ধ্রুব আর ছবি আঁকবে না
মৃত্তিকাকে চেনো? লম্বা ছিপছিপে মেয়েটা। বাঁশির মতো খাড়া নাক। ঘন-কালো চুল। ঠোঁটের ফাঁকে সব সময় আঙুল দিয়ে রাখে। আর টান টান করে হেসে হেঁটে বেড়ায় পাক্কা কথা বলে। মৃত্তিকা মানে মাটি। কিন্তু ওর নাম মাটি কেন? কারণ ওর বাবা একজন নামকরা কবি। মৃত্তিকা সেই কবির একমাত্র মেয়ে। কবি একদিন গভীর রাতে লাফ মেরে বিছানায় উঠে বসে। তারপর আনন্দে হা হা করে হাসতে হাসতে বলে, আমি আমার মেয়ের নাম খুঁজে পেয়েছি। নাম পেয়েছি। আমার মেয়ের নাম মৃত্তিকা। মৃত্তিকা গুণ। মৃত্তিকার কোনো ডাক নাম নেই। ভালো নাম নেই। একটাই নাম ওর। মৃত্তিকা।
একটু বয়স হওয়ার পর মৃত্তিকাও কবিতা লিখতে শুরু করে। ছোট ছোট ভাবনার ছোট ছোট কবিতা। সাজ্জাদ শরিফ প্রথম আলোয় একটা-দুটি কবিতা ছেপেওছিল। মৃত্তিকার খুশি আর ধরে না। কবি হয়ে ওঠার প্রথম সিঁড়িতে ও পা দিয়েছে। দীর্ঘ সিঁড়ি। অসীম পথ। পথের শেষ নেই। মানুষ জানে না, কিভাবে একজন কবি হয়ে ওঠে।
মৃত্তিকা বেশ কিছু কবিতা নিয়ে একদিন ধ্রুব এষের বাসায় গেল। ধ্রুব থাকে পল্টনে। পুরনো ধাঁচের একটা বাড়ির চার তলায় ধ্রুব অনেক দিন ধরে ভাড়া থাকে। ওর ঘরে এলোমেলো ছড়ানো-ছিটানো কাগজপত্র আর বইখাতা। রঙতুলি। পেন্সিল কলম। খালি বোতল, ভাঙা গেলাস, মেলামাইনের প্লেট। মেঝেতে আঁকা আছে ডোরাকাটা বাঘ। দেয়ালে বাচ্চাদের মতো দুটি পুতুলের ছবি। ঘরটায় একবার চোখ বুলাতেই বোঝা যায়- ধ্রুব এষ একজন শিল্পী।
মৃত্তিকা চওড়া সিঁড়ি ভেঙে চার তলায় উঠে এলো। দরজায় ধাক্কা দিতেই ধ্রুব বেরিয়ে এলো। মুখে সরু চিলতে হাসি।
ও হো, মৃত্তিকা। এসো।
মৃত্তিকা ঘরে ঢুকে বিব্রত।
মেঝেতে রাখা একটা কুশনে ধাপ করে বসে পড়ল। ডান দিকে একটা বড় জানালা। ওদিকে তাকাতেই বড় বড় ফ্ল্যাটের ঘর, বারান্দা দেখা যাচ্ছে।
কেমন আছো মৃত্তিকা?
জী, ভালো।
কাঁপা কাঁপা স্বরে উত্তর দিলো মৃত্তিকা।
কই তোমার পাণ্ডুলিপি কোথায়?
মৃত্তিকা কাগজগুলো মেলে ধরল ধ্রুব’র সামনে। গোটা গোটা অক্ষরে প্রথম পাতায় লেখা আছে- আমার আকাশে বৃষ্টি।
নামটা তো খুব সুন্দর হয়েছে।
ধ্রুব’র কণ্ঠে প্রশংসা। মৃত্তিকার মুখে লাজুক হাসি।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- ওটার প্রচ্ছদে কি আঁকব?
মৃত্তিকা বলল,
ধ্রুবদা দু-একটা টান দিলেই আপনার হাতে প্রচ্ছদ জীবন্ত হয়ে উঠবে।
না মৃত্তিকা। তা হয় না। বহুদিন আমি আকাশ দেখি না।
কেন?
আহা-আর বোলো না। বাইরে তাকাও। চারদিকে শুধু কংক্রিটের দালান। উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলো আকাশ ঢেকে ফেলেছে।
ধ্রুব’র কণ্ঠে বিষাদের ছায়া।
জানো মৃত্তিকা যখন প্রথম এ বাসায় আসি তখন চারপাশে খোলা আকাশ দেখা যেত। বাড়ির দু’পাশে বড় বড় দুটো পুকুর ছিল। শীতকালে কত পাখি আসতো এ বাড়ির পেছনে। মাত্র দশ বছরেই সব কেমন বদলে গেল। ইটকাঠের দালানে সব ঢাকা পড়ে গেল। বাচ্চাদের খেলার মাঠগুলো দখল হয়ে গেল। শুধুই বিল্ডিং আর বিল্ডি।
বলো, তোমার আকাশ আমি কিভাবে আঁকব?
মৃত্তিকার মনটাও খারাপ হয়ে গেল, গভীর বিষাদে ও জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। না- কোন ফাঁক দিয়েই আকাশ দেখা যাচ্ছে না। মনে পড়ল ছোটবেলার বাবার হাত ধরে ও এ বাসায় এসেছিল। তখন কি আকাশ দেখা গিয়েছিল?
