ছোট্ট একটা বেলুন। কী অবাক কাণ্ডটাই না ঘটাল। তাই বলে এতখানি! ছোট্ট বেলুনখানা, আহা! বদলে দিল পুরো দুনিয়ার অতীত, বর্তমান এমনকি ভবিষ্যৎ পর্যন্ত। মাত্র এই টুকুন বেলুনটা।
গাঢ় নীল রঙের বেলুনটা ছিল রাতিনের হাতে। আর রাতিন ছিল সোলকপুরের বড় রাস্তার ওপর। মায়ের সাথে ফিরছিল স্কুল থেকে। ওর আবদারেই মা বেলুনটা কিনে দিয়েছেন। ওদের সামান্য পিছনে বাবা। ভোরের বাজার থেকে ফিরছেন। সোলকপুরের ভোরবেলাকার বাজার খুব জমজমাট। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ ফুলতে শুরু করল বেলুনটা। কেমন করে ফুলছে, বুঝতে পারল না রাতিন। তবে বেলুনটা ফুলছে। ফুলতে ফুলতে হয়ে গেল ইয়া বড় বেলুন। আর ফুলতে ফুলতে গাঢ় নীল থেকে হয়ে গেল হালকা আকাশী। আকাশী রঙের হয়েই আকাশে ওড়ার জন্য ছটফট করতে লাগল ইয়া বড় বেলুন। আকাশটা যেন ডাকছে- আয় আয় আয়। আকাশের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারা যায়?
বেলুনের সুতোর আরেক মাথা রাতিনের হাতে। এক মাথা তো বেলুনের সাথেই বাঁধা। মাকে বেলুনটা দেখিয়ে রাতিন বলল, ‘মা দেখো, বেলুনটা যেন কেমন করছে?’
মা অবশ্য অনেকক্ষণ ধরেই বলছিলেন, ‘রাতিন, বেলুনটা আর ফুলিও না। ফেটে যাবে।’
রাতিন আর বেলুনটা ফোলায়নি। একা একাই ফুলছিল আর বড় হচ্ছিল। ও অবাক হয়ে বেলুনের বড় হওয়া দেখছিল। আর হাঁটছিল। ওর স্কুল ব্যাগটা মায়ের কাছে।
আবারও চেঁচিয়ে উঠল রাতিন, ‘মা, দেখো না। বেলুনটা আকাশে উড়তে চাইছে।’
মা বললেন, ‘সব বেলুনই আকাশে উড়তে চায়।’
রাতিন মায়ের ঠিক পিছনে। আর মা সামনে। রাতিনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিলেন মা। তবে পিছনে ঘুরে একবারও তাকাননি। অনেক সময় খামোখাই বক বক করে ছেলেটি। সবসময় ভালো লাগে না।
হঠাৎ আকাশপানে উঠতে শুরু করল বেলুনটা। কী অবাক! রাতিনকেও টেনে নিচ্ছে উপরে। অনেকখানি উপরে ওঠার পর রাতিন চেঁচাল, ‘মা, বেলুনটা আমায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে!’
চট করে পিছনে তাকালেন মা। আর তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। ভুল দেখছেন না তো! বেলুনের টানে মাথা সমান উঁচুতে উঠে গেছে রাতিন। এতই অবাক হয়েছেন, কী করবেন বুঝতে পারছেন না। খানিকটা দূর থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন বাবা, ‘ধরো ওকে, ধরো।’ অমনি রাতিনকে ধরে ফেললেন মা। তবে কোনওমতে পা দুটো ধরতে পেরেছেন।
মা ভেবেছিলেন, পা ধরে রাতিনকে টেনে নামিয়ে আনবেন। তারপর হতচ্ছাড়া বেলুনটাকে ফুটো করে দেবেন। কিন্তু অবাক বেলুনটা মাকেও টেনে তুলে ফেলল অনেকখানি। বাজারের ব্যাগ ফেলে দৌড়ে এলেন বাবা। কোনও রকমে মায়ের দুটো পা চেপে ধরতে পেরেছেন। খানিকপরে বাবাকেও টেনে তুলতে শুরু করল বেলুনটা। আর তখনই শুরু হল হইচই। হইচই শুনে কোত্থেকে ছুটে এলো রাতিনে ছয় ছয়জন চাচা। একে একে তাদেরকেও টেনে তুলল বেলুন। নাহ্! যাচ্ছে তাই কাণ্ড ঘটছে সোলকপুরে। বেলুন নাকি মানুষ টেনে নিচ্ছে আকাশে! সোলকপুরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল খবরটা। একে একে মানুষ আসছে আর বেলুনে টানা মানুষের পা টেনে ধরছে। কিন্তু বেলুনখানা যে কী! উঠতে লাগল আরও উপরে। আরও উপরে। আরওঃ
