স্বপ্ন বিভ্রাট

সারাদিন বুঝি নিজের সাথেই কথা বলতে হবে? কি আদিখ্যেতা! কেন আমার কি বন্ধু বান্ধবদের নির্বাসন হয়েছে, নাকি তারা ইহলীলা সাঙ্গ করেছে?

আয়নার সাথে কথা বলাও যা আর নিজের মনে বকাও তা। আমি সব আয়না ভেঙেই ফেলব আজ। দেখি কে আটকায় আমায়।

সন্ধ্যেবেলা বিশ্বম্ভরবাবু এই সব নিজের মনে বলতে বলতে মোড়ের চায়ের দোকানে এসে বসলেন।
“পাঁচু চা দে”, বিশ্বম্ভরবাবুর মাথায় খুন চেপে আছে আজ।
কেন হবে রোজ এরকম? তিনি যার কথাই ভাববেন বা পড়বেন বা শুনবেন, সে সেই রাত্রেই কোন না কোন রোগ নিয়ে তাঁর স্বপ্নে এসে হাজির হবে। বিশ্বম্ভরবাবু হলেন গিয়ে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার এই হেতাল গ্রামের। তা প্রায় বছর তিরিশ হল তিনি ডাক্তারি করছেন এই গ্রামে। বেশ নাম ডাক।
পাঁচু চা দিল। তিনি চা খাচ্ছেন আর গজগজ করছেন। শীতকাল। তেমন কাউকে রাস্তায় দেখাও যাচ্ছে না। কুয়াশায় ঢাকা চারিদিক। পাঁচু পায়ের কাছে বসে। পাঁচুর বয়স আনুমানিক ২৩/২৪ হবে। মা-বাপ মরা ছেলে। গ্রামের লোকেরাই মানুষ করেছে আর এই চায়ের দোকান খুলে দিয়েছে। খুব সরল সাদাসিধে ছেলে। পড়াশোনা ক্লাস থ্রি অবধি।
“কি হইসে ডাক্তার বাবু? আবার স্বপ্ন দ্যাখসেন? কার স্বপ্ন বাবু?”
ডাক্তারবাবু নি:সন্তান। তিনি আর তাঁর পরলোকগতা গিন্নী দুজনেরই খুব স্নেহের পাত্র এই পাঁচু। তাঁদের পরিবারের প্রায় সব কথাই পাঁচু জানে। ডাক্তারবাবু নিজের ছেলের মতন দেখেন পাঁচুকে। সব কথাই বলেন। আর এই স্বপ্নের ব্যাপারটা পাঁচু ছাড়া তিনি আর কাউকে বলেনও নি।
যা হোক। ডাক্তারবাবু ব্যাজার মুখে বললেন, “ওবামা”
“আঁইজ্ঞে কার মা?”
“আরে মুখ্যু ওবামা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। আমাদের দেশে যেমন মোদি, তেমনি ওদের দেশে ওবামা।”
“অ, মানে কি পধানমনতির?”
“হ্যাঁ! সে ব্যাটা দেখি সকালবেলা খাতায় নাম লিখিয়ে রুগীর লাইনে বসে। খোস-পাঁচড়া হয়েছে। একটা লুঙ্গী আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আমার দাওয়াটায় বসে আছে আর বিড়ি ফুঁকছে। তার সাথে আমাদের নেতাই-এর মায়ের তুমুল ঝগড়া। ওবামা নাকি দু’মাসের ঘুঁটের দাম দেয় নি। বোঝ। সুস্থ মানুষ কখোনো এ স্বপ্ন দেখে, তুই বল?”
পাঁচু কি বলবে ভেবে না পেয়ে বলল, “আইজ্ঞে স্বপ্নটা কি ভোরের দিকে দ্যাখসেন?”

“তাতে কি?”