মৃত্তিকার মনে পড়ে না। জানালা দিয়ে ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মৃত্তিকার মনে হয়- ওর কোনো আকাশ নেই। ওর আকাশে বৃষ্টি নেই।
ধ্রুবদা প্রচ্ছদে তাহলে কি আঁকবে?
আমার বাবা অতি সরল ছিলেন
আমার বাবা খুব সরল ছিলেন। যে যত বেশি গরিব সে তত বেশি সরল। বাবা ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। অল্প বেতনের চাকুরে। সংসার ছিল খুব বড়। আমরা ছিলাম ছয় ভাই। আমাদের কোনো বোন ছিল না। মা-বাবা দু’জনই খুব পরিশ্রম করতেন। মা একা হাতে সব সামলাতেন। ছেলেদের জন্য তিনবেলা নিজ হাতে রান্না করা, কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা, বিছানা-বালিশ ঠিক করা- সব কিছু মা নিজ হাতে করতেন।
বাবা সন্ধ্যার পর আমাদের লেখাপড়া করাতেন। লেখাপড়া না পারলে বাবা অগ্নিমূর্তি ধারণ করতেন। ভয়ানক রাগ করতেন। উত্তেজনায় ছটফট করতেন। বাবা যেন রাগ না করে সে কারণ আমরা ভালো ছাত্র হয়ে গেলাম। স্যাররা জানতেন, আমরা গরিব কিন্তু ভালো ছাত্র। তাই তার বিনামূল্যে আমাদের প্রাইভেট পড়ার সুযোগ করে দিতেন। কারণ আমরা যে স্যারের কাছে পড়ব অন্য ছাত্ররাও সেই স্যারের কাছে পড়ার জন্য ভিড় করে।
বাবা খাওয়ার ব্যাপারে কোনো কৃপণতা করতেন না। মাছ-মাংস কিনতেন। মাসের শুরুর দিকে বেতন পাওয়ার পর বাবার ভাবটা থাকতো যেন উনি একজন রাজা। প্রচুর খাদ্যদ্রব্য ও ফলফলাদি কিনতেন। খাওয়া বাদে অন্যান্য জিনিস কেনায় বাবার ছিল চরম অনীহা। খাবার ছাড়া অন্য কোনো কিছুর প্রতি তার লোভ ছিল না।
আমার সেই অতি সরল পিতার একটাই আকাঙ্ক্ষা ছিল। তিনি মাথা গোঁজার মতো একটা ঠাঁই তৈরি করবেন। তার নিজের একটা বাড়ি দরকার।
মায়ের গয়নাগাটি বিক্রি করে মিরপুরের ভেতরে সামান্য একটু জমি কিনলেন তিনি। হিন্দুদের ফেলে রাখা জমি। অতি অল্প দাম। এ এলাকাটা কোনো দিন জনবসতি হবে ভাবা যায় না। আশপাশে কয়েকটা মাটির ঘরে দু’চারজন বাস করেন। তারা সবাই মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করেন। সোজা বাংলায় ওদের বলা হয় পাল। বাবার টাকা-পয়সা নাই। কিন্তু বাবা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন, তার নিজস্ব একটা বাড়ি হবে। বাড়িতে একটা উঠোন থাকবে। একটা পেয়ারা গাছ আর ঝাঁকড়মাকড় একটা বকুল ফুলের কাছে থাকবে। বাবা বিকালে বকুলতলায় বসে চা-মুড়ি খাবেন। তার চোখের সামনে আমরা উঠোনে খেলাধুলা করবো। শীতল পাটি বিছিয়ে লেখাপড়া করবো। টিনের চৌচালা ঘর থাকবে চু’চারটা। চাপকলের পানি খাব। একটা ছোট্ট রান্নাঘর থাকবে। মোরগ-মুরগির খোঁয়াড় থাকবে। মোরগ-মুরগি ভোরবেলা কোঁকড় কোঁ ডাক দিয়ে আমাদের ঘুম ভাঙাবে।
বাবার স্বপ্ন দীর্ঘ হতে লাগল। কিন্তু বাবার হাতে কোনো টাকা নেই।
কাগজ-কলম নিয়ে বাবা নিজের বাড়ির ড্রইং করতে থাকেন। কোথায় শোবার ঘর হবে, কোথায় বসার ঘর হবে- এসব আর কি? বাবার খাট থাকবে জানালার ধারে। বাবা শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখবেন। নীল আকাশ বাবার খুব প্রিয়। মাঝেমধ্যেই বাবা মিরপুরের গোলারটেকে চলে যান। তখন এখানে তেমন জনবসতি গড়ে ওঠেনি। চারপাশে ফাঁকা জায়গা-জমি। মাঠের পর মাঠ। পাশে বিস্তীর্ণ কবরস্থান।
বিশাল মাঠগুলো কবরস্থানের জমি। এখানেই আছে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্তান। বাবা নিজের একচিলতে জমিতে চুপচাপ বসে থাকতেন। একধারে ছোট্ট একটা অপুষ্ট পেয়ারা গাছ আছে। গাছে পেয়ারা ধরে না। গাছটাও বাড়ে না। আর একধারে আছে একটা সূর্যমুখী ফুলের গাছ।
বাবা মাদুর পেতে চুপচাপ বসে থাকেন। দু-একজন এলাকাবাসী বাবাকে সালাম দেন।
চাচা, বাড়ি কবে বানাইবেন?
