সেই ভয়ানক রাতটার কথা মনে হলে এখনও আমি হিস্টেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীর ন্যায় কেঁপে কেঁপে উঠি। আমি যেন গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিলাম।
অক্টোবর মাসের শেষ দিক। হেমন্তকে বিদায় জানিয়ে শীত আসি আসি করছে। খুব ভোরে এবং সন্ধ্যের পর থেকে হালকা কুয়াশায় ক্রমশ আচ্ছাদিত হয়ে থাকে রহস্যময় প্রকৃতি। কুয়াশাঘেরা এই রহস্যময় প্রকৃতি, পৃথিবীর বুকে যেন রহস্যতাকে আরো শীর্ষে তুলে নিয়ে যায়। এ রকম হালকা শীত পড়া এক রাতে ঘর থেকে বের হয়েছি। নেহাৎ ঘরে বসে থাকতে মন চাইছেনা তাই। ভাবলাম- মোড়ের বন্ধ হয়ে থাকা টংয়ের দোকানে কিছুক্ষণ বসে থেকে আস
। দুলাভাইয়ের মুখে অনেক শুনেছি, মেরিডিয়ানের এক কাপ কফির চেয়ে মোড়ের দোকানটার চা ঢের ভাল। অমৃত। অমৃত না ছাই। লিকার আর চিনি বেশি দিলেই চা হয়না। সেদ্ধ গরম পানিও তাহলে চায়ের মর্যাদা পেত।
উদ্দেশ্যবিহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে ফরেস্ট গেইটের সামনে চলে এলাম। বারকয়েক জায়গাটা দেখেছি কিন্তু কখনো ভেতরে ঢোকা হয়নি। মাঝরাত্তিরে ভেতরে ঢোকাটা শ্রেয় হবেনা। শুনেছি এখানে কয়েকটা মেয়ের মার্ডারও হয়েছে। সিম্পল রেইপ কেস। জায়গাটা নিয়ে আমার অবশ্য কৌতূহলের অন্ত ছিল না। বিশাল জায়গা। গাছের কারণে অন্ধকার রাত মিচমিচে কালোয় রূপ নিয়েছে। অচেনা জায়গা। গাছের বড় বড় গুঁড়ি কেটে ফেলে রাখা হয়েছ
। অন্ধকারে সেগুলো মৃত লাশের ন্যায় দেখা যাচ্ছে। নিস্তব্দ পরিবেশ।ঘন কুয়াশার কারণে বেশিদূর দেখা সম্ভব হচ্ছেনা। পেঁচার গগন-বিদারী চিৎকার হঠাৎ হঠাৎ বাতাসকে ভয়ার্ত করে তুলছে। প্রচন্ড সাহসের উপর ভর করে তবুও সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। রেইন-ট্রি, কাঠ-সেগুন আর শিরিষ গাছগুলোর বেখাপ্পা উচ্চতায় আকাশটা ঠিকমত দেখা যাচ্ছেনা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে জবুথবু হয়ে হাঁটছি। উড অফিসের সামনে একশ ওয়াটের
লদে সোডিয়াম বাতি ধিকিধিকি জ্বলছে। সরকারী মালপত্র। ঠিক-ঠাকমত খোঁজ নেয়ারও কেউ থাকেনা।
ভাবছিলাম- কোথাও সিগারেট পেলে মন্দ হত না। সিগারেটের ধোঁয়া ছড়িয়ে ছড়িয়ে মাঝরাত্তিরে মধ্যপথ হেঁটে যেতাম।এ এক অন্যরকম মজা। হঠাৎ মাথার উপর একফোঁটা তরল পদার্থ চিন্তার জগৎে বিচ্ছেদ ঘটাল। শিশিরভেজা পাতার চুইয়ে পড়া পানি। গাঁ হিম হয়ে যাওয়ার অবস্থা। হঠাৎ এর মধ্যে মনে হলো মাথার ওপর দিয়ে কী যেন শোঁ শোঁ করে উড়ে গেল। ক্ষণিক পরেই বুঝলাম, সেটা আবার মাথার ওপর উড়ে উড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার ম
থায় বা গায়ের ওপর সেটা বসতে চেষ্টা করছে। সাথে একটা কড়া সুগন্ধীযুক্ত দমকা হাওয়া চোখে মুখে লাগল। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। গা-টা ছম ছম করে উঠল।
মা-দাদীর কাছে একসময় গল্প শুনেছিলাম, মাঝরাতে ফাঁকাস্থানে থাকলে, ভূতপ্রেত ও জিন পরীরা গায়ে এসে ভর করে, তাই ভয় পেয়ে সামনের দিকে সজোরে হাঁটছিলাম। সেল ফোনটা বের করে বাটন টেপার চেষ্টা করলাম কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় কি না, এই ভেবে। কিন্তু, চার্জ শূণ্যের কোঠায় থাকায় সম্ভব হলো না। আকাশ থেকে দিগন্ত বিস্তৃত কালো অন্ধকার মাটি ছুঁয়ে গেছে। লোম খাড়া হয়ে যাওয়ার মত অনুভূতি। তবুও মানবমন
ড়ই কৌতূহলী। এ মন আকর্ষিত বস্তুর উপর থেকে সহজেই দৃষ্টি নিপাতিত করতে চায়না।জীবনের শেষ নিঃশ্বাস বিন্দু টুকু দিয়েও হলেও কৌতূহলের শেষ অংশটুকু দেখে যেতে চায়। এ যেন এক অদ্ভুত মায়া !