“না কত্তামা(ডাক্তারবাবুর স্ত্রী) বইলতেন ভোরের স্বপ্ন সত্তি হয়। তা হতিই পারে। কত মানুষ আইসে আপনের কাসে আর ওবার-মা না আসার কি আছে তো বুঝি না। কেন, গেল বার পুজোর সময় সদরের কোন এইম এল এ সাহেব আইসলেন না! বাতের ব্যাথার ওষুধ নিতি। তো? ইনিও দেহেন আইজ কাইলের মধ্যে এইসে পড়ল বুলে”, বলে পাঁচু একগাল হাসল।
“তোমার যেমন বুদ্ধি!”, ডাক্তারবাবু অন্যমনস্ক হয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
পাঁচুর মনটাও ভাল যাচ্ছে না, ডাক্তারবাবুকে কদিন ধরে এমন উতলা দেখে। আজ বৃহস্পতিবার বলে না হয় ডাক্তারবাবু রুগী দেখেন না, তাই তাঁর এখানে আসেন, দুটো কথা কন। অন্যদিন তো সেই রাত দশটা অবধি রুগী। কার সাথেই আর মনের কথা কবেন। কি দুখ্য এই বুড়ো বয়সে কত্তার।এই সব ভাবতে ভাবতে পাঁচু বলল, “আরেক কাপ চা দিই কত্তা?”
বিশ্বম্ভর বাবু অন্যমনস্ক ভাবেই বললেন, “তাই দে।”

আবার স্বপ্ন!

আজ দেখলেন তেনজিং নোরগে-কে। সক্কাল সক্কাল আসলেন, খাতায় নাম লেখালেন, কিন্তু একি! রুগীদের সারিতে না বসে তিনি বাড়ির সামনের নারকেল গাছ বেয়ে তরতর করে উপরে গিয়ে উঠলেন। এদিকে বিশ্বম্ভর বাবু নীচে রুগী দেখতে মাঝে মাঝেই বাইরে এসে তাঁকে অনুরোধ করছেন নীচে নেমে আসার জন্য। দু – তিন ঘন্টা হয়ে গেল কিছুতেই তিনি নামতে চাইছেন না। মুশকিল হল, নারকেল গাছে চড়ে তো আর চিকিৎসা করা সম্ভব না! আবার এদিকে এত নামী লোক যে যাকে তাকে দিয়ে তাঁকে নামানোও যায় না। কি ফ্যাসাদ!
ভাগ্যে গদাই-এর ঠাকুমা এসেছিলেন সেই সময়ে ওষুধ নিতে। তাঁর খুব উপস্থিত বুদ্ধি। গ্রামে তাই নিয়ে বেশ সুনামও আছে। অবশেষে তিনিই একটা উপায় বার করলেন।
গদাই-এর জন্মদিন বলে তিনি কয়েকটা মালপো ভেজেছিলেন। বাড়ি থেকে তাই নিয়ে এসে গাছতলায় বসলেন আর বলতে লাগলেন, “অ বাবা নারুগে, নেমে আয় সোনা। ডাক্তারবাবু তোকে দেখে তো নাইতে যাবেন বাবা। কত্ত বেলা হল দ্যাখ দেকিনি। মানুষটার তো বয়স হল বল? ওরে লালমুখো, নেমে আয় বাবা!”
