সকালবেলাতেই ঘোষ পাব্লিকেশনের অনন্ত বাবু এসে হাজীর দুর্গাপদ বাবুর বাড়িতে। এই সময় যে তিনি আসেন না, এমন নয়। এর আগেও এসেছেন। সেই পুরনো ধুতি আর শার্ট, মাথার যাই যাই করা চুল তেল দিয়ে পাট পাট করা, আর পায়ে কোলাপুরি চটি। অনন্ত বাবু’র মুখে এই একটি হাসি সব সময় লেগেই থাকে। কারোর দুঃখের দিনেই হোক, বা সুখের দিনে। অনন্ত বাবু মানে তাঁর
এই হাসি। এটা ওঁর বিজনেস প্রপ্স, না এটাই ওঁর চরিত্র— তা জানেন না দুর্গা বাবু। মুখ যেন গোমরা ক’রতে জানেন না ভদ্রলোকটি।
এই প্রকাশনার মাসিক একটি পত্রিকায় এবং শারদীয়াতে নিয়মিত লেখা দিতে হয় দুর্গা বাবু’কে। শুধু এই পত্রিকা নয়, আরো কয়েকটি পত্রিকা আছে যেখানে নিয়মিত দুর্গাপদ মজুমদারের গল্প ও উপন্যাস ছাপা হয়। যদিও আজো পর্যন্ত তাঁর তিনটের বেশী বই ছেপে বের করেননি কেউ। এই পত্র-পত্রিকায় লেখা দিয়ে যে দুর্গা বাবু’র তেমন রুটি রুজি হয়, তা নয়। আজকাল সাহিত্য কেনেই বা কে, আর পড়েই বা কে? এই বিজ্ঞান আর হাজার বিনোদনের যুগে মানুষের সময়ই বা কৈ বা ধৈর্যই কোথায়? ফলে তেমন পেমেন্ট পান না দুর্গাপদ বাবু’র মতো সাহিত্যিক বা কবি সমাজ। ঐ… মনের মধ্যে বার বার কুরে কুরে খাওয়া ভাবনা-চিন্তাগুলো কোনোরকমে খাতায় প্রকাশ ক’রে দিতে পারলে তা ছেপে বের হবার একটা হিল্লে হ’য়ে যায় দুর্গা বাবুদের মতো লেখকদের। ওইটাই সন্তুষ্টি। তা নয়তো এ পোড়া দেশে কত উপযুক্ত কবি আর লেখক মাথা খুড়ে ম’রছে তাদের একটা লেখা একবার কোনোরকমে ছেপে বের করবার জন্যে। কিন্তু আজকের প্রকাশকদের কথা— পয়সা ফেলো, ছেপে দিচ্ছি দায়িত্ব নিয়ে। কিন্তু বিনিয়োগ? নো নো, মাই ডিয়ার। ও দিন আর নেই।
দুর্গা বাবু জানেন, অনন্ত বাবু কেন এসেছেন। এটা চ’লছে জুলাই-এর শেষ। ফলে লেখার তাগাদা দিয়ে যাবেন শারদ সংখ্যার জন্যে। গতকালও একজন এসে গেছেন। এ্যাডভান্স টাকা এঁরা দিয়েই দেন। আজকের সাহিত্যে জগতে এই তো কটামাত্র নামধাম করা যেতে পারে, এমন লেখক আছেন। এমন লেখকের লেখা পত্রিকায় না ছেপে বেরোলে পত্রিকার বাজারে কাটতি হবে না ব’লেই এঁদের পেছনে তাঁদেরকে ঘুর ঘুর ক’রতে হয়, এমন তাগাদা দিতে হয়। তা নয়তো