বাবার সরল উত্তর।
এই তো বাবা, কাম ধরুম। একটা ঘর বানাইলেই এখানে আইসা পরুম। আর ভাড়াবাড়িতে ভালো লাগে না।
হ হ চাচা- আইসা পড়েন। চারদিকে খোলা জায়গাজমি। শরীর ভালো হইয়া যাইবো চাচা।
বাবা মাথা নাড়েন। তাদের সাথে তিনিও একমত।
বাবা একা একা বসে বসে জমির হিসাব করেন। বড় ঘরটা কোথায় হবে? দক্ষিণে দরজা-জানালা রাখতে হবে। বকুল গাছটা কোথায় লাগানো হবে? চাপকলের ব্যবস্থা একটু দূরে রাখতে হবে। নরম মাটিতে চাপকল থাকলে পানির প্রবাহ ভালো থাকবে। এই রকম নানা হিসাব-নিকাশ করেন আমাদের সরল পিতা। কিন্তু তার কাছে সামান্য টাকা-পয়সাও নাই। টিনের ছাদ কিংবা এক গাড়ি ইট যে কিনবেন তেমন সামর্থ্যও তার নাই।
কিন্তু তার মাথা গোঁজার ঠাঁই দরকার। নিজের বাড়ি দরকার। নিজের একটা ঘর দরকার। কিন্তু সরল বাবা বুঝতেন না যে, পরের জাগা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই।
নিজের ঘরে শুয়ে আকাশ দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি।
বইচোর
আমরা ছোটবেলায় খুব গরিব ছিলাম। একটা ঘরে গাদাগাদি করে আমরা ছয় ভাই থাকতাম। সে কী কষ্টকর জীবনযাপন। ছোটবেলার একটা গল্প শোনাই তোমাদের।
তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুলে। আজিমপুর আর লালবাগের সন্ধিস্থলে এ স্কুল। আজিমপুরে তখন শিক্ষিত সমাজ গড়ে উঠেছে। আর লালবাগে ব্যবসায়ীদের বসবাস। তাদের কেউ কেউ পড়াশোনা করে শিক্ষিত ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।
’৭৩ সালে আমি ক্লাস ফাইভে পড়তাম। মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের স্কুলের খ্যাতিও তখন তুঙ্গে। সব স্কুল মিলিয়ে আমরা ফার্স্ট হচ্ছি। বছরে বছরে শীর্ষ রেজাল্ট করছে আমাদের স্কুল। সেই খ্যাতির অংশীদার হয়ে আমরা লেখাপড়া, খেলাধুলা করে যাচ্ছি। আমাদের স্কুলের পরিবেশটা খুব ভালো ছিল। আমরা স্কুলের অধিকাংশ সময় কাটাতে খুব পছন্দ করতাম। স্কুলের সামনে ছোট্ট একচিলতে মাঠ। তারপর গেটের সামনে চওড়া এক রাস্তা- নাম লালবাগ রোড। রোডের ওপারেই আজিমপুর কলোনি। প্রথম বিল্ডিংটাই ৪২ নম্বর বল পরিচিত। কোন বাউন্ডারি ছিল না তখন। স্কুল থেকে লাফ মেরেই ৪২নং নম্বর বিল্ডিং-এর কাছে পৌঁছে যাওয়া যেত। বিল্ডিং-এর সামনের মাঠটা ৪২ নম্বর মাঠ বলে পরিচিত ছিল। বিশাল মাঠ। চারপাশে চারটা কলোনি।
ছোটবেলায় স্কুলের মাঠে আমরা খেলার সুযোগ পেতাম না। বড় ভাইরা ছুটির পড়ে ফুটবল খেলত সেই মাঠে। আমরা ৪২ নম্বর মাঠে চলে যেতাম। এক কোনায় একটু জায়গা নিয়ে ফুটবল খেলতাম। এই ৪২ নম্বর মাঠে অনেক বড় বড় ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়েছে। অতিথি হিসেবে এসেছেন অনেক বড় খেলোয়াড়। এ মাঠে ফুটবল প্র্যাকটিস করতে দেখেছি জাকারিয়া পিন্টু, মালা, গফুর- সেই আমলের খ্যাতিমান ফুটবলারদের।
আমাদের মর্নিং শিফট ক্লাস। তারপর বাবা ফেরার আগে আমরা খানিকক্ষণ ৪২ নম্বরে ফুটবল খেলতাম। ঘাম ঝরাতাম।
খেলতে খেলতে হঠাৎ দেখি ঘাসের মধ্যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে অনেক বই। বুঝতে পারলাম, কলোনিরই কোনো ফ্ল্যাটের বাসিন্দা বইগুলোকে রোদে শুকাতে দিয়েছেন। কোনো কোনো বইতে পোকা ধরছে। বিপুল পরিমাণ বই দেখে আমি অভিভূত। খেলা ছেড়ে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে লোভাতুর চোখে বইগুলো দেখতে থাকি। অধিকাংশ বড়দের বই। তবে দু’টি বই তীব্রভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একটা বইয়ের নাম ট্রেজার আইল্যান্ড- অনুবাদকের নাম মোহাম্মদ নাসির আলী। আরেকটা বই আলাদাভাবে পড়ে আছে। একেবারে পোকায় কাটা। প্রতিটা পাতাতেই ফোঁটা ফোঁটা ছিদ্র। নিষ্ঠুরভাবে পোকারা আক্রমণ করেছে বইটাকে। কিন্তু উন্নতমানের কাগজ ও বাঁধাইয়ের কারণে বইটিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে পারেনি পোকার সাম্রাজ।