ঠাকুমা তো ডেকেই যাচ্ছেন। এদিকে নীচে মেলা বসে গেছে। দূর দূর থেকে লোক আসছে দেখতে। স্কুলের ভুগোলের কনক স্যার বেশ কিছু উৎসাহী ছাত্র পেয়ে গেছেন দর্শকদের মধ্যে। তাদের গোল করে বসিয়ে বোঝাচ্ছেন কোথায় এভারেস্ট, কি করে উঠেছিল, এভারেস্ট-এর উচ্চতা কত। আবার পড়াও ধরছেন। ওই তো কেলে বিশু, যার সাইকেল সারানোর দোকান তাকে নীল ডাউন করিয়ে রেখেছেন এভারেস্ট-এর উচ্চতা তিন বার ভুল বলার পর।
পাঁচু চা বিক্রি করতে লেগে গেছে। গবা আর তার বউ পাঁপড় বিক্রি করছে। হেডস্যার স্কুল ছুটি দিয়ে ছাত্রদের নিয়ে এসেছেন। গ্রামে নোরগেবাবুর জন্য সংবর্ধনা সভার আয়োজন চলছে লাইব্রেরীর মাঠে। তার জন্য মহিলা সমিতি রিহার্সাল শুরু করেছেন মাঠের এক কোণে। “উঠ গো ভারতলক্ষী” আর “হও ধরমেতে ধীর” গান হচ্ছে, সব অনুষ্ঠানেই অবশ্য এই দুটো গানই হয়ে থাকে। ওদিকে গদাই তার মালপো বেহাত হয়ে যাচ্ছে দেখে তুমুল কান্নাকাটি শুরু করেছে। বেজায় শোরগোল। কিন্তু নোরগেবাবু নারকেল গাছে নির্বিকার।
মোক্ষদা দেবীর বয়স আশি পেরিয়েছে এ বছর। তিনিও সব শুনেছেন। সব শুনে তাঁর ধারণা হয়েছে কৈলাসে আর এভারেস্টে শুধুই নামের ফারাক। তাঁর ধারণা তিনি নিজে কৈলাসে উঠতে না পারলে কি হবে, বাবা তাঁর সাধনায় তুষ্ট হয়ে এমন ক্রান্তদর্শী নোরগেবাবাকে শুধু তাঁরই জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন এই হেতাল গ্রামে। ” ভাগ্যিস সকাল থেকে কিচ্ছুটি দাঁতে কাটিনি, এমন পয়মন্তর মানুষ কি আর বিনা তপস্যায় দেখতে আছে!” সুতরাং তিনি নির্জলা উপোসের সঙ্কল্প নিয়ে ফুল বেলপাতা জোগাড় করে বসে আছেন নারকেল গাছেটার নীচেই প্রায়,-“কৈলাসে চড়া মানুষ বলে কথা! তা তাঁর সৎকার করতে হবে না? গেরামের মুখ থাকবে তা না হলে?” এই কথাগুলো মোক্ষদাদেবী বার পঞ্চাশেক শুনিয়েছেন সব্বাইকে। সবাই মাথা নেড়ে বলেছে, “তা তো বটেই, তা তো বটেই।”
এদিকে মোক্ষদাদেবীর প্রাণের বান্ধবী হরিদাসীও এসেছেন একটা গাঁদাফুলের মালা নিয়ে। তাঁর বক্তব্য, “কৈলাসে যখন উঠেছেন, বৈকুণ্ঠধাম কি আর উঁকি মেরে দেখেন নি? তাও কি হয়?”
এই নিয়ে বেধে গেল তুমুল ঝামেলা। মোক্ষদা বলেন কৈলাসের নীচে বৈকুণ্ঠ আর হরিদাসী বলেন বৈকুণ্ঠধামের নীচে কৈলাস। ব্যাস লেগে যা নারদ নারদ। প্রথমে মুখে মুখে,তারপর হাতাহাতি, চুলোচুলি… হরি হরি….শিব শিব…

