আমরা অনেক বন্ধু সে দিন আর এক বন্ধুর বাড়িতে জড়ো হয়েছিলাম। গেট-টুগেদার। কারণ? তেমন কিছু নয়, এমনি। হরলিকসের বিজ্ঞাপনের একটি বাচ্চা মেয়ে বলত না? আমি তো এমনি এমনি খাই। তেমনি আমাদের এমনি এমনি গেট-টুগেদার। জন্মদিন-টিন অনেক হল। এখন জন্মদিন এলেই মৃত্যু-দিনের কথা মনে পড়ে যায়। নিছক আনন্দের জন্য মেলাটাই সত্যিকারের আনন্দ-মেলা। নির্ভার, নির্দায়, নিরঞ্জন।
তা আমরা জনা কুড়ি তো হবেই— ভারতী, শ্বেতা, বনানী, দূর্বা, শমিতা, অজানা, মৌ, শর্বরী, ঈপ্সা, সুলতা, ঝিলম, ভাস্বতী, রোহিণী, জয়ী, আয়েষা, সুমন, সুছন্দা, ধৃতি, পূজা। এতগুলো নাম লিখতে হল, আপনাদের পড়তেও হবে। তা হোক, আমরা শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম মুখস্থ করা জাতি, আমাদের অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। গিয়েছিলাম ভারতীর বাড়িতে।
বাইপাসের ধারে বাড়ি। বিরাট একটা কমপ্লেক্সের সাততলা। দফায় দফায় যাচ্ছি। আজকে এদের লিফটের দরুন কমন ইলেকট্রিক বিলটা চড় চড় করে উঠবে। কে জানে ভারতীর কাছে ফিফটি পার্সেন্ট চাইবে কি না। আমাদের কমপ্লেক্সে তো চায়। আর এন এ-র বাড়িতে প্রচুর গেস্ট আসে। ওঁর নাকি ‘কমন’ বিলটার অন্তত থার্টি পার্সেন্ট দেওয়া উচিত। পি চৌধুরী বললেন— ‘আমি তো দেবই না নইলে এর একটা বিহিত করা দরকার।’ উত্তেজিত হয়ে আর এন বললেন— ‘আরে দুর মশাই আপনার গেস্টের দরকার কী! বাড়িতেই তো সাত জন মেম্বার। পাম্পের বিলটাও তা হলে আপনার থার্টি পার্সেন্ট হয়ে যাক।’ এরই মধ্যে আমি মহিলা সেক্রেটারি ক্ষীণকণ্ঠে বলতে থাকি— ‘চৌধুরী সাহেব চুপ করুন প্লিজ, মিঃ আঢ্য প্লিজ আমাকে কথা বলতে দিন।’ সাহেব বলাতে চৌধুরী একটু প্রশমিত হলেন, মিঃ আঢ্যকে যে চৌধুরীর মতো আড্ডিবাবু বললাম না তাতেও আর এন অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ আঢ্য একটু আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন। এই সব মাল্টি-স্টোরিড সমস্যার খুঁটিনাটি আমি হাড়ে হাড়ে জানি। যাক গে যাক, ভারতীরটা ভারতী বুঝবে এখন। তাই বলে তো আর সাত তলায় ঢিকিস ঢিকিস করে উঠতে পারি না!
অজানা, শমিতা আর ঈপ্সা সমেত আমিই আগে পৌঁছোই। দারুণ বাড়ি সাজিয়েছে ভারতী। পর্দা পাল্টে সব ঝা-চকচক। সোফার কুশনে হায়দরাবাদি পুঁতি-টুঁতির জমকালো কাজ। প্রচুর দেয়াল-সজ্জা— সব ঝকঝক করছে। বারান্দায়, ফ্ল্যাটে ঢোকবার মুখে অজস্র গাছ লতাপাতা। লাল কার্পেটের ওপর অপেক্ষাকৃত ছোটরা বসবে। আমাদের জন্যে নিশ্চয়ই সোফা, কৌচ, চেয়ার। দেখতে দেখতে মনটা খারাপ হয়ে যায়— আমিও গাছ রাখি— হাউস প্লান্ট যাকে বলে। এত বিদ্ঘুটে, যে ঝপ করে শুকিয়ে যায়। ফুলগাছ ভালবাসি— রাখার উপায় নেই। মালি, মানে গড়িয়াহাটের ফুলগাছ দোকানের সেয়ানা মালি, যার মাস মাইনেতে কাজ করার মতলব, সে ব্যাটা বলে— ‘বারান্দায় কাপড় শুকুত দিলে ফুলগাছ বাঁচবে না দিদি, যতই করুন আর ততই করুন। তার চেয়ে এই পাতাবাহার, মনি প্লান্ট, পাম-টামই ভাল।’ হাজার হাজার টাকা দিয়ে পর্দা করিয়েছি। কিন্তু সবসুদ্ধ ঘরখানা ম্যাড়ম্যাড় করে। গোমড়ামুখো, মুখপোড়া ঘর। ধ্যাত্তেরি!
