মিনহাজের গোয়েন্দা অভিযান—- কা জী মু হা ম্ম দ সো লা ই মা ন

ঘড়ির দিকে আবার তাকাল মিনহাজ। এখন রাত একটা। সে সবার দিকে তাকাল। কারো চেহারা দেখা যাচ্ছে না। অথচ তার আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। আশরাফ, সাবিবর, আলম, শিহাব ও মাহবুব। তাতুম মিনহাজকে আবার সর্তক করল, ঘড়ির বাতিও জ্বালানো যাবে না। দু’মিনিট পর হাতের পেন্সিল ব্যাটারীটা জ্বালাল তাতুম নিজেই। বাটির উপর পড়ে থাকা স্বর্ণগুলো চিকচিক করে উঠলো। সবগুলো স্বর্ণ আবার নেড়েচেড়ে দেখল সে।

তোমরা বসে পড়ো। আদেশ দিলো তাতুম।

তারা নিঃশব্দে মাটির শয্যায় বসে পড়লো। মন্ত্র পাঠ শুরু করল তাতুম। তার মন্ত্র পাঠের শব্দ ভেসে আসতে লাগল তাদের কানে। উত্তেজনায় কেঁপে উঠল মিনহাজ। তার বুকের তন্ত্রি গুলো আনন্দে নাচানাচি করছে। ‘‘আর কিছুক্ষণ পর আমরা বিশাল ধনের মালিক হয়ে যাবো। এত অল্প বয়সে লাখপতি! কি বেকুব আমাদের বাবা-মায়েরা। তারা কোন ঝুঁকি নিতে কেন চায়নি, আমি এখনো ভেবে পাচ্ছি না? তারা কি কখনো পড়েনি, ঝুঁকি নাইতো, অর্জন নাই? অমত্মত দাদুর তো পড়ার কথা, অথচ তিনিও শুধু বাঁধা দিয়ে গেছেন।’’ ভাবতে ভাবতে তাতুমের মন্ত্র পাঠ শুনতে লাগলো মিনহাজ। অর্থগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করলো। না, কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। হয়ত সে অন্য কোন ভাষায় মন্ত্র পাঠ করছে। মন্ত্র পাঠ বন্ধ হলে আবার কিছুক্ষণ চুপ থাকলো তাতুম।

‘তোমাদের কেউ নাড়াচাড়া করেছে।’ সে বললো।

‘না তো, আমাদের কেউ নাড়াচাড়া করেনি।’ জবাব দিলো মিনহাজ।

‘অবশ্যই করেছে।’ তার দৃঢ় কণ্ঠ ভেসে আসলো। ‘আমার মন্ত্র পাঠ ব্যর্থ হয়েছে। কত বারই না বললাম, নড়াচড়া সম্পূর্ণ নিষেধ।’

হাতের পেন্সিল ব্যাটারীটা আবার জ্বালাল সে। স্বর্ণ গুলো এই মৃদু আলোতে আবার চিক চিক করে উঠলো। ব্যাটারীর আলো দিয়ে সবাইকে দেখে নিয়ে আবার কড়া নির্দেশ জারী করলো, ‘একটু ও নড়াচড়া করা যাবে না। আমাকে আবার নতুনভাবে সবকিছু শুরু করতে হচ্ছে।’

মন্ত্র পাঠ শুরু করল সে। আবারো ভাবনার উষ্ণ জগতে নিজেকে সঁপে দিলো মিনহাজ। বৃহত্তম কোনকিছু পেতে হলে বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আজ স্বপ্নকে বাসত্মবে রূপ দেবার দ্বারপ্রামেত্ম তারা। সবাই যখন এতগুলো স্বর্ণ তার হাতে দেখবে আমাকে নিয়ে কি না নাচানাচি করবে? সবাই আমাকে ডাকবে, সোনালী বালক।

তাতুমের ডাক শুনে তার সম্বিত ফিরে আসলো। ‘কে আমার সাথে যাবে?’

‘আমিই যাব।’ লাফিয়ে উঠলো মিনহাজ।

‘তুমি দারুণ সাহসী, তোমাকে আমার দরকার। বিপদ দেখলে ভয় পাবে না তো?’

‘কি ধরনের বিপদ?’ জানতে চাইল মিনহাজ।

‘ওরা কি এমনে ছেড়ে দেবে? তারা কখনো বাঘ, কখনো সিংহ, কখনো সাপের রূপ ধরে তোমাকে ভয় দেখাবে। তোমার দায়িত্ব হবে, ভয় না পাওয়া। যদি একটুও ভয় পাও, তবে বিপদ। নিশ্চিত মৃত্যু।’

শুনে সত্যি ভয় পেল মিনহাজ। তার মনোবল ভেঙে গেছে। কারো যদি মনোবল নষ্ট করা যায়, তাকে আর যুদ্ধ করে পরাসত্ম করতে হয় না, এমনিতে ভেঙে পড়ে। ভয়ে মিনহাজ যেতে অস্বীকার করলো। তাতুম খুবই হতাশ হল। তার দু’নাকের ছিদ্র দিয়ে বড় নিঃশ্বাস বের হবার শব্দ হল। সবাই সে নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল।

‘আর কেউ রাজি আছ?’ আবার জানতে চাইল সে।

আশরাফ চুপ।

সাবিবর চুপ।

আলম চুপ।

মাহবুব চুপ।

শিহাবও চুপ।

‘আমাকে একাই যেতে হবে। জানতাম সব কষ্ট আমাকে সহ্য করতে হবে।’ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সে। এবার নতুন নির্দেশনা জারি করলো। ‘তোমরা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক। সাবধান, হাতে মুষ্টিবদ্ধ করাও যাবে না। আমি না আসা পর্যমত্ম তোমাদের এভাবে থাকতে হবে। না হলে ভয়ংকর বিপদ হতে পারে। সাবধান! আবার বলছি, সাবধান।’

সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লো। তাতুম নতুন করে মন্ত্র পাঠ শুরু করেছে। তার এগিয়ে যাওয়াটা বুঝা যাচ্ছে মন্ত্র পাঠ হতে। শব্দ গুলো ক্রমশ দূর হতে দূরবর্তি হচ্ছে।

মফিজুর রহমানের ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেয়াল হাতড়ে সুইচ চালু করল সে। টেবিলে রাখা জগের দিকে তাকাল। কোন পানি নেই সেখানে। পানির খুবই তৃষ্ণা পেয়েছে। মিনহাজের কক্ষের দিকে তাকিয়ে ডাক দিল। মিনহাজ মিনহাজ…

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আবার ডাকল, মিনহাজ… মিনহাজ…

এবারও কোন সাড়া শব্দ নাই। বিছানা ছেড়ে উঠে মিনহাজের দরজায় টোকা দিল।… এবারও একই অবস্থা।

উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, শিকল লাগানো। আতঙ্কিত হয়ে উঠল মফিজুর রহমান। ছেলেটা আজ আবারও বাইরে চলে গেল। ততক্ষণে সেখানে এসে পৌঁছেছে মালেকা। তার পিছনে পিছনে মিনাও। তারা তিন জন টর্চ হাতে বেরিয়ে গেল মিনহাজকে খুঁজে বের করতে। গতবার যখন এ ঘটনা ঘটেছিল তখন পুরো পাড়া জুড়ে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল। শেষে তাদের সবাইকে পাওয়া গিয়েছিল মাহবুবদের ঘরে। সেখানে গিয়ে মাহবুবের মাকে ডাকা হল। দেখল মাহবুবও নাই। বাড়ির সবখানে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। কাউকে পাওয়া গেল না। তাদের চেঁচামেচিতে আরো কয়েকজন এসে জড়ো হলো সেখানে। সবখানে খোঁজা হচ্ছে তাদের, কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ভয়ে কেঁদে দিল মিনা। ডাক দিলো, ‘ভাইয়া, ভাইয়া।’ মালেকাও কান্না দমিয়ে রাখতে পারছে না। সমত্মানের জন্য তার বুকে শোকের পাথার উপচে পড়ছে। ক্রমশ অনেক লোক এসে জড়ো হলো। সবার হাতে টর্চ। যতই সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, সবার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ততই বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণ। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল পাড়ার অনেক গুলো ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরে ঘরে উঠল কান্নার রোল। সবাই পুকুর, ঝোপ জঙ্গল, গাছের শাখায় শাখায় টর্চ মেরে তাদের খুঁজতে লাগল। না, কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আতঙ্কে অনেকে আজান দেওয়া শুরু করল। মফিজুর রহমান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত ২.৩০। সকাল হবার বাকী অনেক-

কয়েকজন মিলে চলে গেল পাশের পাড়ায়। ওখানেও একজন তান্ত্রিক থাকে। রফিক। তাকে নিয়ে এল তারা। সে এসে একটা বই খুলল। বইটা হরেক রকম নকশায় ভরপুর। বিচিত্র সব নকশা। এটা তাবিজের কিতাব। রফিক বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা পাতায় থামল। সবার চোখ জোড়া তার দিকে চেয়ে আছে। সে এক গ্লাস পানি চাইল। মুফিজুর রহমানের এবার মনে পড়লো, তার গলা শুকনো। পানি পান করা দরকার। পানি আনা হলে মুফিজুর রহমান প্রথমে পান করার পর বাকীটা রফিকের দিকে এগিয়ে দিলেন। মন্ত্র পড়ে মাটির উপর একটা নকশা এঁকে তার উপর পানি চিটিয়ে দিল রফিক। মিনাকে বসাল সে নকশার সামনে। মনে মনে কি যেন পড়ে ফুঁক দিলো মিনার চোখে। মিনার চোখ গুলো বন্ধ হয়ে গেল।

রফিক মিনার কাছে জানতে চাইল, তারা এখন কোথায়?’

মিনা জবাব দিল, ‘তারা সবাই পাড়ার বাইরে একটা মাঠে ঘুমিয়ে আছে। তাদের সামনে বিপদ। এমনকি মৃত্যুর আশঙ্কাও আছে।’

মিনার কথা শুনে সবাই কেঁদে উঠল। রফিক মিনার চোখে আবার পানি ছিটিয়ে দিলে মিনা চোখ খুলল। তৎক্ষণাৎ সবাই উল্লুক ভিটার দিকে দৌড় দিলো তাদের খোঁজে। ঘরে ঘরে মহিলারা মাতম করছে।

কেন তারা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে?

 

 

 

 

 

মিনহাজ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে, ভাবল মফিজুর রহমান।

তাকে খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। তার পুরো মুখমন্ডল ঘন মেঘের কালো চাদরে আবৃত। যেন এক্ষুণি বৃষ্টি হবে। কিছুক্ষণ পর তার দু’চোখ হতে বেরিয়ে আসতে লাগল কান্নার বৃষ্টি। সে বৃষ্টিতে তার কষ্ট মোড়ানো হৃদয়টা হাল্কা হবার পরিবর্তে আরো মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। উদ্বেগ উত্তেজনার শীতল শিহরণ তার শিরায় শিরায় বয়ে যাচ্ছে। সে দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছে, মিনহাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। ধ্বংসের সব গুলো লক্ষণ ফুটে উঠেছে তার আচরণে। স্কুল পালানো তার কাছে ডাল-ভাত। শিক্ষকদের হাতে অনেকবার মার খেয়েছে সে। তবুও থামে নি। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্ত্তটিকে সে সমানে অপচয় করে। যার দাম কোটি টাকার উপরে। তাকে অনেকবার প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘তুমি কি পৃথিবীর সবচে মূল্যবান বস্ত্তটি কি জান?