বিশ্বম্ভরবাবুর ঘুম যখন ভাঙল তখন ওনার মাথা ঝিমঝিম করছে, গা গুলোচ্ছে। উঠেই জানলা দিয়ে নারকেল গাছটা দেখলেন। না, কিছু নেই,একটা দাঁড়কাক ছাড়া। আজ কিছু একটা হেস্তনেস্ত করবেনই। হঠাৎ তাঁর মনে হল তারিণী মশায়ের কথা। হ্যাঁ উনি কিছু একটা উপায় বার করতে পারেন! ভাবতেই বিশ্বম্ভরবাবুর গলাটা আবেগে রুদ্ধ হয়ে আসল।তাড়াতাড়ি স্নান সেরে দুটো ছোলা বাদাম মুখে দিয়ে, গায়ে একটা শাল চাপিয়ে হনহন করে বেরিয়ে পড়লেন।

তারিনী মশায়ের বয়স আন্দাজ ৮৮ হবে। খুব জ্ঞানী মানুষ। কলেজে দর্শন পড়াতেন। রিটায়ার হওয়ার পর থেকে এই গ্রামেই পৈতৃক ভিটেতে বাস করেন।

সকাল ৯ টা নাগাদ হন্তদন্ত হয়ে বিশ্বম্ভরবাবু ঢুকলেন। এই মাঘের শীতেও বেশ ঘেমে গেছেন।
তারিনীবাবু তাঁর উঠোনে একটি ইজিচেয়ারে বসে কাগজ পড়ছিলেন। বিশ্বম্ভরবাবু এসেই তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে পাশের একটা মোড়াতে ধপ করে বসে পড়লেন।
“তোমার মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেন বিশু?”, তারিনী মশায় ওই নামেই ডাকেন ডাক্তারবাবুকে।
ডাক্তার প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে সব বর্ণনা করলেন তারিনী মশায়কে। তিনি সব মন দিয়ে শুনলেন আর বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“বুঝলাম বিশু। বৌমা চলে যাওয়ার পর থেকে তুমি যে পুরো আটকে নিলে নিজেকে বিশু। পুজোকমিটি ছেড়ে দিলে, আমাদের সংগীতচক্রটা ছেড়ে দিলে, এমন সুন্দর বেহালার হাত তোমার! এভাবে কি চলে বিশু?”
তারিনী মশায় চোখ বন্ধ করে বলে যাচ্ছিলেন, বিশ্বম্ভরবাবু মাথা নীচু করে শুনছিলেন বাধ্য ছেলের মত।
তারিনী মশায় আবার বললেন, “এ তোমার একা থেকে থেকে মাথা গরম হওয়ার ফল বিশু। তুমি আবার বেরোও। সন্ধ্যেবেলা চেম্বার তাড়াতাড়ি বন্ধ করো দেখি। বয়স তো হচ্ছে। চন্ডীমন্ডপে চলে এসো আজ থেকে। ধ্যানেশ কি সুন্দর রামায়ণ পাঠ করছে! আহা! আহা! আজই চলে এসো। সব ঠিক হয়ে যাবে বিশু…”, বলতে বলতে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন আবেগে।
বিশ্বম্ভরবাবু খুবই মুশকিলে পড়লেন। তারিনী মশায় বলে কথা, এক্কেবারে মুখের ওপর নাও বলতে পারছেন না, এদিকে তিরিশ বছরের পুরোন অভ্যেস রাত দশটা অবধি রুগী দেখা। কি যে করেন।
যা হোক, ‘দেখছি’ বলে বাড়ি ফিরে আসলেন।
এদিকে স্বপ্ন আরো জটিল হতে শুরু করল।

একদিন দেখলেন ইন্দ্রদেব আর ঊর্বশীর বাসর ঘরে জাম্বুবান ঢুকে ইন্দ্রদেবকে যাচ্ছেতাই রকম খিমচেছে। যা হোক সেই সময় যুধিষ্ঠির এসে পড়ায় জোর বেঁচে গেছেন ইন্দ্রদেব। ঊর্বশী ইন্দ্রদেবকে নিয়ে এসেছেন চিকিৎসার জন্য।
সেদিন দেখলেন বাবর আর পুরু বসে দাবা খেলছেন এমন সময় সাইরেন বেজে উঠল। সব বলল, “পালাও পালাও, জাপানী বোমারু প্লেন আসছে।” বাবর পড়িমরি করে দৌড়াতে গিয়ে পায়ের কয়েকটা লিগামেন্ট ছিঁড়ে ফেলেছেন। পুরু তাকে নিয়ে এসেছেন চিকিৎসার জন্য।
আরেকদিন দেখলেন মেগাস্থিনিস এসেছেন আর্কিমিডিসকে নিয়ে। সারাদিন চৌবাচ্চায় শুয়ে শুয়ে আর্কিমিডিসের সারা গায়ে ফাংগাল ইনফেকশন হয়ে গেছে।
অন্যদিন দেখলেন গরুড়জী এসেছেন কিছুটা ঘায়েল হয়ে। আমাজন জঙ্গলে নাকি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শাখা খোলা হবে। তা গরুড়জী গেছিলেন হ্যান্ডবিল বিলি করতে। খিদে পেয়ে যাওয়াতে দুটো অ্যনাকোন্ডার স্যুপ খেয়েছিলেন। সেই থেকে পেট ছেড়ে দিয়েছে।
তবে শেষ যেটা দেখেছেন তা নিয়ে ওনার অভিযোগটা অনেক কম। দেখেন হ্যানিম্যানকে নিয়ে রবিঠাকুর এসেছেন। ওনারা তাঁর হাতের তৈরি ডাঁটা চচ্চড়ি আর লাউ শাক, গরম ভাত দিয়ে মেঝেতে বসে পরম তৃপ্তি সহকারে খেয়েছিলেন। উফ্… কি যে আবেগঘন মুহুর্ত! উনি এত কেঁদেছিলেন ঘুমের মধ্যে যে সকালে উঠে বালিশের ওয়াড় শুকুতে দিতে হয়েছিল। অবিশ্যি কেন এসেছিলেন তা আর মনে কত্তে পারেন নি সকাল থেকে।
তবে আর না। আজ তিনি চন্ডীমন্ডপ যাবেনই। সাইনবোর্ড পাল্টে রুগী দেখার সময় সন্ধ্যে সাতটা অবধি করলেন।