যাক গে। এ প্রবলেম তো আমার সব ব্যাপারেই। ভাল শাড়ি গোটা কয়েক। গয়না যা ছিল বেশির ভাগই মেয়ে, ছেলের বউ এদের দিয়ে দিয়েছি। ফার্দার গয়না কিনতে আমার লজ্জা করে। যে দেশে সত্তর পার্সেন্ট না কত যেন লোক দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে, যে দেশে প্রতি তিন না কত মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষিতা হচ্ছে, কন্যা-ভ্রূণ হত্যা হচ্ছে, সে দেশের মেয়েদের গয়না মানে ঠাট্টা। গয়নার দোকান তাদের বয়কট করা উচিত। আমি করেছি। তো, মেয়েদের চোখ তো মাইক্রোসকোপিক সবাই জানে।— এই রঞ্জু, এই গাদোয়ালটাই না সে দিন অমুকের বিয়েতে পরেছিলি? আরে! এটা তোর সেই পাটোলাটা, না? বছর দশেক আগে আমার সঙ্গেই তো কিনলি? এ সব আমায় হামেশা শুনতে হয়। কিন্তু আজকাল পুংদের চোখও বেশ ধারালো হয়ে উঠেছে। এক উদাসদর্শন শিল্পী-ভদ্রলোক সে দিন বললেন— এই পেস্তা-সবুজ চান্দেরিটা আপনাকে খুব মানায়, বুঝলেন রঞ্জনা?— অর্থাৎ তিনি আমাকে ওই শাড়িতে একাধিকবার দেখেছেন সেটাই জানিয়ে দিলেন। মেয়েরা যত পুরুষদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, পুরুষরাও নারীদের দিকে ততই ঘেঁষে আসবে, এতে আর আশ্চর্য কী!
যাই হোক, সবচেয়ে যেটি সুখাসন মনে হল সেইটিতে বসে পড়ি। মহাজনরা বলে গেছেন— উচ্চাসনে বসবে, সুখাসনে বসবে, কোকিলের স্বরে কথা কইবে. আমি তো আর রূপকথার বোকা জামাই নই যে, এ সব উপদেশের নিহিতার্থ বুঝব না! সুতরাং মিষ্টি করে ভারতীর ওয়ল কাবিনেট, তার প্যাঁচার কালেকশন, তার ইজিপ্ট থেকে আনা নেফার-তিতির বাস্ট আর বার্মা থেকে আনা বার্মিজ বুদ্ধর প্রশংসা করতে থাকি। প্রশংসাটা কিন্তু সেন্ট পার্সেন্ট সত্যি। আমি মিথ্যে বলা পছন্দ করি না। কিন্তু না-ও তো বলতে পারতাম! বলাটা একটা ভদ্রতা, একটা পলিসিও বটে। ডেল কার্নেগি বলে এক ভদ্রলোক আমাদের ছোটকালে ‘হাউ টু উইন ফ্রেণ্ডস অ্যাণ্ড ইনফ্লুয়েন্স পিপল’ বলে একটা বই লিখে লাখ-লাখ না কোটি-কোটি ডলার কামিয়ে নিয়েছিলেন। সফল হবার এই হ্যাণ্ডবুক সব্বাই তখন পড়েছিল, আমার এক খুড়তুতো দাদা সেটাকে কাজেও লাগিয়েছিল। ফেয়ারলি প্লেসে টিকিট কাটতে গেছে। মা বাবা ভাই বোন সব দুন এক্সপ্রেস-এ মুসৌরি মানে দেরাদুন যাবে। তখন তো যন্ত্রগণক চালু হয়নি, কম্পিউটার তখন মার্কিন রূপকথা। বেচারি সফল হবার জন্য কিউয়ের সামনে, ভদ্রলোককে বলেছিল— আপনি কি রেগুলার ব্যায়াম করেন? ওর আশা ওই ভদ্রলোকই ওর টিকিটগুলো কেটে দেবেন।
—কেন বলুন তো?
