অফিস থেকে বেড়োতে আজ অনেকটা দেরী হয়ে গেছে । বাড়ীতে নিশ্চয়ই এতক্ষনে চিন্তা শুরু হয়ে গেছে, কিছু করার নেই, রাজুর বইটা কিনে নিয়ে যেতেই হবে । বাসটাও ঢিমেতালে চলছে, কলেজ ষ্ট্রীট আসলে নেমে পড়লাম । আমার ভাই রাজু এবার মাধ্যমিক দেবে, আজই টেষ্ট পেপার বেড়িয়েছে, বইটা নিয়েগেলে ওর উপকার হবে । ওই তো আমার একমাত্র ভরসা । বাবাকে সেই ছোট বেলাতেহারিয়েছি, মা চির অসুস্থ, আমি , আমার বোন ,ভাই । বাবার মৃত্যুর পর বাবার জমান টাকা কখন ফুটো কলসীর থেকে জল বেরিয়ে মত শেষ হলো বুঝতেও পারিনি । আমার বোন একজন বিধর্মীকে বিয়ে করে সুখে আছে । আমি হয়ত বিধর্মী হতে পারলাম না বলেই সমস্ত দুঃখের বোঝা বয়ে চলেছি । মাকে ঠিক বুঝতে পারি না কখনও বলে তোর বিয়ে দেওয়া উচিৎ – কখনও বলে তোর বিয়ে হলে আমাদের কি হবে ? কখনও আমিও ভাবি আমার কি হবে? নাঃ – জানি না এর উত্তর আমার জানা নেই ।
বাব্বা ,টেষ্ট পেপার নেওয়ার জন্যও লাইন । লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম, দেশটার কি যে হলো ,সর্বত্র লাইন । অনেকদিন কফি হাউসে যাওয়া হয় নি । তখনও স্বপ্ন দেখতাম কিছু করার ,আর, মাঝে মাঝেই এসে কফির টেবিলে ঝড় তুলতাম । মনে হলো এক কাপ কফি আসলে কেমন হয় ,নাঃ মনটা খারাপ হয়ে গেল । যাব না কফি হাউস । বইটা নিয়ে টাকা দিয়ে, মানিব্যাগটা ভ্যানিটি ব্যাগে রাখতে রাখতে দোকান থেকে বেড়িয়ে আসলাম । আরে রণজয় না -কেমন চেহারা, উসকো খুসখো চুল , গালে ক’দিনের না কামান দাড়ি । ডাকলাম- রণজয় , রণজয় শুনতে না পেয়ে চলে যাচ্ছিল । আবার ডাকলাম ,এবার দাঁড়িয়ে পড়ে চারদিকে খুঁজতে লাগল ,এগিয়ে গিয়ে বললাম – কি হলো রণজয় চিনতে পারছ না ? নাকের উপর চশমাটা ঠিক করে নিয়ে ভাল করে দেখল -আরে মোহিনী !
-যাক চিনতে পারলে তা হলে ,আমি তো ভেবেছিলাম চিনতেই পারবে না । -আসলে অনেকদিন পরে দেখা ,কেমন আছ মোহিনী ? -ভালো তুমি কেমন আছো ? -মন্দ নয় অনেক কথা জমে আছে, চল একটু কফি হাউসে আমার দিকে তাকিয়ে রণজয়ের কথা শেষ হল না । কিন্তু আমার তো অনেক কথা বলার আছে, তাই আমিই বললাম -হ্যঁা ,চল খানিকক্ষন কফি হাউসে গিয়ে বসি । কফির টেবিলে দুটো কফির অর্ডার দিয়ে আমরা বসলাম । কিছু সময় নিঃশব্দে কেটে গেল । আজ থেকে আট বছর আগে ঐ কোনের টেবিলটায় পাক্কা দুঘন্টা একজনের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম , বাড়ী ফিরে গিয়ে তার প্রত্যাখানের চিঠি পেয়েছিলাম কারন – আমি আমার মা , ভাইবোনেকে চিরদিনেজন্য ছাড়তে পারব না বলে- আসলে শর্ত ছিল- গরীব মা ভাইবোনের সাথে সম্পর্ক রাখা যাবে না ।
