ছোট্ট একটা ভাতঘুম দিচ্ছিলাম দুপুরবেলায়। কলিংবেলের তীক্ষ্ন চিৎকারে তন্দ্রার দফারফা। এই অসময়ে কে এল রে বাবা? সুরভি তো রুটি-টুটি করতে আসে পাঁচটা নাগাদ, এখন তো সবে সওয়া তিনটে!
ঝিমঝিম চোখে দরজা খুলেছি, কোলাপসিবল গেটের ওপারে এক মহিলা। বয়স্কা। প্রায় বৃদ্ধাই বলা যায়, বছর ষাটেক তো হবেই। রোগাসোগা ছোটোখাটো চেহারা, পরনে তাঁতের শাড়ি, চোখে গোলাপি সেলুলয়েড ফ্রেমের চশমা, সিঁথিতে ডগডগে সিঁদুর। সস্তার ভ্যানিটিব্যাগ ঝুলছে কাঁধে। বেচতে এসেছে কিছু? নাকি সাহায্যপ্রার্থী? স্বামীর অসুখ, কিংবা মেয়ের বিয়ে…!
বেজার গলায় জিজ্ঞেস করলাম,— কী চাই?
হাতজোড় করে নমস্কার করল মহিলা,— আজ্ঞে আমার নাম মল্লিকা চক্রবর্তী। আমাকে মিতালিদি পাঠিয়েছেন।
—কী ব্যাপার বলুন তো?
—আপনি নাকি ম্যাসেজ করার লোক খুঁজছেন—
ও হ্যাঁ, মিতালিকে তো বলেছিলাম বটে। হিস্টেরেকটমির পর থেকে শরীরটা কেমন ভারী হয়ে যাচ্ছে, উপসর্গও দেখা দিয়েছে নানারকম। গা-হাত-পা ব্যথা, জয়েন্ট পেন, কোমরে যন্ত্রণা…। তাই একটা ম্যাশিওরের সন্ধানে ছিলাম, নিয়মিত ম্যাসাজ করালে যদি একটু আরাম হয়। মিতালি বেছে বেছে এই বুড়িটাকে পাঠাল?
ভুরু কুঁচকে বললাম,— কে করবে ম্যাসাজ? আপনি?
—হ্যাঁ দিদি। আমি তো এই কাজই করি।
—পারবেন?
—দেখুন না করিয়ে। আমার হাতের খুব সুনাম আছে। একবার যারা করেছে, তারা আর আমায় ছাড়তে চায় না।
তেমন একটা প্রতীতি জন্মাল না। তবে মিতালি পাঠিয়েছে, ফেরানোও তো যায় না, ভদ্রতা করে গেট খুলে দিলাম।
বললাম,— আসুন।
বেশ সপ্রতিভ ভঙ্গিতেই ভিতরে ঢুকল মহিলা। সোফায় নয়, বেঁটে টুলটায় বসেছে। পেশাদারি স্বরে জিজ্ঞেস করল,— কী দিয়ে করবেন? পাউডার? না তেল?
ম্যাসাজের আমি কিই বা বুঝি? বললাম,— কোনটা দিয়ে করলে ভালো হয়?
—সেটা আপনার ওপর। যদি শরীরটাকে খেলাতে চান, তাহলে পাউডারই যথেষ্ট। কিন্তু ব্যথা-বেদনা থাকলে তেলেই উপকার বেশি। তেলটা শরীরের ভিতর চলে যায় তো। চামড়াও মোলায়েম থাকে।
—তাহলে তেলই করুন। কোমরটা আমায় খুব ভোগাচ্ছে।
—শুধু কোমর কমাবেন?
—না না, গেটা বডি।
—কোমর ছাড়া আর কোথায় কোথায় ব্যথা আছে?
—গাঁটে গাঁটে সর্বাঙ্গে।
—দেহে তো দেখছি চর্বিও জমিয়েছেন বেশ। চশমার ফাঁক দিয়ে একটুক্ষণ আমায় নিরীক্ষণ করল মল্লিকা। প্রশ্ন করল,— অস্টো আরথাইটিস আছে? পন্ডেলাইটিস?
মজা লাগল। ভুলভাল উচ্চারণ করলেও অসুখগুলোর নাম জানে তো! পালটা প্রশ্ন হানলাম,
—কদ্দিন ধরে করছেন এইসব ম্যাসাজ-ট্যাসাজ?
—তা দিদি… হল গিয়ে প্রায় পনেরো ষোলো বছর। ব্যাগটাকে কাঁধ থেকে কোলে নিল মল্লিকা— ডাক্তার অনিল সিকদারের নাম শুনেছেন? পণ্ডিতিয়ায় যাঁর ফিজিয়োথেরাপির চেম্বার ছিল? উনিই আমায় স্বহস্তে শিখিয়েছিলেন।
—তাই নাকি?
