ছোট্ট তিনি্নকে ওর বাবা খুব ভালোবাসেন। তিনি্নও ওর বাবাকে খুব ভালোবাসে। ফাঁক পেলে বাবার সঙ্গে ও রিকশায় ঘোরে, পার্কে চিড়িয়াখানায় যায়। বাসায় থাকলেও বাবার সঙ্গে ও খুব আনন্দ করে। ও ওর বাবার কাঁধে বসে প্রায় সন্ধ্যায় এক সুরে ছড়া কাটে_
ডিম ডিমা ডিম ডিম
কিসের বাদ্য বাজে
খুকু যাবে পাঠশালাতে
তাই তো এত সাজে।
ও মেয়ে বলে ওর বাবা ইচ্ছা করেই ছড়াতে একটু ভুল বলেন। খোকার জায়গায় খুকু বলেন যাতে ও নিজের কথা ভেবে খুশি হয়। ওর বাবা যখন ওকে কাঁধে চড়িয়ে ছড়া কাটার তালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাচেন তখন আয়নায় তাকিয়ে ও খুব আনন্দ পায়। মাঝেমধ্যে ছড়া বন্ধ করে শুধু হাসে।
বাবা চান তিনি্ন পড়ালেখা করে খুব বড় মাপের মানুষ হোক, মানুষের মতো মানুষ হোক। সময় পেলেই তিনি ওকে নানা বিষয়ে পড়ান। দুজনের লক্ষ্য হলো_ ও পরীক্ষায় ফার্স্ট হবে। ওদের কিন্ডারগার্টেনে ক্লাস টুতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৯৮। গেল বছর বার্ষিক পরীক্ষায় ৫৮তম হয়ে ও খুব কেঁদেছিল। এ বছর প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় ও দশম হয়েছিল। বাবা অনেক করে বুঝিয়ে বলেছিলেন, এ ফল খুবই ভালো। ফার্স্টের কাছাকাছি। পরের বারে নিশ্চয়ই ও ফার্স্ট হবে। কিন্তু পরীক্ষার আগে সামান্য জ্বর হওয়ায় ওর ফল গেল আগের চেয়ে খারাপ হয়ে। এবারে ও ১৯তম হয়েছে। তাই পরবর্তী টার্গেট হচ্ছে বার্ষিক পরীক্ষা। বার্ষিক পরীক্ষায় যে করেই হোক ওর ফার্স্ট হওয়া চাই। এ লক্ষ্যে বাবা-মেয়ে খাটছে খুব।
বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরোলে দেখা গেল তিনি্ন নবম হয়েছে। ফার্স্ট হতে না পেরে এবারেও ওর সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগল। কারণ ও ওর এই ক্ষুদ্র জীবনে এত বেশি আর খাটেনি। ও দিনভর মুখ গোমড়া করে রইল। ওর বার বার শুধু মনে পড়ছিল ফার্স্ট হওয়া তন্দ্রিলার কথা। আহা! কত হাততালি পেল ও। কত হাসল সবাই ওকে নিয়ে। তন্দ্রিলাও কত হাসল। অথচ ওর বেলায় কিছুই হলো না। মায়ের হাত ধরে মুখ গোমড়া করে বাসায় চলে এলো ও। মা কত বোঝালেন, কিন্তু মন ভালো হলো না ওর। ঘরের কোনায় বসেই আছে। নাওয়া-খাওয়াও করেনি ঠিকমতো।
বিকালে বাবা ঘরে ফিরেই ওর গোমড়া মুখ দেখে চিন্তিত হলেন। তিনি অবশ্য আগেই অনেকটা অনুমান করেছিলেন ওর পরীক্ষার ফল কেমন হতে পারে। আগেভাগে দুঃখ না পেতে তাই অফিস থেকে বাসায় ফোন করেননি। একই কারণে ওর মা-ও তাকে ফোন করেননি। কিন্তু দুঃখটা শেষ পর্যন্ত তাকে পেতেই হলো। তবুও তা লুকিয়ে তিনি হাসিমুখে বললেন, কী তিনি্ন মামণি, এবারো ফার্স্ট হওয়া গেল না বুঝি?
হ্যাঁ। তিনি্ন কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল।
কেন এমন হলো?
