লিখেছেনঃ জাহিদুজ্জামান ,
আমাদের কলোনীর ভিতরে এক মুদি দোকানদার আছে। নাম মোহাম্মদ মালেক মোল্লা, আমি দোকানে কিছু কিনতে গেলেই সে হাত কচলাকচলি করে বলে, ভাইজান আপনার হাতে সময় হইলে দুইটা জ্ঞানের কথা কইতাম। আমি সবসময় তাকে এড়িয়ে চলি। তার কাছ থেকে সবসময়ই পালিয়ে বাঁচি। দোকানের সামনে দিয়ে কোথাও যেতে হলে আর একদিক তাকিয়ে হেঁটে যাই। তার ভাইজান ভাইজান বলে ডাকা-ডাকি শুনেও না শোনার ভান করি।
একদিন বিকালে হাঁটতে বেরিয়েছি, দেখি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে মালেক মোল্লা, আমি অন্য দিক থেকে যেতে চাইলেও মালেক মোল্লা আমাকে দেখে ফেললো, দাড়ি-মোচের ভিতর থেকে লালচে গোলাপী দাঁত বের করে বললো, ভাইজান, আসসালা মালাইকুম। বুঝলাম বিপদ আসন্ন।
মালেক মোল্লা তার বীরত্বের কথা বলতে থাকল; আমি হাঁটছি আর শুনছি।
– ভাইজান, আমি ছিলাম বিজ্ঞানের ছাত্র; বিজ্ঞান ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না। আমার ছেলেকে হাফেজিয়া মাদ্রাসায় দিয়েছি সব কুরান মুখস্থ করে ফেলবে। জানেন তো এই পৃথিবীতে বিজ্ঞানের যত আবিষ্কার তার সকলই কোরানশরীফে আগে থেকে বলা ছিল। আমি বললাম, কি বললেন মালেক সাহেব? সে বলল, জি ভাইজান, কোরানশরীফ গবেষণা করেই এসব আবিষ্কার করা হয়েছে।
আমি বললাম, মালেক সাহেব আপনি কোরানশরীফের সাথে বিজ্ঞানকে মেলাচ্ছেন? সে বললো, মেলাবো না কেন ভাইজান? আল্লার নির্দেশ ছাড়া কিছু আবিষ্কার হইতে পারে? আমি চুপ করে রইলাম, মালেক মোল্লার সাথে তর্কে যাওয়া আমার ঠিক হবে না। সে বললো, ভাইজান মানুষ ইদানীং কুসংস্কারে খুব বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে – ন্ধ আমার ভাইয়ের ছেলে এসেছে গ্রাম থেকে। গলায় তার এতগুলো তাবিজ। তার উপর নাকি জ্বীন-পরীর আছর লেগেছে। আমি সব তাবিজ গলা থেকে খুলে দিয়েছি। এই সব কুসংস্কার ধরে রাখা ঠিক না। কি বলেন ভাইজান, এই একবিংশ শতাব্দীতে জ্বীন-পরীর কথা বিশ্বাস করা যায়?
আমি বললাম, মালেক সাহেব, তাহলে তো আপনাকে কোরানশরীফ অস্বীকার করতে হয়, কারণ কোরানশরীফে জ্বীন-পরীদের কথা বলা আছে।
হঠাৎ করে মালেক মোল্লা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সে পাথরের চোখের দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল যেখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ছায়া। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, মালেক সাহেব কি হল? সে নিঃশব্দে হা করে থাকল। তার মুখের ভিতর থেকে আলজিব দেখা যাচ্ছে। আমি বললাম, মালেক সাহেব মুখের ভিতর মাছি যাবে তো! সে কিছুতেই নড়তে পারল না। আমি বাসায় ফিরে আসলাম।
বাসায় ফিরে দেখি আমাদের দরজার সামনে মা দাঁড়িয়ে। আমাদের বিল্ডিংয়ের তিন তলার ভাবী চোখ বড়বড় করে ভয় পাওয়া গলায় তার সাথে কি যেন বলছে। তার সঙ্গে সেখানে আরও ৪/৫ জন মহিলা যারা সবাই বিভিন্ন ডেপুটি সেক্রেটারীর স্ত্রী। আমাকে দেখে তারা যেন শক্তি পেল। ভাবী আমার কাছে এসে বললো, ছোট ভাই, আমাদের বিল্ডং-এ জ্বীন-পরীদের আছর লাগছে। হুজুর ডেকে এনে বাড়ী বন্ধন দিতে হবে।
এবার মালেক মোল্লার চেয়েও বড় হা করে আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কারণ তিনি একজন ডেপুটি সেক্রেটারীর স্ত্রী, অনার্স-মাস্টার্স পাশ। মালেক মোল্লাও কুসংস্কারের হাত থেকে বাঁচতে চায়, কিন্তু সে জানে না কোনটা কুসংস্কার। কিন্তু একজন ডেপুটি সেক্রেটারীর স্ত্রী যখন সবকিছু জেনেশুনেও জীòন-পরীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য হুজুর ডেকে এনে বাড়ী বন্ধন দিতে চায় এবং বিল্ডিং-এর আরও কয়েকজন ডেপুটি-স্ত্রীও তার সাথে একমত তখন এ কথা জানার পর সত্যিই হা করা ছাড়া অন্য কিছুই করার থাকে না।
মা বললো, কিরে হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো; সবাই হুজুরের টাকা রেডি করছে। এই টাকা নে, আজকের মধ্যে হুজুর ডেকে আনবি; আমারও কেন জানি ভয় ভয় লাগছে।
আমি টাকা হাতে নিয়ে হা করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।