অপাঙক্তেয় বসবাস—- মুর্শিদা জামান

বিকেল এখানে একাই আসে। বলে যায় চলে যাওয়া সকালের কথা। তারপর নিরবচ্ছিন্ন ক্লান্ত রাত। নিজের সাথে নিজেরই বসবাসের রাত। এসব বেহিসেবি সময়ের খোঁজ নিতে ইচ্ছে হয় না মেহরাবের। তবুও এই ঝরঝরে বিকেলে নিজের সাথে কথোপকথনে ও দেখল অনেকগুলো দিন আর রাতে যেন নেই হয়ে গেছে। হাতড়ে পাওয়া গেল না তাদের। রাতের পর রাত ক্রমাগত লিখে লিখে বুঝি ও অন্ধই হয়ে গেছে। এখন যে চলমান কোন ঋতু সেও অজানা। দৈনিক কাগজগুলোর মধ্যভাগে যে মানুষটির লেখা উজ্জ্বল মেধা বহন করে, সে মানুষটি অভিক মেহরাব।
ওর প্রতিটি কলাম ধারালো কাঁচির মতো কেটে কেটে দেয় সভ্য সমাজের চিন্তাকে, ধারণাকে। কিন্তু মেহরাব আগের মতো সচল মস্তিষ্কের মানুষটি আর নেই। বাইরে আস্ত দেখালেও ভেতরে ভেতরে আসলে ও একটা ভগ্ন বাড়ি। সব কর্মশৈলী, মননসুধা জলহীন পত্রবীথির মতো করুণ অবয়বে দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালের পূর্ব কোণ থেকে ছাইরঙা টিকটিকিটি এমনি সময় ডেকে উঠল। টিক টিক, টিক টিক টিক। ঠিক যেন ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজিয়ে দিল কেউ। মেহরাব মন্ত্র পড়ার মতো বিড় বিড় করল ঠিক, ঠিক, ঠিক।
মায়ের মুখ, শরীর, শাড়ি, চুড়ি, এমনকি পাঁচ ফোড়নের গন্ধশুদ্ধ স্পষ্ট হয়ে উঠলো মেহরাবের সামনে।
‘মাথায় সেই নরম ভেজা স্পর্শ’- বড় হবি। তুই অনেক বড় হবি, খোকা।
‘দেখেছিস টিকটিকি কেমন ঠিক ঠিক করে উঠলো। অভিমানে বুকটা বাস্পময় ওর।’
‘তুমি সব সময় আস না কেন, মা?’ মায়ের মুখে সরল মমতার রেখা ফুটে ওঠে সহসা, ‘বোকা ছেলে’।
‘আমি তো তোর পাশেই থাকি। তুই মন দিয়ে লিখে যা খোকা। সময় নেই রে।’
হালকা কুয়াশার ভেতর দিয়ে মায়ের মুখ, শরীর-সমস্ত মিলিয়ে গেল পলকেই। অমনি বিষকামড় অনুভব হতে লাগলো মেহরাবের মাথার কোষে কোষে। ঘোর শূন্যতা খামচে ধরলো ওর দৃশ্যমান বাস্তবকে। এই বড় হওয়া চায়নি কোনোদিন। হাতের মুঠো ফাঁকা হয়ে যাবার মতো বড় হওয়া চায়নি। বালিশের তলায় সেলফোনটা গোঁ গোঁ করে জানান দিল কেউ কল করেছে। অন্যমনস্কভাবে হাতটা ঢুকিয়ে দিল ও সেখানে। স্ক্রিনে তখন সন্দ্বীপের নাম তির তির করে লাফাচ্ছে। অতল কোন চেতনার ভেতর থেকে মেহরাব মনে করার চেষ্টা করল, ——-?
সবুজ বোতামে চাপ দিল। অমনি ও পাশ থেকে হুঙ্কার।
‘পণ্ডিতের বাচ্চা! কখন থেকে রিং দিয়ে যাচ্ছি, কোথায় ছিলি?’
স্বরটাই চিন্তার সুতো জুড়ে দিল। এ তো ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মুহূর্তে মেহরাব সজাগ হলো। স্বাভাবিক আন্তরিক
শোনালো ওর গলা।
‘কি খবর তোর, সন্দ্বীপ। ডলারের দাম উঠেছে নাকি আবার? এত হট আছিস যে!’
