মুনার প্রতি আমার অনুভূতি এতো দ্রুত পারদের চাপের মতো উঠা নামা করবে ভাবি নি। এইতো সেদিন পরিচয় একটি সেমিনারে। দিন ব্যাপী সেমিনার বলে পাশাপাশি বসাতে বেশ কয়েকবার কথাবার্তা হয়েছে। আমাদের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় একটি মেয়ের পাশে বসলে অন্যরকম কিছু অনুভুতি কাজ করে প্রতিটি ছেলের। আমারও ব্যতিক্রম ছিল না। তাই বারবার প্যান্টের জিপার, ইন করা শার্ট, মাথার চুল চেক করছিলাম ঠিক আছে কি না। মেয়েদেরও এমনটিই কাজ করে-বারবার ওড়না ঠিক করা, চুল এবং চেহারা ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর রাখা আয়নায় চেক করা। মুনার ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনঃদৃশ্যায়ন। তার মশুরি কালারের ফতুয়া, জিন্সের প্যান্টের সাথে ম্যাচ করা ওড়না সে বারবার চেক করছিল। যদিও আমার চোখ অতটা দুষ্ট ছিল না। কিন্তু আমি আড়চোখে মুনার কর্মকাণ্ড খেয়াল করছিলাম। সেমিনারেও মাঝে মাঝে আমরা বিভিন্ন আলোচনায় অংশগ্রহণ করলাম। সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার সময় কি মনে করে নাম্বারটা নিলাম নিজেরটা তাকে দিলাম।
নিজের কাজের ব্যস্ততার জন্য মুনাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। একদিন রাতে হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। দেখি মুনার নাম্বার থেকে ফোন। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে অভিযোগের সুর। সেই যে গেলেন আরতো কোন খবর রাখলেন না। আমি ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে ভাবছিলাম অভিযোগের সুরে কথা বলার কি আছে! তার সঙ্গেতো আমার ফোন করার কোন অঙ্গীকার ছিল না। এমনতো কতজনেরই নাম্বার নেয়া হয়। যাই হোক তার কুশলাদি জিজ্ঞেস করছিলাম। মনের ভেতর একটা কৃত্রিম আগ্রহ তৈরি করলাম। সে যেটাই বলছে তাতে কিছুটা অবাক হওয়ার ভান করছিলাম। সে তার কক্সবাজারের ছয় মাসের চাকরীর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিল। তার বর্ণনা শুনতে শুনতে আমার ঘুম এসে যাচ্ছিল কিন্তু তার বর্ণনা শেষ হচ্ছিল না। একটি সুন্দরী মেয়ে ফোন করে কথা বলবে আর আমি এমন নির্লিপ্ত বিষয়টা মোটেই স্বাভাবিক না। এটা সে বুঝতে পারা মানে তার জন্য একটা অপমান। কিন্তু আমি অতোটা চালাক নই যে বিষয়টা গোপন রাখব। আমি শুধু হু হা করে যাচ্ছিলাম দেখে, সে প্রশ্ন করে বসল আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছি কি না!! আমি বেরসিকের মতো বলে দিলাম একটু ঘুম ঘুম ভাব আসছে। মুনা রাগ করলো কিনা জানি না কিন্তু ফোন রেখে দিল, আর আমার ঘুমটাও কেটে গেলো। নিজের এমন অপুরুষসূচক আচরণে নিজের প্রতি বিরক্ত লাগছে। আমিতো একটু আহ্লাদ দেখাতে পারতাম। আমিতো বলতে পারতাম ওমা কক্সবাজারের মতো সুন্দর জায়গায় আপনি ছয় মাস ছিলেন, নিশ্চয় অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি তুলেছেন! ইস আমি যদি যেতে পারতাম কি মজাই না হত।
রাতে ভালো ঘুম হল না। শুধু মুনার অভিমানী মুখটা কল্পনায় আসছে। ওতো আমার কেউ না, তার কথা আমি ভাবছি কেন? নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে আনার সবচেয়ে ভালো উপায় একটি নির্দিষ্ট মেয়েকে নিয়ে ভাবা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী সোমার কথা ভাবতে ভাবতে চারটা বছর গেলো। বিনিময়ে বন্ধুবান্ধবের টিটকিরি, ঠাট্টা, তামাশা ছাড়া কিছুই জুটেনি। সোমার স্বপ্ন সে ম্যাজিস্ট্রেট বিয়ে করবে, আমিতো ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম না তাই আমি কল্পনা ছাড়া তার খুব বেশি কাছে ঘেঁষতে পারি নি। ক্যাফেটেরিয়ায় একসাথে অনেকের সঙ্গে আড্ডা দিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। অথচ এসাইনমেন্টের কপি চাওয়ার আগেই তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি কতো। কারো জন্য কিছু করে তার খোটা দিতে নেই। ভালোবাসেনি বলে আমিও এসবের খোটা দিতে পারি নি। ভালবাসতে তার যথেষ্ট অনীহা থাকলেও সাহায্য নেয়ার ক্ষেত্রে ছিল পুরো বিপরীত। সবার কপালে আসলে সব কিছু সয় না!