বইটির নাম রুশ দেশের উপকথা। রাশিয়ায় ছাপা বই। অদ্ভুত সুন্দর বইটা। আমার মন ছটফট করে উঠল। বইটা একটু আলাদাভাবে রাখা আছে। অর্থাৎ বইটা কি ফেলে দেয়া হয়েছে? বুঝতে পারলাম না। বইটা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম। গোলরুটির একটা গল্প রয়েছে শুরুতেই। পাতা উল্টে দেখি, একটা দীর্ঘ গল্পের নাম- অজানি দেশের নাজানি কি। আরও কত গল্প- বোকা ইভান, সিতকা বুর্মা, বাবা ইয়াগার গল্প। ক্রমাগত আমার বিস্ময় বাড়তে লাগলো। অনন্ত বিস্ময়ের মুখোমুখি আমি। বই পড়ার নিদারুণ অভ্যাস আমি খুব শৈশবেই অর্জন করেছিলাম। আমার বড় ভাই বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে বই আনতেন। ধীরে ধীরে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। কিন্তু রুশ দেশের উপকথার মতো সুন্দর বই তখনও আমার পড়া হয়নি। কেন এ রকম একটি বই দেখা হয়নি? হতাশায় মন আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
কিন্তু বইটা কি করে সংগ্রহ করা যায়? আব্বাকে যদি কিনে দেয়ার কথা বলি আব্বা সহজভাবে না করে দেবেন। বলবেন, পরে। এখন আমার কাছে বই কেনার মতো যথেষ্ট টাকা নাই। আমার বড় ভাইয়েরও সামর্থ্য নেই বইটা কেনার। তাহলে কি করা যায়?
ঝাঁজালো রোদ উঠেছে আকাশে। বইগুলো চড়চড় করে তরতাজা হয়ে উঠছে। বইটা আমি হাতে নিয়ে আরেকটু দূরে রাখলাম। চারপাশে তাকিয়ে দেখি- কেউ না করল না। কড়াচোখে কেউ আমার দিকে তাকিয়ে নেই। বইটা উদাস মনে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ও সুযোগ আছে। একজন বইচোর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবো- এই বিশ্বাস তৈরি হচ্ছে। আস্থাও পাচ্ছি।
ঠিক তখনই দেখলাম, চশমা পরা এক ভদ্রলোক আমার সামনে। লুঙ্গি ও হাওয়াই শার্ট পরনে। তিনি আমার দিকে তাকালেন না। ভ্রুক্ষেপ নেই। আপনমনে উল্টেপাল্টে দিলেন। তারপর চলে গেলেন ৪২ নম্বর বিল্ডিংয়ের পশ্চিমদিকের একতলা ফ্ল্যাটে। বুঝলাম উনার বই। খুব যত্ন করে উনি বই সংগ্রহ করেন। রুশদের উপকথা মাটিতে পড়ে আছে। আমি অসহায়। ভয়ে বইটা মাটিতে ফেলে দিয়েছি। ব্যর্থ হৃদয়ে দাঁড়িয়ে আছি। নিদারুণ শোকাতুর আমি। বইটা কি পড়তে পারবো না?
তখন মাঝ আকাশে সূর্য উঠেছে। পেটেও খিদে। সবাই যে যার বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। আমিও। বাসায় মা চিন্তা করবে। খুব দেরি করে আমি বাসা ফিরি না।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর উঠোনে আমার মায়েদের আড্ডা বসে। আমরা থাকি ৬/৪ শেখ সাহেব বাজার রোডে। শাহ সাহেব বাড়ি নামেই এটা পরিচিত। আমাদের স্কুলের পাশেই বাড়িটা। সাত-আট ঘর ভাড়াটিয়া। সবাই সবার আত্মীয়ের মতো।
আমার মন ছটফট করছে। মায়েদের আড্ডা জমে উঠেছে। আমি সুড়সুড় করে বাসা থেকে বের হয়ে আবার মাঠে চলে গেলাম।
দুপুরের কড়া রোদ। ৪২ নম্বর মাঠে এখন কেউ নেই। শূন্য মাঠ। আমি ৪২ নম্বর কলোনির দিকে তাকালাম। দরজা বন্ধ। সহসা কারও বের হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ধীর পায়ে আমি বইয়ের দিকে এগোলাম। এখন ছেঁড়াখোঁড়া কিছু বই পড়ে আছে। অধিকাংশ বই হয়তো বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
তাকিয়ে দেখি- রুশ দেশের উপকথা বইটা একাকী পড়ে আছে নিঃস্ব হৃদয়ে।
বইটা কুড়িয়ে বুকের মধ্যে নিলাম। আনন্দে হৃদয় ভরে গেল আমার। কেউ আমার দিকে তাকিয়ে নেই। আমি কি বইচোর? কেউ আমাকে ধাওয়া করছে না। ঘরে ফিরে আনন্দে চোখে পানি এসে পড়ে আমার। অসাধারণ এক গল্পের বই। সারা বিলে সারা সন্ধে সেই বই চোখের সামনে নিয়ে বসে রইলাম। প্রতিটা পৃষ্ঠা যেন জাদুর জগৎ।
রাতেও বইটা বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে রইলাম। বইচোর হতে পেরে আমি গর্বিত।
এই আনন্দময় স্মৃতি কোনোদিন কি ভোলা যায়?
ছড়া যায় ফুরিয়ে
কেন ছড়া লিখি?
