কাগজের ঠোঙা থেকে একটুখানি ঝালমুড়ি ঢেলে নিয়ে মুখে দিলাম। দারুণ স্বাদ! প্রথম দফায় মুখে চালান করা মুড়িগুলো আয়েশ করে চিবিয়ে ফের ঠোঙা থেকে ঢালতে গেছি, অমনি চিলের মতো ছোঁ মেরে কেউ ঠোঙাটা তুলে নিল। স্কুলের বারান্দার সিঁড়িতে বসে মুড়ি খাচ্ছিলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি সঞ্জয়। ততক্ষণে সে আমার সাধের ঝালমুড়ি রাক্ষসের মতো গিলতে শুরু করেছে। ওকে এড়িয়ে কিচ্ছুটি খাওয়ার জো নেই। সে যেমন পেটুক, তেমনি চাপাবাজ। সঞ্জয়ের বিশেষ গুণ হলো চরম অবিশ্বাস্য ঘটনাও সে এমনভাবে বলে যে বিশ্বাস না করে উপায় থাকে না।
কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা সঞ্জয়, চাঁদ পর্যন্ত একটা সিঁড়ি বানানো কি সম্ভব?’
সঞ্জয় তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলবে, ‘অবশ্যই সম্ভব। রহিম কাকা, মানে আমাদের পাড়ার রহিম মিস্ত্রির কাছে এটা ডালভাত ব্যাপার। তিনি সৌরজগতের যেকোনো গ্রহ-উপগ্রহে যাওয়ার সিঁড়ি বানাতে পারেন।’
এই হলো আমার বন্ধু সঞ্জয়। মুড়ি চিবোতে চিবোতে বলল, ‘বল্টু, তোর মুড়ি খেলাম বলে দুঃখ করিস না। তোকে দারুণ একটা জিনিস দেখাব।’
আমার নাম বল্টু নয়, বজলু। কিন্তু জানি না কেন, সে আমাকে বল্টু বলেই ডাকবে। বিরক্ত হয়ে জানতে চাইলাম, ‘কী এমন দারুণ জিনিস, যা এই ঝালমুড়ির চেয়েও ভালো?’
মুড়ি শেষ করে ঠোঙায় হাত মুছে সে বলল, ‘তোকে বাঘ দেখাব। রয়েল বেঙ্গল টাইগার।’
তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, ‘কোথায় থাকে সেই বাঘ?’
‘আমাদের হিরণপুরের জঙ্গলে।’
আমি অনেক কষ্টে হাসি চাপলাম। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, তাও কিনা আমাদের গ্রাম হিরণপুরে। হ্যাঁ, এখানে একটা মাঝারি আকারের জঙ্গল আছে বটে। তবে সেখানে বাঘ তো দূরের কথা, খ্যাঁকশিয়াল আছে কি না সন্দেহ।
আমার মুখভঙ্গি দেখে সঞ্জয় বলল, ‘বিশ্বাস করছিস না তো? যা, শুক্রবারের মধ্যে বাঘ দেখাতে না পারলে তোকে ভরপেট মিষ্টি খাওয়াব।’
দুই.
সঞ্জয়ের অনেক চাপাবাজির মতো এটাও আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু শুক্রবার বিকেলে খেলার মাঠে সে বলল, ‘চল, আজ বাঘ দেখাব।’
আমি হেসেই উড়িয়ে দিলাম। সঞ্জয় গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ফাজলামো নয়। চল, এখনই রওনা হতে হবে।’
ওর কথা বলার বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গির কারণে আমি আর না করতে পারলাম না।
হিরণপুর গ্রাম ছাড়িয়ে আরও কিছুটা পথ যাওয়ার পর ডানদিক থেকে শুরু হয়েছে জঙ্গল। দুজনে যখন জঙ্গলের ভেতরে এক পোড়োবাড়ির কাছে পৌঁছালাম, তখন সূর্য ডুবতে বেশি দেরি নেই।
সঞ্জয় বলল, ‘তুই এখানে অপেক্ষা কর। আমি বাঘের খোঁজ নিয়ে আসি।’
‘কার কাছে খোঁজ নিবি?’
