কান্তার মরু – ১১ –মাসুদ রানা

 

সূর্যোদয়ের দু’ঘণ্টা পর। দূরে, ছোট্ট এক গ্রামের উদ্দেশে চলে যাওয়া একটা ট্রেইল দেখতে পাওয়া গেল। আবু হাতেম সেদিকে নিয়ে চলল ওদের। লোকটা কাহিল, জ্বরাক্রান্ত, স্যাডলে দোল খাচ্ছে; বেশ ক’বার দেখল রানা। ক্যাম্প ত্যাগের আগে ওর জখমটা পরখ করেছে সে। সংক্রমণ ছড়িয়েছে। বুলেট, হাড়ের ভাঙা টুকরো ও কাপড় শীঘ্রিই সরানো দরকার।
‘স্যাডলে বসে থাকতে পারবে?’ রানা জিজ্ঞেস করল। ‘নাকি আমি ক্যারি করব?’
‘তুমি ইতিমধ্যেই আমার জীবন বাঁচিয়েছ,’ বলল লোকটা।
‘রানা, একটা খায়েশ পূরণ হলো না।’
‘কি সেটা?’
‘ওই নোংরা সোমালীটাকে তুমি নিজের হাতে খুন করতে দিলে না।’
‘আরও অসংখ্য শত্রুকে না মেরে মরছ না তুমি,’ অভয় দিল রানা।
‘সত্যি বলছ, রানা?’
লোকটার প্রশেড়বর জবাবে মৃদু মাথা নাড়ল রানা।
‘কিন্তু এরকম অভিযান জীবনে আর করতে পারব না। লোকের মুখে মুখে ফিরবে তোমার আর আমার কথা। সোমালীটা যোদ্ধার ছাতাও ছিল না। আর বাকি রইল এক নারী-জুলেখা। আমরা কতজনকে খুন করেছি, রানা?’
‘হিসেব নেই আমার,’ বলল রানা। ‘তেরোজন হতে পারে।’
‘অস্ত্রগুলো কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে। শহরে ওসবের দরকার পড়বে না।’
উটেরা ট্রেইলে নিজেদের রাস্তা বেছে নিয়েছে। ডানপাশে বেশ কিছু প্রকাণ্ড পাথর পড়ে আছে, এমনি এক জায়গায় রানা ওর উটটাকে দাঁড় করাল। ‘এই পাথরগুলোর ফাঁক-ফোকরে অস্ত্র লুকানো যায়।’
দ্বিরুক্তি করল না আবু হাতেম।
জুলেখা আর রানা ওকে রাইফেল ও গোলাগুলির ভারমুক্ত করে, কোমর থেকে পিস্তলটাও খসিয়ে নিল। পাথরস্তূপে চড়ে দুই পাথরের মাঝে এক ফাটল আবিষ্কার করল রানা। রাইফেল ও পিস্তল ওটার ফাঁকে ছেড়ে দিয়ে, নিজের সাবমেশিনগানটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। এটা ছাড়া নগড়ব মনে হবে ওর নিজেকে, কিন্তু সশস্ত্র হয়ে শহরে প্রবেশ করাটাও সম্ভব নয়। বন্ধুত্বের খোঁজে যাচ্ছে ওরা, শত্রুতা করতে নয়।
আবু হাতেমকে মাঝে রেখে এগিয়ে চলল ওরা একটু পর। থানায় যেতে রাজি নয় ডানাকিল। লোকটার চোখ-মুখ থেকে অহংকারের দ্যুতি ঠিকরে পড়ছে।
‘জুলেখা,’ ইংরেজিতে বলল রানা, ‘এ লোকের যতড়ব নিতে পুলিসকে রাজি করাতে পারবে?’