সে এক গল্প। গল্পের সবই চমকপ্রদ। ছোটবেলায় ছড়া পড়ার খুব ইচ্ছা হতো। কিন্তু ছড়ার বইয়ের সংখ্যা ছিল খুব…। কোনো লাইব্রেরিতে, কারো বাসায় ছড়ার বই পেতাম না। সবাই গল্পের বই পড়ে। ছড়ার বই কোথায়?
যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন হাতে এলো ‘খাপছাড়া’ নামের একটি ছড়ার বই। লেখকের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুধু লেখা নয়, ছবিও এঁকেছেন তিনি স্বয়ং। ছড়ার অর্থ হয়তো সব বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে ছড়ার সুর ও ছন্দ আমাকে খুব আলোড়িত করলো। প্রাণমন নেচে উঠল।
ছড়ার প্রতি তৈরি হলো আশ্চর্য আকর্ষণ।
বাবা বলতেন, আধুনিক ছড়া বুঝতে হলে লোকছড়া পড়তে হবে।
বাবা একদিন যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘খুকুমণির ছড়া’ বইটা এনে দিলেন। চোখের সামনে সোনালি দরজা খুলে গেল। আগডুম বাগডুম, হাট্টিমা টিম, আঁটুল বাঁটুল শাপলা শাটুল- এসব ধ্বনি তরঙ্গ আমাকে অন্য এক পৃথিবীতে নিয়ে গেল।
আমারও ইচ্ছা হলো, ছন্দ মিলিয়ে ছড়া লেখা নিশ্চয়ই খুব কঠিন কাজ। কারণ অধিকাংশ কথক ছড়া লেখেন না। লেখকরা কবিতা লেখেন। গল্প-উপন্যাস, চিন্তাশীল প্রবন্ধ, নাটক লেখেন। কিন্তু ছড়া লেখার পরিমাণ এত কম কেন? এ ভাবনায় আমার উপলব্ধি হলো- ছড়া লেখা সহজ নয়। আমি এই কঠিন কাজটি করবো।
আর বাবা বোঝালেন,
ছড়া লেখা খুব সোজা।
মা-খালারা মুখে মুখে ছড়া তৈরি করেছেন। ছড়া এক ধরনের সহজবোধ্য ব্যাপার।
বাবা বলতেন,
ছড়া মানে অশিক্ষিতের পটুত্ব।
এ কথার অর্থ সেই ছোটবেলায় তেমন করে বুঝিনি। আজও বুঝি না। তবে ছড়া লিখি। ছড়া লিখলেই সেটা ছড়া হয়ে ওঠে না। অজস্র ছড়া লেখা হয়। কিন্তু কয়টা ছড়া হয়? কয়টা খাঁটি ছড়া হয়ে ওঠে।
ছড়া এক ধরনের ম্যাজিক। মুখের বুলিও ছড়া হয়ে উঠতে পারে। সামান্য কথাও অসামান্য হতে পারে।
কিন্তু ছড়া?
সব কিছু ছড়া হয় না।
এখনও ছড়া লিখতে গেলে বাবার কথা মনে করি। বাবা বলেছিলেন ছড়া হচ্ছে অশিক্ষিতের পটুত্ব। ছড়া লেখা অনেক কঠিন। আমি কঠিনের ভালোবাসিলাম।
গল্প নয়
এটাকে ঠিক গল্প বলা যাবে কিনা জানি না। তবে গল্প তো অনেক রকম। সেই অর্থে সাহস নিয়ে লেখাটা শুরু করলাম।
আমার বাবাকে নিয়ে গল্প। আমার বাবা ছিলেন খুব রাগি মানুষ। হুটহাট করে রেগে যেতেন। মায়ের সঙ্গে খুব ঝগড়া করতেন। একবার আমার বড় ভাইয়ের পিঠে ক্রমাগত বেত মারতে মারতে বেত ভেঙে ফেলতেন। ব্যাপারটা খুবই সামান্য। অনেকবার দেখিয়ে দেয়া সত্ত্বেও বড়ভাই ‘দ্রাক্ষা’ বানানটা ভুল লিখেছে।
তাতেই বাবা রেগে অগ্নিশর্মা। আমি ছিলাম মেজো ছেলে। ছোটবেলা থেকে একটু নির্জনতাপ্রিয়। চুপচাপ থাকতাম। নিজের ঘোরে চলতাম। প্রচুর বাইরের বই পড়তাম। আর অল্প একটু মেধাবীও ছিলাম, যা একবার পড়তাম তা মনে থাকতো। বাবা পছন্দ করতেন- যেন আমি অঙ্ক ভালো মতো শিখতে পারি। অঙ্ক আমার প্রিয় বিষয় ছিল। বাবা বলার আগেই অঙ্ক বইটা আমি ঝরঝরা করে রাখতাম। ল.সা.গু, গ.সা.গু, সুদকষা, শতকরা ঐকিক নিয়ম- এ রকম নানা ধরনের অঙ্ক।
সে কারণে বাবার হাতের মার আমার পিঠে খুব বেশি পড়েনি। আর যখন-তখন আমি গল্পের বই পড়তে বসে যেতাম। বাবা এটা খুব পছন্দ করতেন। পড়ার বইয়ের বাইরে যে কোনো বই অবাধে পড়তে পারতাম। বাবা হয়তো দু’-একবার জিজ্ঞেস করতেন,
কিরে- ক্লাসের পড়া হয়েছে?
আমি মাথা নাড়তাম। অর্থাৎ কমপ্লিট।
এখন কি পড়ছিস?