প্রাণখোলা হাসি ওপারে।
‘না রে টাকার গন্ধ আর নিতে ইচ্ছে হয় না। চল না দুই বন্ধু মিলে কোথাও ঘুরে আসি। পড়শু শ্রেয়া কানাডা যাচ্ছে, আবার স্কলারশিপ হয়েছে ওর।
‘বাহ্। ভালো খবর। তুইও যা না ওর সাথে।’
‘আমি তো মাটির তলার খবর নেই না রে, মাটির মানুষ নিয়ে কারবার আমার। শোন, হাতের কাজ থাকলে সেরে ফেল। সন্ধ্যার পর উত্তরা চলে আয়। কষে প্ল্যান করবো দুজনে।’
‘উহ্! আজ না রে দীপ। ড. শোভনের ওখানে সিটিং আছে রে। তুই বরং চলে আয়। বাজারে কুমড়োফুল উঠেছে। জম্পেশ বড়া খাব মুড়ি দিয়ে। ঠিক হ্যায়!’
‘ওকে, ডান। তুই কি রেগুলার যাচ্ছিস সিটিং দিতে? মানে এখনও…’
‘তা যাচ্ছি। কেন?’
‘না ভাবছি আমিও একবার যাব। চারদিকের অনেক কিছুই ভালো লাগে না আগের মতো।’
‘আই সি; কাল আয় আগে। এখন ছাড়ছি রে। ওকে বাই নাও।’
‘বাই।’
ফোন রেখে ঘড়ির দিকে তাকালো মেহরাব। না, একদমই সময় নেই হাতে। ঝটপট বেরুতে হবে। কোনোমতে হালকা জলপাই পাতা রঙের একটা শার্ট গায়ে চাপাল। আয়নায় দেখল নিজেকে। সেখানে অনেক দিনের ফেলে আসা একটি মানুষকে দেখতে পেল ও। আয়নাও কখনো কখনো ভীষণ স্বার্থপর হয়ে ওঠে। আয়নার মাঝখানে দিলার লাল টিপ কট কট করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। দিলা খুব ভালোবাসত এই লাল টিপ। বলতো, যখন থাকব না, এই টিপের দিকে তাকিয়ে দেখ আমাকেও দেখতে পাবে। মেহরাব তাকায় কিন্তু দিলাকে দেখতে পায় না।
মহানগরী বলে কথা! এখানে মানুষের ব্যস্ততা একে অপরের থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। আর সেই দূরত্ব বাড়াচ্ছে অনেক অসুখ। মনের ভেতর অল্প অল্প করে জায়গা করে নিচ্ছে অবিশ্বাস, ঘৃণা ও শূন্যতা। ফলে ডা. শোভনের চেম্বারেও ভিড় বাড়ছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর যশও রয়েছে। এর কারণ তিনি প্রতিটি পেশেন্টকে সমানভাবে নিজের করে নিতে জানেন। চোখা নাক, ঘন চুলের নিচে দুটি বিদ্যুৎদীপ্ত চোখ। আর সাথে চমৎকার কণ্ঠস্বর যেন দেবতার বর। ভদ্রলোককে প্রথম দিন দেখেই মেহরাবের মনে হয়েছিল গ্রিক পুরাণ থেকে উঠে আসা কোনো চরিত্র বুঝি। বরাবরের মতো আজও ভেতরে ঢুকতেই নরম আলো জাপটে ধরলো ওকে। সেই সাথে ডা. শোভনের নির্মল হাসি নির্ভার করে তুললো মেহরাবকে।
ডা. শোভনেরও ভালো লাগে অভিক মেহরাবকে। মানুষের মন ও মস্তিষ্ক হাতড়েই তিনি তুলে আনেন সুদূর অতীত অথবা কষ্টের নুড়িপাথর। কিন্তু এই পেশেন্টের সাথেই তিনি একটা মমতা অনুভব করেন অন্যরকমভাবে।
‘কাল রাতের বৃষ্টিটা কেমন ছিল মি. অভিক মেহরাব?’
