টেংরা মাছের বিষ! নাম শুনলেই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে! এর কাঁটার ঘা একবার যে খেয়েছে সে-ই বলতে পারবে এতটুকুন মাছের ভেতরে কতটা বিষ আর ত্যাজ লুকিয়ে আছে। টেংরার বিষাক্ত কাঁটার ঘা খাওয়ার দুর্ভাগ্য আমার একবার হয়েছিল। এতে কী আছে তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম!
মাছটা দেখতে সুন্দর, খেতেও বেশ কিন্তু আদরে আরাম নেই। গায়ে হাত দিলেন তো মরলেন। সুঁচালো শক্ত কাঁটার একটু খোঁচা লাগলেই বুঝবেন মজাটা। সময় পাবেন না কান্নার। সহসা ব্যথা কমবে না। ওঝা ফকির ডাক্তার কবরেজ পর্যন্ত ছুটতে হবে। এরই নাম টেংরাবিষ!
শরীরে এ বিষ নিয়ে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায় টেংরা-টেংরিরা। কাউকে পাত্তা দিতে চায় না এরা। আমরা যেমন বড়দের সম্মান করি, ভয়ে দূরে সরে দাঁড়াই; মাছেরাও তেমন তেমনটিই করে থাকে। টেংরা-টেংরিরা কিন্তু এমনটি করে না। এরা ছোটদের চেয়ে বড়দের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে বেশি। সে ঘোরাফেরার মধ্যে কোন সৌন্দর্য নেই; আছে নির্ভেজাল অহংবোধ।
বোয়ালের মুখ বড়-খায় বেশি-বুদ্ধি কম। তার ুধা লাগলে আর হুঁশ থাকে না। একদিন এক ুধার্ত বোয়াল খাবারের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখল সামনে টেংরা-টেংরিরা দলবেধে মনের আনন্দে লেজ নেড়ে মোছ পাকিয়ে ঘোরাফেরা করছে। ুধার্ত বোয়াল আর লোভ সামলাতে পারেনি। নানা রঙের সুন্দর মাছগুলো নিশ্চিত খেয়ে ফেলবে মনে করে আনন্দে তিনটে ডিগবাজি খেয়ে নিল সে। বোয়াল তার তেজস্বী ও বাহাদুরি ভাবটা টেংরাদের দেখিয়ে নিল একটু। কিন্তু টেংরা-টেংরিরা তার হম্বি-তম্বিকে কোন পাত্তাই দিল না। রাগে বোয়ালের ুধার পেটে আগুন ধরে গেল। সে দাঁত কটমটিয়ে মনে মনে বলল, এক খাবলে যেখানে তিন চারটে টেংরা খেতাম এখন টেংরার পুরো দলটাই খেয়ে ফেলবো আমি। এই বলে বোয়াল হা করে টেংরা-টেংরির দলের কাছাকাছি চলে গেল। টেংরা-টেংরিরা বোয়ালের বিশাল হা-করা মুখ দেখে একজন আরেকজনের গায়ে ধাক্কা দিয়ে মুখ টিপে হাসি-তামাশা করতে লাগল। আর যায় কোথায়! ‘আমার সাথে মশকরা!’ –বলেই ুধার্ত বোয়াল বিশাল হা-করে ঝাপিয়ে পড়ল টেংরা-টেংরির দলে। গপাস গপাস করে প্রায় দশটা টেংরা-টেংরি মুখের ভেতরে লুফে নিল সে। প্রচন্ড রাগে মাছগুলোকে পিষে ফেলার জন্যে দিল একটা চিবান। উফ্! ওরে বাবারে, মরে গেলাম রে বলে বোয়াল লেজের প্রচন্ড আঘাতে পানি থেকে প্রায় সাত হাত উপরে উঠে লাফিয়ে পড়ল পানিতে। বোয়াল অর্ধ হা করা রক্তাক্ত মুখে পাগলের ন্যায় ওল্টে-পুল্টে এদিক-ওদিক উর্দ্ধশ্বাসে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। তার দৌড়াদৌড়ি আর বেশামাল তান্ডবে বিলের মাছগুলো প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল। বিল জুড়ে শন্শন্, পন্পন্, ভন্ভন্ শব্দতরঙ্গ। দেখতে দেখতে নদীর স্বচ্ছজল ঘোলাটে হয়ে হয়ে গেল।