একটি পয়সা ঠেকাতে হবে না, এমন লেখকদের খোঁজ ক’রলে ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে এখানে সেখানে। কিন্তু সেইসব নাম তো বাজারে কাটবে না। পত্রিকা বেরিয়েছে কিন্তু দুর্গাপদ বাবু অথবা অশেষ ঘোষ কিম্বা প্রতুল গাঙ্গুলি’র লেখা থাকবে না, এমন পত্রিকা মানুষ কিনবে নাকি! সে তাঁরা হাবিজাবি যা খুশি লিখুন না কেন, ওঁদেরকেই চাই। পাঠক তো ভাবে না, একজন লেখকের লিখবার একটা নির্দিষ্ট দৌড় আছে। তার বাইরে তাঁকে দিয়ে গুষ্টির লেখা লেখালে আর যাই হোক, তাঁর মানের লেখা নামবে না। বিদগ্ধজন তাকে ব’লবে বস্তাপচা।
সকালের এই সময়টা দুর্গা বাবু সাধারণত এই বারান্দায় থাকেন না। তিনি নিজের ঘরে স্নান ক’রে ব’সে যান লিখতে। কিন্তু আজ ঘরে যাননি। বারান্দায়টায় একা ব’সে আছেন। ঘরে নিঃশব্দে কাঁদছেন তাঁর স্ত্রী। ব’সে ব’সে একেবারে অনুষ্ঠান ক’রে যে কাঁদছেন, বা মড়া কান্না কাঁদছেন, তা নয়। নিত্য-নৈমিত্যিক কাজ ক’রতে ক’রতে চোখ মুছছেন। কাল সকালে একটা বাজে খবর এসেছে। এমনটা ভাবতেই পারেননি দুর্গা বাবু বা তাঁর স্ত্রী। একেবারে অভাবনীয়, অপ্রত্যাশিত। দুর্গা বাবু’র সদ্য বিয়ে হওয়া মেয়েটি থাকে আসানসোলে। কদিন যাবৎ মেয়েটার শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছিলো না, এমন একটা খবর আসছিলো। মাঝে মাঝে জ্বর হয়, মাঝে মাঝে সর্দি কাশি লাগে। এমনটা ওর জীবনে আগে কখনও ছিলো না। দুর্গা বাবু’র মেয়ে মিনতি চিকিৎসা জগত থেকে একটু বেশীরকম দূরেই ছিল। ছেলেটাই বরং একটু অসুস্থ ছিলো বরাবর। কিন্তু আজ টেলিফোনে জামাই ব’লেছে যে, একটা ব্লাড টেস্ট ক’রতেই বিষয়টা হঠাৎ ধরা পড়েছে। সাথে সাথে কেঁদে প’ড়েছেন স্ত্রী বিনতা। লোকে হয়তো এই অবস্থায় কতকগুলো অনেকবার শোনা, অনেকবার অনেককে বলা সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু দুর্গা বাবু মনে করেন, এ কি সান্ত্বনা দেবার বিষয়! মা’কে কি এই অবস্থায় বলা যায়, ‘স্থির হও, কেঁদো না।’ কান্না তো মনের আর শরীরের স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়। আচ্ছা আচ্ছা মানুষ একে সামলে রাখতে পারলো না, তো বিনতা কোন ছার!
