাকলে আমরা ভেসে যেতাম, যদি তিনি বেঁচে না থাকেন মহাপাতক হব, দাদাকে আমার গান শুনিয়ে আসব, মেয়েজামাই থাকে কসবা, তাদেরও খবর দিলাম ফোনে, ও মুকুন্দদা, বড়দা চিনতে পারছ না তুমি?

বাবা হাসলেন, চেনা যাচ্ছে আবার যাচ্ছেও না, তবে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি আপনি যে বড়দলের লোক তা শুনে, আমার বাসা বড়দলের লোকের জন্য, বড়দলের মানুষ তো পথে ঘুরতে পারে না, স্টেশনে থাকতে পারে না, তাদের আশ্রয় দিতেই হবে, আপনার নাম?

মন খারাপ হয়ে গেল। কী হল? শেষের ক’দিন স্মৃতিভ্রংশ হয়ে বেঁচে থাকবেন বাবা? ঠাকুরদাস মিত্তির যে লোকটার কথা শুনিয়ে গেল, সেই জাফর মণ্ডল আর সিকান্দার যে এক নয় তা তার বর্ণনায় বোঝা গেছে। সে হল কাটিপাড়ার লোক। কাটিপাড়ায় মায়ের বাপের বাড়ি। সেই গাঁয়ের লোক এপারে এসে আমার মা বাবাকে খুঁজছে। আশ্চর্য! বাবার আর কী পরিচয় ওই কাটিপাড়ায়? জামাই। মার জন্ম ওই গাঁয়ে। সিকান্দার আলি এনেছে রোশোনারার মৃত্যুসংবাদ, ওই জাফরই আবার কার খবর বয়ে এনেছে এদেশে তাই বা কে জানে?

মা শুনতে শুনতে বলল, ইকবালভাইদের কেউ হবে।

কে ইকবালভাই? রীনা মুখ টিপে হাসে।

স্বদেশী করত, জেল খেটেছিল তার তিনভাই-ই, এখন কি কেউ বেঁচে আছে?

তাদের নাম মনে পড়ল কেন?

মা বলল, ওরা তোর বাবাকে খুব করে বলেছিল দেশ না ছাড়তে, কিন্তু ওদের সাধ্য ছিল না দাঙ্গা থামানোর।

আমরা স্বামী স্ত্রী ভাবতে লাগলাম লোকটা যদি সত্যি সত্যি আস্তে চায় আমার মা বাবার কাছে, ঠিক চলে আসবে। অনেকদিন বাদে গঙ্গায় স্টিমারের ভোঁ শোনা গেল। আমরা অপেক্ষা করছিলাম কারোর জন্য, সে ওপার থেকে মায়ের কাছে এতবছর বাদে ইকবালভাইদের খবর আনবে।

কেমন ছিল ইকবালভাইরা? রীনা জিজ্ঞেস করেছে মাকে।

খুব সুপুরুষ, লম্বা, বাংলার মাটি বাংলার জল গাইত যখন…। মা কথা থামিয়ে বাংলার মাটি বাংলার জলের কথা ভাবছিলেন।

তারা এপারে আসেনি মা, আপনারা যে চলে এলেন? রীনা জিজ্ঞেস করে।

না আসেনি, বলেছিল, কোনওদিন আসবে না।

কেন?

মার মুখ থমথম করছিল, মাথা নাড়ছিলেন মা। রীনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছিল। মা বলতে চাইছিলেন না আর কিছু। শুধু আর একবার বললেন, তাঁদের দালানে এক সন্ধেয় তিন ভাই মিলে বাংলার মাটি বাংলার জল গেয়েছিল, মনে আছে, খুব মনে আছে, এখনও কানে লেগে আছে। তিনভাই পিঠোপিঠি। এক দেড় বছর অন্তর অন্তর জন্মেছিল তারা। তিনজনই সুন্দর। তিনজনের গানের গলাই সুন্দর। তিনজনের ডাকই সুন্দর।

রীনা আমাকে অনেক রাত্তিরে বলল, তোমার ঠাকুরদাসকাকা কিছু মনে রাখতে পারেন না, কী বলতে কী বলছেন খেয়ালও করতে পারেন না, হয়তো সিকান্দার আলির সঙ্গেই দেখা হয়েছিল তাঁর, তুমি না বলেছিলে লোকটা গোবরডাঙ্গা গেছে।

 

হারানো নদির স্রোত-অষ্ঠম  অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!