আশরাফ সাহেবের গরু কেনা

আশরাফ সাহেব চিন্তায় চিন্তায় মহা অস্হির হয়ে গেছেন । গরু কেনার গুরু দায়িত্বটা পড়েছে এবার উনার উপর । উনার অস্হিরতা সংক্রামক ব্যাধির মত পরিবারের সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে । সংক্রামকের কাজটা অবশ্য আশরাফ সাহেব নিজেই করে থাকেন । তিনি ঘরের ভিতর পায়চারি করছেন । আর বলছেন, ইশ বড় ভাই এভাবে চলে গেলেন কেন ! তিনি একটা গরু কিনে দিয়ে যাবেন না ! আহা, কি এক ঝামেলায় পড়লাম !
হঠাৎ ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেন, কি এক অপদার্থ ছেলে হয়েছে । একটা গরুও কিনতে পারে না !
এটা শুনে আসিফ বলে উঠল, আব্বা আমি তো বলছিলাম । আমি কিনতে পারব । কোন …
তুর মত গাধারে দায়িত্ব দেই, আর আমার কুরবানীটা মার্ডার করি আর কি ! দেখা যাবে গরুর বদলে গাধা নিয়ে আসছস । আর বলদ হইতি তাও একটা কাজ হইত । এত চিন্তা করা লাগত না, তুরেই বিসমিল্লাহ বলে চালাই দিতে পারতাম ।
আহ, কি সব বলেন ! ছেলে বড় হইছে । ঝাঁকিয়ে উঠেন শাহেদা বেগম ।
ভুলটা কি বলছি, বল তো আসিফের মা ! তবু ভাল গাধার বাচ্চা তো আর বলি নাই ।
আবিদা বলে উঠে, আব্বা তাইলে তো গাধাটা … । আর না বলে ফিক ফিক করে ফিচলে হাসি দেয় সে ।
দেখেই গা জ্বলে উঠে আশরাফ সাহেবের । আদরে আদরে বেশ ফাজিল হয়েছে মেয়েটা । ছোট বলে বেশী আদর হয়ে গেছে । সবই মাইরের অভাব । ঠিকমত পরলে এক্কেবারে সোজা হয়ে যাইত । কিন্তু মাইর টা দেবে কে !
প্রতিবার আশরাফ সাহেব উনার বড় ভাইয়ের সাথে কুরবানী করেন । বড় ভাই সব কিছু করতেন । আশরাফ সাহেব শুধু বাড়িতে এসে গরু কেমন হল না-হল সেই মতামত প্রকাশ করতেন । এবার বড় ভাই পবিত্র হজ্ব আদায় করতে গেছেন । আর আশরাফ সাহেব পড়ে গেছেন মহা ফ্যাসাদে । তিনি ভেবে ঠিক করছিলেন, গরু গ্রাম থেকেই কিনবেন । পরে আবার মত পালটে শহর থেকে কেনার সিদ্ধান্ত নেন । গ্রাম থেকে মানুষ এসে নিয়ে যাবে ।
আসিফ একবার বলেছিল, শহরেই কুরবান করতে । শুনে আশরাফ সাহেব বলে উঠেন, সাধে কি তুরে গাধা বলি ! গ্রামের গরীব-মিসকীনদের একটা হক আছে । পাড়া-প্রতিবেশীর একটা আহ্লাদ আছে । শহরে সে সব তুই করবি কেমনে, বাবা ! কেমন জানি উদাস লাগে আশরাফ সাহেবের কন্ঠ ।
গত দুইদিন যাবত আশরাফ সাহেব বাসায় ফিরেছেন, রাত দশটার পর । অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা গেছেন গরুর হাটে । ঘুরে-ফিরে দেখেছেন । আজ তিনি একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হলেন । গরুর হাটে দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা গরু তার ভীষন মনে ধরে গেল । যদিও বাজেট থেকে একটু বেশী । তবু সেটাই কিনবেন । ছেলেকে ফোনে বললেন, বাসা থেকে টাকা নিয়ে আসতে । গ্রামে ফোন করেছিলেন । তাঁরা বলল, ভাইজান আজকে তো রাত হই গেছে । আপনি আজকের রাতটা রাখেন । আমরা ফজর নামাজ পড়েই আল্লাহর নামে বেরিয়ে পড়ব । কি আর করা ! একটা রাত রাখা তেমন কোন সমস্যা হবে না, ইনশাআল্লাহ ।
