ময়না পাখি, বনস্পতি ও কাক: একটি আধুনিক রূপকথা

অনেক অনেক দিন আগের কথা। জাল সম্রাজ্যের কোন এক প্রান্তে বিশাল এক জঙ্গল। সেখানে বিশাল বিশাল বনস্পতি গাছেদের বাস। সেখানে, একটু দূরে, একদিন জন্ম নিলো ছোট এক বনস্পতি। ছোট হোক বনস্পতি তো। নতুন গাছ দেখে সেখানে আশ্রয় নিলো বড় বনস্পতিতে থাকা কিছু ময়না পাখি। যারা কালের বিবর্তনে কথা বলা শিখছে। সুন্দর সুন্দর কথা বলে। চলতে পথে পথিকদের থেকে নতুন নতুন কথা শিখে সেগুলোই বলতে থাকে। দিন যায় । বড় বড় বনস্পতির ছায়ায় ছোট বনস্পতি বড় হতে পারে না। কেউ তার গোড়ায় পানিও দেয় না । কিছু দিন পর সেই সব ময়না পাখি বুঝলো নাহ এই বনস্পতি হয়ত বড় হবে না । তাই তারা আস্তে আস্তে বনস্পতিকে ছেড়ে চলে গেলো। মাঝে মাঝে আসে , আবার চলে যায় বড় বনস্পতিতে ।
কিছু ছন্নছাড়া কাক এসে বসলো একদিন সেই ছোট বনস্পতিতে। কাকেদের মনে হলো এইতো তাদের কাঙ্ক্ষিত জায়গা। যেখানে গলা ছেড়া কা কা করায় কেউ বাধা দিবে না। তারা ঠিক করল তারা এইখানেই থাকবে । কিছু দিন পর তাদের নিয়মিত আসা যাওয়ায় বড় বনস্পতিদের অনেক পাতা পড়ে গেল। তৈরী হলো রাস্তা। সেখান দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ল ছোট বনস্পতির উপর। কাকেরা ঠোটে করে বিন্দু বিন্দু পানি এনে দিতে লাগলো বনস্পতির গোড়ায়। আবার প্রানবন্ত হতে শুরু করলো ছোট বনস্পতি।
দিন যায় । বড় হয় ছোট বনস্পতি। কাকেদের উৎসাহ উদ্দীপনা বাড়ে। একদিন হঠাৎ তারা দেখতে পেলো কিছু ময়না পাখি। তাদের জিজ্ঞেস করলো আপনারা কারা? তারা জানালো তারা বনস্পতির আদি বাসিন্দা। কাকেরা খুব খুশী হয়ে উঠলো। ভাবলো ময়না পাখিদের থেকে বুলি শিখবে। ময়না পাখিদের পেয়ে খুব খুশী তারা। স্বপ্ন দেখা শুরু করলো একসাথে তারা থাকবে, আড্ডা দিবে, খাবার ভাগ করে খাবে। কাকেরা নিজের বাসস্থানকে নতুন উদ্দমে সাজানোর জন্যে উঠে পড়ে লাগলো। বিধিবাম। কিছুদিনের মাঝেই তারা খেয়াল করলো তারাই শুধু ময়না পাখিদের আড্ডায় যায়, ময়না পাখিরা তাদের আড্ডায় আসে না। আড্ডা তো পরের ব্যাপার এমন কি তারা কাকদের সাথে কথাও বলে না। এমন কি এক ময়না পাখি এক কাককে বলেই ফেললো তাদের আড্ডায় গেলে নাকি ময়না পাখিদের গলার জাত যাবে। ময়না পাখিরা এমনকি নিজেদের বাসস্থান বললেও তারা এইখানে থাকে না। কিছুক্ষন এইখানে থেকে আবার ফিরে যায় বড় বনস্পতিতে। কাকেরা ব্যাপারটাকে গা করলো না। ভাবলো ধূর ছাই ময়নারা ময়নাদের মত থাক আমরা আমাদের মত খাবার খাবো কা কা করবো এতো কিছু দেখার কি দরকার।
আরো দিন যায়। বনস্পতি আরো বড় হয়। জঙ্গলের অন্য বনস্পতিরাও তাকে এখন দাম দেয়। ময়না পাখিদের আনাগোনা আরো বাড়লো। একসময় ময়না পাখিরাই যেন বনস্পতির প্রান হয়ে উঠলো। কাকেদের কথা ভূলে গেলো বনস্পতি। ভুলে গেলো তাদের ঠোটের আগায় বিন্দু বিন্দু জলই তার মাঝে প্রানের স ার ঘটিয়েছিলো। এরপরে কাকেরা আড্ডায় বসে আলাপ করতে লাগলো। সাদা কাক, কালো কাক, খয়েরী কাক, লাল কাক, দাড় কাক, ছোট বড় সহ সবধরনের কাক আলাপচারিতায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশ নিলো। কাকেরা বললো এই বনস্পতি আমাদের আবাস স্থল। আমাদের নিজের হাতে বড় করা। আমাদের সন্তানের মত। বনস্পতির এহেন আচরনের কারন কি হতে পারে? বয়োবৃদ্ধ সাদা কাক বললো দেখো আমরা আমরাই। আমাদের উচিৎ চলো আমরা বনস্পতিকে জিজ্ঞেস করি। নিজেরা কথা না বললে নিজেদের মাঝে ভূল বুঝাবুঝি হবে। সবাই একমত হলো। তারা ঠিক করলো তারা বনস্পতিকে জিজ্ঞেস করবে এহেন আচরনের কারন কি।