‘জানি না। বাবার নাম বলে যদি কাজ হয় তো ইমিডিয়েটলি ডাক্তার ডাকতে বলব। বড় ধরনের অপরাধের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী-একথা বললে হয়তো টনিকের কাজ দেবে।’
‘আবু হাতেম আমাদের জন্যে যা করেছে, তারপর ওর হাত কাটা গেলে মেনে নিতে পারব না,’ বলল রানা।
‘আমি বুঝি সেটা, রানা,’ বলল জুলেখা। ‘কিন্তু পুলিসকে বিশ্বাস করানো শক্ত হবে আমি কে। ওরা রিপোর্ট করবে। আমাদের নাম জানাবে সুপিরিয়রদের কাছে। কিন্তু একজন
আমহারিক মহিলাকে ইসলামী বেশে দেখলে ওরা তাড়াহুড়ো করতে দ্বিধা করবে।’
গ্রামটা মুসলমানদের, মহিলাদের পোশাক বলে দিল রানাকে।
সোজা পুলিস স্টেশনে গেল ওরা। খাকি পোশাকধারী দু’জন লোক দৌড়ে বেরিয়ে এল, হোলস্টারের বোতাম খোলা রেখে। জুলেখা আমহারিক ভাষায় শুরু করল, এবং রানা তার নাম অনেকবার উচ্চারিত হতে শুনল। আহত আবু হাতেমের প্রতি ওদের সহানুভূতি লক্ষ করে খুশি হলো রানা।
পুলিসদের একজন একটা সেলের সামনে নিয়ে গিয়ে, পিঠে ঠেলা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল রানাকে। তালা লেগে গেল।
‘আপনি বাংলাদেশী?’ কাঁচা ইংরেজিতে শুধাল।
‘হ্যাঁ, আমার নাম মাসুদ রানা।’
‘সাথে কাগজপত্র আছে?’
‘না।’
‘এখানে অপেক্ষা করুন।’
সেলের এক কিনারে একটা তোবড়ানো, ছাল-চামড়া ওঠা আর্মি খাট। ছারপোকা কম থাকলেই বাঁচোয়া, ভাবল রানা। গত ক’দিন ঘুম খুব সামান্যই হয়েছে ওর, ইন্দ্রিয় সজাগ রাখতে হয়েছে ক্ষীণতম বিপদ সঙ্কেতের জন্যে। আপাতত সে চিন্তা যখন নেই, আরামসে ঘুম দেয়া যাবে এখানে। মালদিনির হাত এত দূর উত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত নয়। কাজেই খাটে শুতে না শুতেই ঘুম।
‘মিস্টার রানা, মিস্টার রানা, মিস্টার রানা।’ কার যেন এক নাগাড়ে ডাকাডাকিতে ঘুমটা ভাঙল ওর।
চোখ খুলে হাতঘড়িতে নজর বুলাল ও। দু’ঘণ্টার কিছুটা বেশি ঘুমিয়েছে। শরীরটা ঝরঝরে লাগছে ওর। আস্ত একখানা উটের রোস্ট পেলে পাঁচ মিনিটে সাবড়ে দেবে।
‘মিস্টার রানা, দয়া করে আসুন আমার সাথে,’ জেলে ঢুকিয়েছিল যে পুলিসটি সে বলল।
সটান উঠে দাঁড়াল রানা। একটা করিডর দিয়ে, জেলখানার পেছনদিকে, দেয়াল ঘেরা এক কোর্টইয়ার্ডে নিয়ে এল লোকটা ওকে। গরম পানির মস্ত এক টাবের নিচে আগুন উস্কে দিচ্ছে এক বন্দী। খেঁকিয়ে আদেশ করল পুলিসম্যান। বন্দী বেচারা আরেকটা টাবে গরম পানি ঢেলে তাতে ঠাণ্ডা মেশাল।
‘এই নিন, সাবান,’ বলল পুলিসম্যান। ‘আর আপনার জন্যে কাপড়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
সাবান ঘষে ঘষে মহানন্দে গোসল সারল রানা। এবার পরিষ্কার স্ন্যাক্স, যদিও লম্বায় ইঞ্চিখানেক খাটো, ধবধবে সাদা মোজা আর একখানা পরিষ্কার শার্ট বেঞ্চি থেকে তুলে নিয়ে পরে ফেলল। এরপর শেভিঙের পালা। ছোট একটা আয়না, প্রাচীন এক শেভিং মগ, ভাঙা ব্রাশ সবই কপালে জুটল। বন্দী লোকটা এক গামলা পানি এনে দিয়েছে। জবু ুবু হয়ে বসতে হলো রানাকে আয়নায় মুখ দেখার জন্যে, কিন্তু শেভের পর নিজেকে ভিনড়ব মানুষ বলে মনে হলো ওর।