—না, চেহারাটা দেখে বলছি। চমৎকার! একেবারে পহলোয়ান।
ভদ্রলোক বলেছিলেন— যে সে ব্যায়াম নয় হে ছোকরা, কুস্তি। তোমার মতো প্যাংলাকে বাঁ হাতে ধরে উ-ই উদিকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারি।
আমার খুড়তুতো দাদা হাল ছাড়েনি। আর একটু এগিয়ে নিজেরই বয়সী কী একটু ছোট, এক হাল-ফ্যাশনের ছোকরাকে বলেছিল— ইয়ে মানে তোমার চুলগুলো তো ভারী চমৎকার! ঠিক এই তরিকাই ডেল কার্নেগি বাতলেছিলেন। তা, জবাবে হাল-ফ্যাশন নব্বই ডিগ্রি ঘুরে তাকে সপাটে একটি চড় মেরেছিল। চোখে সর্ষেফুল দেখতে দেখতে আমার খুড়তুতো দাদা দেখে ওটি আদৌ ছেলে নয়, একটি মেয়ে।
যাক গে, আমি এ রকম কৃত্রিম আরোপিত অভিসন্ধিমূলক পদ্ধতিতে বিশ্বাস করি না। ভারতী আমাদের নেমন্তন্ন করে ষোড়শ ব্যঞ্জনে আপ্যায়িত করছে। গত তিন দিন ধরে বেচারি চাটনি, ডাল, মাছের পুর, পুডিং ইত্যাদি রাঁধছে আর ফ্রিজে ঢোকাচ্ছে। ওকে একটা প্রিয় সত্য, প্রিয় শংসাপত্র দিতে আমি যদি কুণ্ঠিত হই তবে আর আমি লেখিকা কেন? মানুষই বা কী!
একে একে সব প্রবেশ করতে থাকেন। পরীটি হয়ে। কে অল-ব্ল্যাক, কে অল-হোয়াইট, কে শলমা-চুমকি, কে জারদোজির সালোয়ার কামিজ, কত আর বলব! এক্ষুনি সবাই বলবেন— এই শুরু হল, লেখক হোক আর যাই হোক ‘মেয়েমানুষ’ তো! শাড়ি ছাড়িয়ে আর বেশি দূর এগোতে পারে না। এদের সব সময়ে মহিলা লেখিকা বলা উচিত, ডবল স্ত্রীলিঙ্গ। ভারতী ভীষণ খুশি হয়ে বারবার বলতে লাগল— চাঁদের হাট, আজ আমার বাড়িতে চাঁদের হাট। শুনতে কার না ভাল লাগে? অত আদর, আপ্যায়ন, অত খুশি? সেই ছোটবেলায় মামার বাড়িতে যখন সব নাতি-নাতনিরা মিশতুম তখন দিদিমা কথাটা বলতেন, চাঁদের হাট। ব্যাস আর কখনও চাঁদ-টাঁদ শুনিনি।
আমাদের জন্য পানীয় ছিল— হার্ড না সফ্ট বলব না। নেহি। টেবিলে দিব্যি কাজু-ভরা বাটি। ভারতীর কর্মিণীটি আবার কীসের লোভনীয় পকোড়া গরম গরম ভেজে এনে রাখল। ঠিক যেন একটা আসল ককটেল। মুড এসে যায় আমাদের।
শ্বেতা বলল— পড়ি তা হলে?
