মনঃদর

বাড়ির দারোয়ানটি আহাদ সাহেবকে এসে জানালো রাস্তায় একটাও ট্যাক্সি নাই ।
বদমেজাজি আহাদ সাহেব কি বলবেন কিছুই বুঝতে পারলেন না , শুধু মিন-মিনিয়ে দাঁত চাবিয়ে বলতে লাগলেন “ব্যাটা সময় পেলেই রাস্তায় দাড়িয়ে বিড়ি টানবে , তুই কি গাড়ি খুঁজেছিস।”
যেতেই যখন হবে তখন বাধ্য হয়ে আহাদ সাহেব নিজেই নামলেন গাড়ি ঠিক করতে । তিনি নিজেও একটা বিড়ি জ্বালিয়েছেন ।
সত্যিই রাস্তায় ট্যাক্সি-ক্যাব কম , আর যা দেখতে পাচ্ছেন সেটাও যাত্রীসহ ।
কি হবে এখন ? ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে । কি হবে ? এসব মেলা কথা ভাবতে ভাবতেই সামনে একটা খালি ট্যাক্সি-ক্যাব এসে দাঁড়ালো । শান্তির এক শ্বাস নিলেন আহাদ সাহেব ।
তবে এখন এই শান্তিকে পরম শান্তিতে রুপান্তর করতে হলে চালক সাহেবের সাথে কথা বলতে হবে । যদি সে না যায় ?
“ভাই যাবেন?”
“কোথায় যাবেন?”
“বিমান বন্দর”
“না যাব না।”
চালকের “না যাবনা” শব্দ শুনে আহাদ সাহেব বুকে চিন-চিন ব্যথা অনুভব করলো । তবুও অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেন ।
“কেন যাবেন না ভাই?”
কর্কশ কণ্ঠধারী আহাদ সাহেবের গলা দিয়ে যেন এখন মধু ঝরছে । তিনি চালকের মন গলানোর চেষ্টা করছেন বোঝা যাচ্ছে ।
“যাব না বলছি তো ভাই ; আর কেন যাব না তা আপনার কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে ?”
“চলেন ভাই , খুবই জরুরী । ভাড়া বেশী দিব।”
হাড়-কিপটে আহাদ সাহেব একি বললেন ? ভাগ্যিস এই কথা বলার সময় তার পরিবারের কেউ পাশে ছিলো না , থাকলে নগত অজ্ঞান ।
“ভাই , সত্যি বলতে কি আমি বিমানবন্দর চিনিনা , তাই যাব নাহ ।”
চালকের এই কথা শুনে আহাদ সাহেব একটু মুচকি হাসলেন ।
“চিনেন না , কোন সমস্যা নেই আমিই আপনায় চিনিয়ে নিয়ে যাব । তবুও চলেন ভাই।”
আহাদ সাহেবের আশা-স্বরূপ কথা শুনে চালক তাকে গাড়ীতে উঠতে বললেন ।
পঁচিশ-সাতাশ বছর বয়স্ক এক পাঁচতলা বাড়ির সামনে এসে ক্যাবটা দাঁড়ালো ।
মানুষ কিপটে না হলে জীবনে উন্নতি করতে পারে না আহাদ সাহেব তার জলজ্যান্ত প্রমাণ ।
এ বাড়িটি তার ।
বড় মেয়ের বিয়ের সময় বাড়িটি রং করিয়েছিলেন ; সেও প্রায় এক যুগ হয়েছে । দেয়ালের মাঝে মাঝে সিধলে পড়েছে ।
এই সিধলা নাকি এক ধরনের দেয়াল-চিত্র ; আহাদ সাহেবের ভাষায় ।
আহাদ সাহেব বাড়ির নীচে এসে চিল্লিয়ে শান্তাকে ডাকলেন ।
এক চিৎকার দেবার পর আহাদ সাহেবের বুকে হাত । ব্যবসায় একবার ক্ষতি হবার পর থেকেই বুকের ভেতর এই ব্যথার আগমন । বেচারা ব্যথায় বুকে হাত দিয়ে বসে-শুয়ে-দাড়িয়ে চোখ মিট-মিট করে দাঁত কামড়িয়ে সহ্য করবেন তবুও ডাক্তার দেখাবেন নাহ , তাই চিৎকার দিলেই বুকে হাত ।
মানুষটা জীবনের সাথেও কিপ্টামি করেন ।
আহাদ সাহেবের ছোট মেয়ে শান্তা ; নীচে নেমে এলো ।
শান্তা সুন্দরী , যার কারনে ওদের বাড়িসহ এলাকায় অনেকেই শান্তাকে ভালবাসে । তবে গোপনে , কারন যদি রক্তিম জানতে পারে তবে দেহটা খণ্ড-বিখন্ড না হলেও হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে এটা নিশ্চিত ।
রক্তিম শান্তার প্রেমিক ; একথা সবাই জানে কিন্তু কেউ মানতে চায় না । কারন রক্তিম যে ছন্নছাড়া , মাস্তান তবে অর্থশালী ।
আহাদ সাহেবের চোখের বিষ ।
“বাবা এত আগে না গেলেও পারতে ।”
“কেন মা রক্তিমের সাথে কি আজ দেখা করার কথা ছিল ?”