চন্ডীমন্ডপে যখন তিনি পৌঁছালেন তখন পাঠ অনেকক্ষণ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। বেশ ভীড়। সবাই চাদর শাল মুড়ি দিয়ে বসে শুনছে। কাউকে চেনা কঠিন। নেতাই-এর ঠাকুমা, মোক্ষদা দেবী, হরিদাসী দেবী সবাই শুনছেন চোখ বন্ধ করে। মোক্ষদা দেবী তো গোটা কম্বল গায়ে জড়িয়েই চলে এসেছেন।

যা হোক বিশ্বম্ভরবাবুকে দেখেই সব সরে সরে জায়গা করে দিল। তিনি তারিনী মশায়ের পাশে গিয়ে বসলেন। পাঠে বিরতি পড়ল। তারিনী মশায় বললেন, “তা ছেদ যখন পড়ল রামের ইচ্ছায়, একটু চা খাওয়া যাক। কি বলেন পাঠক মশায়?” ধ্যানেশবাবু অর্থাৎ পাঠক মশায় নস্যি নেওয়া দাঁত বিকশিত করে ঘাড় হেলিয়ে দিলেন কাৎ করে। সভায় সবাই বলে উঠল, “হ্যাঁ হ্যাঁ চা হোক, চা হোক।”
একজন ছোকরা – বিলে, তারিনী মশায়ের দেখা শোনা করে, সে ছুটে গেল পাঁচুর দোকানে চায়ের অর্ডার দিতে। চা এসে গেল, সাথে পাঁচু। চা খাওয়া হল, গল্প হল, আবার পাঠ শুরু হল।
হনুমানজী এসেছেন রাবণকে বুঝাতে রামের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য, ওই অংশটা পাঠ হচ্ছে।
বিশ্বম্ভরবাবু মন দিয়ে শুনতে চাইছেন। কিন্তু কিছুতেই পেরে আর উঠছেন না। যতবার তাঁর চোখ সবার দিকে পড়ছে ততবার তাঁর কোন না কোন স্বপ্ন মনে পড়ে যাচ্ছে আর মনটা অস্থির লাগতে শুরু করেছে।
এই তো টেঁপির দাদু স্বপ্নে হিউয়েন সাঙ-কে কি গালাগাল করছিল। হিউয়েন সাঙ দোষের মধ্যে বলে ফেলেছিল যে সে চীন থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছে ডাক্তার দেখাবে বলে। টেঁপির দাদু কিছুতেই মানবে না সে কথা। বলে, “তুমি আমায় মদন পেয়েছ ভোঁতামুখো। চীন থেকে হেঁটে হেঁটে আসা! যত সব ঢপের কেত্তন! কেন রে তোদের গাড়ি ঘোড়ার হরতাল, না দিনের বেলায়ও ওই সব ছাঁইপাশ গেলা হয়। আমার ঠাকুরদা হেঁটে পুরী যেতে গিয়েই বাঘের পেটে চলে গেছিলেন! আর এ আপদ বলে কি না চীন থেকে হেঁটে আসছে, যেন পথে সমুদ্দুর মরুভুমি পড়েনি”
হিউয়েনবাবু যত বোঝান, “আজ্ঞে চীনের পথে ওসব পড়ে না”, টেঁপির দাদু তত ক্ষেপে ওঠেন। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ভারতের চারিদিকে চার মহাসাগর আর তার ওপারে যত ম্লেচ্ছদের বাস।
ওই যে বাড়ুয্যে মশায়। যোগ ব্যায়াম করার খুব শখ। একটা আখড়াও খুলে ছিলেন। কিন্তু নেতাই-এর ঠাকুমার লেংটি পরা ছেলে দেখতে ভীষণ আপত্তি। “বলি গ্রামে বয়স্থ মেয়ে নেই নাকি লো! ওই ধুম্ব ধুম্ব পেছন বার করে কি চুলোচুলি রে বাবা! রেখে দে ওসব বাড়ুয্যে। বামুনের ছেলে কোথায় টোল খুলবে, তা না কি একটা ন্যাংটা ছেলের আখড়া খুলে বসল গা!” আখড়া উঠল।
সে আখড়ায় এখন মুদির দোকান দিয়েছে ওনার বড় ছেলে।
ওই বাড়ুয্যেই হিটলারকে কি নাকানি চোবানি খাইয়েছিল যোগ ব্যায়াম করিয়ে! অবশ্যই স্বপ্নে। হিটলার এসেছিলেন ওনার পাইলসের ওষুধটা নিতে। পড়ে গেলেন বাড়ুয্যের খপ্পরে! এই আসন, সেই আসন করিয়ে হিটলারের শরীরের সব কলকব্জা তখন খুলে যাওয়ার যোগাড়। সে কি কান্না হিটলারের বাচ্চাদের মত।
শেষে আবার নেতাই এর ঠাকুমা এলেন নাড়ু নিয়ে। নেতাই তিনবারের বার এক চান্সেই ক্লাস সিক্সে উঠেছে বলে তিনি নাড়ু বানিয়েছিলেন। হিটলারকে তো নাড়ু দিয়ে শান্ত করা গেল। কিন্তু ওদিকে নেতাই জুড়ে দিল কান্না, “অ্যাঁ অ্যাঁ… আমি আর কোনোদিন যদি পাশ করেছি দেখো…. আর কক্ষোনো করব না… আমার পাশের নাড়ু ওই হতচ্ছাড়া শুঁটকে লোকটাকে খাওয়ানো অ্যাঁ অ্যাঁ…..”

