হারানো নদীর স্রোত-৬ষ্ঠ অংশ

 

নার্সিং হোমে বাবাকে ভর্তি করে আমি সমস্ত রাত্রি একা একা বসে থাকলাম নীচে রিসেপশনে। ভগ্নিপতি অফিসের কাজে বাইরে, টেলিফোনে বোন ঝুমা কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। রাত যত বাড়তে লাগল, নার্সিং হোম চুপচাপ হয়ে গেল। ব্যস্ত পায়ে সিস্টারদের চলাফেরা দেখতে দেখতে ঝিমিয়ে পড়তে লাগলাম আমি একা। এখন এই এত রাত্তিরে যদি বাবার কিছু ঘটে যায়, আমি একা কি করব? ভয় করতে লাগল। আমাদের বাসা বাড়িতে একসময় কত মানুষ থেকে গেছে। তারা সবাই ভুলে গেছে আমাদের।

পরদিন রবিবার। বাড়ি ফিরলাম সকাল আটটা নাগাদ। মা, রীনা উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিল। সব খবর নিয়ে রীনা বলল, ওই লোকটা না এলে এসব হত না।

আহা ওর কী দোষ?

অদ্ভুত মানুষ! কী করতে এসেছিল ওই সিকান্দার আলি, কেন এসেছিল?

আমি বললাম, সে তো তুমিও শুনেছ, নদীর মৃত্যু সংবাদ দিতে।

উঁহু! মাথা নাড়ল রীনা, ও এসেছিল রোশোনারা বিবির মৃত্যুসংবাদ দিতে, আর তা শুনেই বাবার উপর অ্যাটাকটা হয়ে গেছে, এখন যদি বাবার কিছু হয়ে যায়।

আমি চুপ করে থাকলাম। রীনা চাপা গলায় বলতে লাগল, কাল সমস্ত রাত মাও ঘুমোয়নি। মা কেঁদেছে, বলছে, ওই রোশোনারা টেনেছে বাবাকে। দেশ আলাদা, কত বছর কেটে গেছে, বুড়ো হয়ে গেল সবাই, মরণের বয়স এসে গেল, তবু কিনা সে ঢুকে পড়ল এই সংসারে। আঞ্জুমান কম কেঁদেছে ওই রোশোনারার জন্য! কী দেমাক তার!

আমি বললাম, না নদী শুকিয়ে গেছে, এটা সহ্য করতে পারেনি বাবা।

কী জানি। মা তো কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, মরে কবরে গিয়েও রূপে ভোলাচ্ছে রোশোনারা, এত রূপ ছিল কেন তার? এত রূপ যে ভোলা যায় না মরণের পরেও, পরের জন্মেও মনে থাকে, কত চুল ছিল রোশোনারার, কেমন টানা টানা চোখ ছিল, দুধে-আলতায় রং ছিল, পায়ে ঘুঙুর ছিল, সেই টেনেছে বাবাকে।

না, না, বাবা নদীর শোক পেয়েছেন।

মাথা নাড়ল রীনা, রোশোনারা বিবির দিকে তাকালে নাকি চোখ জুড়িয়ে যেত, মা নিজেও নাকি চোখ ফেরাতে পারত না, মৃত্যুর সময় রোশোনারা বলে গিয়েছিল এখানে খবর দিতে, কেন বলে গিয়েছিল বলো দেখি?

মাকে দেখলাম মুখ থমথম করছে। ন্যুজ হয়ে গেছে মা এক রাত্তিরেই। আরও বুড়ি হয়ে গেছে আমার মা। পরাজিতের মতো ঘাড় হেঁট করে বসে আছে বিষাদ প্রতিমা। আমি মায়ের গায়ে হাত রাখলাম, ভাবছ কেন, বাবা ঠিক ফিরে আসবে এখানে।

নব্বই বছরের বুড়ো মানুষকে ওইসব খবর দিতে এল কেন এত বছর বাদে? ও কার ছেলে, আঞ্জুর না রোশোনারার? মার গলা ভার।

বাবা সহ্য করতে পারেনি নদীর শুকিয়ে যাওয়ার কথা। আমি বোঝালাম মাকে।

মা চুপ করে থাকল। রোশোনারার কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারে না মা। চোখ মেলে আছে জানালা দিয়ে খোলা আকাশে। স্পষ্ট যেন দেখতে পাচ্ছে কাউকে।

সেদিন বিকেলে আমি আর রীনা নার্সিং হোমে গিয়ে দেখলাম বাবা ঘুমিয়ে। চোখমুখে কী প্রশান্তি। ঠোঁটের কোণে আবছা হাসি। স্বপ্ন দেখছেন হয়তো। বোন এসেছিল। শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকল সমস্ত সময়। সে বিনবিন করে বলল, বাবা নার্সিং হোমে, আমাদের কি আর কেউ নেই দাদা, সব তোকে করতে হবে, কত লোক থেকেছে আমাদের বাসায়…।

পরদিন আমাকে যেতে হল আপিসে। ছুটির ব্যবস্থা করে নার্সিং হোমে পৌঁছতে বিকেল সাড়ে চারটে। নীচে দাঁড়িয়ে আছে রীনা। ভিজিটিং আওয়ার শুরু হয়ে গেছে, এখনও নীচে কেন?

রীনা বলল, ওপরে ঝুমা আছে, আরও চারজন এসেছে গোবরডাঙা থেকে।

গোবরডাঙা? কারা?

আমি তো চিনি না, ঝুমা জানে হয়তো।

বাবার অসুখের খবর কে দিল?

আজ দুপুরে বুড়োবুড়ি আমাদের বাড়ি গিয়েছিল, মা চেনে, মা দেখে কাঁদতে লাগল, ওখান থেকেই খবর নিয়ে এসেছে।

আশ্চর্য! খারাপ খবর কি আপনা আপনি চলে যায়। বাতাসে বাতাসে?

গোবরডাঙা থেকে ঠাকুরদাস মিত্তির সপরিবারে এসেছে। ঠাকুর কাকা? তিনি তাঁর স্ত্রী, মেয়ে জামাই নিয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে। আমি দেখলাম লোকটা বুড়ো হয়ে গেছে। মাথার সব চুল সাদা। লোকটা গ্রাম সম্পর্কে কাকা। ভাল গান গাইত। অর গানের রেকর্ডও বেরিয়েছিল এক সময়। রেডিওতে হয়েছিল। তারপর তো আর যোগাযোগ নেই কোনও। কতদিন হয়ে গেল। কত বছর! হিসেব নেই।

বাবা বেডে বসে আছেন। হাসছেন, বলছেন, আপনারা যে এসেছেন তাতে খুব ভাল লাগছে, আপনি যে কষ্ট করে এত দূরে-!

বাবার কথাগুলো খুব স্বাভাবিক নয়। স্পষ্ট চিনতে পারছেন না ঠাকুরদাস মিত্তিরকে। আমাদেরও না। বাবা বলছেন, আপনি তাহলে বড়দলের লোক, খুব ভাল কথা, বড়দলে দুই নদী কপোতাক্ষ, বেতনা, এতদিনে নদী মরে গেছে না বেঁচে আছে কে জানে, আপনি বড়দলের খোঁজটা এনে দিন।

 

হারানো নদীর স্রোত সপ্তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!