—হ্যাঁ দিদি। ব্যাগের চেন খুলে ছোট্ট একটা ছবি বার করে দিল, মল্লিকা,— এই দেখুন, ইনিই আমার গুরু। আমার ভগবান। এঁর দয়াতেই আপনাদের উপকারে লাগতে পারছি।
পাসপোর্ট সাইজের ফোটোখানা হাতে নিয়ে দেখছিলাম। টাক মাথা, গোলগাল মুখ, এক মধ্যবয়সির ছবি। গলায় টাই। পুরোনো ফোটোগ্রাফ তেল-টেল মেখে আরও যেন হলদেটে মেরে গেছে।
ছবিটা ফেরত নিয়ে কপালে ঠেকাল মল্লিকা। যথাস্থানে রেখে দিয়ে বলল,— তিনি তো মানুষ ছিলেন না, তিনি ছিলেন সত্যিই দেবতা। যদ্দিন স্যার বেঁচে ছিলেন, ডেকে ডেকে পেশেন্ট দিয়েছেন আমাকে। কারোর কাছ থেকে একশো নিতাম, কারোর কাছে থেকে দুশো… কেউ দিতে পোতিবাদ করত না। তা বিধাতাঠাকুর তো ভালোমানুষদের বেশিদিন পিথিবিতে রাখেন না, তাই হয়তো কাছে টেনে নিলেন। দিব্যি সুস্থ মানুষ চেম্বার থেকে বাড়ি গেল, তারই কিনা রাত্তিরে সেবিব্বাল! ডাক্তারকে ফোন করারও সুযোগ দেয়নি, সঙ্গে সঙ্গে শেষ। কী বলব দিদি, সে কথা ভাবলে আমার…
সর্বনাশ, এখন গুরুকীর্তন চলবে নাকি? থামালাম তাড়াতাড়ি। বললা,— চলুন, শুরু করা যাক।
—হ্যাঁ, চলুন। আপনার তেল আছে তো?
—আছে।
আমার সঙ্গে শোওয়ার ঘরে এল মল্লিকা। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্র্যাকটিকাল ট্রেনিং নিতে তিরুবনন্তপুরম গিয়েছিল বুল্টু, সেখান থেকে একটা আয়ুর্বেদিক থেল এনেছিল আমার জন্য। মালিশের। সিলটা পর্যন্ত খোলা হয়নি। বোতালটা বের করে দিলাম মল্লিকাকে। উৎকট গন্ধ, তবে শোঁকার ধরন দেখে মনে হল বেশ পছন্দই হয়েছে মল্লিকার। আমাকে শুতে বলে ব্যানিটিব্যাগ থেকে গুটিয়ে মুটিয়ে রাখা তেল চিটচিটে নাইলনের শাড়ি বার করল একখানা। তাঁত খুলে সযত্নে পাট করে রেখে পরে নিল নাইলন শাড়ি। শুরু করল কাজ।
নাহ, মহিলা মালিশটা ভালোই জানে। অনর্থক চাপ দিচ্ছে না, দলাইমালাই করছে না, স্নায়ু বুঝে বুঝে, শিরা ধরে চমৎকার টান দিচ্ছে। নিপুণ অঙ্গুলি চালনার দৌলতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সত্যিই ঝরঝরে হয়ে গেল শরীর।
ঠিক করে ফেললাম মল্লিকাকে দিয়েই মালিশ করাব নিয়মিত। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন।
মাসখানেকের মধ্যে হাতেনাতে ফল পেতে লাগলাম মালিশের। গা-কোমরের ব্যথা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে, দিব্যি ঝরঝরে লাগে সারাদিন। পেটে হাত বুলিয়ে মনে হয় মেদও যেন ঝরেছে খানিকটা। ফ্ল্যাটবাড়ির একতলা-তিনতলা করতে এখন আর অসুবিধে হয় না তেমন, হাঁপাই না আগের মতোন। মল্লিকা আমায় কয়েকটা ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ শিখিয়ে দিয়েছে, সেগুলোও করছি রোজ।
মল্লিকাকে নিয়ে একটাই যা সমস্যা। বড্ড বেশি কথা বলে মল্লিকা। বকে বকে কানের পোকা বের করে দেয়। একদিকে আঙুল চলছে, অন্যদিকে মুখ।
—বুঝলে দিদি, গোবিন্দর বাপের খুব বড়ো কারবার ছিল। ধূপকাঠির। কারখানা তত বড়ো নয়, তবে লোক খাটত। চন্দন মগরা গোলাপ, কত গন্ধের ধূপ যে বানাত তোবিন্দর বাপ, শহরে বেচত না। বলত, শহরের জন্য তো বড়ো বড়ো কোম্পানি আছে, আমি সুবাস বিলোব গাঁয়ে-গঞ্জে। তা সে ধূপ চলতও বটে। বললে তুমি বিশ্বাস করবে না গো দিদি, গোস গোস মাল উঠে যেত। মহাজন এসে হাপিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে থাকত দোরগোড়ায়। তখন আমার গায়ে গয়না উঠেছে, দামি দামি শাড়ি হয়েছে…
সারা অঙ্গে মালিশের সুখ নিতে নিতে আমি হয়তো একটা বেফাঁস প্রশ্ন করে বসলাম,— তা সে ব্যাবসার হাল খারাপ হল কেন?
ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে কথা লুফে নিয়েছে মল্লিকা,— কপাল গো দিদি, কপাল। যে মহাজনদের পেট পালার ব্যবস্থা করে দিল আমার স্বামী, তারাই কিনা ঠকাতে শুরু করল ভালোমানুষটাকে। মাল নিয়ে টাকা দেয় না, পয়সা দেয় না, শুধু ঘোরায়। সেও সাদা মনের মানুষ, গিয়ে জোরাজুরি করতে পারে না। দেখতে দেখতে তরুণী ডুবল। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দিল এক কর্মচারী। গোবিন্দর বাপ তাকে ছেলের মতো দেখত। সেই কিনা পেটি পেটি মাল চুরি করে হাওয়া। মানুষটার মনের অবস্থা যে তখন কী! শোকে-তাপে রোগে পড়ে গেল। ছ-ছমাস বিছানায় শয্যাশায়ী। এদিকে ঘরে তখন আমার তিন তিনটে কচি ছেলে, গোবিন্দর তখনও গোঁফের রেখা ওঠেনি… তাদের মুখে অন্ন জোগাতে আমাকেই তখন নামতে হল আয়ার কাজে। পেট কী লজ্জা-ঘেন্না মানবে, বলো দিদি? অথথোপেটিক হসপিটালে চাকরি নিলাম… দিনের পর দিন নাইট ডিউটি। বামুনের ঘরের মেয়ে হয়ে অজাত-কুজাতের গু-মুত ঘাঁটছি, তাদের সেবা করছি…। ঘরে ফিরলে গোবিন্দর বাপা তো হাউমাউ কান্না জুড়ত, তোমার কষ্ট আমি আর চোখে দেখতে পারি না মণি।…
হ্যাঁ গো দিদি, সে আমায় মণি বলে ডাকে। আমার ডাকনাম তো বুঁচি, ও নাম তার পছন্দ নয়।… তা আমি বলেছি, মন খারাপ কোরো না গো, জীবনে তো জোয়ার-ভাটা আছেই। জোয়ারে টাকা এসেছিল, ভাটির টানে চলে গেছে। কিন্তু তলার মাটিটুকু তো আছে। আর তোমার সেই মাটি তো আমিই, নয় কী? আত্মীয় বন্ধুরা পাশে নেই বলেও দুঃখ কোরো না গো, জানালা খোলা পেলে সুখের পাখিরা সব উড়ে যায়।… ঠিক বলিনি, বলো দিদি?
আমার মতামতের অবশ্য ধার ধারে না মল্লিকা ঠাকরুণ। মালাইচাকিতে কায়দা করে হাত ঘোরাতে ঘোরাতে বলে চলে, গোবিন্দর বাপের ধাতটা কিন্তু একদমই আলাদা গো দিদি। অন্য মানুষ হলে অত বড়ো ব্যামোর পর আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত না। সে কিন্তু দেখিয়ে দিল। শরীরে একটু বল ফিরে পেতেই ধার-কর্জ করে খুলল একটা রোলের দোকান। ময়েম দিয়ে কী সুন্দর পরোটা বানাত গো! আমার স্বামীর হাতের শিককাবাব যে খেয়েছে, সে মিত্যু অব্দি ভুলবে না। কোত্থেকে যে শিখে ফেলল ওসব।… ভালো জিনিসের তো মার নেই, ক-টা মাস যেতে না যেতে জমে গেল দোকান। খদ্দেররা দাঁড়িয়ে থাকে লাইন দিয়ে। কিন্তু ওই যে বললম… কপাল। সাদা মনের মানুষের পায়ে পায়ে বিপদ !… পাশের রোলের দোকানখানা ফেল পড়ার উপোক্কম হয়েছিল। সেই লোকটা পায়ে পা বাধিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিল গো। কয়েকটা মোদো মাতালকে লেলিয়ে দিল একদিন, তারা হল্লাগুল্লা কর ভেঙে দিয়ে গেল গোবিন্দর বাপের দোকান। আবার নৌকাডুবি।… ততেও মানুষটা নুয়ে পড়েনি, এখন পুরি তরকারি বানিয়ে এক এক ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে বসে বেচে। খুব বিক্রি, বাবুরা সব চেটেপুটে খায়। ও অবশ্য খুব একটা বেশি মাল বানায় নাকো। ওই এক ডেকচি সবচি, আশি একশোটা পুরি, ব্যস। বলে, এতেই তো আমাদের বেশ চলে যাচ্ছে, লাভ বাড়িয়ে ফের কেন মানুষের বুকে হিংসে ডেকে আনি মণি!… শুনছো গো, ও দিদি? নাকি ঘুমিয়ে পড়লে?
