মা, আবির এবং একটি হুইল চেয়ার

আবির নামের ছোট্ট ছেলেটি কিছুই বুঝতে চাচ্ছিলো না। ‘আমি মায়ের কাছে যাবো’ বলে কেবল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো। রূপা তাকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করছিলো- ‘একটু পরই তোমার মা চলে আসবে বাবা’, কিন্তু সে কিছুতেই ভাত মুখে তুলল না। হুইল চেয়ারটা ধরে বারান্দায় নিয়ে গেল রূপা। বারান্দার ওপাশে খোলা মাঠ, সবুজ ঘাসে ছাওয়া। সেখানে তার বয়সী ছেলেরা খেলছে। আবির সেদিকে তাকিয়ে আরও অস্থির হয়ে উঠছে। ক্ষেপে গিয়ে ফুপুকে খামছি দিয়ে জখম করে দিল। পিছনে দাদী এসে দাঁড়ায়। ‘মা দেখো তো, বাবু কি করলো!’ রূপা মাকে দেখায় তার হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে। দাদী কিছুক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেয়। অনেকক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করার পর একদম চুপ করে যায় আবির। বারান্দার গ্রিলের ওপাশে খোলা আকাশ। নীল আকাশের বুকে মুক্ত পাখিরা উড়ে বেড়ায়, আবির চুপচাপ দেখে।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রাবু’র তন্দ্রালু ভাবটা ক্রমশ কেটে যাচ্ছিলো। একটা ঘোরের মধ্যে থেকেও ছেলের চেহারাটা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো কেবল। যে ছেলেকে মুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করতে পারে না, অথচ আজ দু’দিন ধরে তাকে ছেড়ে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে সে। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। রাবু টের পায়, ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়।
-আমার আবির কেমন আছে, মা?’
-ভাল আছে।
-ওর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে।
-ওকে নিয়ে তোর চিন্তা করা লাগবে না। ওর কাছে দাদী, ফুপু আছে।
-ও যা জিদ্দি! আমি ছাড়া কারো হাতে তো খায় না।
-তুই তো এখন হাসপাতালে। এখন তো ওকে অন্য কাউকে দেখতে হবে, নাকি? মা কিছুটা বিরক্ত হয়।
-তুমি ভুলে গেছো মা আমার আবির অটিস্টিক। সবাই ওকে ম্যানেজ করতে পারে না।
-আমি জানি, কিন্তু এখানে বসে তুই কি করতে পারবি?
রাবু চুপ করে থাকে। চোখে ভেসে ওঠে হুইল চেয়ারে বসা ছেলেটার অসহায় মুখের ছবি, যার কাছে মা-ই তার জগৎ। সব আবদার তার মায়ের কাছে। রাবু’র চোখের কোণে জল জমে। তার ছেলেটা এমন হল কেন? যেদিন ওর জন্ম হল কি ফুটফুটে ছিল দেখতে! কিন্তু যত দিন যেতে লাগলো ধীরে ধীরে পাল্টে গেল সবকিছু। একসময় হুইলচেয়ারই হয়ে উঠল ওর চিরস্থায়ী বসবাসের স্থান। তারপর কেটে গেল গোটা দশটি বছর। অনেকেই বিরক্ত হয় কিন্তু রাবু? ওর খুব কষ্ট হয়। ছেলেটার এই অসহাত্ব দেখে সহ্য করতে পারে না।

সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। দেশের নামকরা ডাক্তারের তত্বাবধানে ছিল রাবু। প্রতি মাসে নিয়মিত চেক-আপে কোন অসঙ্গতি ছিল না। কেবলমাত্র শেষ মুহূর্তে ডাক্তারের অবহেলায় তার ছেলেটার জীবন এলোমেলো হয়ে গেল। আর কয়েক ঘণ্টা আগে ডেলিভারিটা হলে হয়তো অন্যরকম হতে পারতো। কারো কিছু ক্ষতি হয়নি, কেবল রাবু’র জীবন থেকে আনন্দ-হাসি-খুশি মুছে গেল চিরতরে।
