এক রাজকন্যা ও তিন রাজপুত্র

নীচের রূপকথার গল্পটা খুব ছোটবেলায় মায়ের কাছে শুনেছিলাম। ঠিক গল্প নয় এটা আসলে – বরং গল্পের আদলে একটা ধাঁধা। আমি শুনেছিলাম মায়ের কাছে, আবার তিনি নাকি শুনেছিলেন (যদ্দুর মনে পড়ে, তবে ভুল স্মৃতিও হতে পারে) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর আইন বিভাগের ক্লাশে শিক্ষকের মুখে প্রশ্নের আকারে। গল্প-ধাঁধাটার একদম সারসংক্ষেপটুকুই শুধু আমার আবছা মনে আছে, তাই বাধ্য হয়ে তার সাথে নিজের ভাষায় খানিকটা রক্তমাংস যোগ করে দিলাম এখানে। ঠিকঠাকমত হল কিনা জানি না।
একদিন রানি এসে রাজাকে বললেন, কন্যার বিয়ের বয়স হয়েছে। এবার তার বিয়ে দেয়া দরকার। কিন্তু তার তুলনাহীণা কন্যার জন্য তেমনই যোগ্যতম পাত্র চাই।
রাজামশাই অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে দিকে দিকে ঢেঁড়া পিটিয়ে ঘোষনা করে দিলেন – যে ব্যক্তি পৃথিবী ঢুঁড়ে দুনিয়ার আশ্চর্যতম উপকারী বস্তুটা তাঁকে এনে দিতে পারবে, তার হাতেই রাজকন্যাকে দেবেন। সেইসাথে অর্ধেক রাজত্ব।
রাজার এই ঘোষনা দিকে দিকে, রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের এই রাজকন্যার অতুলনীয় রূপগুণের কথা দেশ-দেশান্তরের বহু মানুষই জানতেন। ফলে রাজার এই ঘোষনায় বহু বিবাহেচ্ছুক তরুন রাজপুরুষ বেরিয়ে পড়লেন পৃথিবীর আশ্চর্যতম বস্তুটা খুঁজে বের করতে। বিশেষ করে প্রতিবেশি তিন রাজ্যের তিন রাজপুত্র পৃথিবীর তিন দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন।
টগ্‌বগ্‌… টগ্‌বগ্‌… টগ্‌বগ্‌… ছুটছে ঘোড়া
এদিকে দিন যায়, রাত যায়, মাস পেরিয়ে যায়। রাজামশাই সহ রাজপুরীর সবাই পৃথিবীর আশ্চর্যতম বস্তু নিয়ে আসা রাজকন্যার পাণিপ্রার্থী সুযোগ্য সেই পুরুষের অপেক্ষায়।
এমনি একদিন, আবারও সেই টগ্‌বগ্‌… টগ্‌বগ্‌! না, এবারে রাজপুরীর সিংহফটকে। ঐ তিন রাজপুত্রের একজন এসে হাজির হয়েছেন।
‘জাঁহাপনা, আমি এনেছি, পৃথিবী চষে নিয়ে এসেছি সেই আশ্চর্যতম বস্তু! এই দেখুন আমার আশ্চর্য দুরবীন। এই দুরবীনে চোখ লাগিয়ে আপনি যা দেখতে চাইবেন, তা পৃথিবীর যে প্রান্তে বা যেখানেই থাকুক না কেন – সাথে সাথেই সেটা দেখতে পাবেন।’