—তুই আজও এনেছিস? আমরা হই হই করে উঠি।
শ্বেতা বলে— ঢেঁকি স্বর্গে এলেও নিজের কাজটা ভোলে না ভাই। তা ছাড়া আমার কিছু আনবার দরকার হয় না। ‘কণ্ঠে নিলেম গান আমার শেষ পারানির কড়ি’— আমার ব্যাপার তা-ই।
সত্যি। শ্বেতার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। অনর্গল বলে যেতে পারে, নিজের কবিতা, অন্যের কবিতা। গদ্য-উদ্ধৃতি দিতেও সদাই প্রস্তুত। দোষের মধ্যে একটু বেশি মিলিট্যান্ট। একটা ‘যুদ্ধং দেহি’ ভাব।
শ্বেতা পড়ল। কবিতা তো নয়। খবরের কাগজের করুণ খবরের কবিতায়ন। বধূহত্যা। মেয়েটি কত স্বপ্ন চোখে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। বর তার চেনাপরিচিত। এক রকম ভালবাসারই বিয়ে। কিন্তু বছর ঘুরল না— মেয়েটি ঝুলে পড়ল। পুলিশ বলছে সে ঝোলেনি তাকে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ধৃতি বলল— প্লিজ তোরা এই সব নিয়ে কাব্য করিসনি। বটানাইজিং অন ওয়ান’স মাদার্স গ্রেভ। মায়ের কবরের ওপরে গাছ গজিয়েছে। তাদের শোভা, ল্যাটিন নাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া— ভালগার, ভালগার।— বলছে বটে কিন্তু ধৃতির গলা একেবারে ভিজে গেছে। যেন এখনই অশ্রু ঝরে পড়বে।
গুমোট কাটাতে ঈপ্সা গান ধরল— ‘নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী, আমি চিত্রাঙ্গদা!’ এক লাইন গান হতে না হতেই ঝিলম আঁচল কোমরে গুঁজে উঠে পড়ল। ও কলেজ-জীবনে নৃত্যনাট্যে সব সময়ে মেন রোল পেত। এখন বিয়ে-থার দশ বছর পরেও চমৎকার তন্বী আছে।
‘পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে সে নহি নহি’— যখন গান তারসপ্তকে চলে যাচ্ছে তখন ঝিলমের হাত লম্বা করে করে মুদ্রা, ঈষৎ ওপর দিকে তোলা মাথা, সুডোল চিবুক এমন একটা আবহ তৈরি করছিল যে ভারতী চট করে একটা দুটো আলো নিবিয়ে অন্য কী একটা আলো জ্বেলে দিল। একেবারে পুরো রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের স্টেজ। ‘হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি’র সময়ে কে যেন মৃদুস্বরে বলে উঠল— ‘রাইট, অ্যাবসলিউটলি রাইট।’ কে বলল? সুমন গিদওয়ানি বোধহয়। বারাসতের দিকে একটা এন জি ও চালায়। পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের উদ্ধার ও রক্ষণাবেক্ষণ, আত্মনির্ভরতার শিক্ষা দেওয়া এটাই প্রধানত কাজ ওর। ইদানীং সুলভা কেরকারও ওর সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সুলভার আবার মেধা পটেকরের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। পরিবেশ থেকে সরে এসে পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করছে ইদানীং। ওদের দু’জনকেই আমরা খুব শ্রদ্ধা সমীহ করি। সাদা শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ ছাড়া পরে না। চুল ছোট করে ছাঁটা। প্রসাধনের বালাই নেই। ওদের কাজের গুরুত্ব এবং সে ব্যাপারে ওদের আন্তরিকতাই ওদের প্রসাধন। আমাদের জমায়েতে সুমন সুলভা এই দুই সু এলেই দূর্বা ঝিলম রোহিণী এই তিন সাজুনি পুট করে টয়লেটে গিয়ে লিপস্টিক মুছে আসে। গলার জমকালো পুঁতির মালা ব্যাগে পুরে নেয়। পরে ফিসফিস করে বলে— বলবে তো রঞ্জুদি, সুমন আসবে? এ মা!
আমি স্বভাবতই বলি— কপটতা করিসনি, কপটতা করিসনি। তুই লিপস্টিক মুছলেই সে লিপস্টিক মুছবে না, তোর ব্যক্তিত্বের ঠোঁটে ও লিপস্টিক লেগেই আছে। মালাটাও যথাস্থানে থেকে গেছে। যে যেমন সে তেমন, অদ্ভুত তোরা! চোখেও তো কাজল-ফাজল একগাদা লাগিয়েছিস। সেগুলোর কী করবি?
