সন্ধে সাতটা । মোটামুটিভাবে চন্দন ডাক্তারের রোগী দেখা শেষ । খানিক পরেই চেম্বারে, সান্ধ্য আড্ডা শুরু হবে । রথী মহারথীরা এখনও এসে পৌঁছননি । এই অবসরে, সত্য কম্পাউন্ডার জোরে জোরে খবরের কাগজ পড়ছেন । তাঁর বদ্ধমূল ধারণা, জোরে না পড়লে, নিজের কানে ঢোকে না, ফলে যা লেখা আছে সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় । নোয়াখালিতে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তার এই অভ্যেস ।
ইংরেজি ভাষার ওপর তার দুর্বলতা ভয়ঙ্কর । চান্স পেলেই ইংরেজি বলেন আর সেই ইংরেজি শুনে অনেকেই থরথর করে কাঁপে বলে, তার আর এক নাম সত্য কম্পু ।
খবরের কাগজটা অবশ্য তিনি বাংলাতেই পড়েন । মাতৃভাষার প্রতি টান ভয়ঙ্কর । তার মতে, মাতৃভাষা হচ্ছে মাতৃদুগ্ধ পান করার মতো । বাংলা ভাষা, তাই তিনি কখনো ছাড়বেন না ।
নাটু লাহিড়ী অবশ্য অন্য কথা বলেন । তিনি নাকি স্বচক্ষে দেখেছেন, সত্য কম্পু ইংরেজি খবরের কাগজের ওপর জল ছিটিয়ে পড়ার চেষ্টা করছেন । নাটু লাহিড়ীর কাছে ধরা পড়া গিয়ে বলেছিলেন, আজকালকার ইংরেজি তিনি বুঝতে পারেন না বলে জলে ভিজিয়ে নরম করছিলেন।
ক্ষেতু বাগচী ঢুকেই বললেন :-
– বন্ধ কর হে, সত্য !
– হোয়াট ?
– তোমার অই জোরে জোরে খবরের কাগজ পড়া । তাও আবার ওই বিশাল রাজনৈতিক হানাহানির খবর ।
– আই ফ্রম নুয়াখালি ! আমি ডোন্ট কেয়ার কাউকে । হু কী ডু আমাকে ? ডোন্ট কেয়ার আই ।
– আরে না ! তোমার বাংলাটা বড়ই দুর্বল ।
– আফনে হোয়াট স্ফীক ?
– তখন থেকে ত্রুটিকে ক্রুটি উরুশ্চারণ করছো তো ! তাই আর কী !
তরজাটা হয়তো আরও এগোতো, তবে এর মধ্যে এক বিশালবপু মহিলা দুলকি চালে হেঁটে ঢুকে পড়েছেন চেম্বারে !
– ডাইকতারবাবু আছেন ? মহিলার বিনম্র জিজ্ঞাসা।
– হঃ ! ডাক্তারবাবু ফেজেন ! সত্য কম্পুর উত্তর ।
– কোই আচেন ?
– আসতাচেন । আফনে সিট ।
– কী কোইলেন?
– কোইলাম, বয়েন ।
– হঃ ! তয়, অনার কি দেরি হইবো ?
– নো নো ! আইবেন নাউ !
– আপনে কী ভাষায় যে কথা কন ? বুজতে পারতাম না !
– ওই ভাষা আপনি বুজবেন না – ক্ষেতু বাগচী বললেন ।
– হঃ ! আমার নামটা লিখ্খা লন !
– কী নাম আপনার ?
– কৃষ্ণ বিনা প্রাণ বাঁচে না দাসী ।
– ক্ষী !!! সত্য কম্পু প্রায় পড়ে যান আর কী, চেয়ার থেকে ।
– হেই দ্যাহেন ! আমরাগো সব বষ্টুম ! আমার হ্যায়ের নাম হুনলে অজ্ঞান হইবেন, মনে লাগে ।
– ও ! ওইজন্য আপনি দুলে দুলে ঢুকলেন ! এত বড় নামের চাপ ! মনে হলো রাধার দোলায় আগমন । ক্ষেতুদা উবাচ ।
– হ্যাঁ ! এবার গজগজ করবেন যেতে যেতে, তাই রাধার গজে গমন হবে । চন্দন ডাক্তার চেম্বারে ঢুকতে ঢুকতে বলল ।
– আফনারা কী যে কন ! কইতে নাই, তয় কইয়া ফ্যালাই ! আমার হ্যায়ের নাম হইলো গিয়া গোপীজন বল্লভো পদরেণু দাস । বমু এহানে ?