‘দয়া করে আমার সাথে আসুন, মিস্টার রানা,’ বলল পুলিসম্যান।
সামনের ডিউটি রূমের কাছে, প্রাইভেট এক টুকরো এলাকায় নিয়ে এল সে রানাকে। জুলেখা ও এক অফিসার বসে ওখানে, সামনে ধোঁয়া ওঠা স্টু নিয়ে। স্থানীয় সাদা পোশাক পরনে এখন জুলেখার।
‘মিস্টার রানা, আমি এই জেলের কমান্ড্যান্ট,’ আরবীতে বলল লোকটা, উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝাঁকিয়ে দিল রানার। ‘আপনার খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে আসমারা যাব।’
জুলেখার পাশে এক চেয়ারে রানাকে বসিয়ে দিয়ে, বেঁটে, মোটা মত এক মহিলাকে নানান নির্দেশ দিতে লাগল। শীঘ্রি রুটি আর এক পাত্র স্টু নিয়ে এল মহিলা। কি দিয়ে বানিয়েছে সে সব প্রশেড়ব না গিয়ে গোগ্রাসে গিলতে লাগল মাসুদ রানা। স্টু-টা সম্ভবত ভেড়ার মাংসে তৈরি, রুটি টাটকা আর সুস্বাদু। কড়া চা দিয়ে খাওয়ার পর্ব শেষ করল ওরা।
‘তুমি খুব ইম্পর্ট্যান্ট মানুষ বুঝতে পারছি,’ জুলেখাকে বলল রানা।
‘আমি না, তুমি,’ বলল যুবতী। ‘পুলিস তোমার নাম তার করার সাথে সাথে সমস্ত দৃশ্যপট পাল্টে গেল।’
কমান্ড্যান্টের উদ্দেশে ফিরল রানা। ‘আবু হাতেম কেমন আছে এখন?’
‘লোকাল ক্লিনিকে বিশ্রাম নিচ্ছে। ডাক্তার তাকে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছে। হাতটা বেঁচে যাবে।’
খুশি হলো রানা খবরটা পেয়ে।
গলা খাঁকরাল কমান্ড্যান্ট। ‘মিস্টার রানা, আপনাদের অস্ত্রশস্ত্রগুলো কোথায় রেখে এসেছেন?’
‘অস্ত্রশস্ত্র মানে?’ সাধু সাজল রানা। মুচকি হাসল লোকটা।
‘অস্ত্র ছাড়া কেউ ডানাকিলে পাড়ি জমায় না, মিস্টার রানা। আপনার বন্ধু গুলি খেয়েছে। আমার জুরিসডিকশনের বাইরে নিশ্চয়ই গোলাগুলিটা হয়েছে, এবং আমি জানি আপনি আমার সরকারের অনুমতি নিয়ে এসেছেন। সন্ত্রাসী কোন উপজাতির হাতে যাতে অস্ত্রগুলো না পড়ে সেজন্যেই জানতে চাইছি।’
এক মুহূর্ত ভেবে নিল রানা। ‘জায়গাটার নিখুঁত বর্ণনা দিতে পারব কিনা জানি না। ওখান থেকে শহরে পৌঁছতে প্রায় বিশ মিনিটের মত লেগেছে। উটগুলো অবশ্য খুব ধীরে ধীরে চলছিল। বেশ কিছু পাথর আছে ওখানে…’
‘গুড!’ সহাস্যে বলল লোকটা। ‘গ্রামাঞ্চল লক্ষ করারও চোখ আছে আপনার দেখতে পাচ্ছি। ডানাকিলরা শহরে আসার আগে ওখানে অস্ত্রশস্ত্র রেখে আসে। ওটাই হবে আর কি।’
একটা জীপের কাছে অল্পক্ষণ পরে পৌঁছে দিল কমান্ড্যান্ট রানা ও জুলেখাকে। করমর্দন করল। রানা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল তার সহযোগিতার জন্যে।
‘এ তো আমার ডিউটি,’ বলল সে।