ঝিলম বলে— সরু আইলাইনার রঞ্জুদি, আর… আর…ম্যাসকারা।
রোহিণী বলে— পুঁছতে গেলে ধেবড়ে যাবে…প্লিজ।
আশ্চর্য! আমাকে প্লিজ কেন, আমি কি তোদের মুছতে বলেছি?
সাড়ে আটটা বাজতে যাচ্ছে। ভারতী বলল— খাবারগুলো নিয়ে নে না, খেতে খেতে গল্প হবে। সত্যি! গ্রীষ্মকাল হলেও, আর কলকাতার গ্রীষ্মের উন্মাদ হাওয়া ভারতীর বারান্দা থেকে জানলা থেকে আমাদের উথাল-পাথাল করে দিলেও বাইপাসের সাড়ে আটটা নেহাত কম রাত নয়। কে যাবে নিউটাউনে, কে হাওড়া, কে দমদম, কে উত্তরপাড়া, শ্যামনগর, বেহালা….। আমরা যে যার প্লেটে খাবার তুলে নিই।
ভারতী ভীষণ গুণী মেয়ে। রাঁধে, চুলও বাঁধে। এ দিকে বড় বড় ব্যক্তিত্বদের ইন্টারভিউ নিয়ে নিয়ে সাংবাদিক মহলে নাম করে ফেলেছে। ফ্রি লান্সারদের নামধাম করতে কী পরিশ্রম ও এলেম লাগে সবাই হয় তো জানেন না। সে যাই হোক ভারতী পেরেছে। এ দিকে আবার দারুণ বিচক্ষণ রন্ধনশিল্পী। আমার যেটা ওর সবচেয়ে ভাল লাগে ও কখনও হাত দিয়ে খাবার জিনিসের সঙ্গে কাঁটা-চামচের জিনিস মেশায় না। বুফে মানেই তোমাকে এক হাতে প্লেট ধরে আর এক হাতে কাঁটা বা চামচ বা আঙুল দিয়ে, শাড়িটির বারোটা বাজা বাঁচিয়ে খেতে হবে। সুতরাং ওর মাছের চপ, পোলাও, বোনলেস চিকেন, কাবাব— এ সব আমরা বিনা অসুবিধেতে খেতে থাকি আর গল্পগুজব করতে থাকি। জয়ী মুখে মুখে ছড়া বানিয়ে ফেলে—
মৎস্যের চপ খাও, খাও ভেটকি পোলাও,
কাবাবে রবাব বাজে, খেতে খেতে শুনে নাও।
চিকেন মাখন হেন, কি বা তোর চাটনি,
সাকসেসফুল আজ ভারতীর খাটনি।
খেতে খেতেই রোমহর্ষক কাহিনি শোনায় অজানা। ওদের পাড়ায় বাচ্চা মেয়েরা সব ফিয়ার সাইকসিসে ভুগছে। ভয় পায়। চমকে চমকে ওঠে, হঠাৎ মুখ লাল হয়ে যায়, যেন ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। এত দিনে সেই ভয়ের কারণ বেরিয়েছে। পাড়ার বেণীমাধববাবু। বাচ্চাগুলো ওঁকে চকলেটদাদু বলে ডাকত। চকোলেটের আড়ালে দাদু কাজ হাসিল করতেন। পুরো পাড়া নাকি শকে স্তব্ধ হয়ে গেছে। কেউ কখনও ভাবতে পারেনি দাদুজাতীয় এক জন এ রকম ন্যক্কারজনক, বিপজ্জনক হতে পারেন। ক্রুদ্ধ দিশাহারা মায়েরা বলছেন, তবে কি মেয়েকে সব সময়ে আঁচলে বেঁধে ঘুরব? দাদু-টাদুর কাছে পাঠিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারব না?