আমি হয়তো বললাম,
বনমোরগের বাসা।
বাবার ঠোঁটের কোণে হাসি। বললেন,
হ্যাঁ- খুব সুন্দর বই। পড়ে ফ্যাল। পশুপাখি সম্পর্কে একটা ধারণা হবে।
গতকাল কোন বই পড়ছিলি?
আমি বললাম,
দস্যু বনহুরের তেত্রিশ নম্বর বই- ধুমকেতু।
বাবা ভালো-মন্দ কিছু মন্তব্য করলেন না। বললেন,
সব ধরনের বই-ই পড়া উচিত। বই পড়লে আসলে কোনো ক্ষতি হয় না।
বাবা এভাবেই আমাদের মারধোর করতেন। আবার আদর করতেন। যেমন রাগি আবার তেমনি কোমল ছিলেন তিনি। রাগে লাল হয়ে উঠতো তার চোখ। আবার কখনও কান্নায় ভিজে আসতো। বাবা আমাদের তার দুঃখী জীবনের গল্প শোনাতেন। কত কষ্ট করে তিনি বড় হয়েছেন। স্কুলে পড়ার সময় সকালে জমিতে লাঙল চষতেন। দুপুরে স্কুলে যেতেন। এভাবে ঘর সংসারের কাজ করে লেখাপড়া করতেন। অনেক কষ্ট করে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন।
বাবার মুখে ঠাকুর মা’র ঝুলির গল্প শোনার স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বল করে আমার চেতনায়। বাবা রাক্ষুস খোক্কসের গল্প শোনাতেন। শীত-বসন্ত ও সাত ভাই চম্বার গল্প এখনও আমার মনে আছে। এ বাবাই আবার রেগে গেলে আমাদের হাড়গোড় আবার এক করে দিতেন।
প্রচণ্ড বেধড়ক মার দিতেন তিনি। বাবা খেতে খুব পছন্দ করতেন। ব্যাগভর্তি বাজার করতেন। নিজে রান্নাও করতেন খুব ভালো। হাঁড়ি-পাতিল সামনে রেখে ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে খেতে বসতেন। গরুর মাংস আর ঘন মুসুরির ডাল প্রতিবেলায় থাকতে হবে। গরুর মাংস না খেলে নাকি বাবার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়তো। বাবার প্রিয় ছিল রসগোল্লা। খাবার পরে তিনি অবশ্যই রসগোল্লা খেতেন। ফলের মধ্যে প্রিয় ছিল আম-কাঁঠাল। বড় কাঁঠাল কিনে হাতে শর্ষের তেল মেখে তিনি কাঁঠাল ভাঙতেন। বড় বড় কচকচা কাঁঠালের কোয়া তার খুব প্রিয়। আমি কাঁঠাল ততো পছন্দ করতাম না। কিন্তু বাবা জোর করে আমাকে কাঁঠাল খাওয়াতেন। ল্যাংড়া আম আমার খুব প্রিয় ছিল। আমের আঁটি আমি খুব মনোযোগ দিয়ে চুষে চুষে খেতাম।
বাবা বই পড়তেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্রের বই তার খুব প্রিয় ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের থা তিনি কখনও বলেননি। কেন বলেননি, সে প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। এ রকম মধু তেতো মেশানো এক অদ্ভুত চরিত্রের ছিলেন আমার বাবা। যেমন আদর করতেন, তেমনই শাসন করতেন।
একদিন।
ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে সেই সকাল থেকে। খিচুড়ি খেয়ে ঘুম দিলাম। চাদরমুড়ি দিয়ে। আমাদের টিনের ঘরে বৃষ্টিপতনের অবিরাম শব্দ। ছন্দে ছন্দে দুলে উঠেছে ঘর-বারান্দা। বিকালে ঘুম ভাঙল। কিন্তু সন্ধ্যার আবহ। বৃষ্টির বেগ কমে এসেছে। কিন্তু আকাশ কালো। কালো মেঘে ছেয়ে আছে। যেন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মন নেচে উঠল।
এক দৌড়ে চলে গেলাম আজিমপুর বিয়াল্লিশ নম্বর মাঠে। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। মহা-আনন্দ। আমরা প্লাস্টিকের একটি বল নিয়ে খেলা শুরু করলাম। দুটো ইট দিয়ে গোলপোস্ট তৈরি করা হয়েছে। ভেজা মাঠে চিৎকার-চোঁচামেচি করে খেলা শুরু হলো।
এর মধ্যে আবার অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু। ব্যস আহা কি আনন্দ! বৃষ্টিতে ভিজে বল খেলার আনন্দ অন্যরকম। কখন যে মাগরিবের আজান দিয়েছেন খেয়াল করিনি। কলোনির ঘরে ঘরে লাইট জ্বলে উঠেছে। ছায়া ছায়া অন্ধকার।
আমাদের বল খেলার ব্যাপারে ক্লান্তি নেই। হঠাৎ টের পেলাম একটা বজ্রমুষ্টি ঘাড় চেপে ধরেছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার বাবা। রাগে অগ্নিশর্মা। এক হাতে ছাতা। এক হাতে আমি।