স্ত্রী’কে বিলাপ ক’রতে দেখতে না পেরে দুর্গা বাবু বারান্দায় এসে ব’সেছেন। ঘরে কিছুক্ষণ ব’সে ছিলেন ছেলের ছবিটার সামনে। ছবিটা তোলা হ’য়েছিল ও চাকরীটা পাবার ঠিক পরে। দুটো বছর ঘুরে পারেনি ছেলেটা চ’লে গেছে। এর মধ্যে মেয়ে’র এই খবর। মানুষের হৃদযন্ত্রের তো একটা সহন ক্ষমতা আছে। এ তো তা পার ক’রে যাচ্ছে! নিজেকে বারান্দাটায় ব’সে নিজেই সামলাচ্ছেন দুর্গা বাবু। ভূমিকম্প, সুনামি, গ্লোবাল ওয়ারমিং যা-ই হোক, তা তো পৃথিবীর আহ্নিক বা বার্ষিক গতি থামিয়ে দিতে পারবে না। কিছুই তো থেমে থাকে না। চ’লতে পারছি না— ব’ললে হয় না। চ’লতে হয়। দ্য শো মাস্ট গো অন। তাই বারান্দাটায় ব’সে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা ক’রে যাচ্ছেন দুর্গা বাবু। সারা মাথার চুল খামচে খামচে ধ’রে মেজাজটাকে নিয়ন্ত্রণ ক’রছেন। এটা না ক’রে কোনো উপায় নেই। এক্ষণই আসানসোলে যাবার কোন কায়দা নেই। এদিককার কাজগুলো তো সামলাতে হবেই হবে। উপন্যাস লেখা তো অফিসের কোনো করণিকের কাজ নয় যে, একটা কাউকে দিয়ে সামলে নেওয়া যাবে। সামনে পুজো। আর ওখানে গিয়ে বিশেষ কী-ই বা ক’রবেন! বড়োজোর মেয়ে-জামাইয়ের দুঃখের একটা ভাগ নিতে পারেন। এ তো চিকিৎসারও অতীত। কিছু তো করা যাবে না। পুজোটা না কাটলে তো যাওয়াও যাবে না। ঘাড়ের ওপরে যে দায় র’য়েছে। তিন তিনটে লেখা কমপ্লিট ক’রতে হবে। তিনটে শারদীয়া আছে। তাঁদের দেওয়া অগ্রিম টাকা তো খাওয়া হ’য়ে গেছে।
দুর্গা বাবু’র এই বাস্তববাদিতা বিষয়ে তাঁর আত্মীয়মহলে একটা বদনাম আছে। ছেলে চ’লে যাওয়ার সময়ে তাঁকে চোখের জল ফেলতে কেউ দ্যাখেনি। নীরবে বাবা হ’য়ে সব কাজ ক’রেছেন। লোকে ব’লেছে, ‘কী রে বাবা! পাথর নাকি!’ পাথর যে তিনি নন, তা তো তিনি নিজে জানেন। অনলি দ্য ওয়ারার নোজ হোয়ার দ্য শু পিঞ্চেস। বাবা-ই জানে বাবা’র ব্যথা। অন্যকে জানান দেবার বিষয় তো তা নয়। আজো তিনি চোখের জল ফেলেননি। স্ত্রী বিনতা জানে, মানুষটা কাঁদে না। কিন্তু কাঁদে। সেটা কেউ দেখতে পায় না। এই বত্রিশ বছরে তিনি বুঝে গেছেন, এই মানুষটা কে, বা কী। তাই তাঁর কোনো দাম্পত্য অনুযোগ নেই।
অনন্ত বাবু দুর্গা বাবু’কে এমনটা দেখে মুখে কোনো শব্দ না ক’রে পাশে থাকা কাঠের চেয়ারটা সশব্দে টেনে নিয়ে বসেন। আর তখনই মুখ তুলেছেন তিনি। অনন্ত বাবু’কে দেখে মনের অস্থিরতাটা যেন ঢোক গিলে ফেলার মতো গিলে নিয়েছেন। এর ভাগ তো আর তাঁকে দেওয়া যায় না। দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। তাই ক্ষীণ স্বরে বলেন,
— চিন্তা ক’রবেন না, অনন্ত বাবু। আর দিন দশেকের মধ্যে লেখাটা পেয়ে যাবেন।
কিন্তু হাঁ হাঁ ক’রে ওঠেন অনন্ত বাবু— না না। আমি ওটার জন্যে আসিনি। আমি একটা বিষয় জানতে এলাম।
— কী বিষয়, অনন্ত বাবু?
— আসলে গত কালকে ঘোষাল পাবলিকেশনের বরুণ বাবু’র সাথে দেখা হ’লো। উনি একটা দুঃসংবাদ দিলেন। আমি তো শুনে অবধি চম্কে গেছি।
ঘোষাল পাবলিকেশনের নাম ব’লতে বুঝতে পারেন দুর্গা বাবু, কোন দুঃসংবাদের কথা ব’লছেন অনন্ত বাবু। তবু না জানা’র মতো ব’লেন— কী বিষয় ব’লছেন, বলুন তো?