মিনহাজ এখনো এই উত্তর খুঁজে বের করতে পারেনি। ইশারা ইঙ্গিতে বস্ত্তটি তার হাতে তুলে দিতে চেয়েছে মুফিজুর রহমান, কিন্তু লাভ হয়নি। পৃথিবীর সবচে মূল্যবান বস্ত্তটি কি, মিনহাজ জানে না, জানতে চায়ও না। এখনো তাকে বুঝানো যায়নি ঐ বস্ত্তর গুরুত্ব। নাতিকে অনেকবার উপদেশ দিয়েছে সে। তাকে অনেক ভাবে বুঝাতে চেয়েছে সে অবাধ্য জন্তুটির কথা, যাকে পৃথিবীর সমসত্ম শক্তি দিয়েও ধরে রাখা যায় না। পুরো শক্তিকে দুমড়ে মোচড়ে সে তার চলার পথ করে নেয়। মিনহাজের বন্ধু মহল নিয়ে শিক্ষকেরা ঘোর আপত্তির কথা তাকে জানিয়েছে অনেকবার। ভাবতে ভাবতে ধ্যানমগ্ন হয় মফিজুর রহমান। তাকে ভাবতে হচ্ছে কীভাবে মিনহাজকে সঠিক পথে আনা যায়। ক্রমশ নিরব হয়ে আসছে মফিজুর রহমান। একটা পথ বের করে আনতে হবে এভাবে। পৃথিবীর সমসত্ম জ্ঞানের উৎস হলো এই ধ্যান। জ্ঞানের পথ অর্ধেকে থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু ধ্যানের পথ থমকে দাঁড়ায় না। এ ধ্যান হতে নতুন নতুন জ্ঞান বের হয়ে আসে। ভাবনার জগতে মফিজুর রহমান এত বেশি নিরব নিশ্চল হয়ে গেলো যে, যেন বজ্রাহত মৃত ব্যক্তি।

‘ইউরেকা, ইউরেকা। পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি।’ চিৎকার দিলো মফিজুর রহমান।

‘দাদু তোমাকে ডাকছে ভাইয়া।’ মিনা বিছানায় শুয়ে থাকা মিনহাজকে বলল।

শুনে মুখ বিকৃত করল মিনহাজ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে উঠে দাদার ঘরের দিকে যাত্রা করল। দাদু এক্ষুণি এক গাঁদা উপদেশ দিবে। এটা তার জীবনের অপরিহার্য্য অঙ্গ। উপদেশগুলো শুনতে শুনতে তার কান ঝালাপালা। দাদুর কক্ষে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন করল ‘দাদু, ডাকছেন কেন?’

‘কেন, ডাকব আর? একটা মুমূর্ষু লোককে বাঁচানোর জন্য।’

‘আমি কী মুমূর্ষু?’ আশ্চর্য্য হয়ে জানতে চাইলো মিনহাজ।

‘মুমূর্ষু নয়তো কি? যে আত্মহত্যার চেষ্টায় লিপ্ত তাকে আর কি বলা যায়? শোন, আকাশ হতে নেমে আসা বিপর্যয় এড়ানো যায়, কিন্তু আতমসৃষ্ট বিপদ এড়ানোর পন্থাটা কী? ’

‘মানুষ কী বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে?’ নম্র সুরে প্রশ্ন করল মিনহাজ।

‘তুমি এমনটা প্রশ্ন করলে যাতে স্পষ্ট বুঝা যায়, তুমি কত পিছিয়ে আছ। একজন মানুষের বুদ্ধিমত্তা যাচাইয়ের মাধ্যম হচ্ছে, তার কৃত প্রশ্ন।’

‘আমি কী বিপর্যয় তৈরি করছি?’

‘তুমি কি দেখতে পাচছ না, তোমার বিপর্যয়টা কি? তুমি কী ঠিকমত লেখাপড়া করছ?’

দাদু ঐ সব লেখাপড়া আমাকে দিয়ে হবে না। হাবিব স্যার গতকালও বলেছে, আমার মাথায় নাকি কিছু নাই। একদম খালি।

ওহ! দুঃখের একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল দাদুর বুক বেয়ে। চোখ দুটো বন্ধ করল সে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলা শুরু করল, ‘জাতি শিক্ষকদের কাছ থেকে এমন কথা প্রত্যাশা করে না। যে এমন কথা বলতে পারে, নিশ্চয় সে শিক্ষক হবার উপযুক্ত না। শিক্ষকতায় আসার পর অমত্মত তাদের উচিত ছিল, আইনষ্টাইন, বাফুন প্রভৃতি ব্যক্তির জীবনী পড়া। আইনষ্টাইন সম্পর্কে শিক্ষকেরা মমত্মব্য করেছিল, তার মাথায় গোবর ছাড়া আর কিছুই নাই। তাকে স্কুল হতে বহিষ্কার করেছিল। বিজ্ঞ মাতা সমত্মানের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন। তিনি সমত্মানের সম্ভাবনাকে বুঝতে পেরেছিলেন। অলস বাফুনের স্মরণ শক্তি ছিল কম। আর্থিক অবস্থা ছিল ভাল। ছিল সাংঘাতিক রকমের অলস। বাফুন সিদ্ধামত্ম নিলেন অলসতা তাড়িয়ে দেবেন। ভৃত্য যোশেফকে বললেন, ‘আমাকে উঠিয়ে দিতে পারলে- প্রতিদিন একটাকা পুরস্কার।’ প্রথম দিন যোশেফ তাকে উঠাতে গিয়ে তার কিল ঘুষি খেয়ে আর কাজ করল না। জেগে ওঠার পর বাফুন তাকে তিরস্কার করলেন। দ্বিতীয় দিন বাফুন অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে ঘুম হতে উঠলো না। দুপুরে আবার যোশেফকে তিরস্কার করলেন। তৃতীয় দিন যোশেফ কোন কথা না শুনে বাফুনের বিছানায় পানি ঢেলে দিল। বাফুন উঠে গেলেন। যোশেফ পুরস্কার ফেল। সেই বাফুন প্রতিদিন নয় ঘন্টা করে চল্লিশ বৎসর পরিশ্রম করেছে। একদিনও নষ্ট করেনি। অনেক গুলো বই লিখেছেন। প্রতিটি বই কয়েকবার লিখেছেন। এমন কি একটা বই এগার বার পর্যমত্ম লিখেছেন।

‘যদি তাই হয়, তাহলে আমার সমস্যাটা কি?’ জানতে চাইল মিনহাজ।

‘তুমি।’ জবাব দিলো দাদু,

‘আমি আমার সমস্যা? কীভাবে?’

‘কারণ, তুমি তোমাকে চিনতে পারনি।’ দাদু জবাব দিলো।

‘কি-যে বল না দাদু। আমি আমাকে ভাল করেই চিনি। আমি মিনহাজ। আমার বাবার নাম আব্দুল আলিম। মায়ের নাম মালেকা। আমার দাদুর নাম মফিজুর রহমান। দাদীর নাম রায়হানা ও বোনের নাম মীনা।

দাদু হেসে বললো, তোমার এ পরিচয় সবাই জানে। এ জানাটা যদি আসল জানা হতো সক্রেটিস কখনো বলতো না ‘‘নিজেকে জানো।’’ এই আত্মজ্ঞান পৃথিবীর সবচে জটিলতম কর্ম।

মিনহাজ অবাক। সে বুঝতে পারলো না, কীভাবে নিজেকে জানাটা পৃথিবীর জটিলতম কাজ। প্রত্যেক মানুষ তার সম্পর্কে খুব ভালো করে জানে। সে অনেকক্ষণ চুপ থাকে। দাদুর প্রতি তার সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। তারপর প্রশ্ন করলো, ‘নিজেকে জানা সবচে কঠিন কাজ কীভাবে, দাদু?’

তোমার কাছে আমি এ প্রশ্নটি আশা করেছিলাম। তুমি ঠিক প্রশ্নটি করেছ। এখন তোমাকে ব্যাখ্যা দেব। শুন তবে। তুমি সহজে অন্যের দোষ খুঁজে পাবে অথবা জানতে পারবে, তার কোন গুণ কেমন। তার কোন স্বভাব ক্ষতিকর। তার দাঁত কেমন, নাক কেমন ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজেরগুলো খুঁজতে যাও, তখন বুঝতে পারবে, কত কঠিন এক কাজ। অনুবিক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজলেও তোমার কোন দোষ খুঁজে পাবে না। মনে হবে, তুমি এক অফুরমত্ম গুণের আধার। তোমার গুণগুলো অতুলনীয়। এজন্য চোরকে চোর বললে সে অসন্তুষ্ট হয়। এটা চরিত্রের মন্দ দিক সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতার ফসল। চরিত্রের আরেকটা দিক সম্পর্কেও তুমি সহজে জানতে পারবে না। সেটা হলো, প্রত্যেক মানুষই অনন্য মানুষ, প্রত্যেকের মধ্যে অফুরমত্ম সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। মানুষের মূল দায়িত্ব হলো সে সম্ভাবনাকে বের করে আনা। তুমি শুনে অবাক হবে, মানুষের মত সমতার একটি এটমিক মসিত্মষ্ক তৈরি করতে পনের শত কোটি (১৫০০,০০০০,০০০০,০০) টাকার বেশি প্রয়োজন হবে। এ টাকা দিয়ে দশ হাজার কোটি কম্পিউটার কেনা সম্ভব। মানুষের মসিত্মষ্ক একটি শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার। আমরা নিজেকে চিনি না। চিনতে পারি না। চিনলে আমরা কখনো বলতাম না, আমার মসিত্মষ্ক ভোঁতা। আমি জানতাম, প্রতি সেকেন্ডে দশটি নতুন তথ্য ধারণ করতে পারি মসিত্মষ্কে। মানুষ পুরো জীবনে তার মসিত্মষ্কের ১০-১২% ব্যবহার করে। বলা হয়, আইনষ্টাইন তার মসিত্মষ্কের ২৫% ব্যবহার করেছিল। আমাদের স্মরণশক্তি লোহার মত। কেউ যদি লোহাকে খোলা প্রামত্মরে কয়েকদিন ফেলে রাখে, মরিচা পড়ে যায়। লোহার ব্যবহার তার শক্তিকে ধরে রাখে। কবি বলেছেন,

ঝড়ভঃধিৎব ড়ৎ যধৎফধিৎব

অষষ নধংবফ ড়হ নৎধরহধিৎব

ঝড়, নৎঁংযঁঢ়ুড়ঁৎ নৎধরহ.

এখন বলো, আমরা আমাদের চিনি কি না?

