হরিণের হৃৎপিণ্ড

রুম থেকে বুকশেলফটা সরিয়ে নেয়া হচ্ছে, সব বই নামাতে হচ্ছে। হঠাৎ হাতে লাগল ছোটবেলার প্রিয় একটা বই। এটা এখনও বাসায় আছে ! অবাক হলাম। এই বইটা পড়তে পড়তে ঘুমাতে যেতাম প্রতিদিন। কয়বার যে বইটা পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই। বইটা রাস্তা থেকে কেনা, নাম “ঘুমপাড়ানী গল্প” । কোন লেখক এর নাম নেই, সম্পাদনায় “আবুল বাশার”।
সূচীপত্রে দেখলাম দুইটা গল্প হাইলাইটার দিয়ে মার্ক করে রেখেছি আল্লাহ মালুম কেন? “হরিণের হৃৎপিণ্ড” ও “নাপিতের বুদ্ধি” । “হরিণের হৃৎপিণ্ড” পড়া শুরু করলাম –

এক সিংহ অনেকদিন অসুখে ভুগে কাতর হয়ে পড়ল। গুহা ছেড়ে বের হবার কোন ক্ষমতা তার রইল না। তার প্রিয় অনুচর খেঁকশেয়ালও সিংহের জন্য খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। সিংহ তখন শেয়ালকে বলল, দেখ, আমাকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে চাও তা হলে এক কাজ কর। পাশের বনে যে একটা বড় হরিণ আছে তাকে কোন রকমে ভুলিয়ে আমার কাছে নিয়ে এসো। ওর হৃৎপিণ্ডটা খেলেই আমি সুস্থ হয়ে উঠব।

শেয়াল বলল, আপনার জন্য এ কাজটা করতে পারব না ? আমি এখনি যাচ্ছি। এই বলে সে হরিণের কাছে গিয়ে বলল, শোনো ভাই, তোমার জন্য এক সুখবর এনেছি। বনের রাজা সিংহ যে গুহায় থাকেন আমি তার কাছাকাছি থাকি। রাজার খুব অসুখ, বাঁচবার কোন আশা নেই। এখন তার ভাবনা হয়েছে, এরপর কে রাজা হবে? তিনি বলেছেন, শুয়োরকে রাজা করা যায় না, ওর মাথায় গোবর ভরা, ভালুক হল কুঁড়ের বাদশা, বাঘ ভবঘুরে আর চিতার উগ্র মেজাজ। অনেক ভেবে চিন্তে তিনি তোমাকেই বনের রাজা করবেন বলে ঠিক করেছেন।

 

হরিণ অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি? শেয়াল বলল, হ্যাঁ, এই খবর দেওয়ার জন্য আমাকে বকশিস দেওয়া উচিত তোমার। যা হোক, তুমি এখনই আমার সঙ্গে চল। সিংহ রাজার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকো।
শেয়ালের কথা শুনে হরিণের আর দেরি সহ্য হল না। তখনই চলল শেয়ালের সঙ্গে সিংহের গুহায়। এত তাড়াতাড়ি হরিণ আসবে তা সিংহ ভাবতে পারে নি। তাই সে প্রস্তুত ছিল না। শিকার দেখে তখনই সে লাফিয়ে পড়ল হরিণের ওপর। কিন্তু শরীর দুর্বল থাকায় ঠিক ভাবে লাফাতে পারল না। থাবাটা লাগল হরিণের কানে। কানটা আঁচড়ে গেলেও হরিণ ছুটতে ছুটতে পালিয়ে গেল।

এত কাছে পেয়েও হরিণটাকে ধরতে পারল না, সেই দুঃখে সিংহ গর্জন করতে লাগল। শেয়াল বলল, রাজা মশাই , এ আপনি কি করলেন?
সিংহ বলল ,তুমি আর একবার চেষ্টা করে দেখ হরিণটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসতে পারো কি না।
শেয়াল বলল, কাজটা খুবই কঠিন। তবু একবার চেষ্টা করে দেখি। বলেই সে আবার বেরিয়ে পড়ল হরিণের খোঁজে। পথে একজন রাখালকে দেখতে পেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, এ পথে কোন হরিণকে ছুটে যেতে দেখেছ কি? তার কান দিয়ে রক্ত ঝরছে।
রাখাল বলল, হ্যাঁ ,দেখেছি, হরিণটা ঐ বনের দিকে গেছে।