আজ অফিসে আসার পর থেকে মুনার ফোনের কথা মনে পড়ছে। মনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দুটো সিগারেট খেলাম। সিগারেট খাওয়ার পর মনে হচ্ছে ফুসফুসে নিকোটিনের বদলে মুনা ঢুকে পড়েছে। প্রতিজ্ঞা করেছি কোনো মেয়েকে নিয়ে এ জীবনে আর ভাবব না। সে মতো চলছিলাম বেশ, কিন্তু কাল রাতে অযথাই মুনার ফোন। হয়তো মেয়েটা আমার আমার মতোই এমন, হয়তো মেয়েটা কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল। হাজার রকমের প্রশ্নে মাথা জ্যাম হয়ে আসছে। এটা খুবই খারাপ লক্ষন। সোমাকে যেদিন ক্লাসে প্রথম দেখি সেদিনও আমার এমনটি হয়েছিল। তারপর আর মুক্ত হতে পারি নি সোমা সমস্যা থেকে। হঠাত অফিসে আমার ডেস্কের সামনে বসে আছে আমার বসে’’র সুন্দরী পিএ প্রিয়াংকা । প্রিয়াংকা আমার বসের খুব প্রিয় পাত্রী। মাঝে মাঝে আমার ডেস্কে চকলেট রেখে যায়, জন্মদিন কিংবা ভ্যালেন্টাইন ডেতে ফুল কিংবা কার্ড। আমি বিষয়টাকে মোটেও জটিলভাবে দেখি না। মানুষের মাঝে এতোটুকু সামাজিকতা থাকা খুব দোষের কিছু না। প্রিয়াংকা হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। ভেবেছিলাম আজকে মনে হয় কোন বিশেষ দিবস, কিন্তু না খামটা খুলেই বুকটা কেমন হুহু করে উঠলো। আরে এতো বিয়ের কার্ড, আগামী শুক্রবার প্রিয়াংকার বিয়ে। এমন একটা ভালো খবরে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এটা কী এক ধরনের পরশ্রীকাতরতা না সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে হলে আমার অস্বস্তি বোধ হয়, ঠিক পার্থক্য করতে পারলাম না। মুনার জায়গায় এবার প্রিয়াংকা ঢুকে বসে আছে। অথচ দীর্ঘ পাঁচ বছরে আমি একবার তার দিকে ভালো করে তাকিয়েছি বলে মনে পড়ছে না। আজ কি হল জানি, তার সাথে এক কাপ কফি খেতে ইচ্ছে করছে ভীষণ।
ভনিতা না করেই প্রিয়াংকা কে বললাম ছুটির পর একটু সময় হবে? কোন কিছু না ভেবেই প্রিয়াংকা হ্যাঁসূচক জবাব দিল। ছুটির পর প্রিয়াংকা কে নিয়ে আলো আধারির একটি রেস্টুরেন্টে বসলাম। কফি খেতে খেতে বেহায়ার মতোই প্রশ্ন করে ফেললাম,
-বিয়ের জন্য কি খুব তাড়া ছিল?
– কেউ কি আমার জন্য অপেক্ষা করেছিল?
– এতো তাড়াতাড়ি সবকিছু হয়ে যাবে কেউ কি জানতো?
– বয়স যে অনেক হল তা কি গায়ে লিখে রাখতে হবে?
– কানে কানে বলে গেলেইতো হত। কানতো খাড়া ছিল।
– কারো মুখে কি স্কচ টেপ লাগানো ছিল?
– লজ্জা বলেত একটা বিষয় থাকে, মেয়েদেরতো একটু কম থাকে শুনেছি।
– তবে কি বিয়েটা ভেঙ্গে দিব?
ভালোই আলাপ চলছিল কিন্তু বিয়ে ভাঙার কথা বলাতে একটু ঘাবড়ে গেলাম। আমার প্রেম করার সামর্থ আছে কিন্তু তা একজনের বিয়ে ভেঙ্গে করতে হবে কেন? আমার নিস্তব্ধতা দেখে প্রিয়াংকা সরব হল। আরে সাহেব বিয়ের কার্ডটা আমার নয়, আমার বড় বোনের, উত্তেজনায় নামটা ভালোভাবে খেয়াল করেন নি। আমার মাথায় এবার সত্যি আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমি প্রিয়াংকাকে গুডবাই বলতে এসে এভাবে ওয়েলকাম জানিয়ে দিলাম! এভাবে নিজেকে কেন ফাঁসিয়ে দিলাম! এর থেকেতো মুনাই ভালো ছিল দূরে ছিল, কখন কি করব কোন খবর থাকতো না। এখন চোখের সামনে একজন প্রহরী নিজ থেকেই বেছে নিলাম। আমার এমন শীতলতা দেখে হঠাত করে প্রিয়াংকা বলে উঠলো, অনেক রাত হল, এবার উঠো, আমাকে বাসায় পৌঁছে দাও। আপনি থেকে আকস্মিক তুমি সম্বোধনও আমার কেমন অস্বস্তিকর লাগছে। আমি আসলে অনেক কিছুই খেয়াল করি না। আজকে যে প্রিয়াংকা কালো শাড়ি পড়ে এসেছিল আমি একটুও খেয়াল করি নি। বাসার গেটের সাথে যখন শাড়ির আচল জড়িয়ে গেলো তখনি বুঝলাম আজকে তাকে অপরূপা লাগছে। সকালবেলা মুনার বোঝা নিয়ে ঘুম থেকে উঠে সন্ধ্যায় প্রিয়াংকাকে বয়ে বাসায় ফিরে চলছি।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।