যদি আমি নিজে উত্তর প্রদান করি, তবে উত্তর হবে, চিনি না। আমরা জানি না যে, প্রত্যেক মানুষই মহামানুষ। নিজেকে না চিনার কারণে প্রত্যেক মানুষ সেই মহামানুষকে নিয়ে কবরে চলে যায়।

রাতের প্রথম প্রহর। রিশাদ তাদের বাড়ির নলকূপে গিয়েছে হাত মুখ ধোয়ার জন্য। সে নানার বাড়ি হতে কিছুক্ষণ আগে ফিরে এসেছে। একটা ঢিল এসে পড়লো নলকূপের পাশে। একটু ভীত হল রিশাদ। কিছুক্ষণ পর আরেকটি ঢিল এসে আঘাত করলো নলকূপটিকে। ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাল রিশাদ। চাঁদনি রাতে অনেক দূর পর্যমত্ম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কাউকে দেখতে পেল না রিশাদ। তার লোমকূপগুলো ভয়ে খাড়া হয়ে গেল। সে পালিয়ে যেতে চাইল। এমন সময় দূর হতে অট্টহাসি ভেসে আসল কর্ণকুহরে। ডান-বাম সামনে পিছন হতে। ভীত রিশাদ চিৎকার দিয়ে বাড়ির পথ ধরল। বেশি দূর যেতে পারল না রিশাদ। পড়ে গেল মাটিতে-

অনেকক্ষণ যাবৎ সমত্মান আসছে না দেখে রিশাদের মা বেরিয়ে আসল ঘর হতে। সে ডাক দিল রিশাদ… রিশাদ…

কোন সাড়া শব্দ নাই।

ক্ষণে ক্ষণে অনেকক্ষণ ডাকল সে। না, রিশাদের কোন সাড়া শব্দ নাই।

যেখানে পাব, রিশাদকে কান ধরে নিয়ে আসব, … এমন প্রতিজ্ঞা নিয়ে যখন সে একটু এগিয়ে আসলো, দেখে মাটিতে কি যেন পড়ে আছে। মহিলা ভয় পেলেও সাহস হারায়নি। চর্ট মেরে দেখল রিশাদের শার্ট। দ্রুত এগিয়ে কাছে গিয়ে যখন বেহুশ রিশাদকে দেখল তৎক্ষণাৎ রি… শা… দ… বলে সজোরে চিৎকার দিল। চিৎকার শোনামাত্র প্রতিবেশিরা সবাই বেরিয়ে আসে কি হয়েছে দেখার জন্য। তারা ধরাধরি করে বেহুশ রিশাদকে বাড়িতে নিয়ে আসল। অবস্থা বেগতিক দেখে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হল তাকে। সকালের দিকে চেতনা ফিরে পায় রিশাদ। সবাই জানতে চাইল, কেন এমন হয়েছিল, রিশাদ?

রিশাদ বললো, ভূত আমাকে আক্রমণ করেছিল। তার একথা শুনে সবাই অস্থির হয়ে উঠল। পাড়াতে ভূতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। একে তাড়াতে হলে ‘তদবীর’ করাতে হবে।

পাড়াতে জ্বীন-ভূতের আসর বসেছে। পরপর সংঘটিত কয়েকটি ঘটনা দ্বারা এ বিষয়টি স্পষ্ট হল। পর রাত্রিতে মিনা বাইরে এসে দেখে, তাদের ছাদে কি যেন দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে ঐ বস্ত্তটি টিনের উপর হতে গাছে গিয়ে ওঠে। ভয়ে মুর্ছা যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল তার। আরো অনেকে অনেক কিছু দেখেছে। এসব ঘটনার সূত্র ধরে পাড়ায় তাতুমের আগমন। অনেক খোঁজ করে তাকে আনা হয়েছে। সে এসে আলমদের বাড়িতে উঠল। একটি পিতলের বাটি সামনে রেখে মন্ত্র পাঠ করে ফুঁক দিলে তা আয়নার রূপ পরিগ্রহ করল। উপস্থিত সবাই হতবাক। সে আয়নাটা আলমের হাতে দিল।

‘তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছ?’ তাতুম আলমের জানতে চাইল।

‘কিছুই দেখছি না।’ জবাব দিল আলম।

‘ভাল করে তাকাও।’ তাতুম আলমকে আদেশ দিলো।

আলম অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল আয়নার দিকে। তারপর চিৎকার দিয়ে বলল, ‘ঐ তো, সোনার থালা দেখা যাচ্ছে। রাশি রাশি সোনা।’

তাতুম আলমের হাত হতে আয়নাটি নিয়ে উপস্থিত সবাইকে লক্ষ করে বলল, ‘এখানে জ্বীনদের উৎপাত বৃদ্ধির কারণ হলো, ঐ সোনাগুলো। ঐগুলোর উপর তাদের নজর পড়েছে। ঐ সোনাগুলো মোহন জমিদারের।’ প্রায় দুশো বছর আগে মারা গেছে নিঃসমত্মান মোহন জমিদার। ‘মরার আগে মন্ত্র পড়ে সোনাগুলো ঐখানে রেখে গিয়েছে। জ্বীনেরা সেগুলো নিতে চায়। মন্ত্রের কারণে তারা কব্জা করতে পারছে না। এখন যে ঐগুলো উদ্ধার করতে পারবে সে মালিক হবে। তবে শর্ত হলো, জ্বীনদের খুশি করতে হবে।’

বিকেলে গুরুত্বপূর্ণ সভায় বসল মিনহাজ, আশরাফ, রিশাদ, শাহীন, মাহবুব, সাবিবর ও শিহাব। তাদের আলোচ্য বিষয় স্বর্ণগুলো উদ্ধার করা। পাড়ার সব মুরববীরা এটাকে ‘জাদুকরের ভেলকি’ আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছে। মিনহাজ বলল, এটা কিছুতেই জাদুকরের ভেলকি হতে পারে না। এটা যদি জাদুকরের ভেলকি হয়, তবে বালু দীঘির ঘটনাও মিথ্যা। গ্রামের এ পার্শ্বে ঐ দীঘিটি অবস্থিত। কথিত আছে, জ্বীনেরা একরাতেই ঐ বিশাল দীঘিটি খনন করে গুপ্তধন উদ্ধারের জন্য। সকালে গ্রামের মানুষ ঐ দীঘিটি দেখে অবাক হয়ে গেল। একদিনে এত বড় দীঘি কোত্থেকে এলো? এক মাইলের কম না। কারো বাড়িতে বিয়ে, জেয়াফত, মেজবান ইত্যাদি অনুষ্ঠান থাকলে লোকেরা দীঘির পাড়ে গিয়ে বলে আসতো। পরদিন সকালে দেখা যেত, প্রয়োজনীয় সব জিনিস দীঘির পানিতে ভেসে আছে। কাজ শেষে ঐ জিনিস গুলো দীঘিতে রেখে আসতো। এক অনুষ্ঠানে কেউ একটা বাটি চুরি করে ফেলে। এরপর হতে দীঘিতে ঐ সব জিনিস ভেসে উঠা বন্ধ হয়ে যায়।

সিদ্ধামত্ম নিলো একাজটি তাদেরকেই করতে হবে। বুড়োদের দিয়ে হবে না। তারা একটি কমিটি গঠন করলো সভায়। এ কাজে কমিটি সবার সাহায্য নিয়ে এগিয়ে যাবে। কমিটি আলমকে নিয়েই কাজ শুরু করবে। কমিটির নাম দেওয়া হল ‘‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার।’’ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সিদ্ধামত্ম নিয়ে তারা মাঠে নেমে গেল।

 

 

 

 

 

সফলতা কোন সাধারণ ব্যাপার না। কেউ সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়ালো, আর সিঁড়ি তাকে টেনে তুলে ফেলল, এরকম কখনো ঘটেনি, ঘটবেও না। এটা আলাদিনের প্রদীপের মতও না। তুমি প্রদীপ ঘষা দিলে আর এমনি চেরাগের জ্বীন এসে বলল, কি চাই জাঁহাপনা। উপরে উঠতে হলে তাকে অবশ্যই সিঁড়ি বেয়ে উঠার ঝুঁকি নিতে হবে। যে যত উপরে উঠতে চায়, তার ঝুঁকিও তত বড় হবে। এক কথায়, সাফল্য কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়। পুকুরে না নেমে সাঁতার শেখা যায় না। যেহেতু, আমরা বিশাল ঝুঁকি নিতে যাচ্ছি, আমাদের উচিত কারো পরামর্শ গ্রহণ করা। রিশাদ বলল,

‘হ্যাঁ, তা করা ব্যতিত আমাদের অন্য কোন পথ নাই।’ মিনহাজ তার সাথে একমত হলো। আরো বলল, ‘এ ক্ষেত্রে আমরা দাদার পরামর্শ নিতে পারি। অনুপ্রেরণামূলক কথাবার্তা বলতে দাদা খুব পারঙ্গম। এই বৃদ্ধ বয়সে এসেও তার মধ্যে যৌবনের তারুণ্যের চপলতা আছে।’

‘হ্যাঁ, তাই করতে হবে।’ শাহীন জবাব দিল।

সাবিবর সবাইকে সর্তক করে দিয়ে বলল, সব ঠিক আছে কিন্তু যেন দাদু আমাদের উদ্দেশ্যের কথা জানতে না পারে। তিনি জানলে সব পরিকল্পনা ভেসেত্ম যাবে।

সবাই চলে আসল দাদার কাছে।

দাদা চেয়ারে বসে ডায়েরী পড়ছিল। দাদার প্রিয় ডায়েরী। দাদা এখান হতে নানা বিষয় প্রায়শ মিনহাজকে শোনায়। এত গুলো ছেলে একসাথে সাফল্য নিয়ে পরামর্শ নিতে এসেছে শুনে দাদু খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠে। সফল হতে গেলে কি কি দরকার, তোমরা তা জানতে চাও শুনে আমার খুব ভাল লাগছে। তবে তার আগে তোমাদের কাছে একটা প্রশ্ন করব। তোমরা যদি এর জবাব দিতে পার, তবে আমি তোমাদের সাফল্যের সূত্রাবলী বর্ণনা করব।

মিনহাজ বলল, ‘কি প্রশ্ন বলুন।’

‘পৃথিবীতে কোটি টাকার গুপ্ত সম্পদটা কী?’ দাদু প্রশ্ন করল।

সবাই পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। কেউ বলতে পারছে না। মিনহাজ মনে মনে ভাবল, দাদা সম্ভবত এই গুপ্তধনের কথা বলছে। দাদু প্রকাশ্যে গুপ্তধনের বিরোধিতা করলেও তার অমত্মরে গুপ্ত লোভ বিদ্যমান। ভাবতে ভাবতে শিউরে উঠল সে। সবাই একই কথা মনে মনে জপে যাচ্ছে, দাদাও গুপ্তধন চায়। তারা কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে দাদা বলে উঠল, ‘কি তোমরা উত্তর দিতে পারবে না? তোমরা যদি উত্তর দিতে না পার, আমি কীভাবে সফল হবার পথ তোমাদের দেখাব? এতে আমার ওয়াদা ভঙ্গ হবে।’

‘একজন মুমূর্ষুকে বাঁচানোর জন্য ওয়াদা ভঙ্গ করা যায়।’ বলল মিনহাজ।

‘কে মুমূর্ষু?’ জানতে চাইল দাদা।

‘কেন, আমরা সবাই। যেহেতু আমরা সফলতার পথ চিনি না।’