— আপনার মেয়ে’র নাকি…
— হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছেন। কালকে বরুণ বাবু এসেছিলেন, আর তাই তিনি জেনেছেন। তখনই সংবাদটা এলো কিনা। মেয়ের এক কারণে ব্লাড টেস্ট ক’রতে গিয়ে আর এক সমস্যা ধরা প’ড়েছে।
— সেটা কি লিউকোমিয়া?
— হ্যাঁ। আপাতত তো তাই জানি।
— ওরা কনফার্মড?
— ওরা কনফার্মড কিনা, সেটা থেকে বড়ো কথা, প্যাথলজি সেন্টার কনফার্মড কিনা। তাই ওরা আরো অন্য জায়গা থেকে টেস্ট করাবে।
হাহুতাশ ক’রলেন অনন্ত বাবু। এঁদের সাথে দুর্গা বাবু’র বহুদিনের সম্পর্ক। ফলে দুর্গা বাবু’র পরিবারের নানা কথা জানা এঁদের। সেই অবগতি থেকেই হাহুতাশ ক’রলেন অনন্ত বাবু— আপনারা তো পুত্রশোক আজো ভুলে উঠতে পারলেন না, এর মধ্যে দ্বিতীয় আঘাত!
আসলে দুর্গা বাবু’র ছেলে মারা গেছে প্রায় দুটো বছর আগে। সেটা ছিল একটা মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা। বাড়ি থেকে অশান্তি ক’রেই বেরিয়েছিল ছেলেটা। আর ফেরেনি। দুর্গা বাবু’কে সোজা মর্গে লাশ সনাক্ত ক’রতে যেতে হ’য়েছিলো। তারপর অন্ত্যেষ্টি, পারলৌকিক সব তাঁকেই ক’রতে হ’য়েছে। চাকরী পাবার পর ছেলেটা একটি বিবাহিতা মেয়েকে বিয়ে ক’রতে চেয়েছিলো। দুর্গা বাবু এটাকে ছেলে’র নেহাৎ বালখিল্য ভেবে ব’লেছিলেন,
— জীবনে মানুষকে নানা পরীক্ষা দিতে হয় রে, পাগল। নানা প্রশ্নপত্র সল্ভ ক’রতে হয়। তার সবটা মেলে বা মেলে না। তার দুঃখেই সে অস্থির। এর ওপর আবার নিজে থেকে কোনো পরীক্ষা টেনে আনিস না। এটা বিবাহ ব’লে কথা। স্কুল কলেজের বন্ধুত্ব নয়। মেয়েটা একটি লোকের বিবাহিতা স্ত্রী। তাদের মধ্যে কী সম্পর্ক, কতটা সম্পর্ক— এসব তুই জানতে যাস না। ওকে ওর মতো জীবনটা যুঝে নিতে দে। তুই এর মধ্যে ঢুকলে ওদের সম্পর্কের যেটুকু সম্ভবনা, তাও নষ্ট হবে। গোটা জীবনটা নষ্ট হ’য়ে যাবে। এটা অন্যায়। বাবা হ’য়ে আমি কিছুতেই তোকে সমর্থন ক’রতে পারি না।
কিন্তু চোরায় না শোনে কভু ধর্মের কাহিনি। একটা নেশা যখন মানুষের মাথায় চেপে বসে, তখন সেটাকেই পেতে সে ব্যতিব্যস্ত হ’য়ে ওঠে। তেমনটাই হ’লো দুর্গা বাবু’র ছেলে’র। সে বাবা’কে আক্রমণ ক’রে বসলো— তুমি একজন প্রগতিশীল লেখক হ’য়ে এসব ব’লছো! এটা কি প্রগতিশীলতা!