এদিকে কাকেদের মাঝেই ছিলো হলদে কাক। সে সব শুনলো। যখন দেখলো তার বন্ধু লাল পিপড়ার নামে কথা বলছে তার আতেঁ ঘা লাগলো। আর তার মনে ছিলো অন্য রকম পরিকল্পনা। তার খুব ইচ্ছে ছিল ময়না পাখিদের সাথে বসে আড্ডা দিবে। ময়না পাখির আকৃতির সাথে মিল থাকায় অনেক আগে থেকেই তার খুব ইচ্ছা সেও ময়না পাখির মত কথা কওয়া পাখি হিসাবে পরিচয় পাবে। সে তার বন্ধু লাল পিপড়াকে বলল সব। লাল পিপড়া আর হলদে কাক মিলে সব কাকরা বনস্পতির কাছে যাওয়ার আগেই বনস্পতির কাছে গেলো । বনস্পতি গভীর চিন্তা যুক্ত হয়ে গেল। যে বলল, আগে এসো এদেরকে থামাই পরে ঠিক করা যাবে কি ভাবে এদের তেল কমানো যায়। আমার শাখায় থেকে আমার প্রিয় ময়না পাখিদের নিয়ে ক্ষোভ! এরপরে আমি দরকার হলে ভাড়া করে তোতা , টিয়া , কোকিল আনব। এখনো আমার গোড়ায় পানি প্রয়োজন। যতদিন পানি লাগবে এদের ছাড়া যাবে না । কে পানি এনে দিবে। একবার শিকড়টা পুরোপুরি মাটির গভীরে যাক এরপর যদি এদের না তাড়িয়েছি!!!
তখন সে নিজেই কাকদের ডেকে অনেক কিছু বুঝালো। কাকরা খুশি হয়ে গেলো। আরে বনস্পতিতো আমাদেরই লোক। দিনের সাথে সাথে বনস্পতি মনে করলো শিকড় পোক্ত হয়ে গেড়ে গেলো মাটির গভীরে। কাকদের কা কা তে আকৃষ্ট হয়ে আরো শীতের মওসুমে অনেক ভিনদেশী পাখি এলো। এরপর বনস্পতি এমন আচরন শুরু করলো কাকদের সাথে যে তারা বুঝলো বনস্পতির মনে আসলে কি। একজন একজন করে তারা আস্তে আস্তে বনস্পতি ছেড়ে চলে যেতে লাগলো। যেতে যেতে সাদা কাকটা বার বার ছল ছল চোখে ফিরে তাকালো বনস্পতির দিকে। দাড়কাক চোখ মুছতে মুছতে গেল। কালো কাক নীরবে দু ফোটা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে গেলো। নীলকাক বারবার ফিরে যাচ্ছিলো অতীতের সেই সব দিন গুলোতে। সবারি মনে হাহাকার উঠলো হায় বনস্পতি। সবারি বুকের মাঝে কষ্টের রক্তক্ষরন। চাপা বেদনা আর চোখে জল নিয়ে একসময় সব কাক চলে গেল । শেষ পর্যন্ত শুধু রয়ে গেলো হলদে কাক।
এইদিকে কাকরা চলে যাওয়ার পরে বনস্পতির আসে পাশের পরিবেশ অনেক চুপচাপ হয়ে গেলো। গরম শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ভিনদেশী পাখিরা চলে গেলো নিজের ঠিকানায়। আর অন্যান্য বনস্পতি যারা এতো দিন কাকদের জন্যে কিছু করতে পারেনি তারা এইবার অন্যান্য পাখিদের আকৃষ্ট করা শুরু করলো। অন্যান্য পাখিরাও চলে গেলো তাদের এই প্রানহীন ঠান্ডা পরিবেশ ভালো লাগছিলো না বলে । ময়না পাখিরা এরপরে বনস্পতিকে বলল তুমি তো আচ্ছা বোকা হে। অন্য পাখিরা চলে গেলো বাধা দিলে না ক্যানো? বনস্পতি বলল, তোমরা তো সময় বলেছ সাথে আছো তাই গা করি নি। এবার কিছু করো। আমার উপরে যে আবার অন্য বনস্পতিদের ছায়া চলে আসছে। সূর্যের আলো ছাড়া আমি যে বড় দূর্বল , অসহায়, আমার গোড়ায় আরো পানি দরকার।
– তো কাকগুলাকে ডাকো। ওরা আবার আলো আসার পথ করে দিক, পানি এনে দিক।
– ওরাও তো চলে গেছে ।
– আটকাও নি কেন?
– তোমরা তো বলেছিলে সাথে আছি।
– সেটা তো মজা নিতে। কাজ করতে নাকি?
– এখন তবে কি করবো?
– কি আর করবে, মর। বলে ময়না পাখিরা উড়ে চলে গেল । সাথে করে নিয়ে গেলো তাদের অনুচর লাল পিপড়া ও হলদে কাককে।
বনস্পতি তখন তার ভূল বুঝতে পারলো । সে তখন কেদে কেদে কাকেদের আবার ফিরে আসতে বলল। কিন্তু কাকেরা ততদিনে শিখে গিয়েছে কাজের সময় কাজী কাজ ফুরোলেই পাজী। তাই তারা আর কখনো ফিরে এলো না।
আমার গল্প ফুড়লো
নটে গাছটি মুড়লো ।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!