ছেলেটা টাকা নিয়ে আসতে বেশ দেরী করছে । তিনি একটু পরপর ফোন দিচ্ছেন । হঠাৎ রেগে বলে উঠলেন, কি জ্যামে ! তুই ত চিটাং শহরে ঢাকা শহরের জ্যাম নিয়ে আসছিস । এতক্ষন জ্যাম থাকে নাকি ! আসিফ টাকা নিয়ে পৌছতেই আশরাফ সাহেবের ঝড়ের সম্মুখিন হল । কিরে হারামজাদা, এতক্ষন ! তুরে ছোট থাকতে বলতাম, an ass একটি গাধা । তুই এখন হইছস ভার্সিটি পড়ুয়া গাধা । গাধা সেই গাধাই আছস । বাজারের মাঝখানে আব্বার এমন কথায় আসিফের মরে যেতে ইচ্ছা হল ।
আশরাফ সাহেব গরু নিয়ে ফিরছেন । তার মন থেকে একটা পাথর নেমে গেছে যেন ! মুখে তিনি ছেলেকে যতই গালি দেন, ছেলেটা আসলেই বড় হইছে । এত্তগুলা টাকা… ! তিনি বেশ ভয়ে ছিলেন…। একটা সমস্যা হয়েছে । গরুটা কেমন জানি দার্শনিক টাইপ গরু । একটু পর পর থেমে থেমে কি যেন ভাবে ! আশরাফ সাহেব হট…হট… হুরররর… হররর… করেন । কোন কাজ দেয় না । গরুর মর্জি হলে তবেই নড়ে । আসিফ কোত্থেকে একটা বেত যোগার করল । এটা ভাল কাজ দেয় । পিঠে পড়লেই দার্শনিক-টার্শনিক সব উধাও ।
বাসা থেকে দশ-পনের মিনিট দূরত্বে হঠাৎ এক মুসিবতে পড়লেন আশরাফ সাহেব । হুট করে কারেন্ট চলে গেল । কেন জানি গরুটা বেশ ভড়কে গেল । গরুটার প্রথম দিকের পা’দুটো গিয়ে পড়ল নর্দমায় । ভয়ানক অবস্থা । হৈ হৈ করে কোত্থেকে অনেক গুলা মানুষ জুটে গেল । মোবাইলের টর্চ জ্বলে উঠল কয়েকটা । কে একজন একটা বাঁশ আনল । বাঁশ দিয়ে নাকি গুত্তা দিতে হবে । একজন বলল, গরুকে উপরের দিকে টানতে হবে । আরেকজন বলে উঠল, নাহ নর্দমায় নামা ছাড়া উপায় নাই । কে একজন উদ্ভট এক ধারণা দিল । গরুকে কাতুকুতু দিলেই নাকি হবে । গরু হাসার সময় পা তুলে হাসে ! তো পা উঠে আসবে । আরেকজন তো বেশ ক্ষেপে গেলেন । কারন, গরু হঠাৎ মূত্র বিসর্জন করলে ভদ্রলোকের গা-য়ে ছিটকা পড়ল । এ্যাঁ, গরু সামলাতে না জানলে কে বলছে গরু কিনতে ! একজন বিজ্ঞের মত বলে বসলেন, নর্দমার পাশে একটু উঁচু করা দরকার ছিল । এখন তো গরু পড়ছে, যদি বাচ্চা-কাচ্চা পড়ে ! কতজনের কত মত !
আশরাফ সাহেব একটু দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছেন । তিনি বেশ হতভম্ব । প্রায় ৪৫ মিনিটের চেষ্টায় কিভাবে জানি গরুটাকে উদ্ধার করা গেল ! হাঁপ ছাড়লেন আশরাফ সাহেব । তিনি আরেকবার বুঝতে পারলেন, নাহ তার ছেলে সত্যিই বেশ বড় হয়েছে । আপন মনেই তৃপ্তি অনুভব করেন তিনি ।
রাত সাড়ে বারটার দিকে গরুটার একটা ব্যবস্থা করে যখন আশরাফ সাহেব বাসায় ঢুকলেন, তখন তিনি বেশ খানিকটা ক্লান্ত । তবে আনন্দিত। পরিতৃপ্ত একজন মানুষ ।

দুঃখিত!