‘ঠিক আছে। যদি তাই হয়, তবে সাফল্যের পথ নির্দেশিকা আমি তোমাদের সামনে উপস্থাপন করছি। জীবনে সফল হওয়াটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার না। অক্লামত্ম পরিশ্রমের ফল হচ্ছে সাফল্য। সফলতার প্রথম শর্ত হলো লক্ষ্য স্থির করা। লক্ষ্যবিহীন নৌকা যেমন কূলে ভিড়তে পারে না, তদ্রূপ জীবনে লক্ষ্য উদ্দেশ্য না থাকলে, সে জীবন এগিয়ে যেতে পারে না। এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে আমরা স্বপ্ন বলে অভিহিত করি। যে জীবনে কোন স্বপ্ন নাই, তা মূল্যহীন। জেনে রেখো, ‘ঘুমের ঘোরে মানুষ যা দেখে তা স্বপ্ন নয়, স্বপ্ন তাই যা মানুষকে জাগিয়ে রাখে।’ তোমার স্বপ্ন যদি তোমাকে কাজে অনুপ্রাণিত না করে, তবে সে স্বপ্ন মূল্যহীন। সফলতার এ পথ মসৃণ নয়। এর প্রতিটি কদমে কদমে ছড়িয়ে আছে কাঁটা। যার স্বপ্ন যত বড়, তার পথটা তত বিপদসঙ্কুল। পুকুর পাড়ি দেবার বিপদ ও মহাসাগর পাড়ি দিবার বিপদ এক নয়। এ বিপদ গুলো তোমাকে ধ্বংস করার জন্য নয়। এগুলো তোমার জন্য পরীক্ষা। তারা দেখতে চায়, তুমি যে জিনিসটা প্রত্যাশা করছ, তা তুমি পাবার যোগ্য কি না? যারা সফল তারা লড়াই করে এ প্রতিকুলতা গুলোকে পরাসত্ম করেছে। যারা পরাজিত তাঁরা প্রতিকুলতা দেখে পিছিয়ে গেছে। উদ্দেশ্যের প্রতি শুধু অবিচল থাকলে চলবে না। এর জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন সাধনা। গরমের অত্যাচার হতে মুক্তি পেতে বাতাসের দিকে সরে যাও, শীতের তীব্রতা হতে মুক্তি পেতে যদি কাঁথার উমে বসে থাক, সৌন্দর্য্যে বিভোর হয়ে যদি হাঁ করে তাকিয়ে থাকো, ভীত হয়ে পিছিয়ে যাও, পিচ্ছিল দেখে সরে যাও, অন্ধকার দেখে দাঁড়িয়ে থাকো, হতাশায় মুষড়ে যাও, আনন্দে বিভোর হও, দুর্গন্ধে নাক সিটকাও, সুবাস পেয়ে নাক ডুবাও, বাক্যবানে বিদ্ধ হও, হিংসায় সিদ্ধ হও, পাহাড় দেখে থমকে দাঁড়াও, কম্পন দেখে শুয়ে যাও, লোভে বশীভূত হও, স্নেহ বা প্রেমে মজে যাও, অল্প পেয়ে তৃপ্ত হও, রোগে শোকে কুঁকড়ে যাও, প্রতারিত হয়ে পিছিয়ে যাও, সাহায্য পেয়ে অন্ধ হও, মানসিকভাবে দৃঢ় না হও, তবে তোমার নিরবিচ্ছিন্নতা নষ্ট হবে। কথিত আছে, বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের সময় এডিসন দশ হাজার বার ব্যর্থ হয়েছিল। এক বন্ধু বিস্মিত হয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিল, এত ব্যর্থ হবার পরও তোমার চেষ্টা চালিয়ে যাবার অর্থ কি? এডিসন অধিকতর আশ্চর্য হয়ে বলেছিল, ‘কে বলল যে আমি ব্যর্থ হয়েছি? বরং দশ হাজারটা পথ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি। কোন পথে গেলে কাজ হবে তা আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর কটা পথই বা বাকী আছে? তাদের কোন একটাতে কাজ হতেই হবে। এখন আমি সাফল্যের দ্বারপ্রামেত্ম এসে দাঁড়িয়েছি বলতে পারো।’

ক্লোনিং আবিষ্কারের সময় বৈজ্ঞানিক উইলমুট ৯০০ বারের অধিক ব্যর্থ হয়েছিল। ব্যর্থতা হতে অনুপ্রেরণা নিতে হবে। যারা ব্যর্থতা হতে অনুপ্রেরণা নেয়া দূরে থাক, ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কায় শুরুতেই ঝিমিয়ে পড়ে, তাদের সাফল্যের আশা করাটা বোকামী ছাড়া আর কিছু না। এসব কিছুর ভিত্তি হলো আপন দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি হলো মানুষের অমত্মর্নিহিত শক্তি, যা মানুষকে পরিচালিত করে। এ ক্ষেত্রে আমার ছোটকালের একটা কথা তোমাদের বলতে পারি।

একবার আমরা মাঠে ফুটবল খেলতেছিলাম একটা পুরনো বল দিয়ে। খেলার বিরতির সময় একজন একটা নতুন বল নিয়ে এলো। আমরা নতুন বল নিয়ে খেলতে গিয়ে দেখি কাজ হচ্ছে না। আমাদের একজন মমত্মব্য করলো, বাজে বল। আমি বললাম, বল নতুন বা পুরাতন এটা ব্যাপার না। দেখতে হবে এর ভিতরে কিছু আছে কি না। বলটাতে বাতাস ঢুকানো হল। দেখা গেলো এটা দারুণ একটা ফুটবল। এই বাতাস হলো অমত্মর্নিহিত শক্তি। কোন মানুষের মধ্যে যদি অমত্মর্নিহিত শক্তি না থাকে, তবে বাইরের শক্তি তাকে আর কত পরিচালিত করতে পারে? দাদু প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে একমাস সময় দিচ্ছি আমার প্রশ্নের উত্তর খোঁজে বের করার জন্য।’

সবাই বলল, আচ্ছা দাদু।

‘‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার।’’ কমিটির ৩য় বৈঠক। সব সদস্যরা উপস্থিত। তাদের আলোচ্য বিষয় কাজ শুরু করা। কাজ শুরু করতে হলে যে জিনিসটা প্রথমে প্রয়োজন তা হলো তাতুমকে খুঁজে বের করা। তাতুম কোথা হতে এসেছে কেউ জানে না। হয়তো মুরববীদের কেউ জানে। কিন্তু কে জানে, সে কথাও এ কমিটির কারো জানা নেই। হয়তো দাদু তার সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু তার নিকট হতে এ তথ্য আদায় করা যাবে না। মিনহাজ সবার মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করে দিল, যাতে পাড়ার সব মুরববীদের জিজ্ঞাসা করা যায়। কাউকে যাতে দু’বার জিজ্ঞাসা করা না হয়, সে জন্য প্রত্যেকের হাতে আলাদা আলাদা তালিকা দেওয়া হল। প্রত্যেকে তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদেরকে জিজ্ঞাসা করবে, অন্য কাউকে নয়। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় টাকা। টাকা ছাড়া সব ফাঁকা।

আমাদের কেউ কোন চাকরী বা ব্যবসা করি না, এত টাকা পাব কোথায়? আশরাফ বলল।

‘তুই প্রথমেই বোকার মত প্রশ্ন করলি।’ রিশাদ তাকে ধমক দিল।

‘কেন? কেন??’

আমরা যদি টিফিনের টাকা গুলো বাঁচাই, এক সপ্তাহে কয়টাকা হয় খেয়াল করেছিস? একজনের যদি হয় ৬০ টাকা, তবে আটজনের হয় ৪৮০ টাকা। শোন, ব্রিটেনের একটা গ্রামের লোকদের অভ্যাস ছিল, কেউ যদি বিপদে পড়ে তাকে সবাই এক পেনি করে দিত। একবার গ্রামে ঘূর্ণিঝড়ে এক গরীব লোকের বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছিল। সবাই তাকে এক পেনি করে প্রদান করল বাড়ি করার জন্য। কিছুদিন পর এক বিদেশী গিয়েছিল ঐ গ্রামটি দেখার জন্য। সে ঐ লোকটির বাড়ি খুঁজে শনাক্ত করতে পারছিল না। কারণ, তার বাড়িটি ছিল সবচে’ নতুন। এভাবে যদি আমরা দশে মিলে সঞ্চয় করি, লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক হতে পারব। এখন হতে টাকার মূল সূত্রটি আমরা অনুসরণ করলে হবে।

‘মুল সূত্রটা কি?’ জানতে চাইলো মিনহাজ।

অর্থ সঞ্চয় কর, যখন প্রয়োজন সবচে’ কম। অর্থ ব্যয় কর, যখন চাহিদা সবচে’ বেশী। এভাবে সঞ্চয় গড়ে ওঠে। অর্থ মধ্যপন্থা বুঝে না। মধ্যপন্থায় সঞ্চয় হবে না। আমরা আগামীকাল হতে টিফিনের টাকা, বাজারের বাড়তি টাকা জমা করা শুরু করব। মিনহাজ তুই সবকিছু তদারক করবি। পরে একটা নির্বাচন হলো। সবাই ভোটার, সবাই প্রার্থী ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত উক্ত ভোটে মিনহাজ সভাপতি নির্বাচিত হল। ‘‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার’’ কমিটি শুক্রবারে তাদের পরবর্তি বৈঠকের তারিখ ঘোষণার মাধ্যমে বৈঠক শেষ করল।

সোমবার। অপারেশন হিডেন ট্রেজার কমিটির ‘‘জরুরী বৈঠক’ ডাকা হয়েছে। সবাই উপস্থিত। সবার চেহারায় উদ্বেগের ছাপ। আলম ভয়ঙ্কর খবর নিয়ে এসেছে। তারা চরম সিদ্ধামত্মহীনতায় ভুগছে। বুঝতে পারছে না কি করতে হবে? সবাইকে অন্ধকারে রেখে কে বা কারা গুপ্তধন নিয়ে গেছে? আলম যেখানে গুপ্তধনের কথা বলেছে, সেখানে আজ সকালে দেখা গেছে অনেকগুলো গর্ত।

আলম বলল, ‘আমার মনে হয় এতে রিশাদ জড়িত।’

মিনহাজ জানতে চাইল, ‘কিভাবে বুঝলি?’

সাবিবর বলল, ‘রিশাদ গতকাল হতে অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলে বেড়াচ্ছে।’ সে বলছে, গুপ্তধনের এ কাহিনীটা একটা মিথ্যা ফাঁদ। আমি সেই ফাঁদে পড়তে চাই না।’ ওর মা নাকি ওকে বলেছে, উল্লুক ভিটার বয়স দুইশ’ বৎসরের বেশী। তাদের এক পূর্ব পুরুষ বাড়ি করার জন্য উক্ত ভিটে ভরাট করেছিল। পরে আরো ভাল জায়গা পাওয়ায় তিনি ওখানে আর বাড়ি করেনি। রিশাদ আরো বলছে, গুপ্তধন হলো, একজন মানুষের সুপ্ত সম্ভাবনা। আমার মনে হচ্ছে এসব কথা বলে, সে আমাদের মনোযোগ নষ্ট করে তার উদ্দেশ্য হাসিল করে ফেলেছে। সে তো বুদ্ধির রাজা। কাকে কিভাবে সাইজ করতে হয়, তার ভাল করে জানা আছে। কাল রাতেও তাদের বাড়িতে সবাই ছিল। আজ দেখলাম তালা-মারা।

মিনহাজ বললো, রোগ-শোক-মৃত্যু এসব কারণেও তো তারা ঘর ছাড়তে পারে।

‘তাদের ঘর ছাড়াও উল্লুক ভিটার গর্ত হয়েছে একই সময়ে। এতে কি বুঝা যায়?’ সাবিবর বলল।

‘ঠিক আছে, আমরা আগামী শুক্রবার পর্যমত্ম দেখে পরবর্তী সিদ্ধামত্ম নেব।’ মিনহাজ বলল।

শুক্রবার। ‘‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার’’ কমিটির বৈঠক। বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা পূর্বক তারা বুঝতে পেরেছে, এখনো কেউ গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারেনি। উল্লুক ভিটায় প্রতিদিন গর্তের সংখ্যা বাড়ছে। তার মানে এখনো খোঁজাখুঁজি চলছে। তবে কারা এ কাজ করছে বুঝা যাচ্ছে না। এবারও রিশাদকে সন্দেহের তালিকা হতে বাদ দেওয়া যায়নি। কারণ তার পরিবারের কেউ এখনো ফিরে আসেনি। সবাই সিদ্ধামত্ম নিল, তারা একটা অভিযান পরিচালনা করবে, যারা একাজ করছে তাদের পাকড়াও করার জন্য। আজ রাত হতে উল্লুক ভিটায় অভিযান পরিচালনা করা হবে।