রাস্তার অপরপ্রান্ত হতে সোডিয়াম আলোয় দেখলাম, লাল শাড়ি পরিহিত এক যুবতী কন্যা রাস্তার শুকনো পাতা ঝাড়ু দিচ্ছে। মাঝরাত্তিরে এমন অল্প বয়স্ক মেয়ে এমন নিঝুম জায়গায়। নিজের মধ্যে কিছুটা সাহসের সঞ্চার হল। একটা অল্প বয়সী মেয়ে এত শীতের রাত্রে পাতা কুড়োতে পারে সেক্ষেত্রে আমি কেন নই!
মেয়েটা যথেষ্ট রূপসী কিনা জানা নেই। কিন্তু, মেয়েটার শরীরের প্রতিটি বাঁক যে কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষকে আকর্ষিত করবে সেটা অনেকটা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। মেয়েটার এত রাতে বাহিরে বের হওয়ার কারণ জানতে আমার কৌতুহূলী মন আবার পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছে। মেয়েটার দিকে মৃদুগতিতে হেঁটে যাচ্ছি। মেয়েটা জবুথবু হয়ে আনমনে তখনও রাস্তা ঝাড় দিয়ে চলেছে। আমি যতটা হাঁটছি , মেয়েটা ক্রমশই দূরে চলে যাচ্ছ
। এ কি! এ আমার ভ্রম নয়তো। দূরে দাঁড়িয়েই মেয়েটাকে পরিবেশের নিঃস্তব্দতা ভেঙ্গে মৃদু কণ্ঠে শুধালাম- এত রাত্রে পাতা কুড়োতে আসার প্রয়োজনটা কি ছিল তোমার ? সকাল হলেও আসতে পারতে।
মেয়েটা কোন উত্তর করলোনা। আনমনে পাতা কুড়িয়ে যাচ্ছে। সোডিয়ামের আলোয় দেহাকৃতিটাকে হঠাৎ একটু নড়ে-চড়ে উঠতে দেখা গেল। মাটিতে কিছু একটা নামিয়ে রেখে বস্তা কাঁখে করে ধীরে ধীরে দূর দিগন্তের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আমি পিছু পিছু সেখানে গেলাম। ছোট্ট বাক্সটা পকেটে পুরে বাসায় নিয়ে এলাম। রাতটা আমার অদ্ভুত আর রহস্যঘনই কেঁটেছিল। অথচ, সকালের প্রথম আলোর সংবাদ শিরোনামে আমার চিন্তা-চেতনারা সব গ
কালের রাত্রে দ্বিতীয়বার ফিরে যায়।
চট্টগ্রামের ফরেস্ট গেইটের উড অফিসের সামনে অজ্ঞাতনামা যুবতীর লাশ। জানা যায়, গতকাল রাত্রে দূর্বিত্তরা নৃশংসভাবে ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করে সেখানে ফেলে যায়। মুরাদপুর থানার পুলিশের হেফাজতে লাশ ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে !
–গল্পটি পাঠিয়েছেন —
খুলশী, চট্টগ্রাম থেকে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।