– বসুন বসুন ! চন্দন বলল । আ্যতো বড় বড় সব নামের বাহার, না বসলে খুব মুশকিল !
মহিলা একটা চেয়ারে ওই বিশাল চেহারা নিয়ে বসতেই চেয়ারটা মড়াৎ করে ভেঙ্গে গেল । মহিলা পড়ে গিয়ে এক বিশাল চিৎকার করলেন ।
– ওহো ! আফনে দেখতাসি হেলেন অফ ডেস্ট্রয় ! সত্য কম্পু মহিলাকে হাত ধরে তুলতে তুলতে বললেন ।
– হুম ! একই অঙ্গে দুটো রূপ ! হেলেন আর রাধা ! ক্ষেতু বাগচী উবাচ ।
উঃ ! আঃ ! করতে করতে একটা কাঠের চেয়ারে বসলেন মহিলা, সত্য কম্পুর সাহায্যে । দেখা গেল তেমন কিছু হয়নি । খালি, কনুইয়ের কাছটা একটু ছড়ে গিয়েছে । ডেটল দিয়ে ওয়াশ করে, একটা ব্যান্ড এড লাগিয়ে দিলেন সত্য কম্পু ।
মহিলা ধাতস্থ হয়ে বললেন – আমারে একটু দ্যাহেন ডাইকতার বাবু ।
– কী হয়েছে আপনার ?
– কী আর কমু, ডাইকতার বাবু ! ফরশু দিন আমাগো বাড়ি আইসিলো আর এক বষ্টুম । আমাগো বাড়িত্ কলাগাছে বড় বড় পুরুষ্টু কলা হইসে । কলা দেইখ্যা কয়- জয় রাধে ! কয়েকটা কলা দিবা ? সেবা করতাম ।
রাইগ্যা কইলাম, মুই বোষ্টুম, হ্যায় বষ্টুম, বষ্টুম মোর পোলা/ তিন বষ্টুম ঘরে থাইকতে, পরে খাইবো কলা ? কী করসে, কে জানে, তারপর থিকা শরীর তাজ্জিম – মাজ্জিম করত্যাসে ।
– এ যে দয়াল বাবা, কলা খাবা কেস ! চন্দন বলল ।
– একে একটা টেট ভ্যাক পুশ করে দাও আর “পাস্তুর” নামটা দশবার মাথার ওপর জপে দাও হে চন্দন ! ক্ষেতু বাগচীর পরামর্শ ।
– টেট ভ্যাকটা না হয় বুঝলাম, পড়ে গিয়ে কনুই ছড়ে গিয়েছে, কিন্তু “পাস্তুর” নামটা দশবার মাথার ওপর জপ করে দেবো কেন? বড্ড আনসায়েন্টিফিক কতা- বার্তা বলছেন আজকাল ক্ষেতুদা ! তাছাড়া, ওনাকে তো কুকুরে কামড়ায়নি ।
মহিলাও মওকা পেয়ে বললেন-
– হ ! হ ! দাদুয়ে ঠিক কথা কইসেন । আমাগো তো ঝাঁড়ফুকেরি দস্তুর ! অই যে কী কইলেন – পাতুরী না কি, ওইটা জইপ্যা দ্যান । নিরামিষ অইলেই অইল ।
– বুঝলে হে চন্দন ! কেন যে বললাম কথাটা তার একটা ব্যাখ্যা দেবো তোমায় । তবে, হঠাৎ এই মহিলা পাতুরী আর নিরামিষের কথা বললেন কেন ? বৈষ্ণবরা তো নিরামিষই খায় ।
– হঃ! হগ্গলই নিরামিষ । আমাগো গুরুদেবও কইতেন, মাচ খাবা তয় কাঁচকলা দিয়া রাইন্ধা । মাচ নিরামিষ হইয়া যাইবো গিয়া । আমরা মাচ খাই, তয় কাঁচকলা দেই মাচের ঝুলে । পুরা নিরামিষ । আঁশ পুরা বারণ আমাগো ।