 

 

 

 

 

রাত ১২.০১ মিনিট। টেবিল ঘড়ির ক্রিং ক্রিং শব্দে জেগে উঠল মিনহাজ। হাতের কাছে থাকা ছোট টর্চটি জ্বালিয়ে মৃদু এলার্মটি বন্ধ করলো সে। বাতি জ্বালানো যাবে না। দাদু যদি টের পেয়ে যায়, সব শেষ হয়ে যাবে। চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে উঠে হুক খুলে বাইরে দাঁড়ায় মিনহাজ। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বুঝে নিল, দাদু টের পায়নি। সে নিদ্রামগ্ন। ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল মিনহাজ। আশরাফ, আলম, মাহবুব, শাহীন, সাবিবর, শিহাব তার জন্য অপেক্ষা করছে।

‘রিশাদের খবর কি?’ জানতে চাইল মিনহাজ।

‘এখনো তাদের বাড়িতে তালামারা। কেউ ফিরে আসেনি।’ শাহীন বলল।

তারা যাত্রা শুরু করল। লক্ষ উল্লুকভিটা। সবার বিশ্বাস গুপ্তধনটা এখনো ওখানে আছে। দুদিনের পর্যবেক্ষণে তারা নিশ্চিত হয়েছে, এখনো ওটা কেউ উদ্ধার করতে পারেনি। দুদিনে এ ভিটার এক চতুর্থাংশ খনন করা হয়েছে। কে করেছে কেউ জানে না। তবে সবাই নিশ্চিত, গুপ্তধনের জন্য এ খনন মিশন চালানো হচ্ছে। এ নিয়ে পুরো পাড়া-জুড়ে গুঞ্জন চলছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন গর্ত হচ্ছে এ ভিটায়। সবার মধ্যে গুপ্তধনের বাতিক ঢুকে গেছে। কৌশল হিসেবে কেউ কাউকে প্রকাশ করছে না। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে উল্লুক ভিটার দিকে, মৃদু চাঁদের আলো ভেদ করে। পাড়ার শেষ সীমানা অতিক্রম করতে করতে সবার দৃষ্টি পড়ল ভিটার দিকে। মৃদু আলোতে কারা যেন কাজ করছে। এরা আরো চুপে চুপে অগ্রসর হতে লাগল। এমন সময় মিনহাজ অনুভব করল, পিছন হতে কে যেন আসছে। ভয়ে শরীরের সব লোমকুপ উত্থিত হলেও সাহস হারাল না সে। পিছনে ফিরে দেখে রিশাদ।

‘রিশাদ তুই?’ মিনহাজ জানতে চাইল।

‘মাকে ফাঁকি দিয়ে চলে আসলাম।’ রিশাদ হাসছে।

‘আসলি কখন? গিয়েছিস কোথায়? জানলি কি করে আমরা এখানে?’

‘এইসব হিসাব পরে। এখন চল ঐ চোরদের ধরি।’

রিশাদকে দেখে অবাক হলেও কেউ কথা বাড়াল না। সবাই চুপি চুপি অগ্রসর হতে লাগল। তারা ভিটার কাছাকাছি পৌঁছতেই ঐ বাতিটা নিভে গেলে তারা আরো অবাক হয়ে যায়। আটজন সবাই ভিটের চারদিক ঘিরে অবস্থান নিল গুপ্ত খননকারীকে ধরার জন্য। দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করে নিশ্চিত হল ঐ লোকগুলো পালিয়ে গেছে। তারা যখন উল্লুক ভিটায় উঠল, তাদেরকে অবাক করে দিয়ে রিশাদ অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে চলে যেতে লাগল। সবাই পেছনে পেছনে অনেকদূর পর্যমত্ম গেলেও রিশাদ ফিরে তাকায়নি। রিশাদের এ আচরণে সবাই ক্ষুব্ধ হলেও হতবাক। সে গভীর রাতে একা কিভাবে আসল? আর কিভাবে চলে গেল একা? তার এমন আচরণের হেতু কি? আলম বলল, হয়ত যারা খনন কাজ করছে তাদের সাথে রিশাদের যোগসাজস আছে। এই নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও তারা সিদ্ধামেত্ম আসতে পারেনি রিশাদের বিষয়ে। তারা ফিরে আসার সময় রিশাদের বাড়ির দিকে যেতে যেতে দূর হতে লক্ষ করলো রিশাদ দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। এরা নিকটে আসতে আসতে সে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কাছে এসে দেখতে পেল, তাদের বাড়িটাও তালাবদ্ধ অর্থাৎ কেউ ফিরে আসেনি। তাহলে রিশাদ?

পুরো গ্রামে হৈ চৈ পড়ে গেছে। সবাই গেছে প্রাণীটাকে দেখার জন্য। এমন অদ্ভুত দর্শন প্রাণী কি আসলে থাকতে পারে? কিন্তু চোখের সামনে যা দাঁড়ানো তা বিশ্বাস না করে উপায় কি? এটা পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাণী, কিন্তু সবচেয়ে খাট। সবচেয়ে দ্রুততম প্রাণী, কিন্তু সবচেয়ে ধীর গতি সম্পন্ন। এটা সব ছোট ছোট জিনিস খায়, আর বড় বড় জিনিস নির্মাণ করে। এক হাজার রশি দিয়ে গ্রামবাসী এটাকে বেঁধে রাখল। সবাই সিদ্ধামত্ম নিল, এটাকে গ্রাম ছেড়ে যেতে দেওয়া হবে না। সেটি সব রশি ছিড়ে পার্শববর্তি গ্রামে চলে গেল। ঐ গ্রামের লোকেরা এটিকে বেঁধে রাখার ব্যাপারে আরো কঠোর হল। তারা দুই হাজার রশি দিয়ে প্রাণীটাকে বেঁধে রেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে বাড়ি ফিরল। কিন্তু আটকে রাখা গেল না প্রাণীটাকে। সব রশি ছিড়ে চলে গেল। তৃতীয় গ্রামের লোকেরা তিন হাজার রশি দিয়ে বেuঁধ রাখল। কিন্তু তারাও ব্যর্থ হল। এ সময় এক বৃদ্ধ লোক এগিয়ে এল। যিনি তার কর্মকান্ডের জন্য সবার কাছে পরিচিত। অনুশোচনা করলেও সে বলল, রশি দিয়ে নয়, পৃথিবীর সমসত্ম শক্তি দিয়েও এটা বেঁধে রাখা যাবে না। বৃদ্ধের কথা শুনে সবাই অবাক। তাহলে উপায়? তাদের প্রশ্নের জবাবে সে বলল, তোমরা এটাকে আটকে রাখতে পারবে না, তবে যদি এটা ব্যবহার করতে পার, তোমরা উপকৃত হবে। তারা জানতে চাইল, এটা ব্যবহার করার পদ্ধতি কি? তখন বৃদ্ধ লোকটি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, এ প্রাণীটি আমাদের জন্ম এবং মৃত্যুর কারণ। সে যত এগিয়ে যাবে, তত আমরা মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যাব। আবার এটাকে আটকে রাখাও যাবে না। এরচে বরং আমরা এর পিঠে সওয়ার হয়ে যাই। অনুসরণ করি তার প্রতিটি মুহূর্ত। তবে জীবন কর্মময় হবে। মিনহাজকে গল্প বলতে বলতে দাদা মফিজুর রহমান থামলেন।

‘দাদা, এ প্রাণীটা কোথায় পাওয়া যায়?’ প্রশ্ন করল মিনহাজ।

‘কেন? এ প্রাণীটা পৃথিবীর সর্বত্র পাওয়া যায়। তবে শুনলে আরো অবাক হবে, তবুও বলতে হয়, জন্মের পর হতে এ প্রাণীটা এক মুহূর্তের জন্য বিশ্রাম নেয়নি। আর নেবেও না। যে ব্যক্তি তাকে কাজে লাগাতে পেরেছে, সে ব্যক্তিকে ঐ প্রাণীটা গুপ্তধন দিয়ে সাহায্য করেছে। আর যে তাকে কাজে লাগাতে পারেনি, ঐ প্রাণীটা ঐ লোকটিকে গিলে খেয়ে ফেলেছে। এর জন্য ‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার’ কমিটি গঠন করার ও দরকার হয়নি আজ পর্যমত্ম। দাদুর মুখে, ‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার’ কমিটির নাম শুনে চমকে উঠল মিনহাজ। দাদু জানল কি করে? ভিতরে ভিতরে ঘামতে শুরু করল সে। নিশ্চয় দলের ভিতর গুপ্তচর আছে। কে সে গুপ্তচর? রিশাদ ছাড়া কেউ এ কাজ করতে পারে না। কিন্তু রিশাদ তো কয়েকদিন হল নানার বাড়িতে গেছে। গতরাতে রিশাদকে দেখা গেলো ক্ষণিকের জন্য। অনেকটা অলৌকিক। ভেতরের প্রতিক্রিয়া এড়াতে মিনহাজ আবার দাদুকে প্রশ্ন করল সে প্রাণীটি সম্পর্কে। এ প্রাণীটি পৃথিবীর সর্বত্র থাকলেও তাকে দেখলাম কেন?

‘তোমার সে চোখ নাই, দেখবে কি করে?’ জবাব দিল দাদু।

দুদিন পরের কথা। তহবিল সংগৃহিত হয়েছে, তবে পর্যাপ্ত নয়। সবাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে কাজ শুরু করবে কিনা? এই নিয়ে সভায় বসেছে ‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার’ কমিটি। সবাই এসেছে, রিশাদ এখনো আসেনি। তার ব্যাপারে সবাই সন্দিহান। মিনহাজের দৃঢ় বিশ্বাস এ ব্যাপারে রিশাদ দাদাকে বলেছে। তবে নিশ্চিত নয়। তাই রিশাদের দরকার ছিল এ রহস্য উদ্ঘাটন করার জন্য। গত পরশুর ঘটনাটাও তাকে জিজ্ঞাসা করে, এমন করার কারণ কি জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল। কিন্তু সে আসেনি।

মিনহাজ সবাইকে উদ্দেশ করে বলল, বাদ দাও তার কথা। পৃথিবীটা কারো জন্য বসে থাকে না। এখানে শূন্যস্থান বলে কিছুই নাই। কেউ যখন দায়িত্ব পালন হতে পিছিয়ে যায় বা এগিয়ে না আসে, অন্য কেউ এসে শূন্যস্থান পূরণ করে। আমরাও বসে থাকব না। এখন আমরা আমাদের আলোচনায় আসি কিভাবে কাজ করব।

‘হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথায় বলেছ। এখন আমাদের উচিত কাজ শুরু করা। কিন্তু…..?’ কথা বলছিল আশরাফ,

‘কিন্তু’ একটা ভয়াবহ শব্দ। দ্বিধাগ্রস্ত ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ। কোন রকম সংশয় মনের মধ্যে রেখে কাজ করতে যাওয়াটা বোকামী। আমাদেরকে ‘করব বা মরব’ সিদ্ধামেত্ম উপনীত হতে হবে, যদি আমরা প্রকৃত ফল প্রত্যাশা করি। দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ, প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাব। মনে রেখ, ব্যর্থ হলে হতাশা গ্রাস করতে পারে, কিন্তু চেষ্টা না করলে জীবনটাই ধ্বংস হয়। বলল, মাহবুব।