‘ইথিওপিয়ায় আপনার মত ডিউটি সচেতন মানুষ-জন দরকার,’ বলল জুলেখা।
কৃতার্থ হয়ে গেছে, মাথা নুইয়ে বিগলিত হাসল কমান্ড্যান্ট। জুলেখার পারিবারিক অবস্থান পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পারল রানা।
দু’জন পুলিসের লোক জীপের দরজা মেলে ধরে পেছনের সীটে ওদের বসতে সহায়তা করল। দু’সারি পাহাড়ের মধ্যকার অবতলের উদ্দেশে এবার রওনা হলো ওরা। দশ মাইলের ভেতর আরেকটা গাড়ির দেখা মিলল, প্রাচীন এক ল্যান্ডরোভার কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে চলেছে। রানাদের চালক খিস্তি ঝেড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল হর্নের ওপর, এবং দুটো গাড়ি এতটাই কাছ ঘেঁষে পার হলো, চাইলেই জুলেখা বাঁ পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে পারত ওদেরকে।
দু’মাইলটাক পরে, রীতিমত কসরৎ করে, সারবন্দী উটের পালের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে পথ করে নিতে হলো রানাদের জীপটাকে। বারো মাইলের পর থেকে রাস্তাটা ট্র্যাক থেকে রূপান্ত রিত হলো জমাটবদ্ধ ধুলোয়। হুইলের সঙ্গে রীতিমত লড়াই করে পরবর্তী ঘন্টায় আরও পাঁচ মাইল অতিμম করল ড্রাইভার, এবং এখন ওরা পাশ কাটাচ্ছে অন্যান্য যানবাহনের। বেশ বড়সড় এক শহরে পৌঁছনোর ঠিক আগে, বাঁয়ে তীক্ষ্ন মোড় নিল জীপটা। লক্কড় মার্কা এক ইতালিয়ান ট্রাকের সম্মুখভাগ আড়াআড়িভাবে এড়াল কোনমতে। গুলির মত গালি-গালাজ বর্ষাল ট্রাকের চালক। ঝাঁকি খেতে খেতে এক মাঠে গিয়ে ঢুকল জীপটা, থেমে দাঁড়াল এক হেলিকপ্টারের পাশে।
পাইলট, জনৈক আর্মি অফিসার, লাফিয়ে নেমে স্যালুট করল রানাকে। ‘মিস্টার রানা?’
তার প্রশেড়বর জবাবে মাথা ঝাঁকাল রানা।
‘আপনাকে এখুনি আসমারা নিয়ে যাওয়ার জন্যে পাঠানো হয়েছে আমাকে,’ বলল লোকটা।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে আকাশে উঠে পড়ল ওরা। যন্ত্রটা এতই শব্দ করছে, কথোপকথনের সুযোগ নেই। রানার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল জুলেখা।
সরকারী এক ময়দানে ল্যান্ড করল কপ্টার। রোটর ঘোরা বন্ধ হওয়ার আগেই পাশে সরকারী লেখা নিয়ে বাদামী রঙের একটা গাড়ি তেড়ে এল রানাদের উদ্দেশে। পেছন থেকে উচ্চপদস্থ এক আর্মি অফিসারকে নামতে দেখা গেল। এবার অন্যপাশ থেকে নামল ধোপদুরস্ত পোশাক পরা দ্বিতীয় আরোহী। উজ্জ্বল সূর্যালোকে চোখ পিটপিট করে চাইল রানা। ভুল হয়ে না থাকলে…
রানা কপ্টারের দরজা দিয়ে লাফ মেরে নামতে ওর দিকে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন মেজর জেনারেল রাহাত খান। রানা জুলেখাকে নামতে সাহায্য করে বসের দিকে ফিরে দাঁড়াল। আলিঙ্গনে রানাকে বাঁধলেন বৃদ্ধ। তাঁর চোখে স্বস্তির আভাস অস্পষ্ট ভাবে দেখতে পেয়েছে বলে সন্দেহ হলো রানার।
‘আসমারায় আপনি, স্যার?’