‘আপনিও রাত জাগেন আমার মতো।’
‘গোটা দিন তো কেবল কাজ আর কাজ বলুন। রাতেই তো ভাবনার সময়। আপনি লেখেন আর আমি ঘটনার সাথে ঘটনা মেলাই।’
রুমের এক পাশ থেকে টিকটিকির দুষ্টুমি ডাক। ঠিক ঠিক ঠিক। মেহরাব অমনি চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ঠিক, ঠিক, ঠিক।’
‘দেখেছেন ডাক্তার, দেখেছেন কেমন সত্যি হলো। মা আমার সাথে এখানেও এসে গেছেন।’
তার চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক। ডা. শোভন বুঝলেন বিশ্বাসের দানা কতটা গভীরে গিয়ে বসবাস করছে মেহরাবের মাথায়। এতদিনের এত কাউন্সেলিং সবই তার মানে ভেস্তে গেছে। মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করলেন অভিজ্ঞ ডাক্তার। বুঝলেন, বুদ্ধিমান মেহরাবকে একটু ঘুরপথে নিয়ে যেতে হবে। চমৎকার বাচনভঙ্গির জন্য এমনিতেই তিনি প্রায় পেশেন্টের মনোযোগ দখল করে থাকেন। আর সেটাই এবার কাজে লাগালেন।
‘আপনি কিন্তু গত মাসের তুলনায় বেশ সুন্দর হয়েছেন মি. অভিক মেহরাব। গুছিয়ে কথা বলছেন।’
‘উম! তাই।’
‘নিশ্চয়ই মি. অভিক। এই দেখুন না। আপনার মা এখানে উপস্থিত। এর মানে তিনি আপনাকে ভালোবাসেন। তাই তিনি চাইছেন আপনি সুস্থ-সুন্দর থাকুন। তাই না।’
‘দিলা চায় না তাই না ডাক্তার। ও আপনাকে ফোন করে নিশ্চয়ই বলে মা’র কথা, আমার কথা।’
‘দেখুন দিলা তো আপনার জীবনের সাথে অনেকটা দিন ছিল। আর সে তো পর কেউ নয়। আমার সাথে একদিনই কথা বলেছিলেন তিনি। তাও কেবল আপনার অবস্থা জানতে।’
‘আপনি জানেন না। ও মাকে একদম সহ্য করতে পারত না। বলত সারা ঘরে নাকি পানের পিকের গন্ধ! তাই মা অভিমান করে টিকটিকির ভেতর ঢুকে গেছে।’
ডা. শোভন স্থির চোখে তাকিয়ে ছিলেন ওর দিকে। চোখ বুজে একবার নিজের মায়ের মুখটা দেখে নিলেন। পৃথিবীর সব মাই সন্তানের জন্য পসেসিভ হয়ে থাকেন। মৃত্যুও আড়াল করতে পারে না সেই অতিরিক্ত স্নেহ থেকে। নিজের ভাবনা থেকে সরে এসে তিনি অভিকের চিন্তায় ঢুকে গেলেন।
‘আপনাকে দেখলে আমার নিজের মাকে খুউব মনে পড়ে। কাল ছুটির দিন আছে। চলুন না আজিমপুর কবরস্থানে যাই।’
কণ্ঠে যতটা সম্ভব বিষাদ ঢেলে দিলেন ডা. শোভন। অভিক একটা সবুজ পেপার ওয়েটের দিকে তাকিয়ে ছিল। কথাটা শুনে লাফ দিয়ে উঠল।
‘ভালো কথা বলেছেন তো! বাবাও ওখানে আছেন। ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তো কোনো দোয়া জানি না ডাক্তার! আরবি ভাষা কিছুতেই মুখস্থ হয় না আমার।’
ডা. শোভন মনে মনে খুশি হয়ে উঠলেন। কোনোভাবে কাল তিনি মেহরাবকে আফসানা খাতুনের কবরের সামনে নিয়ে যাবেন। তারপর আসল উদ্দেশ্যটা সফল হবে কাল।
‘নো প্রবলেম! আমি পড়বো, সেটা শুনে শুনে আপনি বলবেন। তাছাড়া আরবিতেই বলতে হবে তা তো নয়। আপনি নিজের ভাষাতেই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করবেন। আপনি টিকটিকির ভাষা বুঝতে পারছেন, আর তিনি আপনার ভাষা বুঝতে পারবেন না!’