আমরা সকলেই উত্তেজিত। অজানা বোধহয় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। শমিতা বলল— চাইল্ড অ্যাবিউজের ডিটেল নিয়ে যদি তোমরা আলোচনা করতে চাও কর, আমার প্লেট রইল, ভারতী স্যরি, আমি চললাম।
তাড়াতাড়ি শমিতাকে শমিত করি আমরা। এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই অল্পবিস্তর আছে। কিন্তু শমিতার সাংঘাতিক। এ প্রসঙ্গ ও এখনও সইতে পারে না। ট্রমা আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবে, মেয়েদের জন্য এ পৃথিবী অর্থাৎ এ দেশ কত ভয়াবহ হয়েছে সে আলোচনা চলতেই থাকে।
সুমন বলল— লেটেস্ট শুনো। আমাদের ‘প্রোটেকশন চিলড্রেন’-এর নামটা এ বার বদলাতে হোবে।
—কেন?
—কেন কি দুটি বাচ্চা এসেচে। আড়াই তিন বছরের। একটা ছেলে আরটা মেয়ে। নেপাল বর্ডার থেকে। তাই ভাবচি, ‘প্রোটেকশন ইনফ্যান্সি’ দিলে কী হয়? ইন ফ্যাক্ট সুলভা ওই নামটাই সাজেস্ট করচে।
অজানা বলল— ভাল কথা, তা হলে জন্মাবামাত্র মেয়েরা সেক্স অবজেক্ট হয়ে যাচ্ছে?
—ছেলেটার কথাও ভুলো না।— সুমন বলল।
—অথচ যারা চায় না, তারা তো আজকাল গর্ভেই মেরে ফেলছে!— বনানী।
—আহা হা, সেটা করে বড় মানে ধনীলোকরা। তাদেরই আলট্রা সাউণ্ড করানো, তার রেজাল্ট আইনি বারণ থাকলেও জেনে নেওয়া এবং চুপচাপ কাজ হাসিল করার এলেম আছে। আমি একটি মারোয়াড়ি বউকে জানি, যার পরপর তিন বার অ্যাবর্শন হয়েছে। এবং সুখের বিষয় বা দুঃখের বিষয় সে সন্তান ধারণের ক্ষমতাটি হারিয়েছে। কী রকম পাগল-ছাগল মতো হয়ে গেছে এখন। মৌ আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট, ও মেয়েদের স্কুলের সূত্রে এখনকার মাদের অনেক প্রবলেম জানে। ও-ই বলল।
আয়েষা বলল— দেখো ওরা চিকিৎসা করাবে না। পাগল বলে দূর করে দেবে, আর একটা বিয়ে করবে।— পূজা নিজে আপকান্ট্রির মেয়ে। ও সায় দিল।
শ্বেতা বিমর্ষ অথচ কেমন রাগী স্বরে বলল— হাসপাতালের বর্জ্যের মধ্যে স্ত্রী-প্রাণাঙ্কুর। ডাউরি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু পণপ্রথাকে নিষিদ্ধ করে করেছ একি পার্লামেন্ট: পণপ্রথাটি ছড়িয়ে গেছে জীবনে। বিয়ের পাঁচ-সাত-ন’ বছর পরেও বাপের বাড়ির থেকে লাখ দু’লাখ পাঁচ লাখ যেমন প্রয়োজন আনতে না পারলে, শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-দেওর এবং স্বামীর হাতে উঠে আসছে দড়ি, কেরোসিন, বিষ। ভাবতে পারো?
সুছন্দা বলল— এবং ধর্ষণ! ধর্ষণ! ধর্ষণ! ধর্ষিতাদের বয়স পাঁচ থেকে পঁয়ষট্টি। ধর্ষকদের— বারো থেকে একশো বারো।
এত দুঃখেও হাসি পায়, জিজ্ঞেস করি— একশো বারোটা কোত্থেকে পেলি?
—আরে জানিস না। নব্বুই বছরের এক বৃদ্ধের সঙ্গে আমার লেখালেখির সূত্রে আলাপ হয়েছিল। ভদ্রলোক রেপের খবর না পড়ে জলগ্রহণ করতেন না। নব্বুই যদি পারে একশো বারোই বা পারবে না কেন?