মাথা খারাপ! ওই ধারাবাহিক কাহিনির স্রোতে ঘুমোনোর জো আছে? তার উপর সে কাহিনি যদি হয় গোবিন্দর বাপের মতো এক লড়াকু মানুষের! যে কখনও হারতে শেখেনি।
শুধু স্বামীই নয়, পরিবারের অন্য সদস্যদের গল্প শোনাতেও ছাড়ে না মল্লিকা। ছেলেদের গল্প বলতে গিয়ে তো বিহ্বল হয়ে পড়ে আবেগে।… কী বলব গো দিদি, জননী হয়ে বড়ো মুখ করে বলতে নেই, আমার তিন ছেলেই মা মা করে আঁকুপাঁকু করে সারাক্ষণ। এখনও। জানো তো, গোবিন্দর লেখাপড়ায় খুব মাথা ছিল, ইচ্ছে করলেই তিন চারটে পাশ দিতে পারত। শুধু মায়ের খাটুনি চোখে দেখতে পারে না বলে পানি ঢেলে দিল পড়াশোনায়। বলল, এবিসিডি অআকখ তো তো শিখে গেছি মা, যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগও করতে পারি, আর বেশি দিগগজ হয়ে আমার কী হবে! তার চেয়ে দুটো রোজগার করে যদি তোমার হাতে দিতে পারি…। পনেরো পুরতে না পুরতে ছেলে আমার নামল পাঁপড়ের ব্যবসায়। বড়োবাজার থেকে কাঁচা পাঁপড় কিনে এনে বালিগঞ্জ স্টেশনে বসে ভাজত আর বেচত। রমরমিয়ে চলত তো দিদি। ওই বয়সে, দিনে বিশ টাকা তিরিশ টাকা করে কামাত রোজ। তা সে ব্যবসা অবশ্য চালাল না শেষ পর্যন্ত। বাবার হাল দেখে দেখে হৃদয়ে ঘেন্না ধরে গেছিল। বলত, ব্যবসা নাকি আমাদের চক্কোত্তি বংশের কপালে নেই, তার চেয়ে পুরুতগিরি লাইনটাই ধরি না কেন মা! নিজের কাকা বেহালায় পুরতগিরি করে, তার সঙ্গে লেগে থেকে শিখে নিল পুজোআচ্চার কাজ। বিয়ে, শ্রাদ্য অন্নপাশন তো আছেই, এছাড়া দুগ্গোপুজো, লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতীপুজো, শনি সত্যনারারায়ণ, কিছু না কিছু তো লেগেই থাকে বারো মাস। চালটা কলাটা মিষ্টিটাও নিত্যি দিন আসে ঘরে। এই তো গত শ্রাবণের আগের শ্রাবণে বিয়ে দিলাম ছেলের। ব্যানার্জিঘরের মেয়ে। আমার বাপের বাড়িও ব্যানার্জি কিনা, তাই বেছে বেছে শাণ্ডিল্য মেয়েই আনলাম। ঠকিনি গো দিদি, বউ আমার মতোই খাটিয়ে। এই যে আমি বেরিয়ে এসেছি কাজে, বউ আমার রেঁধেবেড়ে থালা সাজিয়ে বসে থাকবে। গেলেই বলবে, মা মাগো, তুমি আগে চাট্টি মুখে দাও, তারপর অন্য কথা। গোবিন্দর বাপ তো মা লক্ষ্মী বলতে অজ্ঞান। বলে, ভালো ছেলে গভভেই আসে মণি, ভালো বউ আসে ভাগ্যে। দেওর দুটোকেও বউমা একেবারে যাদু করে রেখেছে। আমার গোলাপ নিতাই, মাকে যদি ষোলো আনা মানে, তা বউদিকে আটআনা। না না, বারো আনা।
এরপর গোপাল, নিতাই-এর উপাখ্যান বিস্তারিত হতে থাকে ক্রমশ। গোপাল মায়ের কতো ভক্ত, এত ধাড়ি ছেলে এখনও কেমন মায়ের কোল ঘেঁষে বসে…। পিজবোর্ড কারখানায় ম্যানেজারি করছে গোপাল, মাইনে পেয়ে পাই পয়াস পর্যন্ত গুনে গেঁথে তুলে দেয় মল্লিকার হাতে। যে ক…টা টাকা হাত খরচা দেয় মা, ছেলে তাতেই খুশি। জানে তো, কী জন্য মা টাকা সরিয়ে রাখছে! বিয়ে দিতে হবে ছেলের, একফালি জমি কিনতে হবে।