– এটা আপনি ঠিক বলেছেন । শাস্ত্রেই আছে :- ইল্লিশ, খল্লিস, ভেটকি, মদগুর এব চ / রোহিত রাজেন্দ্র, পঞ্চমৎসানিরামিষাঃ । ক্ষেতু বাগচী একটানা শ্লোক বলে দমনিলেন । মহিলা, কি বুঝলেন কে জানে ? হাত জোড় করে- জয় রাধে বলে চেঁচিয়ে উঠলেন ।
– মিনিংটা কন ! সত্য কম্পুর ক্ষেতুদাকে জিজ্ঞাসা ।
– শাস্ত্রে বলছে- ইলিশ, খলসে, ভেটকি, মাগুর আর রুই মাছ, এই পাঁচরকম মাছই নিরামিষ ।
– আফনে বাউন ? মহিলার জিজ্ঞাসা ।
– খাস আই এস আই মার্কা বারিন্দির বাউন আমি। ক্ষেতুদার বুক চিতিয়ে উত্তর । তারক মোত্তির এর মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন । বললেন,
– পাকিস্তান সরকার কি আপনাকে কি এই সার্টিফিকেট দিয়েছে নাকি, ক্ষেতুদা ?
– বড্ড প্যাঁচ হে তোমার মনে ! ক্ষেতুদা বিরক্ত । এটা পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স নয় । ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউট !
– বারিন্দিরের মনে প্যাঁচ থাকবে না ? কী যে বলেন ! তালে, আর বারিন্দিরদের কী বৈশিষ্ট্য রইল ? তারক মোত্তির কান খোঁচাতে খোঁচাতে উত্তর দিলেন । মহিলা,মনে হলো একটু চাঙ্গা হয়েছেন । বললেন,
– তাইলে ঠাকুরমশাই, অই মাচগুলা রান্না করলে আর কাঁচকলা লাগবো না কইত্যাচেন ?
– আলবাৎ ! মৎস্যপুরাণের শ্লোক বলে কথা ।
– বাঁচাইলেন ! আফনেই কন, কাঁচাকলা দিয়া ইলশা খাইতে ভালো লাগে ? মরিচপোড়া ঝুল আর সরিষা বাটা দিয়ে অয়নে খামু ! আঃ ! আচ্ছা, ঠাকুর মশাই, ইচা মাচ খাইতে পারুম ?
– শ্বেত সর্ষপ সহযোগে চিংড়ি অতি উপাদেয় । কোনো দোষ নাই ।
– কী কইলেন ?
– বলছি, সাদা সরষে বাটা দিয়ে ডাব চিংড়ি মানে ইচা মাছ খান, কোনো দোষ নাই । ডাব থাকলে চিংড়িওনিরামিষ ।
– বাঁচাইলেন ! হ্যায়রে গিয়া কমু অনে ! আমার শরীলটা অয়নে একটু ভাল্ লাগত্যাসে । ঠিক জায়গাত্ আসছি । কত্ত নাম ডাইক্তারবাবুর !
– কিন্তু, ক্ষেতুদা ! চন্দন ভুরু কুঁচকালো ।
– বল হে !
– হঠাৎ, পাস্তুরের নামটা জপ করতে কেন বললেন ?
– সে অনেক কথা ! দাঁড়াও ! একটা সিগারেট ধরিয়ে নিই ! বল- হরিকে বল চা দিতে !
– আমারটা ভাঁড়ে দিতে কইয়েন, মহিলা যোগ দিলেন । হরি হরি বলে একটু জপও করলেন বোধহয় ।
– চিকেন রোল খাবেন, ক্ষেতুদা ?
