কার ছেলে তুমি, জিজ্ঞেস করতেই শান্ত স্বরে সাত-আট বছরের ছেলেটি বলল, বেশ্যার ছেলে আমি। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমি, কি বলছে এই ছেলে! আমার ভিতরে ঝড়ের মত উন্মাদনা শুরু হল। পার্কে এসেছিলাম একটু হাওয়া খাবার জন্যে, ভিক্টোরিয়া পার্ক আমাদের জগন্নাথ কলেজের সামনেই, প্রতিদিনই কলেজে ঢোকার সময় গাঢ় লিপস্টিক পরা মেয়েদের দেখি, ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখি ছেড়া জামা-কাপড় পরে ঘুর ঘুর করে, পথচারী দেখলেই হাত পাতে ভিক্ষার জন্যে – কখনোই ওদেরকে নিয়ে ভাবিনি, নিজের মত করে কলেজে আসা-যাওয়া করেছি।
আমি স্তব্ধ হয়ে ছেলেটির আরো কাছে গেলাম, বললাম, কি বলছো তুমি! কোথায় তোমার মা! সে আঙ্গুল উঁচিয়ে রাস্তার মোড়ে গাঢ় লাল লিপস্টিক পরা এক মহিলাকে দেখালো, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, সে এক রিকশাওয়ালার সাথে কি নিয়ে যেন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যাচ্ছে, আমি কৌতূহলী হয়ে মহিলার কাছে গেলাম। সে তার ছেলের দিকে তাকিয়ে আগুন হয়ে গেল, বলল, তোরে বলছি না কাস্টমার থাকলে তুই আমার কাছে আসবি না। আমি বুঝলাম রিকশাওয়ালা তার কাস্টমার, আমি ইতস্তত করে তার কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ওর মা? সে আমার দিকে আপদমস্তক তাকিয়ে বলল, আসল কথা ক, ব্যাডা প্যাচাল ভাল্ লাগে না। আমি বললাম, ওর বাবা নাই? সে বলল, তুই ওর বাপ। এখন যা, প্যাচাল পাড়বি না।
আমি পার্কের ভিতরে ফিরে এলাম, দেখলাম ছেলেটা এক কোণায় বসে কাঁদছে, সে চোখের পানি আটকাবার জন্য খুব চেষ্টা করছে, কিছুতেই পানি থামছে না, তার ছেড়া, ময়লা জামা দিয়ে চোখ মুচছে। আমি তার কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিতেই হাউমাউ করে কেঁদে দিল। আমি কি করব কিছুই বুঝতে পারলাম না। বললাম, এই, তোমার নামই তো আমার কাছে বলনি। কি নাম তোমার? ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে বলল, বাদল। খুব সুন্দর নাম, কে তোমার এই নাম রেখেছে? সে কান্না থামিয়ে বলল, মা রেখেছে আমার নাম।
থাক কোথায় তোমরা?
ঐ যে পার্কের কোণায় পলিথিনের ভিতর।
ঐখানে থাক, তোমাদের কেউ কিছু বলে না?
বলে, মাঝে-মধ্যে পুলিশ আইসা মাকে বলে, টাকা দে নয়ত আমাদের সাথে পার্কের মধ্যে চল।
তুমি কি আমার সাথে আমাদের বাসায় যাবে যেখানে সব বেলায় খাবার পাবে, রাত্রে ভাল করে ঘুমুতে পারবে?
আমার মাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
তুমি তোমার মাকে খুব ভালবাস?
হুঁ
তুমি কখনো স্কুলে গিয়েছো?
প্রতিদিনই তো যাই।
কোন ক্লাসে পড়?
আমি তো স্কুলে পড়তে যাই না।
তাহলে কি জন্যে যাও?
কাগজ টোকাইতে। অনেক কাগজ পাওয়া যায়।
তোমার পড়ালেখা করতে ইচ্ছে করে?
হুঁ
ধর, তুমি একদিন অনেক টাকা পেলে; তুমি কি করবে?
মায়ের জন্য একটা ঘর বানিয়ে দিব, মায়ের ঘরের খুব সখ।
আর কি করবে?
আর মাকে ডাক্তার দেখাবো। মার যেন কি হয়েছে, সারাক্ষণ ব্যথা ব্যথা করে চিৎকার করে।
তুমি কি আমার কাছে আজকে কিছু চাইবে না। প্রতিদিনই তো দেখি হাত পাত।
মোড়ের দোকান থেকে আমাকে একটা বাঁশী কিনে দিবেন?
আমি ওকে পার্কে রেখে বাঁশী কিনতে গেলাম, বাঁশী নিয়ে ফিরে এসে দেখি বাদলের মা এসেছে, বাদল মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি বাদলকে জাগালাম না, কি হবে একটা বাঁশী দিয়ে যার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও চিত্তবিনোদন কিছুই নাই তাকে আমি একটা বাঁশী দিলাম আর সমাধান হয়ে গেল? না, সমাধান হল না। বাদলকে যারা জন্ম দিয়েছে তাদেরকে জানাতে হবে শিশুদের অধিকার, জন্ম নেওয়ার পর ভালভাবে বাঁচার অধিকার, অট্টালিকার উপর যে বাদলরা ঘুমায় এই মাটির বাদলও সেই রকম ঘুমানোর অধিকার রাখে। অধিকার রাখে সে হাজারো ছেলের মত স্কুলে যাবার।
আমি বাঁশী নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম, বাদল ঘুম থেকে উঠে হয়ত ভাববে আমিও সবার মত ঠক-প্রতারক। ভাবুক! সত্য কথা ভাবলে দোষ কোথায়?
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।