… আর মেজোর টাকায় যদি জমি হয়, তো ছোটো দেবে বাড়ি তোলার খরচ। ব্যাংকে থেকে লোন নিয়ে ট্যাক্সি কিনেছে নিতাই, গাড়ি খাটিয়ে সেও এখন রোজগারপাতি মন্দ করছে না। তিন ছেলেই রোজ কোরাসে বায়না জোড়ে, আমাদের মানুষ করতে গিয়ে তুমি তো মুখে রক্ত তুললে মা, এবার জিরোও। বুড়ো বয়সে ঠ্যাং-এর উপর ঠ্যাং তুলে টুকুন সুখ করো। কিন্তু চাইলেই কী মল্লিকা তা পারে আর? তার গুরু যে মরার আগে পইপই করে বলে গেছে, যতদিন না গতরে জং ধরে, শেখা বিদ্যেটাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের সেবা কোরো মল্লিকা। জেনো তাহলেই তোমার অক্ষয় স্বর্গ বাঁধা।
প্রথম প্রথম মল্লিকা জীবনচরিত শুনতে মজাই লাগত আমার। কিন্তু এক কথা কাঁহাতাক ভালো লাগে? তবু মল্লিকা শোনাবেই। নিজের সুখের গল্প শোনানো যেন মল্লিকার কাছে একটা নেশা। অনেকটা ম্যাসাজ নিয়ে আরাম পাওয়ার মতো।
এর মধ্যে বুল্টু এল হস্টেল থেকে। সেমিস্টার পরীক্ষা হয়ে গেছে, ছুটি মিলেছে দিন চারেকের। দুপুরে মল্লিকা দর্শন করেই সে আমার পিছনে লেগে গেল,— কী মা, শেষে একটা কেঠো বুড়িকে দিয়ে বডি ম্যাসাজ করাচ্ছ?
ভাস্কর, ছেলেকে আরও উসকে দিল,— ওই বুড়ি তোর মাকে তো মেসমেরাইজ করে রেখেছে রে।
—তাই নাকি?
—তা হলে আর বলছি কী। মালিশের সঙ্গে বুড়ি ফ্রিতে একটা মেগা সিরিয়ালও দিচ্ছে।
—শুধু মেগা নয়, বলো মেগার মেগা। আমিও হেসে ফেললাম,— মেগাতেও গল্প অত আটকে থাকে না। এক আধটা অন্তত বাইরের সিন ঢুকে পড়ে হঠাৎ হঠাৎ। কিন্তু মল্লিকা দেবীর স্টোরির নো নড়নচড়ন। নিজের স্বামী, নিজের ছেলে, নিজের ঘরসংসার। প্রেজেন্ট আছে, ফ্ল্যাশব্যাক আছে…
চার্জ কত নিচ্ছে? বুল্টু চোখ নাচাল।
—প্রথম এক-দুদিন সত্তর করে দিয়েছিলাম। এখন পার সিটিং ষাট। সবই ঠিক আছে, শুধু বুড়ি যদি একটু বকবকটা কম করত।
—না শুনলেই পারো। কানে তুলো গুঁজে রেখো। বাহ, বুদ্ধিটা তো মন্দ নয়। কানে তুলো দিয়ে দিব্যি তো ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিতে পারি। বুড়িও রেকর্ড চালু রাখুক আমিও স্বস্তি পাই।
পুজোতে দিনকয়েকের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা। পাহাড়ে। দার্জিলিং, গ্যাংটক, পেলিং। মল্লিকারও ছুটি ছিল ক’দিন। লক্ষ্মীপুজোর পরের সপ্তাহ থেকে আসার কথা ছিল ফের। কালীপুজো পেরিয়ে গেল, ভাইফোঁটা গেল, তবু তার দর্শন নেই।
একটু ভাবনাতেই পড়ে গেলাম। অসুখবিসুখ করল নাকি? বুড়ি তো কামাই করে না বড়ো একটা! এবছর পুজো দেরিতে ছিল, ঠাণ্ডা পড়ে গেছে অল্প, চামড়াতে টান ধরছে, শরীরেও একটা ম্যাসম্যাজে ভাব, এই সময়েই ডুব মারল মল্লিকা।
আরও দু-একদিন দেখে মিতালিকে ফোন করলাম,— অ্যাই, কী হয়েছে রে বুড়ির? আমার বাড়িতে আসছে না যে বড়ো?
মিতালিকেও ঈষৎ ভাবিত মনে হল,— জানি না রে। এখানেও তো দেখা নেই?
—কাকে দিয়ে খোঁজ নেব ? ওকে তো জুটিয়ে দিয়েছিল আমার রান্নার মেয়েটা। সে তো পুজোর শাড়ি নিয়েই ধাঁ।
—মহা ফ্যাসাদ হল। বুড়ি যেন কসবার কোথায় থাকে না।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, রথতলায়। তোর বাড়ির কাছেই। সুদক্ষিণা নামে একটা হাউজিং কমপ্লেক্সে আছে, তার পেছনটায় !… খুঁজতে যাবি নাকি ওকে?