– আনাবে ? আনাও ! কি দিদি, আপনিও খাবেন নাকি ?
– কি খামু ?
– ওই যে চিকেন রোল ! মানে, মুরগীর মাংস ঝাল ঝাল করে কষে, পরোটা দিয়ে জড়ানো !
– কাঁচকলা থাকবো তো !
– না না ! কাঁচকলা থাকলে টেস্ট খুলবে না !
– তাইলে বাদই দ্যান । হরি, হরি ! জিভের জলটা বোধহয় পড়ল শাড়িতে ।
বল হরি চা দিয়ে গেল । শব্দ করে চুমুক দিলেন ক্ষেতু বাগচী । মহিলাও, শাড়ির আঁচল দিয়ে চায়ের গ্লাসকে ধরে চায়ে ফুঁ দিয়ে একটা চুমুক দিলেন । সিগারেট ধরিয়ে ক্ষেতু বাগচীর কথকতা আরম্ভ হলো –
– গত বছরের শীতকাল ! প্রচণ্ড ঠান্ডা । বোয়েচ ? একটা জরুরী কাজ সেরে ফিরতে রাত বারোটা হয়ে গেছে । ট্যাক্সিটা বড় রাস্তায় ছেড়ে দিতে হয়েছে ড্রাইভার গলিতে আসবে না বলে। হেঁটে পাড়ায় ফিরছি । ঠিক, গলির মোড়ের একটু আগে আমাকে চারধার দিয়ে ঘিরে ধরল, গোটা কয়েক নেড়ি । আমাকে দেখে গোঁ গোঁ করে মাটি আঁচড়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে । চারদিক দরজা জানলা বন্ধ । দৌড়ে গিয়ে যে কারও বাড়িতে উঠবো, তারও উপায় নেই । চট করে, মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল । নেড়ীদের অনেক কমন নাম থাকে । কালু, ভুলু, লালু,হেগো- এরকম আর কি ! আমি জোরে জোরে ওইসব নামগুলো বলে তু-তু করতে লাগলাম । তিনটে নেড়ি দেখি গোঁ গোঁ ছেড়ে, ল্যাজ নাড়তে লাগল । বাকিদেরও গোঁসা দেখলাম কমের দিকে । এই অবসরে আমি গলিতে ঢুকে পড়লাম । পাড়ার নেড়িগুলো আমায় চেনে । ওই নেড়িগুলোকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে তাড়িয়ে নিয়ে গেল ।
– এর সঙ্গে, পাস্তুরের সম্পর্ক কী? তারক মোত্তির বললেন ।
– সেটাই তো বলছি । এইসব নেড়িদের চিৎকার শুনে একটা ফ্ল্যাট বাড়ির পোষা অ্যালসেশিয়ান জলদ গম্ভীর স্বরে বকতে লাগল । নামটা জানতাম । বললাম- টাইগার, পাস্তুর ! বকাটা থেমে গেল । শিক্ষিত কিনা ! নেড়ি হলে বুঝতে পারতো না ।
মহিলা মন দিয়ে শুনছিলেন । তার প্রতিক্রিয়া
– তাইলে ডাইকতার বাবু, আফনে আমার মাথার উফরে লালু নামটাই জইপ্যা দ্যান । ওই বোষ্টুমের লগে একটা নেড়ি আইসিল । তারে, লালু কইরা ডাকতাছিল অই মিনষা । পাতুরীতে কাম নাই ! বাড়ি গিয়া ইলশা মাছের পাতুরী খামু অনে ।
চন্দন বলল- আচ্ছা দিদি আমি সাধু নই ! ডাক্তার ! আপনি বরং ওই ঠাকুরমশাইয়ের কাছ থেকে মাথায় জপ করিয়েনিন । সেরে গেলে, ভালো হয়ে যাবেন । তারক মোত্তিরও সায় দিলেন ।
ক্ষেতু বাগচী রেগে বললেন- এইজন্যই আমি আড্ডায় আসি না ! যত্তসব ফাতরা কথা ! বলে তীর বেগে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলেন ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।