জানি না। খুব করুণ শোনাল ওর কণ্ঠ।
আচ্ছা রেজাল্ট কার্ডটা আন তো দেখি।
তিনি্ন রেজাল্ট কার্ড এনে ওর বাবার হাতে দিয়ে গোমড়া মুখে বসে রইল। বাবা বললেন, দু-এক বিষয়ে মোটামুটি খারাপ হলেও মোটের ওপর রেজাল্ট তো বেশ ভালো করেছ দেখছি। অঙ্কে ১০০, ইংরেজিতে ৯৯, বিজ্ঞানে ৯৭_ বেশ ভালো ফল। এ তিনটাতে কি তোমার চেয়ে কেউ বেশি পেয়েছে?
জানি না।
আচ্ছা, অঙ্কে কে ফার্স্ট হয়েছে?
তিনি্ন একটু সময় ভেবে বলল, আমি।
তাহলে আর এত দুঃখ কেন, মামণি? অঙ্ক হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন বিষয়। সেটাতেই তুমি ফার্স্ট হয়েছে। তার মানে হচ্ছে তুমিও ফার্স্ট, কী বল?
হুঁ।
আচ্ছা তাহলে আর মন খারাপ করে থেক না। এবার হাস, খাও-দাও। সন্ধ্যায় আমরা আজ ছড়ার প্রতিযোগিতায় বসব। দেখি ছড়া কাটায় কে ফার্স্ট হয়। যে ফার্স্ট হবে সেই হবে সত্যিকারের ফার্স্ট, কেমন? আমরা চারজন ছড়া আবৃত্তি করব, কী বল?
কে কে?
আমি, তোমার আম্মু, তোমার আপু, তুমি_ এ চারজন। দেখি কে সবচেয়ে ভালো ছড়া কাটে।
সন্ধ্যায় ছড়ার প্রতিযোগিতা শুরু হলো।
তিনি্নর বাবা বলছেন_
ডিম ডিমা ডিম ডিম
কিসের বাদ্য সাজে
খুকু খাবে পাঠশালাতে
তাই তো এত বাজে।
এটুকু বলতেই তিনি্ন খিলখিল করে হেসে উঠল।
হাসি থামলে তিনি্নর আম্মু বললেন_
ডিম ডিমা ডিম ডিম
তাই তো এত সাজে
খুকু যাবে পাঠশালাতে
কিসের বাদ্য বাজে।
তিনি্ন আবারো খিলখিল করে হেসে উঠল।
এবারে ওর আপু বলল_
ডিম ডিমা ডিম ডিম
কিসের বাদ্য বাজে
নানু যাবে পাঠশালাতে
তাই তো অনেক সাজে।
এবারে তিনি্ন অনেক করে হাসল। বাবা বললেন, আমরা কেউই মনে হয় ঠিকমতো বলতে পারছি না। ভুল হচ্ছে শুধু। এবারে ছড়াটি তুমি বল, মামণি । ঠিক বইতে যেমন পড়েছ সেভাবে।
তিনি্ন তৎক্ষণাৎ ছড়া কাটল_
ডিম ডিমা ডিম ডিম
কিসের বাদ্য বাজে
খোকা যাবে পাঠশালাতে
তাই তো এতে সাজে।
আগে যায় গাড়ি ঘোড়া
পিছে যায় হাতি
তারই সঙ্গে চলে ব্যাঙ
কাঁধে ধরে ছাতি্ত্ত্তই ্ত্ত্ত-।
ছড়া শেষে বাবা বললেন, এবারে বল তো মামণি, কে ফার্স্ট হলো ছড়া কাটায়। তিনি্ন হেসে বলল, আ্ত্তমি।
তাহলে তো তুমিই সত্যিকারের ফার্স্ট, কী বল?
তিনি্ন একগাল হেসে বলল, হুঁ। বাবা বললেন, চল তাহলে এবার সবাই মিলে শুদ্ধভাবে ছড়াটি আবৃত্তি করি। আর এর পর থেকে আমরা সবাই সবকিছু শুদ্ধভাবে করব। তবেই না ফার্স্ট হওয়া, কী বল?
তিনি্ন হেসে বলল, হুঁ। –