“ডাক্তার বাবু বাড়ি যাবেন না?” পাঁচুর গলা না!
আরে তাই তো। পাঠ তো কখন শেষ। সবাই তাঁর মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে। ছি ছি। কি লজ্জা। যা হোক তিনি কোন রকমে এটা ওটা বলে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। তারিনী মশায় কোন কথা না বলে ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলেন অন্ধকারের দিকে, “বিশুর একি হল! এত কি ভাবে?”
বিলে বলল,”ও দাদু তোমার আবার কি হল? চল বাড়ি যাবে না?”
তারিনী মশায়ের ঘোর কাটল। বললেন ” হ্যাঁ হ্যাঁ চ চ…”

কিচ্ছু হল না। বিশ্বম্ভরবাবু পর পর বেশ কয়েকদিন গেলেন সন্ধ্যেবেলা চন্ডীমন্ডপে। পুরো লঙ্কাকান্ড শুনলেন। তা সত্ত্বেও কাল রাতে যা হল! আর তিনি চন্ডীমন্ডপে যাচ্ছেন না।

সেই দু:স্বপ্ন। এবার স্বয়ং রাবণ, ভাবা যায় ব্যটার স্পর্ধা!
তার দশটা মাথা। কেন যে ওর বাবা ছোটবেলাতেই কাটিয়ে নেন নি, কে জানে। সে এসেছে তাঁর কাছে চিকিৎসার জন্য। তার একটা মাথা ঘুরছে, একটা ব্যাথা করছে, আরেকটাতে চুলের ভিতর ঘা, আরেকটাতে আরো কি সব। তার উপর এতগুলো মাথা ঘাড়ে করে বয়ে বয়ে ধরিয়েছে স্পন্ডেলাইটিস। এ সামলানো যায়! বলি মাথা দশটা হলে কি হবে? ঘাড় তো একটা!
এদিকে সে আসছে দেখে গ্রামের ভীতু ছেলেগুলো ভয়ে ঘরে সেঁদিয়ে, নেতাই-এর তো দাঁতকপাটি লেগে ধুম জ্বর। স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছেন হেডস্যার। ওদিকে থানায় রিপোর্ট করতে গিয়ে ছিলেন গ্রামের মাতব্বরেরা। তাঁরা ফিরে এসেছেন। থানার বড়বাবু নাকি রাবণের ভীষণ ভক্ত, তাই রিপোর্ট নেবেন না।
কি হুলুস্থুলু কান্ড। শেষে সভা ডেকে ঠিক করা হল বিশ্বম্ভরবাবুকেই গ্রাম ছেড়ে দুরে গিয়ে চেম্বার করতে হবে। একি কথা! তিনি আপত্তি জানাতে যাবেন, এমন সময় ঘুমটা ভেঙে গেল।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ইস্তক ওনার মেজাজ বিগড়ে আছে। কিচ্ছু খেলেন না। সাইকেলটা নিয়ে সারদিন এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরে বেড়ালেন।
বিকালবেলা গ্রামের বাইরে দিয়ে যাওয়া একটা সরু খালের ধারে এসে বসলেন। বাচ্চারা দুরে খেলছে, আওয়াজ আসছে ওদের চীৎকারের। তাঁর মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। ভাবছেন পাগল হয়ে যাবেন নাকি? না আত্মহত্যা করবেন… মাথার মধ্যে সব ভুলভাল চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি চাইলেও থামাতে পারছেন না আজ।