বাবার এরকম শরীর জ্বালানো কথা শুনে শান্তা নিশ্চুপ হয়ে গাড়িতে উঠে বসলো ।
আহাদ সাহেব ড্রাইভারের পাশে আর শান্তা বসে আছে পেছনের সিটে ।
শান্তার সুন্দর মুখটা রাগে লাল হয়ে আছে । শান্তা অন্য সবকিছু মানতে রাজি কিন্তু রক্তিমের ব্যাপারে যদি খারাপ মনোভাব নিয়ে কেউ কিছু বলে তাহলে সে সাপের মতো ফুঁসতে থাকে ।
“বাবা তুমি শুধু-শুধু বাজে কথা শুনাও । আর আমাদের এত আগে এয়ারপোর্ট যাবার দরকার কি ছিল ? আপু ল্যান্ড করবে ৫ টায় আর এখন বাজতাছে মাত্র ১১ টা । তুমি সবকিছুতেই একটু বেশী কর ।”
সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে বাবাকে অনেকগুলা কথা শুনিয়ে দিল শান্তা ।
“ওহ , আপনারা এয়ারপোর্ট যাবেন চাচা ? একথা আগে বলবেন তো । আমায় আর চিনিয়ে নিতে হবেনা চাচা , আমি এয়ারপোর্ট চিনি ।”
“মানে”
ট্যাক্সি চালকের কথা শুনে শান্তার মুখে এই “মানে” শব্দটাই এসে থেমে গেল ।
শান্তার কিছু বুঝে ওঠার আগেই আহাদ সাহেব অট্ট-হাঁসিতে ভেঙে পড়লো । অনেক জোড়ে আওয়াজ করে হাঁসতে লাগলো তিনি । হাঁসতে তো আর টাকা লাগে না ,নাহয় একটু বুকে ব্যথাই করে । আর এর জন্য আহাদ সাহেবের হাসি থামতে একটু সময় লাগলো ।
চালক আর শান্তা দুজনই আহাদ সাহেবের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । ওদিকে শান্তা ভাবতাছে চালক কি এমন কথা বলল যার কারনে তার বাবা এরকম গুন্ডা-মার্কা হাসি হাসলেন ।
অতঃপর আহাদ সাহেব মুখ খুললেন , “তুমি তো বড় আজব মানুষ ; বিমানবন্দর চিননা কিন্তু এয়ারপোর্ট চিন , কঠিন বাঙালী ।”
চালক চুপ হয়ে রইলো , চোখ দিল সামনের পথে ।
এদিকে শান্তা বিষয়টা বুঝতে পেরে মনের রাগ গুলোকে ভুলে বাবার হাঁসির সঙ্গী হল ।
প্রায় এক ঘণ্টা হয়েছে শান্তা আর আহাদ সাহেব বিমানবন্দরে দাড়িয়ে আছে । এর মধ্যে দুজনে অনেকগুলো বিমান আকাশ থেকে নামতে আর উড়ে যেতে দেখেছেন ।
আরও প্রায় চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে বিমানবন্দরে ।
আহাদ সাহেব হয়তো বুঝতে পেরেছে , তারা অনেকটা আগেই চলে এসেছেন বিমানবন্দরে । আর যতটা সময় অপেক্ষা করতে হবে ততক্ষণ মেয়েটা যেন কিছু বলতে না পারে সে জন্য শান্তাকে অনেকগুলো চকলেট , ঠাণ্ডা পানীয় , আইছক্রিম , ম্যাগাজিন আরও অনেক কিছু কিনে দিয়েছেন ।
কিপটে আহাদ সাহেবের এসব কিনতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে , তবুও কিনেছে ।
টাকার চাইতে যে মেয়ের মনটা তার কাছে বড় ।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!