মাহবুবের কথা শেষ হতে না হতেই রিশাদ এসে উপস্থিত। তাদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তারা সভা চালিয়ে যেতে লাগল।

শিহাব আরো যোগ করল, ‘মাহবুব ঠিক কথায় বলেছে। আমাদের মধ্যে কেরানী মানসিকতা থাকা উচিত হবে না। আমাদের মধ্যে ব্যবস্থাপকীয় মানসিকতা থাকতে হবে- সংশয়বাদী মন নিয়ে কোন কাজ করা যায় না। পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানীরা উড়ো জাহাজ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু দুইজন সাইকেলের কারিগর সফল হয়েছে শুধুমাত্র সংশয়মুক্ত মনোবল থাকার কারণে। আমাদেরকে মনোবল ঠিক রেখে এগুতে হবে। আমরা মনোবল অটুট রেখে সামনে এগিয়ে যাব। আমরা যদি পরাজয়কে বরণ করে না নিই, তবে কেউ আমাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না।’

‘সব ঠিক আছে, তবে আমার মনে হচ্ছে আমরা অলিক স্বপ্নের পেছনে দৌড়াচ্ছি। বিনা শ্রমে কোন কিছু পাওয়ার লোভ মানুষকে ফাঁদে ফেলে। শ্রমের দ্বারা যা অর্জিত হয় তাই আসল পাওয়া। আমরা ধনী হবার সংক্ষিপ্ত পথ ত্যাগ করে বাসত্মববাদী হলে’ …. রিশাদ কথা শেষ করতে পারল না।

‘রাখ, তোর বাণী শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। একটা জিনিস হাতের মুঠোয় আছে, আর তুই আবোল তাবোল বলছিস।’ মিনহাজ তার কথায় বাঁধা দিল।

‘আরে না, গুপ্তধনের জন্য যে মাতলামী হচ্ছে, তা বোকামী ছাড়া আর কিছুই না। প্রতারকরা কাউকে না কাউকে ফাঁদে ফেলে সর্বনাশ করবে। আমার মনে হচ্ছে আমরা তার শিকার হতে যাচ্ছি।’ বলল রিশাদ।

‘তুই এগুলো কি বলছিস? মাথা ঠিক আছে তো? তুই তো জ্বীনের মত হয়ে গেছিস? রাত বিরাতে অন্ধকার পথ দিয়ে হেটে চলে যাস। ঐ তান্ত্রিক তো একদিনও এখানে আর এলো না। সে ফাঁদ ফেলবে কেন?’ শাহীন বলল।

‘এসব কি বলছিস? আমি রাত বিরাতে অন্ধকারে হাঁটি মানে? পাগলের প্রলাপ বকছিস কেন? আমি একটু অন্ধকার হলে আর বাড়ি থেকে বের হই না। আর ফাঁদ? সব সময় এমনভাবে ফেলা হয় যে, যাতে শিকার তা না দেখে। শিকার যদি ফাঁদের রহস্য বুঝতে পারে তবে তো সে তা এড়িয়ে যাবে।’ বলল রিশাদ।

‘সে রাতের কথা ভুলে গেছিস?’ বলল মিনহাজ।

‘কোন রাতে কি হয়েছিল?’ জানতে চাইল রিশাদ।

‘বুঝেও না বুঝার ভান করছিস? পাগলামী করছিস কেন?’ মাহবুব বলল।

‘তোর কথা আমাদের ভালো লাগছে না। তুই তো তাদের দলে যোগদান করেছিস, যারা গুপ্তধন খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে রাতদিন দৌড়াচ্ছে।’ মিনহাজ তাকে ব্যঙ্গ করে বলল।

একথা শোনার পর রিশাদ ওখান হতে উঠে চলে গেল। সবাই স্বসিত্মর নিঃশ্বাস ফেলল।

সাবিবর বলল, ‘আমরা আজই কাজ শুরু করব।’ আগামীকাল পর্যমত্ম অপেক্ষা করার সুযোগ নাই। যারা আগামীকালের জন্য অপেক্ষা করে তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করে। আজকের সুযোগটা আগামীকাল নাও থাকতে পারে। আগামীকাল এমন ঘটনা ঘটতে পারে, যা জীবনকে বিষিয়ে দেবে। আজকেই শ্রেষ্ঠতম সময়। জীবনের সোনালী মুহূর্ত। আগামীকালের জন্য আজকের দিনটা ধ্বংস করা বোকাদের কাজ। ঘড়ি দৌড়াচ্ছে। আমাদেরকে সর্বোচ্চ কাজটা আজকেই শুরু করতে হবে। আমরা যদি একদিনের জন্য গুপ্তধন পেতে ব্যর্থ হই, তবে আমাদেরকে সবাই জিজ্ঞেস করবে একদিনের গুরুত্ব কি? যেমন এক বৎসরের গুরুত্ব বুঝতে হলে সে ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করা দরকার, যে বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করেছে। এক মাসের গুরুত্ব বুঝতে হলে সে মাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, যার অপূর্ণ সমত্মান হয়েছে। এক সপ্তাহের গুরুত্ব বুঝতে হলে সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদককে জিজ্ঞাসা করতে হবে। এক মিনিটের গুরুত্ব বুঝতে হলে সে ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, যে ট্রেন ধরতে পারেনি। এক সেকেন্ডের গুরুত্ব বুঝতে হলে সে ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা দরকার, যে দুর্ঘটনার কবল হতে রক্ষা পেয়েছে। এক মিলি সেকেন্ডের গুরুত্ব বুঝতে হলে সে ব্যক্তিকে জিজ্ঞাস করা লাগবে, যে অলিম্পিকে রৌপ্য জিতেছে।

প্রতিটি মুহূর্ত যা নষ্ট করছি, তার সাথে হাজারো সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে। অপরদিকে প্রতিটি মুহূর্ত যা আমরা কাজে লাগাচ্ছি, তার সাথে সাথে হাজারো সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। যে সময়টা চলে যাচ্ছে, তা এমন শক্তি নিয়ে চলে যাচ্ছে, যদি প্রভুর কাছে হাজারো প্রার্থনা করি তবুও প্রভু তা ফিরিয়ে দেবে না। আমি যদি আরো বলি তবে বলতে হয়, সময়ের গুরুত্বটা সবার কাছে এক রকম না। একজন অশিক্ষিত মানুষের সময়ের চেয়ে শিক্ষিত মানুষের সময়ের গুরুত্ব বেশী। একজন শিক্ষিত মানুষের সময়ের চেয়ে একজন চাকুরীজীবি বা ব্যবসায়ীর সময়ের গুরুত্ব বেশি। একজন ব্যবসায়ী/ চাকুরীজীবির চেয়ে একজন মেম্বারের সময়ের গুরুত্ব বেশি। একজন মেম্বারের চেয়ে একজন চেয়ারম্যানের সময়ের গুরুত্ব বেশি। একজন চেয়ারম্যানের চেয়ে একজন টিএনও বা উপজেলা চেয়ারম্যানের সময়ের গুরুত্ব বেশি। একজন টিএনও এর চেয়ে ডিসির সময়ের গুরুত্ব বেশি। একজন ডিসির চেয়ে একজন সচিবের সময়ের গুরুত্ব বেশি। একজন সচিবের চেয়ে একজন মন্ত্রীর সময়ের গুরুত্ব বেশি। একজন মন্ত্রীর চেয়ে একজন প্রধানমন্ত্রীর সময়ের গুরুত্ব বেশি।

এখন আমাদের কে বুঝতে হবে আমাদের সময়ের গুরুত্বটা কোথায়? অনেকেই গুপ্তধনের খোঁজে নেমে গেছে। আমাদেরকে আর বসে থাকলে চলবে না। মুমূর্ষু রোগী আর প্রতিযোগীদের জন্য প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরাও প্রতিযোগিতায় নেমে গেছি। আমাদের দরকার এখন কাজ শুরু করা। মনে রাখতে হবে, হাজার হাজার তত্ত্ব কথার চেয়ে এক তোলা কাজ অনেক উত্তম।’ কথা শেষ করল সাবিবর।

সাবিবরের বক্তব্যের জন্য সবাই তাকে ধন্যবাদ জানাল। তার কথা সবাইকে অনুপ্রাণিত করেছে। কমিটি সিদ্ধামত্ম নিল, তারা আজ হতে কাজ শুরু করবে। আরো দু’তিনটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধামত্ম নিয়ে তারা সভা শেষ করে চলে যাচ্ছে, এমন সময় দেখা গেল রিশাদ অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মিনহাজ ডাক দিল রিশাদ, রিশাদ। মিনহাজের ডাক শোনার পর সে হাঁটা শুরু করল।

শাহীন বলল, ‘দেখ, বিশ্বাসঘাতক চলে যাচ্ছে।’

‘এমন করছে কেন রিশাদ? তার উদ্দেশ্য কি?’ প্রশ্ন করল আলম।

সিদ্ধামত্ম অনুযায়ী বান্দরবান যাচ্ছে তিনজন। মিনহাজ, শাহীন ও আশরাফ। কমিটির বাকীরা জড়ো হয়েছে তাদের এগিয়ে দিতে। এমনকি রিশাদও সেখানে এসে উপস্থিত। রিশাদকে যে কোন প্রকারে এখান হতে সরাতে হবে। নতুবা তাদের মিশনের তথ্য গোপন থাকবে না। তাই সবাই অস্বস্তিতে আছে। এ সময় মায়ের ডাক শুনে চলে যায় রিশাদ। সে কিছুদূর যাওয়ার পর তারা লোকাল গাড়িতে উঠল। সে গাড়িতে করে সাতকানিয়া আসার পর বান্দরবানের গাড়িতে উঠার জন্য টিকিট কিনল। তারা গাড়িতে উঠে বসল। সিটে বসার পর মিনহাজ দেখল, পাশের সিটে কে একজন মাথা নিচু করে ঘুমাচ্ছে। তার সন্দেহ হলো। কেমন যেন পরিচিত পরিচিত মনে হচ্ছে। লোকটার ঘুম ভেঙ্গে গেলে হাই তুলতেই তাদের বুক ধুরু ধুরু কেঁপে উঠল।

মিনহাজ চিৎকার করে উঠল, ‘তুই’!

 

 

 

 

 

সারি সারি পাহাড় আর বন্ধুর পথ বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সবাই। মাঝে মাঝে বন এত ঘন কালো যে, মনে হয় রাত্রি নেমে এসেছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। আদনান বলল, ‘ভয় নেই, আমরা এখন যৌবনের মুখোমুখি দাঁড়ানো। এটাই যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়। এ সময় যদি আমরা যুদ্ধ না করি, তবে আর কখন করব?’