শুয়োরের বাচ্চা- লেখাপড়া নাই। সারা দিন টো টো করা। বলেই আমাকে ঠুয়া মারলেন দু-তিনটা। সে যেন রামগাট্টা। মনে হলো আমার মাথায় পেছন দিকটা যেন ফেটে গেছে। তিরতির করে রক্ত গড়াচ্ছে। মাথায় হাত দিয়ে কোনো মতে বাড়ি ফিরে এলাম। টিনের বালতির সামনে বসে মা মাথা ধুয়ে দিতে লাগলেন। তখনো রক্ত বেরুচ্ছে। টিনের বালতি রক্তে লাল হয়ে গেছে।
বাবার চোখ-মুখ তখন অপরাধী ভাব। মা বকা দিচ্ছেন, তোর বাপ আর মানুষ হলো না। অকারণ রাগ। এভাবে কেউ ছেলেপেলেদের পিটায়।
বাবা চুপ। গম্ভীরভাবে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। ডাক্তার ডেকে নিয়ে এলেন। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা হলো। তারপর আমি চুপ করে বিছানায় শুয়ে রইলাম। খেলা, মাথায় আঘাত, বৃষ্টিতে ভেজা- সব মিলিয়ে তখন আমি ভয়ানক ক্লান্ত।
শুয়ে পড়তেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। গভীর রাতে ঘুম ভাঙলো আমার।
তখনও বৃষ্টি পড়ছে। আমার মাথার পাশে বাবা বসে আছেন। বাবা বললেন, এখন অনেক রাত। তুই তো কিছু খেলিনি। বাবা।
হুমমম…।
বললাম, অনেক খিদে পেয়েছে আমার। বাবা প্লেট বাড়িয়ে দিলেন। পরোটা, ডিমভাজি আর গরুর গোশত। খেতে খেতে তাকিয়ে দেখলাম, পাশে আঙুর-আপেল আছে একটা ঝুড়িতে। এক প্যাকেট গ্লুকোজ। বাবা হয়তো এসব নিয়ে এসেছেন।
তুমি জেগে আছো কেন? বাবা কিছু বললেন না। ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। গভীর মমতায় তার চোখ ভিজে উঠেছে। আমি বোকার মতো বললাম,
আর কখনও এমন হবে না। সন্ধ্যার আগেই আমি বাড়ি ফিরব।
বাবা আমার কাঁধে হাত রাখলেন। তার মমতার ধারা বয়ে যেতে লাগলো আমার শরীর বেয়ে।
বইমেলার পাঠক
বইমেলায় দেখা হয়েছিল ছেলেটির সঙ্গে। লম্বা ছিপছিপে। বাম চোখটা ঘোলাটে। ওই চোখে সে দেখতে পায় না। ছেঁড়া জামা কাপড় পরনে। একা একা মেলা মাঠে ছেলেটা ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমরা বিকাল ৫টায় বইমেলা প্রাঙ্গণ সরাসরি অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকি। তখন অনেক ব্যস্ততা আমাদের। উপস্থাপনা করেন লুৎফর রহমান রিটন, আহমাদ মাযহার। অনুষ্ঠানটা দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছে। আমরা মেলা মাঠে উপস্থিত থাকলে অনুষ্ঠানটা প্রচারের জন্য খুব যত্ন নিয়ে থাকি। আমি ‘বইমেলা সরাসরি অনুষ্ঠানের পেছনের কর্মী। পাঁচটার সময় খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
ছোটাছুটি শুরু হলো। লাইট, ক্যামেরা, অনএয়ার সব কিছু মিলে হই হই ব্যাপার। অন এয়ার শুরু হতেই একটু স্থির হলাম।
বইমেলার দর্শনার্থীরা চারপাশে গোল হয়ে ভিড় করেছেন। শতবার বলেও ভিড় কমানো যায় না। নান্টু ধাক্কা দিচ্ছে। জামাল-রেজা চেঁচাচ্ছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
আমি একটু দূরে চুপচাপ বসে আছি। মনিটরের দিকে চোখ। অন এয়ার কেমন যাচ্ছে সেটা ফলো করছি।
হঠাৎ বাম দিকে তাকাতেই দেখি- ঘোলাটে চোখের সেই ছেলেটি ম্রিয়মান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উদাস ও করুণ দৃষ্টি।
কি রে, কি হয়েছে?
কিছু না স্যার।
খুব ক্ষীণ কণ্ঠ।
কি হয়েছে, বলবি না?
ছেলেটি নিরুত্তর
তোর চোখে কি হয়েছিল রে? এ রকম ঘোলা কেন?
আর বলবেন না স্যার। ছোটবেলায় একটা কুকুর চোখে থাবা দিয়েছিল। তারপর থেকে চোখটা নষ্ট। বাঁ চোখে কিছু দেখি না স্যার।
আহারে।
ওর করুণ গল্প শুনে বুকটা হা হা করে উঠল। ওদিকে লাইভ অন এয়ার চলছে। তাকিয়ে দেখি, রিটন ভাই তখন কবি আসাদ চৌধুরীন সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন।
আসাদ চৌধুরী বইমেলায় প্রকাশিত ছোটদের বই নিয়ে কথা বলছেন। আমি আবার ছেলেটির দিকে মনোনিবেশ করলাম।
নাম কিরে তোর?
মকবুল।
থাকিস কোথায়?
লালবাগে।
পকেট থেকে একশোটা টাকা বের করে ছেলেটির দিকে দিলাম।
যা কিছু কিনে খাস।
মকবুল গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। টাকা হাতে নিল না।
কিরে টাকা নিচ্ছিস না।
না, স্যার। টাকা নিমু না।
কেন?
বই নিমু।
কোন ক্লাসে পড়স তুই?
ক্লাস সেভেনে।
কোন স্কুলে?