‘শেপ মাইয়ারের ক্যাপ্টেন রিপোর্ট করেছে তুমি নাকি মারা গেছ,’ বললেন মেজর জেনারেল। ‘দু’রকমের দুটো মেসেজ পেয়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল!’
‘ক্যাপ্টেন মালদিনির লোক, স্যার,’ বলল রানা। ‘এঞ্জিনিয়ারিং অফিসাররা বাদে তার সমস্ত ক্রু মালদিনির কেনা গোলাম। জাহাজটা এখনও মাসাওয়ায় নেই নিশ্চয়ই?’
‘না। লোকাল অথরিটির ওটাকে আটকে রাখার কোন কারণ নেই। কুদরতের খবর কি বলো।’
‘বাঁচাতে পারিনি, স্যার।’ রানা সংক্ষেপে সবটা জানাল।
ক’মুহূর্ত থম হয়ে রইলেন রাহাত খান।
‘জেন এসেক্স আর নিক্সন ম্যাকলিন?’
জেনের করুণ পরিণতি অল্প কথায় বসকে জানাল রানা। রাহাত খানের কাছে জানতে পারল, ম্যাকলিনের আসল নাম ব্রুনো কন্টি। সন্ত্রাসবাদী মালদিনির একজন অন্ধ ভক্ত সে। তার জন্যে সবই করতে পারে ইতালিয়ানটা। ‘ম্যাকলিন শয়তানটা আছে মালদিনির ক্যাম্পে। মানে যখন চলে এসেছি তখন পর্যন্ত ছিল। আমার মৃত্যু সম্পর্কে কি গল্প ফাঁদা হয়েছে স্যার?’
‘তুমি মাসাওয়া পৌঁছওনি কেন তার একটা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছে,’ বললেন রাহাত খান। ‘ক্যাপ্টেন জানিয়েছে তোমরা তিনজনই নাকি বিউবোনিক পে−গে মারা পড়েছ, এবং নিরাপত্তার খাতিরে তোমাদের সাগরে ভাসিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে সে। ইথিওপিয়ান কর্তৃপক্ষ ওর বক্তব্য খণ্ডাতে পারেনি, ফলে পোর্ট ছাড়তে দিতে বাধ্য হয় শেপ মাইয়ারকে।’
জুলেখা আর ইথিওপিয়ান জেনারেল এসময় এগিয়ে এলেন ওদের দিকে। দু’জনেই চোস্ত আমহারিক বলছে, এবং রানার ধারণা হলো ভদ্রলোক জুলেখার পূর্ব পরিচিত।
‘জেনারেল হাশমী, এ হচ্ছে আমাদের মাসুদ রানা,’ বললেন মেজর জেনারেল।
করমর্দন করল ওরা। সম্ভ্রান্ত বংশের এক আমহারিক, ছ’ফুট চার ইঞ্চির ইথিওপিয়ান জেনারেল বলিষ্ঠ দেহী, কালো চুলে তাঁর পাক ধরেছে সবে।
‘মিস্টার রানা, জুলেখাকে আমি ওর জন্মের পর থেকেই চিনি। ওকে ফিরিয়ে আনার জন্যে আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। ওর বাবা আর পরিবারের পক্ষ থেকেও আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।’
সাবলীল ইংরেজি বলেন ভদ্রলোক, এবং রানা অনুমান করল, সম্ভবত ইংল্যান্ডে লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়েছে তাঁর।
‘জুলেখাকে ফিরিয়ে আনার কৃতিত্ব আমার নয়, জেনারেল হাশমী। আমরা একসাথে ফিরেছি। আমাদের মত ও-ও উট চালিয়েছে, পাহারা দিয়েছে, শিক্ষিত যোদ্ধার মত রাইফেল চালিয়েছে। বেঁচে যে আছি সেজন্য আমরা দু’জনেই আবু হাতেমের কাছে ঋণী।’
‘মালদিনির হাত এড়িয়ে পালিয়েছেন যখন, দৌড় থামাবেন না,’ হাশমী ফিরলেন রাহাত খানের দিকে। ‘জুলেখা সরকারের ভেতরে থাকা মালদিনির বেশ কিছু এজেন্টের নাম ফাঁস করে দিয়েছে। আরও ক’দিন আগে এগুলো জানা গেলে ভাল হত।’