কোনোরকমে উত্তেজিত হন না দুর্গা বাবু। শান্ত স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলেন— আমি প্রগতিশীল লেখক, এই মনগড়া শব্দ পেলি কোথায়? আমি তো কখনও এসব দাবি করি না।
— হও না হও, তুমি তো একজন মানবতাবাদী শিল্পী। একটি মেয়ে দিনের পর দিন তার স্বামী’র অত্যাচার সইছে। এটা শিল্পী হ’য়ে তুমি মেনে নিতে পারো, বাবা। আমি পারি না। ওকে উদ্ধার করা আমার দায়িত্ব।
বাবা বোঝান— নিজের বৃত্তটা বোঝ্, বাবা। বৃত্তের বাইরে যেতে চাস না। একটা সময়ে সইতে পারবি না। তোকে তখন কে উদ্ধার ক’রবে? আর যদি সত্যি তোর কথা সত্যিও হয়, তবে তো তোকে অপেক্ষা ক’রতে হবে। ওদের মধ্যে সেপারেশন না হ’লে…
অস্থির পুত্র অস্থিরতা প্রকাশ করে— নীনা ঘর ছাড়লে ওর স্বামী বেঁচে যায়, বাবা। কোনো বৈধ বা অবৈধ বিষয় নিয়ে, আইনি বা বে-আইনি ঘটনা নিয়ে ওর কোনো মাথা ব্যথা নেই। ও শুধু মুক্তি পেলেই বেঁচে যায়। ফলে নীনা’রও মুক্তি জরুরী।
কিন্তু দুর্গা বাবু মেনে নিতে পারেন না ছেলে’র এই অবাস্তববাদী কথাবার্তা। এই থেকেই কলহ, এই থেকেই উত্তেজনা। অগ্নিশর্মা হ’য়ে ছেলে মোটর সাইকেলের চাবি ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে যায়। আর আধঘণ্টার মধ্যে ভিআইপি রোডের ওপর এ্যাক্সিডেন্ট করে। সাথে সাথে মৃত্যু। দুর্গা বাবু খবর পান পরদিন। একেবারে মর্গে গিয়ে ছেলের দেহ নিয়ে আসেন। সেই বেদনা কাটতে না কাটতেই আজ মেয়ে’র এই খবর। দুর্গা বাবু মনে মনে একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত যে, দুঃখ-বেদনায় বিনতা কেঁদে ফেলতে পারে। চোখের জলে বুকের সব যন্ত্রণা ধুয়ে দিতে পারে। কিন্তু তিনি তো তাও পারেন না। বুকের মধ্যে যন্ত্রণা ঘুরে ঘুরে মরে।
— ঈশ্বরের এ কী বিচার বলুন তো, দুর্গা বাবু! একটা মানুষকে কত যন্ত্রণা দেওয়া ঠিক, না বেঠিক— সে বোধটুকু পর্যন্ত নেই তাঁর! আপনাদের মতো ভালো মানুষকে কি এভাবে শুধুই কষ্ট দুঃখ দিতে হয়! দুনিয়ায় মন্দ লোকেরা তো দিব্যি খেয়ে প’রে সুখে কাটাচ্ছে!