কামরাঙ্গীরচর হাই স্কুলে।
কি বই কিনবি?
মকবুল বাংলা একাডেমির স্টলের দিকে তাকায়। তারপর খুব করুণ গলায় বলে, একটা ডিকশনারি হইলে খুব ভালো হইতো স্যার। সব পড়তাম। সারাজীবন বইটা আমার লগে থাকতো।
আমি অবাক হয়ে মকবুলের দিকে তাকিয়ে থাকি। তারপর উঠে মকবুলকে সঙ্গে নিয়ে ধীরে ধীরে বাংলা একাডেমির স্টলের দিকে এগিয়ে যাই।
বাংলা-ইংলিশ একটা ডিকশনারি কিনে ওর হাতে দিই। ছেলেটি নিষ্পাপ শিশুর মতো খুশি হয়। আমার পেছন ছাড়তে চায় না। সঙ্গে সঙ্গে থাকে।
আমি বললাম,
বাড়ি যা।
আমাদের অন এয়ার শেষ হলো। সন্ধ্যা নামলো। বইমেলার ভিড় আরও জমে উঠেছে। ছেলেটি চুপচাপ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমার বারবার মনে হতে লাগলো- বইমেলার সত্যিকারের পাঠক এই মকবুল।
পিতা-কন্যা
লোকটা হাঁটছে।
একা একা।
রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের পেছন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লোকটা যাচ্ছে তাজমহল রোডের দিকে। বাঁয়ে ঘুরতেই বিশাল এক ফ্ল্যাটবাড়ি।
ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে দাঁড়ালো লোকটা। তারপর একা একা বলতে লাগলো,
আমার নাম আবদুর রহমান। আমার একটা মেয়ে আছে। ভারি সুন্দর, ছটফটে চঞ্চল একটা মেয়ে, পাখি বা প্রজাপতির মতো মেয়েটা। আমার বুকে অনেক গল্প জমা আছে। ছোট ছোট গল্প। সমুদ্রের গল্প। আকাশের গল্প।
একবার আমার মেয়েকে বলেছিলাম- আমি একটা আকাশ কিনবো। মেয়ে শুনে হেসেই কুটিকুটি। ও তখন বলল, আমি একটা নদী কিনবো।
আমাদের আকাশ বা নদী কোনোটাই কেনা হয়নি। আমার মেয়ের নাম মৌরি। মৌরি মানে ফুল। আমার মেয়ে ফুলের মতোই।
আমাকে খুব মিষ্টি করে বাবা ডাকতো মেয়েটা। আমিও ওকে বলতাম মা। আর কখনও আদর করে মৌ। মৌ মানে মধু।
মৌয়েরও হয়তো অনেক গল্প জমা আছে আমাকে বলার জন্য। হয়তো কোনো একদিন কোনো এক লেকের পাড়ে বসে বসে ‘বাবা-মেয়ে’র একসঙ্গে অনেক গল্প হবে।
আমার মেয়েটা অনেক মেধাবী। স্কুলে সব সময় রেজাল্ট ভালো করেছে। খুব সহজে সব মুখস্থ করে ফেলতে পারে। ওকে আমি ভীষণ আদর করতাম। ওর জামাকাপড় আমি ইস্ত্রি করে দিতাম। অফিস থেকে ফিরেই ওর সঙ্গে গল্প করতাম। পুজো এলে ওকে নিয়ে বিদেশ ঘুরতে যেতাম। কলকাতায় পুজোমণ্ডপে বাবা-মেয়ে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম। আদরের ঝরনাধারা বয়ে যেত আমার শরীরে। মেয়ে ছিল আমার জীবন। আমার ভালোবাসা।
একদিন সেই মেয়ে ভালোবেসে ফ্যালে এক ছেলেকে। ছেলের নাম জয়। গভীর ভালোবাসা। মেয়ের অল্প বয়স। ও জয়কে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। আমি মেয়েকে বিদেশ পাঠাতে চাইলাম। নাহ… মেয়ে যাবে না। ওকে মারলাম পর্যন্ত। বাবা হয়ে জীবনে আমি ওকে ফুলের টোকা পর্যন্ত দিইনি। একা একা কাঁদলাম।
আমি একবার বিদেশে আছি। মেয়ে তখন পালিয়ে জয়কে বিয়ে করে ফেললো। অন্ধ মেয়ে আমার। জয় ও তার বন্ধুদের প্ররোচনায় আমার মেয়ে আমাকে আহত করে তুললো। মেয়ে পালিয়ে গেল।
আমি ওকে আমার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। এত আঘাত কেউ আমাকে দেয়নি। আমি পাগলের মতো হয়ে গেলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম, মেয়ের মুখদর্শন করব না। ও আমার মৃত রাজকুমারী। একই শহরে আমরা থাকি। কিন্তু আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন। মেয়ের সন্তান আছে। ওর নাম আমি জানি না। ওর সন্তানকেও আমার দেখা হয়নি। মেয়ে আমাকে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করে। সেটা আমি টের পাই।
আমিও অনুভব করি। প্রতিদিন বিকালে হাঁটতে বের হই। তখন মেয়ের সঙ্গে আমি একা একা কথা বলি। মেয়েও অনেক কথা বলে।
আমি একা একা স্বপ্ন দেখি। মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন।
মেয়েও আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। একদিন আমাদের দেখা হবে। আমরা অনেক গল্প করব। আরও নতুন নতুন স্বপ্ন দেখব।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।