‘কি ব্যাপার, স্যার?’ মেজর জেনারেলকে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘তোমরা পালানোর সাথে সাথে মালদিনি চাল দিয়েছে।’ বললেন রাহাত খান। ‘চারদিন আগে আলটিমেটাম দিয়েছে সে।’
‘তাহলে আমরা পালানোর সঙ্গে সঙ্গে নয়,’ বলল রানা। ‘ওর গুণ্ডারা আমাদের ধরতে ব্যর্থ হওয়ার পর।’
‘কি চাইছে সে জানেন?’ জেনারেল হাশমীর প্রশ্ন।
‘পূর্ব আফ্রিকার অর্ধেকটা,’ বলল রানা। ‘মিসাইল ছুঁড়বে হুমকি দিয়েছে নাকি?’
‘তিনটে মিনিটম্যান সহ,’ বললেন রাহাত খান। ‘শেপ মাইয়ারে ছিল। জেন এসেক্স ট্র্যাক করছিল ওগুলোকে।’
‘কখন ছুঁড়তে শুরু করবে?’ রানা জবাব চাইল।
‘কাল সন্ধে নাগাদ। আমরা কোন ধরনের উস্কানি দিলে আরও আগে।’
‘যত জলদি পারে ছুঁড়ুক ওগুলো, স্যার,’ বসকে বলল রানা।
‘বিশেষ করে ওই মিনিটম্যানগুলো।’
চোয়াল ঝুলে পড়ল জেনারেল হাশমীর। ফ্যালফ্যাল করে রানার দিকে চেয়ে আছেন তিনি। রাহাত খানকেও মুহূর্তের জন্যে বিভ্রান্ত মনে হলো, তারপর ধীরে ধীরে সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
‘বলে ফেলো, রানা।’
‘মালদিনির মিসাইলগুলোর অন্তত অর্ধেক যারা ছুঁড়বে শুধু তারাই মারা পড়বে। বালির নিচ থেকে মিনিটম্যানের গাইডেন্স সিস্টেম এখনও খুঁড়ে বের করতে পেরেছে কিনা সন্দেহ আছে আমার, কিংবা হয়তো জানেই না কি খোয়া গেছে। খুব ভালভাবে লুকিয়ে রেখেছে ও মিসাইলগুলো। কারণ প্রপার লঞ্চিং সুবিধা নেই তার। আপনার বন্ধু বেঁচে থাকলে ফুল টেকনিক্যাল রিপোর্ট দিতে পারতেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য! বেশ কিছু দুর্ধর্ষ ডানাকিল যোদ্ধা রয়েছে মালদিনির পক্ষে। অটোমেটিক অস্ত্র আছে তাদের কাছে। ওর হুমকির দৌড় ওই পর্যন্তই।’
‘আপনি শিয়োর, মিস্টার রানা?’ জেনারেল হাশমী জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ। কুদরত চৌধুরী মিসাইল নিয়ে কাজ করতেন। মালদিনির বদমতলব জানতে পেরে উনি ওঁর সাধ্যমত স্কিমটাকে স্যাবোটাজ করেন। মালদিনি আশা করেছিল ওর লোকেরা
মরুভূমিতে খতম করে দেবে আমাদের, কারণ কুদরত চৌধুরী বা আমি কেউ যদি একটা রিপোর্ট করতে পারি, ওর অবস্থান জেনে যাবে সরকার। তাছাড়া আরও একটা অসুবিধা ছিল তার, ফাঁস হয়ে যেত কারা কারা তার হয়ে সরকারের ভেতর কাজ করছে।’
‘চৌধুরী সাহেব কি গোলমাল করেছেন জানে না ও,’ বলল জুলেখা। ‘ওর ধারণা একটা মিসাইল ছুঁড়লেই কেঁপে উঠবে গোটা পৃথিবীর অন্তরাত্মা ।’
‘ওর বুকটা ফেটে যাবে,’ বললেন হাশমী। রানার দিকে ঘুরে ওর কাঁধে প্রকাণ্ড একটা হাত রাখলেন। ‘কোনও হোটেলে আজ রাতটা কাটিয়ে, কাল মালদিনির হেডকোয়ার্টারে ফিরে গেলে কেমন হয়, মিস্টার রানা?’