শুকনো হেসে দুর্গা বাবু বলেন— এভাবে বলবেন না, অনন্ত বাবু। এটা ঠিক কথা নয়। এটা সত্য যে, দুঃখ বেদনা মানুষ চায় না। কিন্তু মানুষের সাথে দুঃখের এই সম্বন্ধ তো অবিচ্ছেদ্য, অনিবার্য। এ থেকে তো মুক্তি নেই। আরো আশ্চর্য কি জানেন, মানুষ পকেটের টাকা খরচ ক’রে পর্যন্ত এই দুঃখ কিনতে যায়। দুঃখের কবিতা পড়ে, দুঃখের চলচ্চিত্র দ্যাখে, দুঃখের গান শোনে। দুঃখের সাথে মানুষের অচ্ছেদ্য বন্ধন। ঘরের কোনো না কোনো ফাঁক-ফোঁকর গ’লে সে ঠিক ঢুকে পড়ে। সব ওলট-পালট ক’রে দেয়।
মেনে নিতে হয় অনন্ত বাবু’কে এইসব কথা। মাথা নেড়ে বলেন— ঠিক দুর্গা বাবু। কথাটা ঠিক। আমরা ভাবি, না ভাবি— কথাটা ঠিক। কিন্তু আমি তো এই কথা ব’লছি না। আমি ঈশ্বরের কথা ব’লছি, তার বিচারবোধ অভাবের কথা ব’লছি।
— অমন কথাটাও ঠিক নয়, অনন্ত বাবু। পরম পুরুষ শুধু নেন না। দেনও। আমরা বুঝতে পারি, না পারি, দেখতে পাই, না পাই। পরম পুরুষ ঠিক এক নিয়ে আর এক সাজিয়ে দেন মানুষকে। দেখুন না, রবিঠাকুর। জীবনে একটার পর একটা দুঃখ প্রত্যক্ষ ক’রেছেন আর এক একটি গান, এক একটি কবিতা রচনা ক’রেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চরম দারিদ্রের মধ্যে ডুবতে ডুবতে লিখে রেখে গেছেন তাঁর অমর সব রচনা। কবি কৃত্তিবাস রাম-সীতার বিরহ দৃশ্য লিখে উঠতে না পারলে যখন তাঁর স্ত্রী তাঁকে না জানিয়ে ঘর ছেড়ে চ’লে যান একদিন, তখনই রচিত হয় সেই অনন্য বিরহ দৃশ্য। শুধু এই দেশে কেন! এই তো কার্ল মার্ক্স। তিনি তাঁর জীবনে এক একটি হারানোর বেদনা বুকে ধ’রেছেন আর এক একটি গ্রন্থ লিখেছেন। বেদনাই তো সেই অনন্ত খনি, অনন্ত বাবু। সংসার সমুদ্রে বেদনা’র মাটি খুড়ে খুড়েই তো আমাদেরকে এক একটি মুক্ত তুলে আনতে হয়। আপনি ভাববেন না। আপনাদের লেখা ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে। আমাকে যে পৌঁছতেই হবে। স্বামী মৃত্যু বরণ ক’রলে কি গর্ভবতী স্ত্রী প্রসব থেকে রেহাই পান? আর একটি প্রাণ ঠিক সময়ে চ’লে আসে। আমার কথাই ধরুন না কেন। আমার বাবা ছিলেন আমাদের অঞ্চলের একজন স্বনামধন্য সমাজকর্মী। বাবা মারা যেতে আমরা একেবারে অকুল পাথারে প’ড়ে যাই। তখন তো আমি উপার্জনও করি না। এই সময় আমাদের অঞ্চলেই একটি পত্রিকায় আমাকে বাবা সম্পর্কে একটি যে কোনো মানের লেখা দিতে বলা হয়। না না ক’রতে ক’রতে শেষে একটা সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন লিখেই ফেলি বাবা’র ওপরে। কোনো সমস্যা হয় না। বাবা তো। বাবা’কে তো কাছ থেকে দেখেছি। কিন্তু এই কাজ ক’রতে গিয়েই আবিষ্কার করলাম, আমার হাতে লেখা আছে। আগে তো কখনও এমনটা ভাবিনি। আমার হাতে তার পরেই প্রথম গ্রন্থে লেখা হ’ল আমার বাবা’র পূর্ণ জীবন— এক জীবনের খোঁজে। আর সেটাই তো পেয়ে গেলো এ্যাওয়ার্ড। ব্যস্, আমি হ’য়ে গেলাম নবাগত সাহিত্যিক।