একটু শান দিয়ে কথাটা বললেন তিনি। মেহরাবের মতো মানুষের বিশ্বাস টলাতে গেলে অনেক নাটকের আশ্রয় তাকে নিতে হবে।
ডা. শোভনের চেম্বার থেকে বের হয়ে অভিক নিউমার্কেটের দিকে রওনা দিল। কাল সন্দ¦ীপ আসবে। বাজার করতে হবে। সন্দ¦ীপ এমন একজন মানুষ যার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয়া যায়। সেন্ট্রাল রোড হতে হাঁটা শুরু করল ও। কথা নেই, বার্তা নেই, হুট করে বৃষ্টি নামল। রাস্তার বেশিরভাগ মানুষ দৌড়ে শুকনো জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিল। যাদের তাড়া আছে, কেবল তারাই ভিজতে ভিজতে যেতে লাগলো। অভিকের এই হঠাৎ আসা বৃষ্টিই ভালো লাগলো। অভিকের সামনে দিয়ে একটি অপূর্ব গোলাপি ছাতা মাথায় হেঁটে গেল কেউ একজন। অভিকের মস্তিষ্ক ও মন দুটোই প্রাণপণে ওই সুন্দর ছাতার নিচে থাকা মানুষটির মুখ দেখতে চাইল। দু’কদম আগে গিয়ে তাকাবেÑ সে উপায় নেই। তবে তার পোশাকে বলে দিচ্ছে সে পাহাড়ের মানুষ। অভিক গোলাপি ছাতাটিকে ভিড়ের গভীরে মিশে যেতে দেখল।
অভিকের মস্তিষ্কের ভেতর তখন গোলাপি ছাতাটি ঘূর্ণির মতো ঘুরছে। ঠায় দাঁড়িয়ে গেল ও। যেনবা কেউ ওকে পণ দিয়ে গেছে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলে উঠেছে। ট্রাফিকে আটকে গেছে চলমান গাড়িগুলো। সবটা মিলিয়ে মেহরাবের মাথায় একটা স্থবির অনুভূতি।
প্রথম দৃষ্টিতে দিলা বুঝে উঠতে পারছিল না ওটা অভিক কি-না। কিন্তু দীর্ঘদিনের চেনা কাউকে দূর থেকে দেখলেও মস্তিষ্ক সচেতনভাবে সাড়া দেয়। দিলা ভেবে পেল না কেন এরকমভাবে ভিজছে মেহরাব; কিন্তু পরক্ষণেই মনে করতে পারল ও মেহরাব তো সাংঘাতিক অসুখে ভুগছে। মনের নরম অংশ দিলাকে ধাক্কা দিল এই দৃশ্যে। একবিন্দু না ভেবে ও রিকশা থেকে নামল। যদিও খুব দরকার ছিল আড়ংয়ে যাবার। মেহরাব অব্দি পৌঁছাতেই দিলা ভিজে গেল।
‘কি করছ কি তুমি! ভিজছো কেন এখানে দাঁড়িয়ে?’