‘যাব কিভাবে?’
‘আমার হেলিকপ্টারে। আফ্রিকার সেরা দেড়শো সৈন্যকে লিড করে নিয়ে যেতে পারেন।’
‘আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ওর ঘাঁটি খুঁজে পেলে হয়।’
‘একটা ম্যাপ হবে?’ বলল জুলেখা। ‘আমি চিনিয়ে দেব। পপি খেত ধ্বংস হলে ডানাকিলদের আনুগত্য হারাবে লোকটা।’
জেনারেল হাশমী তাঁর স্টাফ কারের দিকে নিয়ে গেলেন ওদের। মিলিটারী কম্পাউন্ডের উদ্দেশে এগোল ওরা। গাড়িতে এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেম নেই বলে দু’বার দুঃখপ্রকাশ করলেন ভদ্রলোক। নির্মল পাহাড়ী বাতাস কত যে ভাল লাগছে তাঁকে বলে বোঝাতে পারল না রানা।
জুলেখা ও জেনারেল ম্যাপের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লে বসের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান করল রানা।
‘বিসিআই আমার মেসেজ পায়নি, স্যার?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু এত সরাসরি না পাঠিয়ে তোমার উচিত ছিল কোডেড মেসেজ পাঠানো।’ একটু অসন্তুষ্ট শোনাল মেজর জেনারেলের কণ্ঠ।
‘হাতে সময় ছিল না, স্যার।’
‘শেপ মাইয়ার মাসাওয়ায় থামার পর তো ভুয়া ডেথ সার্টিফিকেট রেজিস্টার করল। তখনই নিশ্চিন্ত হলাম আমরা, তোমার মেসেজের অর্থ – জাহাজটা মালদিনির। নরওয়ের মতন ফ্রেন্ডলি দেশে ওগুলো রেজিস্টার করা হলেও ডামি হোল্ডিং কর্পোরেশন যাচাই করতেও কয়েকটা দিন লেগে যায়। আরও কথা আছে, আমরা নিশ্চিত ভাবে জানতাম না তুমি কিংবা জেন এসেক্স বেঁচে আছ কিনা। তাছাড়া মেসেজটা পাঠালে কিভাবে তাও বুঝতে পারছিলাম না।’
সাগ্রহে অপেক্ষা করছেন বস। বোসানস লকারের নিচের খাঁচা ভেঙে, মেসেজ পাঠিয়ে, আবার ফিরে এসে নিজেদের তালা মেরে রাখার কথা তাঁকে জানাল রানা।
‘নাইস ওঅর্ক, রানা,’ বললেন রাহাত খান। ‘তোমার মেসেজ আমাদের পর্যাপ্ত সময় দিয়েছে। এমুহূর্তে ইথিওপিয়া আর তাদের আফ্রিকান বন্ধুরা শেপ মাইয়ারের পেছনে লেগেছে।’
‘মিস্টার রানা, একটু আসবেন প্লিজ?’ ডাকলেন জেনারেল হাশমী।
কামরার ওপ্রান্তে গিয়ে ডানাকিলের একটা রিলিফ ম্যাপ পরীক্ষা করল রানা। জুলেখা ইতোমধ্যেই মালদিনির হেডকোয়ার্টার চিমিত করেছে।
‘হেলিকপ্টার হামলা করার উপযোগী ওখানকার ভৌগোলিক অবস্থান?’ জেনারেল হাশমী জিজ্ঞেস করলেন।