হঠাৎ শুনলেন খুব চীৎকার, চেঁচামেচি। পিছন ফিরে দেখেন বড় ছেলেদের সাথে ছোট ছেলেদের ভীষণ মারামারি বেধে গেছে। দৌড়ে গেলেন। জানলেন, কারা এই মাঠে খেলবে তাই নিয়ে ঝামেলা। বিশ্বম্ভরবাবুকে চেনে না এমন বাচ্চা বুড়ো কেউ এ গ্রাম কেন, আশে পাশে চব্বিশটা গ্রামেও নেই।

তিনি বললেন, “ঠিক আছে বড়রা পনেরদিন আর ছোটরা পনেরদিন করে বল খেলবে, একদিন অন্তর অন্তর।
“আজ যখন বড়রা খেলতে শুরু করে দিয়েছে তখন ওরাই খেলুক। কাল তোরা খেলিস। আবার পরের দিন বড়রা।”, সবাই মেনে নিল।
“তা হলে এখন আমরা কি করব?”, একজন খুদে খেলোয়াড় জিজ্ঞাসা করল।
“তুমি গল্প বলতে পারো?”, আরেকজন খুদের প্রশ্ন।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, গল্প গল্প”, বলতে বলতে বিশ্বম্ভরবাবুর পাঞ্জাবী ধরে এক প্রকার টেনে নিয়েই তাঁকে ওরা খালের ধারে যেখানে ওনার সাইকেল রাখা ছিল – নিয়ে বসাল। নিজেরা বসল গোল হয়ে তাঁকে ঘিরে। কি গল্প বলেন? খুব মুশকিলে পড়লেন তিনি। গল্প বলার অভ্যাসও নেই। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গেল রাতে দেখা রাবণের স্বপ্নটার কথা। ব্যাস বলতে শুরু করলেন।
যখন থামলেন তখন সন্ধ্যে হব হব। দেখেন বড়দের দলও কখন এসে বসে পড়েছে তাঁকে ঘিরে।
“আরে চল চল অন্ধকার হয়ে গেল যে”, বলেই তিনি সাইকেলে চড়ে বসলেন। মনটা কেন জানি হঠাৎ খুব খুশী খুশী লাগছে অনেকদিন পর। যেন কিছুই হয় নি এতদিন। যা হোক, সাইকেলে প্যাডেল করতে যাবেন, এমন সময় একজন খুদে সদস্য ওঁর পায়জামা টেনে ধরল।

তিনি অবাক হয়ে সাইকেল থেকে নেমে পড়লেন, বললেন, “কি রে?”

“কাল আবার আসবি তো?”, খুদে খুব আবদারের সুরে বিশ্বম্ভরবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
কি হল বিশ্বম্ভরবাবুর তিনি বুঝলেন না। তাঁর নাকের কাছটা টনটন করে উঠল, চোখদুটো জ্বালা জ্বালা করে উঠল। আটকাতে পারলেন না নিজেকে। দু’ফোঁটা অবাধ্য জল চোখ থেকে গাল গড়িয়ে পাঞ্জাবীতে পড়ল। ভাগ্যিস অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, না হলে কি লজ্জা! না, লজ্জা কিসের?
কতদিন পর তাঁর মনের ভিতরটা হাল্কা লাগছে। মনে হচ্ছে খুব চীৎকার করে কাঁদেন, যাতে মনোরমা শুনতে পায়। সামলে নিলেন।
বাচ্চাটার গালে হাত দিয়ে বললেন, “আসব”।

এরপরের গল্পটা খুব সোজা। বিশ্বম্ভরবাবু ভীষণ ব্যস্ত। সারাদিন তাঁর বাড়িতে কচি-কাঁচার ভিড়। অবৈতনিক প্রাইমারী স্কুল খুলেছেন তিনি। গ্রামের অনেকেই পড়ায় সেখানে। বাড়ুজ্যে যোগব্যায়াম শেখায়, তারিনী মশায় ইংরাজী পড়ান, আরো অনেকে পড়ান। নেতাই-এর ঠাকুমা পূজো পার্বণে মালপো, নাড়ু বানিয়ে আনেন। সে এক কর্মযজ্ঞ।
আর স্বপ্ন? তার আসার সময় কোথায়?

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!