নীরব-নিস্তব্দ চিনাদী বিল। ঘোলা জল থিতিয়ে স্বচ্ছ হয়েছে। মাছেরা খুব ভয়ে চলাফেরা করছে। এরই মাঝে আহত বোয়াল ধীরে ধীরে অন্যান্য মাছের কাছে এসে নালিশ করল। বোয়ালের হা-করা ফোলাফাঁপা মুখের সব কথা পরিস্কার বুঝতে পারেনি তারা। তবে আহত বোয়াল যে সবার কাছে টেংরা-টেংরিদের বিরুদ্ধে নালিশ করে এদের বিচার চাইছে তা ঠাওর করতে পারল সবাই।
বোয়ালের দুরবস্থা দেখে সবাই ব্যথিত হলো। টেংরা-টেংরিদের অসম্ভব বাড়াবাড়িতে সবাই অতিষ্ঠ। নদীতে শান্তিতে বসবাস করতে হলে এদের অহংকার চূর্ণ-বিচূর্ণ করতেই হবে। ছোট বড় সকল মাছ এক হয়ে গোপনে পরামর্শ করতে লাগল। তবে ওদের সাথে সরাসরি মারামারিতে যেতে চাইল না কেউ। এতে ঘা-গুঁতো খেয়ে অচল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। চিকন বুদ্ধিতে কাজ সারতে হবে। অনেক পরামর্শ ও বুদ্ধি-বিবেচনার পর কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো- টেংরা-টেংরিদের মধ্যে কৌশলে ভয়াবহ ঝগড়া বাধিয়ে দিতে হবে। এদের বিষাক্ত কাঁটার ঘায়ে এরাই শেষ হোক।
যেই কথা সেই কাজ। নানা কথাতে, নানা কৌশলে আর প্রশংসার জোরে টেংরা-টেংরিদের মধ্যে বাধিয়ে দেয়া হল মহা গন্ডগোল। এরা একে অন্যের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে গেল। টেংরারা টেংরিদের বলছে, এতবড় সাহস তোদের, আমাদের সাথে লড়াই! টেংরিরা বলছে আমরা তোমাদের অধীনে থাকবো কেন? আমাদের কাটার বিষ তোমাদের বিষের চেয়ে অনেক বেশি। অন্যেরা তোমাদের ভয় পায় না; ভয় পায় আমাদেরকে। আমাদের দিয়ে তোমাদের এত বড়াই। শুরু হয়ে গেল মরণপণ লড়াই। কেউ হারে না, কেউ ভাগে না। কেউ মানছে না পরাজয়। সবাই সমানে সমান।
কাঁটার ঘায়ে টেংরা-টেংরিদের শরীর রক্তাক্ত হয়ে গেল। বিলের পানি লাল হয়ে উঠল। কান্ত-শ্রান্ত রক্তাক্ত টেংরিরা জীবন থাকতে হার মানবে না বলে শপথ নিল। এ কথা শুনে টেংরারা তাদের টেংরাত্ব বজায় রাখার জন্য মরিয়া হয়ে লড়াই করে যাচ্ছে। ওদের শরীর হচ্ছে ত-বিত। ‘জীবন থাকতে পরাজয় মানব না’-এই তাদের পণ। আহারে! সে কি ভয়াবহ যুদ্ধ!
টেংরা-টেংরিদের লড়াইয়ের ত্যাজ ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগল। এরা ত-বিত-অচল এবং মৃতপ্রায়। পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। কোনমতে একটু এগুতেই ওরা চীৎ হয়ে পানিতে ভাসতে থাকে। এদের ধবধবে সাদা বুক রৌদ্রের উজ্জ¦ল আলোতে চিকচিক করে উঠছে। শান্ত বিলের অশান্ত মাছেরা আশপাশে এসে ভীড় করে দেখছে ওদের। যুদ্ধাহত টেংরা-টেংরিদের নির্মম পরিণতি দেখে আঁৎকে উঠে সবাই। যুদ্ধের কী নির্মম পরিণতি!
হঠাৎ আলো-ছায়ার ঝাপটানি। উপরে বড় বড় পাখা মেলে উড়ছে চিল আর শকূণেরা। দূরাকাশ থেকে ওদের শ্যোণদৃষ্টি পড়ছে এখানে। এদের চিঁ-চিঁ, কি-হি-ই, কি-হি-ই শব্দের ভেতরে বেজে ওঠেছে অশনি শংকেত। প্রচন্ড অহংকারী যুদ্ধাহত টেংরা-টেংরিদের রেখে সরে গেল সবাই।
ক্ষুধার্ত চিল শকূনেরা তীর বেগে নেমে পড়ল বিলে। দেখতে দেখতে আহত, মৃতপ্রায় টেংরা-টেংরিদের টপাটপ গিলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে চলে গেল তারা।
উৎপাৎ উপদ্রবহীন চিনাদী বিলে টেংরা-টেংরিদের খুব একটা দেখা যায় না এখন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।