আদনানের কথা শুনতে শুনতে তারা হাঁটছে। এবড়ো থ্যাবড়ো পথ বেয়ে যেতে যেতে নানা গল্প করছে। আদনান তাদেরকে একটা চমৎকার গল্প শোনাল। এক সামরিক অফিসার তার সাগরেদদেরকে তীর বিদ্যা শিক্ষা দিচ্ছিল। সে একটা গাছের উপর কাঠের পাখি রেখে এক শিষ্যের হাতে তীর-ধনুক দিল। শিষ্যটি পাখিটিকে লক্ষ করে তীর ধরল। অফিসার জানতে চাইল, কি দেখছ? শিষ্যটি জবাবে বলল, আমি গাছের পাতা, গাছের ডাল, আকাশ, আর পাখিটি দেখতে পাচ্ছি। গুরু শিষ্যটাকে বলল, থাম। এরপর অন্য শিষ্যের হাতে ধনুকটি দিল। শিষ্যটি পাখিটির প্রতি তীর নিশানা করল। অফিসার তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি দেখতে পাচ্ছ তুমি?’ শিষ্যটি বলল, ‘আমি শুধু পাখির চোখ দেখতে পাচ্ছি।’ অফিসার তাকে তীর ছুড়ার আদেশ দিল। তীরটি পাখিটিকে আঘাত করল। এটাই হল সফলতার মন্ত্র। আমাদেরকে লক্ষ্যের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। আমরা যদি আবেগের বশে, প্রতীকুলতার কারণে, বা খেয়াল খুশির গোলাম হয়ে জীবনের লক্ষ্যকে অবহেলা করি, তবে কক্ষপথে ফিরে আসা খুব কষ্টসাধ্য হবে। লক্ষ্য উদ্দেশ্যের পানে যাত্রা এক কঠিন যাত্রা। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছতে হলে তার চারপার্শ্বের কষ্টগুলোকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এগুলোকে উপেক্ষা করে পর্বত চূড়ায় আরোহণ সম্ভব নয়। জীবনে সফল হতে হলে এবং কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে হলে প্রতিটি মানুষকে আকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাস ও প্রত্যাশা তিনটি বিষয়কে শুধু উপলব্ধি নয়, আয়ত্ত্বও করতে হবে। এভাবে যদি আমরা একাগ্রচিত্ত সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যাই, তবে সাফল্য অবশ্যই হাতের মুঠোয় আসবে। কথা বলতে বলতে তারা একটা ছোট ঝর্ণার নিকট এসে পৌঁছল। চারিদিকে পাহাড় ঢাকা পথে ছোট্ট ঝর্ণার উপস্থিতি দারুণ নয়নাভিরাম। দেখে শাহীন থমকে দাঁড়াল। শাহীন বলল, ‘এখানে গোসল করতে হবে, না হলে জীবনটা সার্থক হবে না।’

আদনান জবাবে বলল, লক্ষ্যপানে যাবার পথে আমরা যদি সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে বিভোর হয়ে যাই তবে আর এগিয়ে যাওয়া যাবে না। ক্লামত্ম হয়ে বিশ্রাম নিতে পারি। এতে সতেজতা আসবে আর সৌন্দর্য্যে বিভোর হলে দুর্বলতা আসবে। এটাই ধ্বংসের কারণ।

আর কথা না বাড়িয়ে তারা হাঁটতে লাগল। তাদের যাত্রা আরো অনেক দূরে। দুপুরের সূর্য্য পশ্চিমে হেলে যেতে শুরু করেছে। আদনানের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে।

রিশাদ বুঝতে পারছে না সবাই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে কেন? তাকে নিয়ে সবাই বাজে মমত্মব্য করছে কেন? সে গভীরভাবে চিমত্মা করে যাচ্ছে, কিন্তু জবাব পাচ্ছেনা। পাড়ার সব ছেলেরা তাকে দেখলে সটকে যায়। কেউ কেউ চিমটি কেটে বলে সক্রেটিস। কেউ কেউ বলে, মীর জাফরের বাচ্চা। সে ‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার’ কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন হলেও এখন সবার কাছে উটকো বোঝা। এতদিন সে বাড়িতে ছিল না। অথচ তাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, যারা এই গুপ্তধনের জন্য মরিয়া হয়ে রাতদিন এক করে ফেলেছে, তাদের সহযোগী রূপে। শাহীন তাকে বলেছিল জ্বীনের বাদশা। কেন? চিমত্মা করতে করতে অন্যমনস্ক ভাবে হাঁটছিল রিশাদ।

‘কী নাতি, আনমনাভাবে যাচ্ছ কোথায়?’ মফিজুর রহমানের ডাক শুনে সম্বিত ফিরে পেল সে।

‘কোথাও না। সংক্ষেপে জবাব দিল রিশাদ।

‘তোমাকে অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে?’

‘দাদু মন ভালো নেই।’

দাদু, এভাবে ঋণাত্মক কথা বলতে নেই। তোমাকে সকল সময় সব অবস্থায় বলতে হবে ধনাত্মক কথা। ধনাত্মক কথা বার্তার আলাদা একটা মাহাত্ম্য আছে। কেউ যদি সকল অবস্থায় বার বার ধনাত্মক কথা বলে, তবে তার চিমত্মা চেতনাও ভাল-থাকবে। তার মসিত্মকের কর্ম কাঠামো বদলে যাবে। মানুষের নাভার্স সিস্টেম বাসত্মবতা ও কল্পনার মধ্যে কোন তফাত করতে পারে না। বাসত্মব ঘটনা দেখলে যে ব্রেন ওয়েভ-সৃষ্টি হয়, সে রকম ঘটনা কল্পনা করলেও একই ব্রেন ওয়েভ-সৃষ্টি হয়। সে কারণে নাটক, সিনেমা, অভিনয় দেখেও হাসি আসে আর কান্নায় মন সাড়া দেয়। যদিও সবাই জানি, এটা নিছক অভিনয়। এই জন্য আমাদের প্রিয় নবীজী সর্ব অবস্থায়, আলহামদুলিল্লাহ, ভাল আছি বলতে বলেছেন। ধনাত্মক কথা মসিত্মষ্কে ভাল থাকার বাণী পৌঁছে দিয়ে মনোবল চাঙ্গা রাখে।

‘সবাই মনে করে, আমি নাকি গুপ্তধন খোঁজার জন্য বিশ্বাসঘাতকতা করেছি।’

‘তাতে ঘাবড়ানোর কি আছে? তুমি একটা ভুলকে ভুল বলছ, সবাই মনে করছে তা সঠিক। এতে তুমি কিছুদিন বিব্রত থাকলেও শেষ পর্যমত্ম তারাই লজ্জিত হবে। যে নিজের বিশ্বাসে একা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, সে সবচে শক্তিমান মানুষ। তুমি এখন সে শক্তির প্রতীক।

কিন্তু আমি যে একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি?

‘তাতে তোমার ভয় পাবার কি আছে? তুমি জয়লাভ করলে দেখবে, যারা তোমাকে ত্যাগ করেছে, তারাও তোমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সত্যের একদিন জয় হবেই। তাছাড়া প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা দিয়েই মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। অন্যান্য প্রাণী প্রতিকূল পরিবেশে খেই হারিয়ে ফেলে। তুমি মানুষ। তোমাকে জানতে হবে, কিভাবে প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাওয়া যায়? জীবনের আসল সার্থকতা হল বিবেকের কাছে দায়ী না থাকা। তুমি তাদের তথাকথিত গুপ্তধনের বিরোধিতা করায়, বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ না। বিবেক তোমার উপর প্রতিশোধ নিবে না। তুমি মুক্ত। যারা সসত্মাভাবে কিছু পেতে চায়, তারাই সবকিছু হারিয়ে তা হুতাশ করে। তোমার অধ্যয়ন নিয়ে তুমি এগিয়ে যাও। শিক্ষার মধ্যে জীবনের গৌরব নিহিত, ধন সম্পদে নয়। ধন ও খ্যাতির পেছনে দৌড়তে নেই। এগুলোর পেছনে দৌড়লে পাওয়া যায় না।’

‘দাদু তারা আমার সাথে এমন আচরণ করার পর হতে, আমার পড়ায় মন বসছে না।’

‘কি বল!’ দাদু বিস্ময় প্রকাশ করে বলল। ‘ইস! কেউ কি নিজের পায়ে কুড়াল মারে? যে যাই বলুক, কান দিতে নেয়। চিলে কান নিয়ে গেছে বললে চিলের পেছনে না দৌড়ে, হাত দিয়ে কান ধরে দেখতে হয়। তোমাদের এখন জ্ঞান অর্জনের কাল, ধন অন্বেষণের নয়। শোন একদিন দশজন লোক এসে হযরত আলীকে জিজ্ঞাসা করলো, জ্ঞান ও সম্পদের মধ্যে কোনটি ভাল, কেন ভাল? হযরত আলী তাদেরকে জবাবে দশটি উত্তর দিলেন।

১. জ্ঞান হল নবীর নীতি, সম্পদ ফেরআউনের উত্তরাধিকার। তাই জ্ঞান সম্পদের চেয়ে উত্তম।

২. সম্পদকে পাহারা দিতে হয়, জ্ঞান মানুষকে পাহারা দেয়, তাই জ্ঞান উত্তম।

৩. সম্পদশালী মানুষের অনেক শত্রু থাকে, জ্ঞানীর অনেক বন্ধু থাকে, তাই জ্ঞান উত্তম।

৪. জ্ঞান উত্তম, কারণ তা বিতরণে বেড়ে যায়, আর সম্পদ বিতরণে কমে যায়।

৫. জ্ঞান চুরি করা যায় না, কিন্তু সম্পদ চুরি করা যায়, তাই জ্ঞান উত্তম।

৬. সময় জ্ঞানের কোন ক্ষতি করে না, কিন্তু সম্পদ সময়ের বিবর্তনে ক্ষয়ে যায়, তাই জ্ঞান উত্তম।

৭. জ্ঞান সীমাহীন কিন্তু সম্পদ সীমাবদ্ধ, তাই জ্ঞান উত্তম।

৮. জ্ঞান হৃদয় মনকে জ্যোতির্ময় করে, সম্পদ তাকে কলুষিত করে, তাই জ্ঞান উত্তম।

৯. জ্ঞান উত্তম, কারণ জ্ঞানী দানশীল হয়। অন্য দিকে সম্পদশালী ব্যক্তি কৃপণ হয়।

১০. জ্ঞান উত্তম, কারণ জ্ঞান মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ করে, অন্যদিকে সম্পদ ফেরআউন ও নমরুদকে বিপদগ্রস্ত করেছে। তারা তাদেরকে প্রভু দাবী করেছিল।

অতীতে মুসলমানদের এত উন্নতির কারণ ছিল জ্ঞান অমেবষণ। হারুনুর রশিদের সময় পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের রাজা নিসোফোরাস কর দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। খলিফা যখন সৈন্য বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলো, সে পরাজিত হতে লাগল। নিসোফোরাস ভীত হয়ে পূর্বের চাইতে অধিক কর দিতে সম্মত হয়ে সন্ধি ভিক্ষা করলো। ততদিনে তার রাজ্য অর্ধেক শেষ। তবুও খলিফা তার সাথে এই শর্তে চুক্তি করল যে, নিসোফোরাস তার রাজ্যের সমসত্ম সাহিত্য ও বিজ্ঞানের একটি করে অনুলিপি হারুনুর রশিদের রাজ্যে প্রেরণ করবে। এর বিনিময়ে খলিফা তাকে রাজ্য ফিরিয়ে দেবে। এভাবে বাগদাদ সমৃদ্ধ হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শীর্ষে আরোহণ করেছিল। রিশাদ তুমি সে পথে…. হঠাৎ কথা বন্ধ করল মফিজুর রহমান। বারবার দূরে কি যেন দেখছে আর রিশাদের প্রতি তাকাচ্ছে। দাদুর এমন অদ্ভূত আচরণ দেখে, রিশাদ জোরে চিৎকার দিল, মা… মা.. দেখ!!!

দাদু, ততক্ষণে পাগলের প্রলাপ শুরু করেছে, রিশাদ, রিশাদ, তুমি, কি আসলে রিশাদ?