-কিছু বলো রণজয় , এভাবে চুপচাপ বসা যায় না । -কেন ? এর আগে তো কফির টেবিলে মধ্যমনি তো তুমিই থাকতে । – সে মোহিনী অনেক পাল্টে গেছে সেটা তো তুমি জান রণজয় । মুখ তুলে আমার দিকে দেখল তারপর চোখ সরিয়ে নিল , -জান মোহিনী, আমি খুব কষ্টে আছি – কিসের কষ্ট তোমার রণজয় ,তোমাদের মত বড়লোক সারা কলকাতায় কজন আছে গুণে বলতে পারা যাবে । – আর্থিক কষ্ট নয় মোহিনী, মানসিক কষ্ট -আমরা তো গরীব , আমার সামান্য আয়েই সংসার চলে ,তাই আমাদের কাছে কষ্ট হলো অর্থাভাব । রণজয় তীক্ষ্ণ নজরে আমার দিকে তাকাল তারপর মাথা নিচু করে টেবিলের ওপর জড়ো করে রাখা হাত দুটোর উপর রেখে বলতে লাগল – – আজ আমি প্রত্যাখ্যাত । রুবি আমাকে ছেড়েচলে গেছে, জান মোহিনী ও বলেছিল আমার কবিতা লেখা সিগারেট খাওয়া ওর পছন্দ নয় । কবিতা সিগারেট নয়ত রুবিকে যেকোন একটা ছাড়তে হবে বলে জানিয়েছিল । সেদিন এক কবি সম্মেলন থেকে বেড়োতে দেরী হয়ে যায় বলে রুবি কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায় ,তারপর আর ওর দেখা পাই নি, আমাকে বার বার ফিরিয়ে দিয়েছে । পরশু বিকালে এস এম এসে বলেছে ওকে ভূলে যেতে । আমি কি করব মোহিনী ?
রণজয়ের উসকো খুসকো চুলে হাত বুলাতে ইচ্ছে করল । কিন্তু না……. – গোলাপ যদি নিতে চাও কাঁটা সাথে নাও সুখ যিদ পেতে চাও দুঃখ সাথে নাও ভালবাসা যদি পেতে চাও বিরহ সাথে নাও আলো যদি পেতে চাও অন্ধকার সাথে নাও কিছু যদি পেতে চাও তবে কিছু দাও । রণজয় মুখ তুলেদেখল -এখনও তোমার মনে আছে? – একথা গুলি আমি কখনই ভুলতে পারব না রণজয় ,বার বার মনে করতে করতে শব্দ গুলি আমার মনে স্থায়ী বাসা বেঁধে ফেলেছে । -মোহিনী তুমি আমায় ক্ষমা করতে পার না ? -ক্ষমা ,দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসল একটা -আমি তো তোমাকে ক্ষমা অনেকদিন আগেই করেছি । -তবে ফিরে এস মোহিনী আমায় গ্রহন কর ।
রণজয় ,তুমি আজ প্রত্যাখ্যাত বলেই কি আমাকে পেতে চাও? তুমি যে কারনে আমাকে প্রত্যাখান করে ছিলে, তা এখনও ভীষন ভাবে বর্তমান । সংসারের গুরুদ্বায়িত্ব এখনও আমার কাঁধে ,যা আমি অস্বীকার করতে পারিনা । সব জেনেও কেন দীর্ঘ আট বছর পর ফিরেএলে ? তোমাকে এখনও ভালবাসী রণজয় , তোমাকে পেলেই আমি সবচেয়ে খুশী হবো । তবু, তোমার ডাকে সাড়া দেবার ক্ষমতা আজ আমার মধ্যে বিলীন হয়েছে,স্যরি রণজয় পারলাম না তোমায় আপন করতে ।
ম্লান হাসি হাসলাম – – কোণের ঐ টেবিলটার থেকে আজ এই টেবিলে দীর্ঘ আটবছর সময় বয়ে গেছে ।আমার বেড়েছে আরও দ্বায়িত্ব । কিন্তু, জীবনের এই অমুল্য আটবছরের মুল্য কে দেবে রণজয় ?
– প্লিজ মোহিনী আমাকে একটা চান্স দাও । আমি সমস্ত দোষ স্খালন করতে চাই ।
ভ্যানিটি ব্যাগ তুলে দাঁড়িয়ে পড়লাম-চলি রণজয়,মা চিন্তা করছে, বাড়ী ফিরে রান্না করতে হবে ।
চেয়ার সরিয়ে টেবিলে ছেড়ে বেড়িয়ে আসলাম , রণজয় উঠতে গিয়েও বসে পড়ল । এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম সেই টেবিলে একটা মেয়ে একা বসে আছে , হয়ত কারো প্রতীক্ষায় আমারই মতো । কফি হাউস ছেড়ে রাস্তায় নামলাম ,যেন বুকের উপর থেকে একটা ভারী ওজন সরে গেল ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।