হাসিব আজ তিন বছর ধরে দেশের বাইরে, রাবুকে একাই সমলাতে হয় ওকে। ওর সবকিছুই রাবুকে করে দিতে হয়। আবিরের বয়সী ছেলেরা স্কুলে যায়, মাঠে খেলতে যায় আর আবির তখন মায়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে হুইলচেয়ারে বসে বসে সময় কাটায়। শোবার রুমের বারান্দা থেকে খেলার মাঠটা দেখা যায়। বিকাল হলেই বিভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়ের কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে মাঠ। তখন হুইল চেয়ারটা নিয়ে বারান্দায় বসিয়ে দিতে হয়। কিছুক্ষণ খেলা দেখে, তারপর অস্থির হয়ে ওঠে। কেমন যেন ছটফট করতে থাকে। রাবু নানাভাবে ছেলেকে বোঝাতে চেষ্টা করে। যখন কিছুতেই সামলানো যায় না তাকে তখন ধমক দেয়, তারপর নিজেই কাঁদে।
একটা ছোট্ট অপারেশন অপরিহার্য্য হয়ে উঠেছিলো রাবুর। অপারেশনের জন্য হাসপাতালে যাওয়ার সময় বাড়ির সবাই মিলে সান্ত্বনা দিচ্ছিল আবিরকে। ‘মা তোমার জন্য খেলনা কিনতে যাচ্ছে, ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে।’ সেই থেকে আবিরের মায়ের জন্য অপেক্ষা। মা আসলে তাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। বেড়াতে যাওয়া মানেই হুইল চেয়ারে করে সামনের ছোট্ট খোলা চত্ত্বরে কিছুক্ষণ সময় কাটানো। তাতেই খুশি সে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও ঘরের বাইরে তো যাওয়া হয়।
আজ তিনদিন ধরে মাকে দেখে না সে। তার মুখে হাসি নেই। গতকাল সন্ধ্যা থেকে সে একেবারেই চুপচাপ হয়ে গেছে। কাউকে জ্বালাতন করে না, চিৎকার চেঁচামেচি নেই; নিরবে বসে থাকে হুইল চেয়ারে। কেউ ডাকলে সাড়া দেয় না, কেবল তাকিয়ে থাকে। সে চোখে কোন অভিযোগ নেই, প্রত্যাশা নেই, আছে কেবল শূন্যতা।
তিনদিন পর আজ হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছে রাবু। তার আবিরের কাছে ফিরছে। নিজের সমস্ত ব্যথা-যন্ত্রণা ভুলে গেছে ছেলেকে কাছে পাবার আকাঙ্ক্ষায়। হাসপাতাল থেকে বের হতেই চোখে পড়ে- তপ্ত দুপুরের জ্বলন্ত সুর্যটা যেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। রাবু’র কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। মা তাকে ধরে ট্যাক্সিতে তোলে, লক্ষ করে তার অস্থিরতা। হাসে; তারপর মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে, ‘মা-রা এমনই, প্রতিটি মায়ের কাছে সন্তানের জন্য সবকিছু তুচ্ছ মনে হয়, হোক না সে প্রতিবন্ধী।’
বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে আবির। মুক্ত আকাশে পাখিদের ওড়াওড়ি, ছোট্ট মাঠে তার বয়সী ছেলেমেয়েদের ছুটোছুটি দেখার ফাঁকে চোখে পড়ে মাঠের পাশের রাস্তায় ট্যাক্সি থেকে নেমে একটি পরিচিত অবয়ব ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ওদের বাড়ির দিকে। আবিরের চোখ দু’টি চঞ্চল হয়ে ওঠে। আজ তিনদিন পর তার মুখে হাসি ফোটে। দাদীকে আঙুল দিয়ে দেখায়। দাদী তার সাথে সায় দেয়, মা এসেছে, এবার তুমি খুশি তো?
কিছুক্ষণ পরের দৃশ্যটি অন্যরকম। দরজা দিয়ে মাকে ঘরে ঢুকতে দেখে গত তিন দিনের জমানো অভিমান একীভূত হয়ে ঝড়ে রূপ নেয়। একটি অবুঝ বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী বালক তার একমাত্র অবলম্বন মায়ের উপর অভিমানের তীব্র প্রকাশ ঘটায়। তারপর একসময় বালির বাঁধের মত উবে যায় সব রাগ-অভিমান, মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়ে। আশ্রয় খোঁজে, ভালোবাসার আশ্রয়।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!