‘সেটা কত লোক আর কতটা ফায়ার পাওয়ার হাতে পাচ্ছেন তার ওপর নির্ভর করে।’ উজানে, ভাটিতে ও অনুচ্চ পর্বতমালায় তিনটে পয়েন্ট ইঙ্গিত করে বলল রানা। ‘অটোমেটিক অস্ত্রসহ এই তিন এলাকায় লোকজন ল্যান্ড করান, ডানাকিল গ্রাম নিশ্চিম করে দেয়া যাবে।’
‘দুটো হেলিকপ্টার গানশিপও আছে আমাদের।’
‘মালদিনির হেডকোয়ার্টারের ওপরে অন্তত একটাকে তাক করুন,’ বাতলে দিল রানা। ‘তাতে করে ওর লোকেরা সোজা আপনার লোকেদের হাতে গিয়ে পড়বে। ডানাকিলদের বড়সড় কোন ফাইটিং ফোর্স নেই ওর, ড্রাগ আসক্ত ক্রীতদাসদের ওপরেই ভরসা।’
আলোচনাটা নিছক সৌজন্যমূলক হলো। রিসোর্স কিভাবে ব্যবহার করবেন ইতোমধ্যেই ছকে রেখেছেন জেনারেল। ইথিওপীয় সৈন্যদের রণ-কুশলতা দেখিয়ে, তাক লাগিয়ে দিতে
চান তিনি বাংলাদেশী এজেন্ট টিকে।
মিসাইলগুলোর অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে কেউ টুঁ শব্দটি করছে না, এবং রানা ও রাহাত খান এব্যাপারে একান্তে আলোচনার সুযোগ পেলেন না। কিন্তু নিউক্লিয়ার ওঅরহেডগুলো যাতে বাজে লোকের হাতে না পড়ে, সেজন্যেই আবারও মালদিনির হেডকোয়ার্টারে যেতে রাজি হয়েছে রানা।
‘গত ক’দিন ঘুমাতে পেরেছ, রানা?’ স্নেহ ঝরল বসের কণ্ঠে।
‘আজ সকালে জেলে ঘণ্টা দুয়েক,’ বলল রানা।
‘আজ রাতে খুব একটা ঘুম নেই আপনার কপালে,’ বললেন হাশমী। ‘রাত তিনটের দিকে মুভ করব আমরা। সূর্য ওঠার পরপরই হিট করব মালদিনির ক্যাম্প। আঁধারে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে ফ্লাই করা বিপজ্জনক বটে, কিন্তু কেউ ওকে সাবধান করতে পারার আগেই হিট করতে হবে।’
‘তুমি হোটেলে চলে যাও, রানা,’ বললেন রাহাত খান।
‘তোমার ঘুম দরকার। আর হ্যাঁ, লোকাল অথরিটির নির্দেশে শেপ মাইয়ার তোমার সমস্ত জিনিসপত্র নামিয়ে দিয়ে গেছে। তোমার রূমে পাবে।’
‘নিজেকে ভিআইপি মনে হচ্ছে!’ খুশি মনে বলল রানা।
‘মিস্টার রানা, আমার সরকারের তরফ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার ইনফর্মেশনগুলো আমাদের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,’ জেনারেল হাশমী বললেন।
মেজর জেনারেল মগড়ব হয়ে পড়লেন জেনারেল হাশমীর সঙ্গে আলোচনায়। আর সেই সুযোগে রানার কাছ ঘেঁষে এল জুলেখা। ‘আবার দেখা হবে, রানা,’ বলল যুবতী।
‘ইনশাল্লাহ,’ মুচকি হেসে বলল রানা।

দুঃখিত!