বাবা বললেন, তুই দ্যাখ ফ্ল্যাট, আমি এখানেই থেকে যাই।
তুমি থেকে যাবে, আমি চলে যাব?
না, না তা কেন, যে বিলই আসুক, আমি তো থাকতে পারবই যতদিন বেঁচে থাকব।
একদিন রীনা বলল, বাবা কেন অন্য জায়গায় বাড়িঘরদোর করেননি?
কথাটা মা’র কানে গেল। মা বলল, উপায় ছিল না।
সবাই তো করেছে মা, ওদিকে গড়িয়া, বাঘা যতীন, নাকতলা বাঁশদ্রোণী সব ভরে গেল বাড়িতে, এদিকে দমদম, বিরাটি, সোদপুর, আগরপাড়া-কত কত জায়গা ছিল, এখন আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই।
মা চুপ করে থাকল কিছু সময়, তারপর বলল, কত লোক ছিল এই বাসায়।
কত লোক? এক একদিন তিরিশজনের ভাত রেঁধেছি পর্যন্ত।
কেন রেঁধেছিলেন, তারা কেউ খোঁজ নেয়?
মা বলল, না রেঁধে উপায় ছিল না, এই একটাই বাসাবাড়ি, তারা ওপার থেকে এসেছে, থাকার জায়গা ছিল না।
তা তো হল, একটা বাড়ি করা যেত মা।
চন্দননগরে পাওয়া গেছিল।
চন্দননগর! অত দূরে?
গঙ্গার ধারে খুঁজছিল তোমার বাবা।
গঙ্গার ধারে কেন?
নদী না থাকলে মানুষের জীবন শুকিয়ে যায় মা।
রীনা অবাক। তার মানে? আমি যে বাঁকুড়ার মেয়ে, মানে আমার বাবা যে চাকরি করতেন বাঁকুড়ায়, সেখানে নদী কই?
ছিল না?
রীনা চুপ করে থাকল কিছু সময়, তারপর বলল, ছিল, খুব ছোট নদী।
তবু নদী তো।
হ্যাঁ, সারা বছর জল থাকত না গন্ধেশ্বরীতে, শুধু বর্ষায় বান ডাকত।
মা বলল, আমরা খোঁজ নিয়েছিলাম।
কী খোঁজ?
মা হাসল, তোমাদের মায়ের বাপের বাড়ির পাশে মধুমতী নদী ছিল, তোমার বাবারা ছিলেন বালুরঘাটের মানুষ, ওখানে আত্রেয়ী নদী।
হ্যাঁ মা, তাতে কী হল? নদীর ধারেই তো মানুষ বাস করত।
নদীর ধারের মানুষ ভাল হয়, তাদের মন নরম হয়।
কে বলল?
তোমার শ্বশুরমশাই।
না মানে, বাবা কি করে জানলেন?
উনি জানেন।
রীনা বলল, আমাদের বাড়ি হল না কেন?
বলছি তো নদীর কাছে জায়গা মেলেনি তাই।
মা আর রীনায় যে কথা হয় তার কিছু কিছু আমি শুনতে পাই। রীনা সমস্ত দিন বাড়ি থাকে, বুড়ো শ্বশুর, শাশুড়ি আর ছেলেই তার জগৎ। ছেলে এখন বড় হয়ে গেছে, তাকে এখন ছোঁয়াও কঠিন, সব সময় সাইকেল নিয়ে ছুটছে এ কোচিং সে কোচিং, ক্রিকেট ম্যাচ, কম্পিউটার সেন্টার। গঙ্গায় সাঁতারটা শুধু আটকেছে রীনা। গঙ্গার জল তার কাছে খুব ভয়ের, মাঝে মধ্যে তো খবর হয় অমুক ঘাট থেকে তলিয়ে গেছে মানুষ, অমুক ঘাটে এসে ঠেকেছে জলে ডোবা মাছে খাওয়া লাশ। বলতে গেলে রীনার চাপেই আমি বাড়ি খুঁজছি। এ পাড়ায় ফ্ল্যাট যে কিনতে পারব না আমি তাতে রীনা খুব খুশি। রীনা চায় এই গঙ্গার কূল ছেড়ে আমরা অন্য কোথাও চলে যাই যেখানে নদী থাকবে না। তার কিশোর পুত্রটিকে নিয়ে তার কোন উদ্বেগ থাকবে না।
আমি অন্য বাসস্থান খুঁজছিলাম। একটু আলো, একটু হাওয়া, দেয়ালের মসৃণতায় রঙের গভীর আবরণ, নতুন জানালা, নতুন দরজা, মোজাইক মেঝে থেকে শীতে হিম, বর্ষায় স্যাঁতসেতে জলীয় ভাব উঠে আসবে না পায়ের পাতায়-এমন কোন বাড়ি, ফ্ল্যাট, না-হলে জমি। এই পুরনো বাড়ি বলি, ফ্ল্যাট বলি, বাসা বলি-এখানে আর থাকতে ভাল লাগে না। দক্ষিণের হাওয়া আসত আগে, ওদিকে একটা বহুতল উঠে তা বন্ধ করে দিয়েছে। দেওয়াল, মেঝে সব জল টেনে নিচ্ছে মাটি থেকে, তাই স্যাঁতসেতে ভাব সবসময়। প্লাস্টার খসে যাচ্ছে হোয়াইটওয়াশ করা দেওয়ালের, মেঝের খাবলা উঠে যাচ্ছে। কবে যে এ বাড়ি ছেড়ে পারব রীনা বলে।
রীনার সঙ্গে আমার কথা হয় রাতে। রীনা সব বলে। বাবা কী বলেন, মা কী বলেন, আমাদের ছেলে শুভম কী বলে, প্রতিবেশীরা কী বলে, এমন কী থালাবাসন প্লাস্টিকের বালতি মগ ফেরি করা লোকটাই বা কী বলে।
বাবা একদিন বলেন, খুঁজছিস বাসা?
বাসা না নিজের বাড়ি।
বাগবাজার ছেড়ে চলে যাবি?
আমাদের নিজেদের বাড়ি হবে না?
বাবা বললেন, তুই যাবি, আমি তোর মাকে নিয়ে থেকে যাব এখানে, এই শেষ বয়সে আমি গঙ্গা ছেড়ে যাব না।
ওসবের কোন মানে আছে?
বাবা হাসলেন, আছে, মরি তো গঙ্গাতীরেই মরি, নিমতলা, কাশীমিত্তির ঘাট কত কাছে, নদীর ধারে থাকলে মনে বৈরাগ্য আসে।
আমি চুপ করে থাকলাম। সেই সময় একদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার সময় দেখি পায়জামা পরা, গালে মুসলমানি দাড়ি এক প্রৌঢ় অনাথ বিশ্বাস বাই-লেনে কেমন দিশাহীন হয়ে ঘুরছেন, তেতাল্লিশ এর ডি বাই ফাইভ নম্বর বাড়িটা কোথায় হতি পারে বলতি পারেন, এহেনে নম্বর ঠিক পরপর নেই।
কথার টানে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। এত চেনা উচ্চারণ, ভঙ্গি। কই এখন তো আর এমন টানা শোনা যায় না বাবার মুখে, মায়ের মুখে। হারিয়েই গেছে এই ভাষা।
হারানো নদীর স্রোত ৪র্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।