—ভাবছি।… দেখি আর দু-একদিন।
—খোঁজ পেলে আমায় একটা রিং করিস। বলিস, আমিও কিন্তু ওর উপর খুব চটে আছি। এরকম করলে ভবিষ্যতে আর কোনো নতুন ক্লায়েন্ট দেব না।
দু-তিন দিন নয়, আরও একটা সপ্তাহ প্রতীক্ষা করলাম মল্লিকার। উঁহু, টিকিটির দেখা নেই।
খানিকটা দোনামোনা করে বেরিয়ে পড়লাম এক বিকেলে। রিকশা নিয়ে রথতলা। সুদক্ষিণা চেনাই ছিল, খুঁজে খুঁজে বার করে ফেলেছি মল্লিকা দেবীর ডেরা। মালিশের কাজ করে বলেই বোধহয় পাড়ার লোক চেনে মল্লিকাকে, দেখিয়ে দিল এক কথায়।
বারো ঘর এক উঠোনের বাড়ি। টানা লম্বা বারান্দায় সার সার ঘর। মাথায় কালচে টিনের চাল, দেওয়াল টেওয়ালগুলো মোটেই পদের নয়, সর্বাঙ্গে কেমন একটা বস্তি বস্তি ভাব। এক পাল বাচ্চা খেলছে উঠোনে, জোর ক্যালর ব্যালর চলছে। বারান্দাতেও বিচ্ছিরি হল্লাগুল্লা।
এক মাঝবয়সি মহিলা অশ্লীলতম ভাষায় গাল পাড়ছে কোনো এক অদৃশ্য প্রতিপক্ষকে, তাকে ঘিরে মজা দেখছে জনা পাঁচ সাত মেয়ে বউ।
থতমত খেয়ে গেলাম। এমন একটা পরিবেশে থাকে মল্লিকা? কথাবার্তা শুনে তো অন্য রকমটাই মনে হয়েছিল।
আমায় উঠোনে দেখে চিৎকার থমকেছে হঠাৎ। খিস্তির ফোয়ারা ছোটানো মধ্যবয়সি বউটাই এগিয়ে এল,— কাকে চাই?
আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম,— মল্লিকা চক্রবর্তী এখানে থাকে?
—মল্লিকা? চোখ পিটপিট করল মহিলা,— মালিশদিদি? সে তো এখন নেই। হাসপাতালে।
—কেন? কী হয়েছে তার?
—ওর আবার কী হবে, মরতে বসেছে তো ওর বেআক্কেলে বর। আর ওই লোকের জন্য মালিশদিদি হাসপাতালে হত্যে দিয়ে আছে।
—ওমা, সে কী? মল্লিকাদির স্বামী বুঝি খুব অসুস্থ?
—ডেকে আনা অসুখ। মদ খেয়ে খেয়ে লিবার একেবারে ঝাঁজরা করে ফেলেছে গা। পুজোর সময় থেকেই বাড়াবাড়ি চলছিল, তাও ঘরে রেখেই চিকিচ্ছে করছিল মালিশদিদি। গতিক সুবিধের নয় দেখে কালীপুজোর আগের দিন হাাসপাতালে ভরতি করল। এখনও যমে-মানুষে টানাটানি চলছে।
আমি হতবাক। আরও কয়েকটা বউ ঘিরে ফেলেছে আমাকে। নানান বয়সের। ঘুরে ঘুরে দেখছি তাদের।
অল্পবয়সি একটি বউ বলে উঠল,— ঠিক হয়েছে। বুড়োর উচিত শাস্তি হয়েছে। বামুন হয়ে চাঁড়ালদের মতো চুল্লু গিলবে… ধম্মে সইবে কেন? বুড়ো এখন ভালোয় ভালোয় মরলে হয়, মাসি ওই মড়াখেকোর হাত থেকে বাঁচে। এই বয়সেও একগলা গিলে এসে কী মারটাই না মারে মাসিকে। বউ সারাজীবন খেটেখুটে এনে খাওয়াল, আর উনি তারই বুকে বসে ফুর্তি করে গেলেন…?
অস্ফুটে বললাম,— উনি কী সব করতেন না? কীসব পুরিটুরি বেচতেন…?
—গোড়ার মাথা। বেচত ঘুগনি। তাও ওই মাসিই কাজে বেরোনোর আগে বানিয়ে দিয়ে যেত। আর হাঁড়ি ভরতি ঘুগনির টাকা উনি চুল্লুর ঠেকে উপুড় করে আসতেন। পাজির পা ঝাড়া আর কাকে বলে!