রাজা নবাগত রাজপুত্রের হাত থেকে যাদুর দুরবীণটা নিয়ে চোখে লাগাতেই, দুরবীণের ভিতর দিয়ে তাঁর চোখে ভেসে উঠল সুদূর এক রাজ্যের রাজা তাঁর শ্বশুর মশাইর বেডরুম। কিছুক্ষণ আগেই রানির সাথে তার বাবার বিষয়ে কথা হচ্ছিল তাঁর, দুরবীণটা চোখে লাগানোর সময়ও তাঁর মনের কোনে সে আলাপেরই রেশ লেগেছিল।
রাজা দুরবীণের ভিতর দিয়ে হতবাক হয়ে দেখলেন তাঁর শ্বশুর মশাই শয্যাশায়ী এবং মরণাপন্ন। রানিকেও ডেকে এনে দেখালেন। হায় হায় করে উঠলেন দুজনেই। এখন তাঁরা কি করবেন? তিনি নিজ রাজ্যে রাজা এবং প্রবল ক্ষমতাশালী হলেও এতদূরের এক রাজ্যে শিয়রে যম এসে দাঁড়ানো শ্বশুরের জন্য তিনি কীইবা করতে পারেন এই মুহূর্তে? এমনকি শেষ দেখাটাও তো সম্ভব হবে না। তার বহু-বহু আগেই…
‘জাঁহাপনা, দুশ্চিন্তা করবেন না। আমার কাছে এর সমাধান আছে। এই দেখুন আমি কি নিয়ে এসেছি — এ এক আশ্চর্য যাদুর গালিচা! এতে চেপে বসে আপনি বিশ্বের যে প্রান্তেই যেতে চান না কেন, চোখের পলকে এই গালিচা আপনাকে সেখানে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।’
এমন একটা জিনিষ এমন একটা ক্রিটিকাল সময়ে পেয়ে রাজামশাই আর দেরি করলেন না। সাথে সাথে রাজা-রানি আর দুই রাজপুত্র তাতে চেপে বসলেন। তারা যখন উড়াল দিতে যাবেন, ঠিক সেই সময় – ‘রোক্‌কে… রোক্‌কে…’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে ৩য় রাজপুত্র হাঁপাতে হাঁপাতে সেখানে এসে হাজির। তার অনুরোধে তাকেও সাথে নেয়া হল।তো প্রতিশ্রুতিমত ২য় রাজপুত্রের যাদুর গালিচা সত্যি সত্যিই কত দেশ, কত পর্বত, কত নদীনালা ছাড়িয়ে চোখের পলকেই তাঁদের সবাইকে সেই সুদূর রাজ্যে শ্বশুর মশাইর বেডরুমে নিয়ে হাজির করল।
“আশ্চর্য গালিচাটা বেডরুমে ল্যাণ্ড করতে না করতেই রাজা লক্ষ্য করলেন তাঁর শ্বশুর মশাইর প্রাণপাখি একদম নাকে এসে ঠেকেছে। আক্ষরিক অর্থেই তিনি তার একদম শেষ নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করতে যাচ্ছেন। মুহূর্তের মধ্যে তিনি মারা যাবেন। এতকিছুর পরেও এখন আর কিছুই করার সময় নেই!!!