মেহরাব নিশ্চুপ। কে পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কি বলছে, কিছুই বোঝার মতো অবস্থা নেই ওর। চোখজুড়ে কেবল গোলাপি ছাতা। মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাওয়া। মায়ের বারান্দায় গোলাপি ছাতা মেলা। সেখানে লুকোচুরি খেলা। এসব দৃশ্যই এখন মেহরাবের মস্তিষ্ক অন্তর্গত।
খুব জোরে ঝাকি দিল দিলা ওকে। মুখটা ভিজে সাদা হয়ে গেছে। দিলা গভীর একটা মমতা বোধ করলো মেহরাবের প্রতি। মেহরাবের শীতল হাত ধরতে যেয়ে দেখল মনের কোথাও যেন চুপটি করে বসে ছিল ভালোবাসা। গত দেড় বছর এই হাত ও ছেড়ে ছিল। না ঠিক হলো না। গত তিন বছর। একই ঘর, একই বিছানা, কিন্তু আলাদা বসবাস ছিল ওদের। শাশুড়ির চলে যাওয়াটা মেহরাবকে দ্বিখ-িত করে ফেলেছিল বাস্তবতা থেকে। কল্পনা আর আবেগ দিয়ে ও বিশ্বাস করেছিল মা মারা যায়নি। একটা শিশুকে নিয়ে রাস্তা পার হলে যে রকম বোধ হয়, দিলা সেভাবেই মেহরাবকে নিয়ে পার হলো। তারপর রিকশা নিল বাসার উদ্দেশে। কতদিন পর। বৃষ্টিটা থামলো। কিন্তু ধুস করে বিদ্যুৎ চলে গেল। সেই চেনা গলি। সেই বকুল গাছ। হেনার বাড়ির নিচে এখনও পার্ক করা ভেসপাটা নির্বাক।
দেড় বছর আগে এসব চেনা পথ, বস্তু ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আজ আবার সবকিছু দেখতে পেয়ে আপন লাগছে ঢাকা শহরটাকে। ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কটা কান্নাভেজা হয়ে স্বাগত জানাল দিলাকে। বাসার গেটে ইমান আলী আলস্য নিয়ে বসে আছে। মেহরাবকে নিয়ে দিলাকে নামতে দেখে দৌড়ে এসে হাত লাগালো। লিফটটা বন্ধ হয়ে আছে। বিপদের ওপর বিপদ। এক একটা সিঁড়ি পার হতে দিলার সর্বোচ্চ পরিশ্রম দিতে হচ্ছে। সব রাগ, কষ্ট, অভিমান এই কায়িক শ্রমে বিলীন হয়ে যেতে লাগলো। মেহরাবের পকেট থেকে চাবি নিয়ে খুলতে গিয়ে মনে হলো, কতদিন ভুলে এই বাসার চাবি দিয়ে ইস্কাটনের বাসার দরজা খুলতে গেছে ও। শেষে ফেলেই দিয়েছিল হাতিরঝিলে সেই চাবি।
কোনোভাবে সোফাতেই শোয়ালো মেহরাবকে। ঝটপট শার্ট খুলে দিল। জুতা-মোজা খুলে দিল। হাতড়ে হাতড়ে আইপিএসের সুইচটা খুঁজে নিল। বাহ! কি ঝকঝকে ঘর করে রেখেছে মেহরাব। দেখে মনেই হচ্ছে না এ বাসায় এতদিন কোনো মেয়ে ছিল না। তোয়ালেটা ঠিক জায়গামত পেয়ে গেল। নিজের স্বামীর প্যান্ট খুলতে গিয়েও দিলাকে একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরলো। তবুও গা থেকে সব ভেজা কাপড় সরিয়ে দিল ও। অনেকটা শুকিয়ে গেছে মেহরাব। মাথা মুছিয়ে দিল। বেশ জ্বর জ্বর করছে গা। সন্দ্বীপকে ফোন দিয়েও লাভ নেই। এই জলবৃষ্টিতে উত্তরা থেকে আসতেই মধ্যরাত হয়ে যাবে। মেহরাবের জামার কোনো পকেটেই মোবাইল ফোন পেল না দিলা। দৌড়ে বেডরুমে গেল। ঠিক যা ভেবেছিল। বালিশের ওপর ফোনটা। ডা. শোভনের নম্বরটা খুঁজছে দিলা। এই নামে কোনো নম্বরই নেই তাতে। কি অদ্ভুত!