সোলকপুরের একটা মানুষও বাদ নেই। যেখানে যত মানুষ ছিল, হাট-বাজার-স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-অফিস-আদালত- ছুটে এলো সবাই। একজন মানুষ আসে আর আগের আসা মানুষের পা ধরে উপরে ওঠে। আরেক জন আসে আগের জনের পা ধরে উপরে ওঠে। আর উড়তে উড়তে একেবারে মেঘ ছুঁয়ে ফেলল বেলুনখানা। খানিকপর মেঘ ছাপিয়ে আরও উপরে উঠল। তারপর আরও উপরে। তারপর আরও। আরওঃ
আরও কিছুক্ষণ পর বেলুনের অনেক নিচে পড়ে রইল মেঘ। মেঘের অনেক নিচে সোলকপুর। বেলুনখানা এমনভাবে উঠছে, যেন মহাকাশের ঘুড়ি। আর দুই হাজার চারশ বারো জন মানুষ যেন সুতো। মানুষসুতো। এরাই বেলুনখানাকে একের পর এক ধরে রেখেছে। সবার প্রথমে রাতিন। আর সবার শেষেঃ সবার শেষে যে কে, কেউ জানে না। কেউ বলতেও পারবে না। কারণ সবাই তাকিয়ে আছে উপরের দিকে। বেলুনটা আর কত উপরে উঠবে?
মানুষসুতোর শেষ মানুষটাও উঠে যেতে লাগল উপরে। আর কেউ নাগাল পাবে না তারও। একটা বেলুন টেনে নিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ, ওটা দেখারও কেউ রইল না সোলকপুরে। সবাই যে বেলুনের সঙ্গেই পাড়ি দিয়েছে মহাকাশে। বেলুনটারও থামাথামি নেই। উঠছে তো উঠছেই। আরও উপরে উঠছে। আরও উপরে। আরওঃ
হঠাৎ কোত্থেকে ছুটে এলো একটা উল্কা পিণ্ড। ঠোক্কর মারল বেলুনের গায়ে। আর অমনি ফুসসসসসঃ
কী ভাবছ বলো তো? ভাবছ ঠোকর খেয়ে বেলুনের হাওয়া সব বেরিয়ে গেল? বেলুনখানা চুপসে গেল? তারপর একে একে দুই হাজার চারশ তের বার টুপ করে শব্দ হল? (একেকটা টুপ মানে একজন করে মানুষের পড়ার শব্দ। আর শেষ টুপটা বেলুনের।)
না। সেটা হলে তো ভালোই হতো। দুনিয়ার মানুষের কত্ত খরচ বেঁচে যেত! একেকটা মহাকাশ যাত্রায় খরচ তো আর কম নয়! লক্ষ হাতি পোষার চেয়েও বেশি।
কিন্তু ওটা যখন হল না, তারপর কী হল? তারপর হল মহাসর্বনাশ। কারণ উল্কা পিণ্ডের সঙ্গে ঠোক্করটা লেগেছে বেলুনের তলায়। ব্যস। অমনি বেলুনখানা হয়ে গেল একটা রকেট। এতক্ষণ তো কেবল উড়ছিল আর উপরে উঠছিল, এবার ছুটতে শুরু করল। ফুসসসস শব্দ তুলে ভীষণ বেগে ছুটতে শুরু করল। রকেটের চেয়েও ভীষণ গতিতে। ছুটতে ছুটতে ছুটতেঃ মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ছিন্ন করে কোথায় যে ছিটকে গেল, কেউ জানে না। আজও জানে না কেউ। সোলকপুরের পুরো দুই হাজার চারশ বারোজন মানুষও ছুটেছিল ওই বেলুনের সঙ্গে। কোন গ্রহে গিয়ে যে আস্তানা গাড়ল- কেউ জানে না। তবে জানতে চায়। পুরো দুনিয়াই জানতে চায়। আর জানতে চায় বলেই তো একের পর এক মহাকাশ যান পাঠাচ্ছে মহাকাশে। কোন গ্রহে মানুষ আছে সেটা খুঁজতে। ওই সোলকপুরের মানুষ খুঁজতে। এখনও খুঁজছে। খুঁজেই যাচ্ছে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।