‘সে আমি বুঝব। তুই চুপচাপ ওই পোড়োবাড়ির কোনাটার দিকে তাকিয়ে থাক। ওদিকটায় কয়েকবার বাঘ দেখা গেছে।’
আমি কিছুটা ভয় পেয়ে বললাম। ‘খোঁজ নিতে হবে না। তুই এখানেই থাক।’
সঞ্জয় হেসে বলল, ‘ভিতুর ডিম। আমি যাব আর আসব।’
পরের ১০ মিনিটে সঞ্জয়ের দেখা মিলল না। আমি দু-তিনবার ওর নাম ধরে ডাকলাম। কোনো সাড়া নেই। একটু পরই অন্ধকার নামবে। বাঘ থাক বা না থাক, পরিস্থিতিটাই কেমন গা ছমছমে। একাই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
ঠিক তখনই পোড়োবাড়ির কোণের জঙ্গলটায় একটা নড়াচড়া নজরে এল। পরমুহূর্তে সেখান থেকে বেরিয়ে এল এক জলজ্যান্ত ডোরাকাটা বাঘ! অজান্তেই আমার ভেতর থেকে একটা চিত্কার বেরিয়ে এল। অসাড় হয়ে পড়ল হাত-পা। এর মধ্যে বাঘটা পোড়োবাড়ির সামনে চক্কর দিয়ে ভাঙা দালানকোঠার ভেতর ঢুকে গেল।
ঠিক তখনই পোড়োবাড়ির কোণের জঙ্গলটায় একটা নড়াচড়া নজরে এল। পরমুহূর্তে সেখান থেকে বেরিয়ে এল এক জলজ্যান্ত ডোরাকাটা বাঘ!
কতক্ষণ পর যে সঞ্জয় এল বলতে পারব না। তখন আমি ভয়ে প্রায় অচেতন।
সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, ‘বাঘের দেখা পেলি?’
উত্তরে আমি শুধু বললাম, ‘ভাই, আমাকে দ্রুত বাড়ি নিয়ে চল।’
সঞ্জয়ের মুখে বিজয়ের হাসি।
এমন সময় হঠাৎ একটা জিনিসে আমার চোখ আটকে গেল। কয়েক মুহূর্ত ভেবে সঞ্জয়কে বললাম, ‘অপেক্ষা কর, আমি আসছি।’
‘কোথায় যাবি? অন্ধকার হয়ে এসেছে প্রায়।’
‘আসছি’, বলে আমি গাছের আড়ালে চলে গেলাম।
একটু পর পোড়োবাড়ি থেকে ফের বেরিয়ে এল বাঘটি। সোজা এগোচ্ছে সঞ্জয়ের দিকে। সেই সঙ্গে হালুম হালুম হুংকার। ঢিবিতে বসে থাকা সঞ্জয়ের গলা শুকিয়ে কাঠ। সে চিত্কার করে ডাকল, ‘বল্টু, বল্টু কই তুই?’ তারপরই অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়ল। আমি বাঘের মুখোশ খুলে ওকে ডাকলাম ‘সঞ্জয়, বাঘ নয় রে! আমি।’
সে হুড়মুড় করে উঠে বসল। ‘তু-তুই?’
আমি পুরো শরীর থেকে বাঘের পোশাক খুলে বললাম, ‘হ্যাঁ আমি। তুই পারলে আমি পারব না কেন?’
‘কিন্তু তুই বিষয়টা বুঝলি কীভাবে?’
আমি ব্যাখ্যা করলাম, ‘প্রথমে সত্যি সত্যি বাঘ ভেবে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। তুই ফিরে আসার পর দেখলাম, তোর চুলে বাঘের হলুদ পশমের মতো কয়েকটি সুতা আটকে আছে। চট করে তোর কৌশলটা বুঝে ফেললাম। নিশ্চিত হওয়ার জন্য তোকে রেখে পেছন দিয়ে ওই পোড়োবাড়িতে ঢুকে দেখি আমার ধারণা সত্যি। সেখানে এক কোণে বাঘের নকল পোশাক রাখা। বাকিটুকু তো বুঝতেই পারছিস। কিন্তু তুই এত ভয় পেলি কেন?’
সঞ্জয় বলল, ‘আমি ভেবেছি, বাঘের পোশাক পরে তো অন্য কারও এই এলাকায় ঘোরার কথা না। তার মানে এটা সত্যিকারের বাঘ। আর তুই তো বাঘের ডাকও বেশ নকল করতে পারিস!’
হেসে বললাম, ‘কোথায় পেয়েছিস এটা? হুবহু আসল বাঘের মতো দেখায়।’
‘মেজ কাকু জন্মদিনে উপহার দিয়েছেন।’