কিন্তু দুর্গা বাবু’র দয়াময় পরমপুরুষ তাঁর এইসব জীবন দর্শন’কে একেবারে ভেঙ্গেচুরে দিয়ে তাঁকে একেবারে পরাভবের প্রান্তসীমায় দাঁড় ক’রিয়ে দিলো দু-দিন পরেই। মেয়ে’কে কেন্দ্র ক’রে স্ত্রী বিনতা’র মানসিক বোঝা ক্রমে তাঁর শারীরিক অস্থিরতা হ’য়ে উপস্থিত হ’লো। ভীষণ রকম উচ্চ রক্তচাপ তাঁকে পাঠিয়ে দিলো একেবারে নার্সিংহোমে। তখন দুর্গা বাবু সবে স্ত্রী’কে আশ্বস্ত ক’রতে অবশেষে আসানসোলে মেয়ে’র কাছেই একবার যাবেন ব’লে স্থির ক’রেছেন। এই সময়ই বিনতা’কে পাঠাতে হ’ল নার্সিংহোমে। এমনকি অপারেশন করার প্রশ্নটা পর্যন্ত এসে যায়। সন্দেহ হয়, হয়তো এটা একটা হার্ট এ্যাটাক। কোনো আর্টারি হয়তো ব্লক হ’য়ে গেছে। প্রথমটা এই সংবাদ পাননি কোনো প্রকাশনা সংস্থা। দু-দুটো দিন কেটে যায়। দুর্গা বাবু’র খোঁজ ক’রতে এসে এঁদেরই একজন জানতে পারেন এই নতুন ক’রে নেমে আসা ঘটনাটি। ওঁরা বেশ বুঝতে পারছিলেন, দুর্গা বাবু’র পক্ষে এবারের শারদ সংখ্যায় লেখা দেওয়া আর বোধহয় সম্ভব হ’লো না। ভদ্রলোক একেবারে অক্টোপাসের আটটি শুঁড়ে আটকে গেছেন। মেয়ের মৃত্যু অথবা স্ত্রী’র মৃত্যু, কিম্বা উভয়ের মৃত্যুই তাঁকে প্রত্যক্ষ ক’রতে হবে।
প্রায় দল বেঁধেই তিন প্রকাশনা সংস্থার তিন কর্ণধার হাসপাতালে এসে দাঁড়ান। তাঁরা দেখতে চান, সত্যি দুর্গা বাবু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি কী নেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনো আবেগের স্থান নেই। প্রকাশনা সংস্থা’র কাছে বিপদ আপদের জন্যে অবশ্যই ব্যবস্থা থাকে। দুর্গা বাবু হাত তুলে দিলেই অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে তাঁদেরকে। তাঁরা হাতে অন্য লেখা নিয়েই আজ এসেছেন হাসপাতালে। বেলা তখন সাড়ে চারটে। হাসপাতালের গেটেই দুর্গা বাবু’র সাথে সাক্ষাৎ হ’ল ওঁদের। কিন্তু অবাক হ’লেন অনন্ত বাবুরা। এ তো সেই দুর্গাপদ মজুমদার নয়। ভদ্রলোক’কে দেখে কে বলবে, ওঁর স্ত্রী হাসপাতালে, আর মেয়ে ব্লাড ক্যান্সারের পেশেন্ট! দিব্যি ভদ্রলোক একটি সিগারেট টানছেন বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ওঁদের’কে দেখেই একেবারে এক গাল হেসে দিলেন না বটে কিন্তু বেশ তৃপ্ত তৃপ্ত ভাব ক’রেই বললেন,
— আরে আপনারা যে! কী ক’রে জানলেন, আমি হাসপাতালে?
অনন্ত বাবু ব’ললেন— সেকি! আপনি কি আমজনতা’র মধ্যে পড়েন যে, এমনভাবে ব’লছেন? অবশ্য আমরা আপনার বাড়ি গিয়েই জেনেছি প্রতিবেশীদের থেকে। তা এখন ম্যাডাম আছেন কেমন?
আর একজনের প্রশ্ন— এমনটা হ’লো কী ক’রে, দাদা? ম্যাডামের কি হার্ট প্রবলেম আগে থাকতে ছিল?