ভারতী এক বার বলল— তোরা আমার এত কষ্টের রান্নাগুলোর বারোটা বাজিয়ে দিলি। মাছের চপটাকে এখন গোবরের চপ লাগছে।
সুমন বলল— না না, নো। এই ভাবেই আমার বেঁচে আচি, কাজ করচি, সিনেমা, মিউজিক, টিভি এভরিথিং— অ্যাবসলুটলি নর্ম্যাল ভারতী। আমরা তুমার সব রান্না সব আইটেম এনজয় করচি। দিস ইজ হাউ উই গ্রো, উই অ্যডাপ্ট টু অ্যাডভার্স নেচার, অ্যাডভার্স সোসাইটি, ডোন্ট ইউ নো?
ভারতীর ক্ষীণ আপত্তি সত্ত্বেও কখনও উত্তপ্ত, কখনও হতাশা, কখনও সজল আলোচনা চলতেই থাকল। চলতেই থাকল।
কত ধর্ষণ কাগজে উঠেছে, কত ওঠেনি। কত এফ আই আর পুলিশ নিয়েছে, কত নেয়নি। ধর্ষণোত্তর মার্ডারের শাস্তিস্বরূপ প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে কি হবে না, এই নিয়ে তুমুল পণ্ডিতি এবং মানবিক তর্ক-বিতর্ক। বাংলাদেশের, নেপালের হতদরিদ্র মেয়েরা সীমান্ত পেরিয়ে চলে যাচ্ছে মুম্বইয়ের লালবাতি এলাকায়। মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে এখনও অমর্যাদার শিকার। ভাস্বতী ওর অফিসে অনবরত বাঁকা মন্তব্য শোনে ওর পোশাকের জন্য। ও এক দিন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে— হট প্যান্ট কিংবা বিকিনি তো আর পরিনি। পরেছি? বেশ করব, শার্ট প্যান্টালুন পরব, বয়ছাঁটে চুল ছাঁটব, বাসে-ট্রামে আপনাদের হাত সাফাই বন্ধুরা চট করে ধরতে পারবে না। ভদ্রমহিলা না ভেবে আমাকে ভদ্রলোক ভাবলেই আমার স্বস্তি। আর কিছু বলবেন?
শর্বরী বেচারির কেস আরও খারাপ। কর্পোরেট হাউস একে তো প্রাণান্ত খাটায়, তার ওপর সূক্ষ্ম উপায়ে চলতে থাকে হ্যারাসমেন্ট। অব্যবহিত বস বিজনেস-লাঞ্চের কথা জানালেন ফোনে। গিয়ে দেখা গেল— ও হরি আর কেউ নেই। সমস্ত বিজনেস ও পার্টির প্রতিভূ ভদ্রলোক স্বয়ং। কনফারেন্স শেষ হয়ে গেল। তার কাগজপত্র ফাইলিং আর শেষ হচ্ছেই না। এক দফা শেষ হল তো আর এক দফা এসে গেল। রাত দশটায় বাড়ি। বরের মুখ ভার।
দশটার কথায় আমার খেয়াল হয়— আরে তাই তো! দশটা তো বাজতে চলল— ভারতীর স্বামী, ছেলে ওরা কোথায়?
জিজ্ঞেস করি— হ্যাঁ রে ভারতী, তোর ভদ্রলোক কোথায়? ছেলেরা?
ভারতী একটু যেন বিব্রত মুখে বলল— দ্যাখ না, বড়টার তো আই টি, কখন ফিরবে, আদৌ ফিরবে কি না ঠিক নেই। ছোটটা বলল— তোমরা নিজেরা গল্পসল্প করো না, আমি আজকে বন্ধুর হস্টেলে থেকে যাচ্ছি।
—আর ছেলেদের বাবা?
—ওর কথা আর বলিস না। ভারতী একটা মুখভঙ্গি করল— বললেন, ওরে বাবা এত জন নারীবাদী? আমি আইনক্সে যাচ্ছি। ফিল্ম-টিল্ম দেখে খেয়ে-দেয়ে ফিরব।
ঝলকিত রঙ্গমঞ্চ। আলো আমাদের মুখের ওপর। সংলাপ আরও যথাযথ। আবেগমথিত, মর্মভেদী করতে আমরা চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। কিন্তু বুঝতে পারি প্রেক্ষাগৃহ শূন্য। শ্রোতা নেই, দর্শক নেই। শুধু অন্ধকার।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।