যাক, এত কিছু ভাবতে পারছে না আর ও। নিজের ভেজা শাড়িও বদলানো দরকার। আলমারিতে হাত দিল ও। আগের সবকিছু ঠিক এক জায়গাতেই আছে। যেন মেহরাব জানত দিলা ফিরে আসবেই। হাউজকোট গায়ে চাপিয়েই মেহরাবের কাছে এল ও। এখনও অচেতন হয়ে আছে। আবারও তুমুল পরিশ্রমে মেহরাবকে নিয়ে বেডরুমে শোয়ালো দিলা। নিজের উষ্ণ চেতন শরীর দিয়ে মেহরাবকে আঁকড়ে নিল। শ্বাস পড়ছে মৃদু তালে। বুকে হাত ঘষে দিল। প্রায় মিনিট কুড়ি অমনি পরে রইল দিলা। সারা ঘর নিস্তব্ধতার স্বর। হঠাৎই একটা টিকটিকি টিক টিক করে ডেকে উঠলো। একবার নয়, দুবার ডাকলো।
মেহরাব চেতনা ফিরে পেল। অন্তর্লোক হতে বলে উঠলোÑ ‘মা, মা গো।’
দিলা চমকে উঠলো। ছিটকে সরে গেল। সহসা পা থেকে মাথা অব্দি নিস্পাপ লজ্জা ওকে আনত করে রাখল। মেহরাব বিড় বিড় করছে তখনও।
‘মা, আজ বাজারে যেতে পারিনি। কাল ঠিক পান কিনে আনবো। তোমার গোলাপি ছাতা মা…’
দিলা বুঝলো মেহরাব আসলে ঘোরে আছে এখনও। ওকে তুলতে হবে। ঘণ্টার প্রতিটি মিনিট দিয়ে দিলা মেহরাবকে শুশ্রƒষা দিল। হালকা একটা আলো এখন ঘরজুড়ে।
মেহরাব চোখ খুলে দিলাকে প্রথম চিনতে পারেনি। ভেবেছে পাহাড়ি মেয়েটা ওকে বাড়ি নিয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে অবস্থা আয়ত্ত করলো ও। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সন্ধ্যার ঘটনা শুনলো। আকাশে তখন বসনখোলা চাঁদ। তীব্র আলো। বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে ধুলোময় ঢাকা। তাই এত উজ্জ্বল রাত। দিলাও তাকিয়ে ছিল আকাশে। কথা খুঁজে পাচ্ছে না ও। একদিন এরকমই নির্বাক হয়ে এসেছিল মেহরাবের ঘরে। শাশুড়ি যা বলত, তাই করতো। ‘মেহরাব কিন্তু নুডুলসে আলু খায় না বৌমা। না না, ইলিশ বেশি ভাজবে না। সে কি! ডালে আজ পেঁপে দাওনি। নানান রকমের অনুযোগ করতেন সর্বক্ষণ।’ খুব মন উঠে গিয়েছিল তাঁর ওপর থেকে। বিয়ের পর থেকে একদিনের জন্যও দিলা নিজের মতো করে এ বাড়িতে রাঁধতে পারেনি। ঘর সাজাতে পারেনি। তার ওপর ছিল মেহরাবের রাতজাগা কাজ। লেখা ছাড়া একদণ্ডও থাকেনি সে।
যখন শাশুড়ি মারা গেলেন, তখন তো অন্য আরেক উপদ্রব এসে ভর করলো। দিনের পর দিন মেহরাব উদভ্রান্তের মতো মা মা করত। টিকটিকিকে মা ভেবে কথা বলত। প্রাইভেট অ্যাক্ট বলে জীবনে কিছু ছিল না দিলার। শরীরের তাগিদ দিলাকে মাঝে মাঝে এতটা উন্মুখ করে ফেলত যে, কাঁদত মাঝ রাতে শাওয়ার খুলে। সেসব দিনের ব্যথা বুকে বয়ে একা একা বাঁচার প্রাণপণ চেষ্টায় ছিল ও। আজ তাকানো যায় না মেহরাবের দিকে। চোখের তলায় কালসিটে। কী ভীষণ ভালোবাসত এই চোখ ও।
মেহরাবের মন ও মস্তিষ্ক কিছুতেই দিলার উপস্থিতি বিশ্বাস করতে চাইছে না। তোলপাড় হচ্ছে খুব ভেতরে। কুমড়োফুলগুলো কেনা হয়নি আর। কলার মোচাঘণ্ট চিংড়ি দিয়ে কী ভালোই না রাঁধত মা! কতকাল খায় না ও। বড্ড খিদে পেয়েছে ওর। কাঙালের মতো বলে ফেলল,
‘দিলা, ভাত খাব।’
অতল কোনো জগত থেকে যেন দিলা শুনতে পেল মেহরাবের গলা।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!