—যা বলেছ। সারাটা জীবন মল্লিকাদিদিকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিলে গো লোকটা। ধূপের কারখানায় লেবার খাটত, চুরি করে ধরা পড়ে চাকরি খোওয়াল। মল্লিকাদিদি ধরে করে হালতু মোড়ে রোল মোগলাই-এর দোকানে কাজ জুটিয়ে দিল, চুল্লু গিলে নিজের মালিকের দোকানই ভাঙচুর করল শয়তানটা ভাগ্যিস মল্লিকাদিদি মালিশটা জানত, তাই বুড়ো এ জীবনে তরে গেল।
—মালিশের কাজ তো হালে শিখেছে মল্লিকাদিদি। দশ পনেরো বছর হবে। আগে আয়ার কাজে কী খাটনিটাই না যেত দিদির। দেখেছি তো, দিনের পর দিন ডবল ডিউটি করছে; রাতের পর রাত বাড়ি ফিরতে পারে না…। ধুঁকছে। ঘরের অতগুলো প্রাণীর মুখে একা অন্ন জোগানো…
—তা ছেলে তিনটেও তো কম বেইমান নয়। যে মা অত কষ্ট করে বড়ো করল, তার মুখেও কেমন লাথি মেরে দিল। ডানা গজাতে না গজাতে যে যার মতো উড়ছে বাবুরা।
কী কা-, এদের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই তো বুঝছি না আমি! মস্তিষ্কে গেঁথে যাওয়া ছবিটা কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে!
ভ্যাবচ্যাকা খাওয়া মুখে বললাম,— ছেলো মায়ের সঙ্গে থাকে না?
—দূর দূর, যত্ত সব কুলাঙ্গার। মা ইস্কুলে ভরতি করে দিল, যে যার মতো পড়া ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় খেলে বেড়াচ্ছে। গোবিন্দটা তো মার আঁচল থেকে পয়সা ঝেড়ে সিনেমা হলে লাইন লাগাত, ন্যাড়ার বাবা কত দিন স্বচক্ষে দেখেছে। শেষে মা শিবমন্দিরের ঠাকুরমশায়ের কাছে পাঠিয়ে পুরুতগিরি শিখিয়ে…
—ওই বড়টাই সব চেয়ে বজ্জাত। হাড়হারামি। ভাব করে এমন একখানা বউ আনল… উঠতে বসতে ওই ঠাণ্ডা শাশুড়ির গালে ঠোনা মারে! খেতে দিয়েও ভারতের থালা মুখের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যেত। আমরা আশপাশে না থাকলে ওই বউ-এর হাতেও পিটান খাওয়া কপালে লেখা ছিল মল্লিকাদির। গোবিন্দটা বউ নিয়ে ভেন্ন হতে বেচারি প্রাণে বেঁচেছে। স্বামীর হাতের দু-চার ঘা তাও সহ্য হয়, ছেলের বউ যদি…
—বাকি ব্যাটা দুটোও কি এমন দেবতা দিদি? এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায়। এ পাতা খেয়ে পড়ে থাকে, তো ও সাট্টা খেলে পয়সা ওড়ায়। দ্যাখো না, গোপালের বাক্স কারখানার চাকরিটা এবার গেল বলে! কোন মালিক পয়সা দিয়ে পাতাখোর পুষবে?
—ছোটোটার তবু মায়াদয়া আছে মনে। ট্যাক্সি চালিয়ে যা পায়, তার থেকে দু-চার পয়সা তাও ঠেকায় মাকে।
—তার চেয়ে পাঁচগুণ বেরও করে নেয় গো। এই তো সেদিন… বাপের অসুখে মার কী জেরবার দশা… তার মধ্যে টাকা চেয়ে পায়নি বলে মা-র হাত মুচড়ে ধরেছিল নিতাই। ভাবো, কী পাষ- সন্তান!
নাহ, এবার ভোঁ ভোঁ করতে শুরু করেছে কান মাথা। কখন যে সরে এসেছি জটলা থেকে, রিকশায় উঠে বসেছি, ফিরে এসেছি বাড়ি, নিজেও যেন জানি না। ঘোর ঘোর লাগছিল।
কী নিপুণ অভিনয় করতে পারে মল্লিকা! কেমন চমৎকার সাজিয়ে গুছিয়ে একই মিথ্যে বলে যেতে পারে দিনের পর দিন। দৈন্য ঢাকতে চায়? লুকিয়ে রাখতে চায় নিজের অসহায়তা?
কিন্তু কেন? সত্যি বললেই তো বরং মায়া বেশি বাড়ে মানুষের। আশ্চর্য মহিলা তো!
মল্লিকা এল প্রায় মাস দেড়েক পর।
শীতের দুপুরে দিব্যি কম্বলে ঢুকে ছিলাম, কলিংবেলের আওয়াজে উষ্ণ আমেজটুকু খানখান। মল্লিকাকে দেখেই ছ্যাঁৎ করে উঠছে বুকটা। আরও শীর্ণ হলে গেছে মল্লিকা, আরও বুড়িয়েছে, তবে সে কারণে নয়। সাদা খোলের শাড়ির পরে আছে মল্লিকা, সিঁথিতে ডগডগে সিঁদুরটা নেই।
কিছু বলার আগে মল্লিকারই স্বর বেজে উঠল। ঠোঁটে এক চিলতে মস্নান হাসি ফুটিয়ে বলল,— উনি হঠাৎ চলে গেলেন গো দিদি।
মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,— তাই নাকি?