কিন্তু না! উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে এতক্ষণ নিশ্চুপ থাকা ৩য় রাজপুত্র এক ঝটকায় নিজের কোটের পকেট থেকে একটা লাল টুকটুকে আপেল বের করে শ্বশুর মশাইর মুখে গুঁজে দিলেন।
জানা গেল, ৩য় রাজপুত্রের এই আপেলটাই তার আনা সেই আশ্চর্যতম বস্তু। এ এক সর্বরোগহর জীবনদায়ী যাদুর আপেল, যা মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও কাউকে খাইয়ে দিতে পারলে সে মানুষটি বেঁচে উঠে। যাই হয়ে থাকুক না কেন তার। শিয়রে দাঁড়ানো যম পালাতে পথ পায় না তখন।এরপর সাত দিন সাত রাত্রি মহা উৎসবের মধ্য দিয়ে কেটে গেল শ্বশুর মশাইর রাজ্যে তাঁর সুস্থ হয়ে ওঠা উপলক্ষে। এরপরেই শুধু আমাদের রাজা-রানি তিন পাণিপ্রার্থী রাজপুত্রকে নিয়ে স্বদেশে ফিরতে পারলেন।
এইবার শুরু হল আসল ঝামেলা। কন্যাদায়গ্রস্ত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাজা এবার কার হাতে রাজকন্যাকে তুলে দিবেন? কোন রাজপুত্রের হাতে তুলে দিলে প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ হবে না, ন্যায়বিচার হবে
এমন সময়ে দ্বিতীয় রাজপুত্র বাধা দিয়ে বলে উঠলেন – দূরবীণ দিয়ে শুধু জানতে পেরে কীইবা লাভ হত, যদি তার যাদুর গালিচাটা না থাকত? কারন তার যাদুর গালিচা ছাড়া অযুত-নিযুত যোজন দূরে ঐ সুদূর রাজ্যে সময় থাকতে পৌঁছানো যেত না কিছুতেই। ঘরে বসে কান্নাকাটি আর হাত কামড়ান ছাড়া আর কিছুই করা থাকত না তখন রাজারানির। সুতরাং তার আনা বস্তুটাই আশ্চর্যতম, এবং একারনে তিনিই যোগ্যতম পাণিপ্রার্থী। রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব তারই প্রাপ্য।
তৃতীয় রাজপুত্র এতক্ষণ চুপটি মেরে মুচকি মুচকি হাসছিলেন আর শুনছিলেন এই বিতর্ক। এবার তিনি বলে উঠলেন -‘সবই তো বুঝলাম! কিন্তু দেখে, জেনে, বা পৌঁছে কি লাভ হত যদি আমি আর আমার যাদুর আপেল না থাকত? ওখানে পৌঁছেও তো সেই একই অক্ষম আক্ষেপে হাত কামড়াতেই হত আমার আপেলটা না থাকলে। আমার যাদুর আপেলটাই তো শেষ পর্যন্ত আসল কার্যোদ্ধার করল, জীবন বাঁচাল জাঁহাপনার শ্বশুর মহাশয়ের। আসল কাজটা, সবচেয়ে আশ্চর্য উপকারটা আমার আনা আশ্চর্যতম বস্তুটাই করেছে। সুতরাং আমিই যোগ্যতম প্রার্থী।তৃতীয় রাজপুত্রের এই কথা শুনে অন্য দুই রাজপুত্র হৈহৈ-রৈরৈ করে বলে উঠলেন – আমার দূরবীণ না থাকলে…. আমার গালিচা না থাকলে… কি হত ঐ আপেল দিয়ে?! কিছু জানা হত না…কিছুতেই সময়মত পৌঁছুনো যেত না… আপনার ঐ আপেল দিয়ে তখন কিভাবে শ্বশুর মশাইর প্রাণ বাঁচাতেন
রাজা মশাই তিন রাজপুত্রের যুক্তিতর্ক শুনে মহাচিন্তায় পড়ে গেলেন। এদের কার কাছে তিনি মেয়ের বিয়ে দিবেন? কে যোগ্যতম? কার আনা বস্তুটা আশ্চর্যতম? কার কাছে রাজকন্যার বিয়ে দিলে তাঁর প্রতিশ্রুতিভঙ্গ হবে না এবং এদের প্রতি ন্যায়বিচার হবে? তাঁর কাছে তো এদের সবার যুক্তিই অকাট্য লাগছে, কারো দাবীই ফেলনা মনে হচ্ছে না। কিন্তু তাই বলে তো তিনজনের কাছেই মেয়ের বিয়ে দেয়া যায় না, বা মেয়েকে তিন টুকরো করে বিলিয়ে দেয়া যায় না! এখন রাজামশাই কি করবেন, কিভাবে ন্যায়বিচারের সাথে প্রতিশ্রুতিমত এই সমস্যার সমাধাণ করবেন? কোনজন এনেছে সন্দেহাতীত ভাবে আশ্চর্যতম উপকারী বস্তুটি যার কাছে মেয়ের বিয়ে দেবেন তিনি? আপনি বলতে পারেন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!