প্রবোধ দিতে চেষ্টা করেন দুর্গা বাবু— না না। সে সব তো টের পাইনি। মেয়ে’র কাছ থেকে দুঃসংবাদটা শুনেই উনি ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পড়েন। এই থেকেই একেবারে সোজা নার্সিংহোম।
অনন্ত বাবু বলেন— আপনি কিন্তু একদম চিন্তা ক’রবেন না। ট্রিটমেন্টের কোনো কার্পণ্য ক’রবেন না। আমরা পাবলিকেশন এ্যান্ড রাইটার্স ফোরামের সাথে কথা ব’লবো। টাকা’র অভাব হবে না। একটা এইড পেয়েই যাবো।
কিন্তু সকলকে অবাক ক’রে দিয়ে দুর্গা বাবু জানালেন— না না। আপনারা অযথা দুশ্চিন্তা ক’রবেন না। বিনতা আজ ভালো আছে। অনেক বেটার।
পুলকিত অনন্ত বাবু বলেন— তাই নাকি! বাঃ! সে তো ভালো কথা, দুর্গা বাবু। তা এমন ম্যাজিকটা হ’লো কী ক’রে?
এবারে একগাল হেসে দিয়ে দুর্গা বাবু বললেন— আজকে সকালে আমি ওকে ভিজিট ক’রতে এসে কানে কানে ব’ললাম, ‘তোমার মেয়ে’র ব্লাড ক্যান্সার নয় গো। ওটা ভুল খবর।’ ব্যস্, ম্যাজিক। বিকেলে এসে জানলাম যে, ও বেশ ভালো বোধ ক’রছে। কমপ্লিকেসিগুলো অনেকটা দূর হ’য়েছে।
অনন্ত বাবু একেবারে মুখটা হাঁ ক’রে ব’ললেন— এভাবে জলজ্যান্ত মিথ্যে ব’ললেন! কিন্তু বউদি’কে বাড়িতে এনে কী বলবেন? তখনও তো সত্যিটা সত্যিই থেকে যাবে।
— আমি তো মিথ্যে ব’লিনি, অনন্ত বাবু। আজ সকালেই তো জামাই ফোন ক’রে জানালো, আমার মেয়ের নাম আর পদবী মিলিয়ে আর একজন মেয়ে তার ব্লাড টেস্ট করাতে দিয়েছিলো। প্যাথলজি সেন্টার ভুল ক’রে সেই মেয়েটির রিপোর্ট আমার জামাইয়ের হাতে ধ’রিয়ে দিয়েছিল। আর তা থেকেই এই বিপর্যয়য়। অবশেষে বিষয়টা ধরা প’ড়েছে।
— তাহ’লে তো আনন্দের খবর, বলুন? এক দুপুরে কিন্তু খাওয়াতে হবে।
কিন্তু দুর্গা বাবু মলিন মুখে জানালেন— এটাকে এভাবে ব্যাখ্যা ক’রবেন না। ঐ মেয়েটারও আমার মতো একটি বাবা আছেন, বিনতা’র মতো মা আছেন। তাঁদের অবস্থাও যে আমারই মতো, অনন্ত বাবু। তবে এবারে আপনাদের আরো একটি সুসংবাদ আমি দেবো।
মুখ হাঁ হয়ে থাকা প্রকাশনা সংস্থাদের কর্ণধারদের থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পেয়ে আবার বললেন দুর্গা বাবু— আপনাদের জন্যে লেখার বেশ ভালো ভালো পরিণতি আমার মাথাতে এসে গেছে। আমার থেকে আবার তিনটে ভালো রচনা পাবেন। আমি নিশ্চিত। তাছাড়া আপনারা যে আমাকে নিয়ে এতোটা ভাবেন, এমন চিন্তা-ভাবনা করেন, এটাও কি আগে জানতাম, বলুন? ব’লেছিলাম না, পরমপুরুষ আমাদের থেকে শুধু নেন না। কখন যেন নিঃশব্দে আমাদেরকে দু-হাত ভ’রে দিয়েও যান। রবিঠাকুর লিখেছেন না, ‘দুখের বেশে এসেছ ব’লে তোমারে নাহি ডরিবো হে / যেখানে ব্যথা তোমারে সেথা নিবিড় ক’রে ধ’রিব হে…’।