—হ্যাঁ গো দিদি। ঘরে ঢুকে বেঁটে টুলটায় বসল মল্লিকা। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল, — পুজোর সময়ে উনি বললেন, তোমায় নিয়ে কখনও তো কোনো তীর্থে যাইনি মণি, চলো দুজনে একবার কেদার-বদরি ঘুরে আসি। ছেলেরাও বলল, যাও না মা, তুমি তো চিরকাল ঘরেই বন্দি হয়ে রইলে, স্বচক্ষে একবার বরফে ঢাকা পাহাড় দেখে এসে।
শীতের দুপুরে দিব্যি কম্বলে ঢুকে ছিলাম, কলিংবেলের আওয়াজে উষ্ণ আমেজটুকু খানখান। মল্লিকাকে দেখেই ছ্যাঁৎ করে উঠছে বুকটা। আরও শীর্ণ হলে গেছে মল্লিকা, আরও বুড়িয়েছে, তবে সে কারণে নয়। সাদা খোলের শাড়ির পরে আছে মল্লিকা, সিঁথিতে ডগডগে সিঁদুরটা নেই।
কিছু বলার আগে মল্লিকারই স্বর বেজে উঠল। ঠোঁটে এক চিলতে মস্নান হাসি ফুটিয়ে বলল,— উনি হঠাৎ চলে গেলেন গো দিদি।
মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,— তাই নাকি?
—হ্যাঁ গো দিদি। ঘরে ঢুকে বেঁটে টুলটায় বসল মল্লিকা। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল, — পুজোর সময়ে উনি বললেন, তোমায় নিয়ে কখনও তো কোনো তীর্থে যাইনি মণি, চলো দুজনে একবার কেদার-বদরি ঘুরে আসি। ছেলেরাও বলল, যাও না মা, তুমি তো চিরকাল ঘরেই বন্দি হয়ে রইলে, স্বচক্ষে একবার বরফে ঢাকা পাহাড় দেখে এসে।
ফের বলে ফেললাম,— তারপর?
—সক্কলের পীড়াপীড়িতে না করতে পারলাম না। বউমা নিজের হাতে বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে দিল, খাবার ভরে দিল টিফিন কেরিয়ারে… আমরাও বুড়োবুড়ি চড়ে বসলাম হরিদ্বারের গাড়িতে। সে যে কত দূর, কত দূর… রাস্তা যেন আর ফুরোয় না। পথের দু-ধারে কী শোভা! পাহাড় জঙ্গল নদী… নয়ন যেন জুড়িয়ে গেল। তার হরিদ্বারে পেঁৗছেও দিব্যি ছিল গোবিন্দর বাপ। দুজনে গঙ্গায় স্নান করলাম, মন্দিরে পুজো দিলাম, সন্ধ্যারতি দেখলাম, প্রদীপ ভাসালাম… তারপর বাসে করে চললাম বদরিনাথের পথে। চারদিকে পাহাড় পাহাড় পাহাড়-বরফ বরফ বরফ-মনে হচ্ছে দুজনে পাশাপাশি স্বর্গের পথে চলেছি। যেতে যেতে… যেতে যেতে… কী যেন জায়গাটার নাম… হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেবপ্রয়াগ… কী যেন একটা নদী আছে সেখানে…হ্যাঁ, হ্যাঁ, অলকানন্দা… স্বর্গের নদী…। শীতল ধারার পাশে দু-জনে মুখোমুখি বসেছি… হঠাৎ বুকে ব্যথা উঠল গোবিন্দর বাপের। একবার শুধু আহ করলে, পরক্ষণে আমার কোলে মাথা রেখে শেষ। পুণ্যবান মানুষ তো, যাওয়ার আগে এতটুকু কষ্ট পেলেন না। ওই অলকানন্দার পাড়েই ওনাকে…। ছেলেরা তো ফেরার পর থেকে হাউহাউ করে কাঁদছে। আমি কত করে বলছি ওরে, তোদের বাবার বড়ো সাধ ছিল দেবস্থানে দেহ রাখবে…।… এভাবে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার সৌভাগ্য কি বেশি লোকের হয়… বলো দিদি?
আমার আর স্বর ফুটছিল না। কীসের যেন একটা ডেলা আটকে গেছে গলায়। মিথ্যে নয়, মিথ্যে নয়, মোটেই অভিনয় করছে না মল্লিকা। করেওনি কোনোদিন।
শব্দমুক্তোয় স্বপ্নের মালা গাঁথছে মল্লিকা। হ্যাঁ, স্বপ্ন। যে স্বপ্নগুলোকে নিয়ে মল্লিকারা বেঁচে থাকে আজীবন।