শেয়ালটা খুব জোরে ছুটে গিয়ে সেই হরিণের দেখা পেয়ে গেল। শেয়ালকে দেখেই হরিণ রেগে একেবারে কাঁই। বলল, আবার আমাকে ধরতে এসেছিস? দেখেছিস আমার শিং? তোর নাড়ীভুঁড়ি বের করে দেব। যা এখান থেকে।
শেয়াল বলল ,তুমি মিছেমিছি আমার ওপর রাগ করছো হরিণ ভাই। কিন্তু তুমি যে এমন ভীরু তা তো আমি জানতাম না। বুদ্ধি ও তোমার কম আছে দেখছি। সিংহ তোমার কান ধরেছিল কেন জানো? কান ধরেছিল তোমাকে গোপানে কিছু বুদ্ধি দিতে। রাজ্য চালাতে হলে অনেক কিছু পরামর্শের সাথে গোপানে দিতে হয়।
পীড়িত বৃদ্ধ সিংহের নখের একটা আঁচড় লাগতেই তুমি পালিয়ে এলে? তুমি চলে এসেছ বলে রাজার কি রাগ। বললেন, না, হরিণকে আর নয়, নেকেড়েকেই রাজা করে আমি সন্ন্যাস নেব।

হরিণ সে কথা শুনে কি যেন ভাবতে লাগল। শেয়াল বলল, নেকড়ে রাজা হলে আমাদের কি দশা হবে ভাব তো? কেউ চায় না নেকড়ে রাজা হোক। তুমি একটু কষ্ট স্বীকার করেও আবার চল। আমি তোমাকে বুদ্ধি শিখিয়ে দিচ্ছি। তুমি খুব অনুগতের মত চুপ করে বসে থাকবে। রাজা কি পরামর্শ দেয় টা মন দিয়ে শুনবে।তা না হলে ঠিক ভাবে রাজ্য চালাবে কি করে? এসো, নইলে রাজার মনের ভাব বদলে যেতে পারে।

শেয়ালের মুখে এমন সব কথা শুনে হরিনের মনের ভাবও বদলে গেল। রাজা হবার লোভ আবার প্রবল হয়ে উঠল তার। সে সিংহের গুহার দিকে রওনা হয়ে গেল। সিংহ এবার প্রস্তুত হয়েই ছিল। হরিণ গুহায় ঢুকতেই তাকে আদর দেখিয়ে টেনে নিল আরও কাছে। তারপর কায়দা করে ভাল ভাবে ধরে পেটটাকে চিরে ফেলল। তারপর মাংস হাড় সব খেতে লাগল মজা করে। হরিণের হৃৎপিণ্ডটার কথা তখন সিংহের মনেই ছিল না। সুস্বাদু মাংস খাওয়ার দিকেই ছিল তার বেশি নজর। হরিণের হৃৎপিণ্ডটা কখন ছিটকে পড়ে গিয়েছিল তা সে খেয়াল করেনি। শেয়াল কিন্তু তা দেখতে পেয়েই কুড়িয়ে নিয়ে চট করে খেয়ে ফেলল। আঃ, টাটকা কলিজা কি সুস্বাদু!

 

ওদিকে সব কিছু খাওয়া হয়ে হয়ে যাওয়ার পর সিংহ বলল, আহা! তোকে তো একটু ভাগ দেওয়া হল না। হরিণের শিঙের নীচে কিছুটা শক্ত মাংস লেগে ছিল, সেগুলো শেয়ালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে, তুই খা। বলতে বলতেই হঠাৎ হরিণের কলিজাটার কথা মনে পড়ে গেল। বলল, হরিণের কলিজাটা কোথায়? মনে হয় সেটা খাইনি। ধূর্ত শেয়াল বলল, রাজামশাই, ওর কলিজাটা ছিল না। যে জীব একবার নয়, দু- দুবার সিংহের কাছে আসে, তার কি কোন কলিজে থাকতে পারে?”

মনে পড়ল হাইলাইটার দিয়ে মার্ক করে রাখার কারন, ছোটো বেলায় এই গল্পটা খুব মজা লাগত, ভাবতাম হরিণটা এত বোকা, হা হা হা। এখন মনে হয় একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করে আমিও কি হৃদয়হীনার মত কাজ করছি না! ছোটবেলার সেই হাসির গল্পে এখন আর হাসি পায় না। কেটে যায় স্তব্ধ কিছু মুহূর্ত।

আবার মনে পড়ে গুরুজীর কথা, ” …যতবার হোঁচট খান ততবার উঠে দাঁড়ান”। হঠাৎ কৃতজ্ঞতায় ভরে যায় মন। এই কৃতজ্ঞতা স্রস্টার প্রতি, গুরুর প্রতি, সংঘের প্রতি, যারা প্রতিবার আমাকে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি যোগান, নতুন বিশ্বাসে নিজেকে বদলানোর সাহস যোগান।

দুঃখিত!