দাদুর এমন পাগলামী দেখে রিশাদ বুদ্ধিহত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।

দাদু বলে যাচ্ছে, ‘ঐ রিশাদ আর এ রিশাদের মধ্যে কে আসল?

 

 

 

 

 

আদনানরা একটা পবর্তের নিচে দাঁড়াল। আদনান বলল, এই পবর্তের চূড়ায় তাতুমের ঘর। বাড়িতে উঠার জন্য পাহাড় কেটে সিঁড়ি করা হয়েছে। উপরে বাuঁশর ঘর। ধীরে ধীরে তারা উপরে উঠে গেল। তাতুমের সহকারী মালেক তাদেরকে স্বাগতম জানিয়ে আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইল। সব জানার পর তিনি তাদেরকে ঘরের ভিতর নিয়ে গেল। ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে মিনহাজ, শাহীন, আশরাফ দেখল অন্য দরজা দিয়ে রিশাদ বেরিয়ে যাচ্ছে। দেখে মিনহাজ ডাক দিতে চাইলেও তার আগেই অদৃশ্য হয়ে গেল রিশাদ। তারা রিশাদকে ধরার জন্য বেরিয়ে আসবে এমন সময় তাতুম এসে তাদের সামনে হাজির। তাদের আর বের হওয়া হলো না। তাতুম মিনহাজের নাম ধরে ডাক দিলে চমকে উঠল সবাই। এ লোক কিভাবে জানল এ নাম? পরে ভাবল, রিশাদ নিশ্চয় তাদের নাম তাকে বলে দিয়েছে। তাতুম তাদেরকে অন্য একটি ঘরে নিয়ে গেল।

মিনহাজ জানতে চাইল, ‘কিছুক্ষণ আগে যে লোকটা বেরিয়ে গেল, সে লোকটা কে?’

‘কি পাগলের প্রলাপ বকছ? এখানে তো এতক্ষণ মালেক ছাড়া কেউ ছিল না।’ জবাব দিল তাতুম।

‘না আঙ্কেল, আমরা ঘরে ঢুকা মাত্র একজন লোক বেরিয়ে গেল।’

মালেক, মালেক, ডাক দিল তাতুম। মালেক এলো।

তাতুম জানতে চাইল, ‘এখানে কি কেউ এসেছিল?’

‘না স্যার, এখানে এতক্ষণ একটা পোকাও ছিল না।’

‘এখন বল তোমরা কেন এসেছ?’ তাতুম প্রশ্ন করল।

মিনহাজ সব বলার পর তাতুম তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘শেষ পর্যমত্ম তোমরা এলে। তোমরা দারুণ বুদ্ধিমান।’ তারপর তাতুম একটি পুতুল বের করল। তাতে ফুঁক দিতেই তা জীবিত হয়ে উঠল। এটির চোখ খুব বড় বড়। চোখগুলোতে আয়নার টুকরো বসানো। এই আয়নাগুলোতে ভেসে উঠা প্রতিচ্ছবিতে স্বর্ণ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।

তাতুম জানতে চাইল, ‘ঐ স্বর্ণগুলোর কি অবস্থা।’

পুতুলটি চিৎকার দিয়ে বলল, ‘কোটি টাকার ধন ওখানে।’ আরো জানালো, ‘যদিও এগুলো পেতে অনেকে চেষ্টা করে যাচ্ছে, তবে পাওয়া সম্ভব নয়। এগুলো পেতে হলে অনেক ত্যাগের দরকার।

তার এমন সত্য সংবাদে কে-না শিহরিত হয়? মিনহাজরাও শিহরিত হল। তারা বুঝতে পারল, তাতুমকে দিয়েই একশ ভাগ কাজ আদায় করা যাবে জ্বীনদের কিভাবে খুশি করা যাবে? প্রশ্ন করল আদনান।

‘তোমরা তা পারবে কি না তাই নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।’

প্রথমে বলুন, তারপর ভেবে দেখব।

ওরা চায়, সোনার বদলে সোনা। তোমরা যদি সোনা দিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করতে পার, তবে তারা ঐ সোনাগুলো নিতে তোমাদের বাঁধা দিবে না।

মিনহাজ বলল, ‘আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্ত্তত।’

‘কখন?’ তাতুম প্রশ্ন করল।

কয়েকদিন পর আমরা আপনার সাথে আবার দেখা করব।

‘কয়েকদিন? কি বল? হায় যুবক, তুমি কাজের গুরুত্ব বুঝলে না। কোটি টাকার ধন এভাবে হারিয়ে ফেলার কোন মানে হয় না। একদিনের অর্থ তুমি বুঝ? একদিন মানেই বিশাল ব্যাপার। যে দিন তুমি কোন কাজ করলে না, ওটা নির্মম একটা দিন। ও দিনটা খুব মর্যাদাহীন তুচ্ছ একটা দিন। এটা শুধু তোমার জন্য গুরুত্বহীন নয়, এর মাধ্যমে তুমি পুরো জাতির ক্ষতি করলে।’ তাতুম তাদেরকে বলল।

মিনহাজকে উদ্দেশ করে আরো বলল, ‘তুমি কি জান না, যে অগ্রদূত তাকে অধিক সাহসী, অধিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং অধিক দৃঢ়প্রত্যয়ী হতে হয়। আজকের কাজ আগামীদিনের জন্য ফেলে রাখবে কেন? আগামী দিন তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। কখনো সময় নষ্ট করবে না। যদি সময় নষ্ট কর এর পরিণতি তোমাকে ভোগ করতেই হবে। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি এখনই কাজ শুরু করে আর অজ্ঞ লোক কাজ শুরু করব, শুরু করব বলে জীবন ক্ষয় করে। তোমাদের মধ্যে প্রাজ্ঞতা থাকা চাই, অজ্ঞতা নয়। তোমরা স্বপ্ন দেখছ, বড় কিছু পাবার। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বিরতি নিচ্ছ। তোমার স্বপ্ন যদি তোমাকে বলে, এখন নয় আগামীকাল। তবে তুমি দিবা স্বপ্ন দেখছ। প্রকৃত স্বপ্ন বলে, এখনই কাজ শুরু কর। না হলে তুমি ব্যর্থ হবে।

গুপ্তধন উদ্ধারের ব্যাপারে তাতুমের সাথে আরো অনেক কথা-বার্তা শলা পরামর্শ করে ফিরে আসছিল তারা। সূর্যের আলো নিসেত্মজ হয়ে আসছে। সূর্য নিদ্রায় যাওয়ার জন্য ক্রমশ পশ্চিমে চলে যাচ্ছে। আদনান তাদেরকে দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে যেতে বলল। না হলে ভয়ঙ্কর পাহাড়ী বিপদ তাদেরকে গ্রাস করে ফেলবে। সে ঝর্ণার কাছে পৌঁছে আবার সৌন্দর্য্য মুগ্ধ হয়ে পড়ল শাহীন। সে কিছুক্ষণ এখানে বিশ্রাম নিয়ে তারপর যাবে।

আদনানের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছে। ভয়ে ডুবমত্ম সূর্যের সাথে প্রতিযোগিতা করে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। রাত নেমে যাচ্ছে। অথচ শাহীন সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে মত্ত। আদনানের চোখ গেল ঝোপের দিকে। কি যেন দাঁড়িয়ে আছে? দেখে চমকে উঠলো তারা। এই তো রিশাদ।

‘রিশাদ তুই এখানে?’ মিনহাজ জানতে চাইল।

রিশাদ কোন কথা বলল না। কেমন যেন অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল রিশাদ। ‘তোরা এখানে কেন? তোরাতো আমাকে গাড়িতে বলেছিলি, নীলগীরি দেখতে যাচ্ছিস।’

শাহীন বলল, ‘তুই এখানে কেন তাই বল? তোকে না তাতুমের ঘরে দেখেছিলাম। আবার এখানে?’

আমার মামাত ভাই জঙ্গলে গেছে একটু কাজে। তাকে অনেক করে বুঝিয়েছি কিন্তু সে সব মানবে না, কি আর করা? এখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। হয়ত এতক্ষণে চলে আসছে সে।

তারা দেখতে পেল ঝোপের মধ্য হতে কে একজন বেরিয়ে আসছে। লোকটি কাছে আসার পর মিনহাজ সবাইকে বলল,‘চল।’

সবাই হাঁটতে শুরু করল।

 

 

 

 

 

উল্লুক ভিটা একটি পরিত্যক্ত ভিটা। এখানে কখনো কিছু আবাদ করবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি আলমের বাবা। গুপ্তধন সন্ধানকারীরা তার চোখ খুলে দিয়েছে। পুরো ভিটায় খনন কার্য পরিচালিত হওয়ায় সে এখানে শিম, হলুদ ও অন্যান্য ফসলি গাছ লাগানোর সিদ্ধামত্ম নিয়ে এগিয়ে গেল। গ্রামের সবখানে খোঁজাখুঁজি করে গোবর সংগ্রহ করল। গোবর গুলো কয়েকদিন শুকানোর পর পিতা-পুত্র দু’জনে মিলে সেগুলো চূর্ণ করে জমিতে ছিটিয়ে দিল। আলমের বাবার মুখে বিজয়ের হাসি। এটাকেই বলা হয় ভাগ্য। হঠাৎ কারা যেন তার অন্ধ দু’চোখে সম্ভাবনার আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। সে হিসাব কষতে লাগল, সব্জি বাগান করে কত টাকা লাভ পাবে। মনে মনে তান্ত্রিককে শত শত ধন্যবাদ দিল গুপ্তধনের খোঁজ দেওয়ার জন্য। সে তান্ত্রিকটা ধোঁকা দেওয়ার জন্য গুপ্তধনের কথা বলেছে আর সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে কথিত গুপ্তধনের খোঁজে। গুপ্তধন কেউ পেয়েছে কিনা তা তার জানা নাই। মাঝখানে তার ভিটাতে কর্ষণ কার্য হয়ে গেল। যে ভিটায় কখনো চাষের চিমত্মা-ভাবনা করেনি, তাতে লাগিয়ে ফেলল শিম, হলুদ, বেগুন ও মরিচের চারা। কয়েকদিন পর বাতাসের মৃদু আলিঙ্গনে যখন গাছ গুলো ডানে বায়ে নড়তে লাগল, সাথে সাথে তার ভাগ্য ও যেন ঝিলিক মেরে উঠেছে।

মিনহাজরা ফিরে এসেছে বান্দরবান হতে। সবাই উৎফুল্ল। তাতুম তাদেরকে জোর দিয়ে বলেছে গুপ্তধনটা এক গভীর স্থানে প্রোথিত। জ্বীন-পরীদের সাহায্য ছাড়া ওটা উঠানো সম্ভব না। তাদেরকে বান্দরবান চারদিন অবস্থান করতে হয়েছে। ফিরে এসে যখন দাদা আর রিশাদের কাহিনী শুনল, তারাও হতভম্ভ। যদি রিশাদ সত্যিই এখানে থাকে, তবে সাতকানিয়া ও বান্দরবানে যে রিশাদকে দেখেছে ঐ রিশাদটা কে? তারা কোন হিসাব মিলাতে পারছে না। সবাইকে যখন তারা বান্দরবানের রিশাদের কথা বলছিল, এমন সময় দেখা গেল রিশাদ আসছে। তাকে দেখে সবাই অস্থির হয়ে গেল। মুফিজুর রহমান সবাইকে নির্দেশ দিল আযান দেওয়ার জন্য। আযান দিলে খারাপ জ্বীন-ভূত থাকে না, পালিয়ে যায়। সবাই একযোগে আযান দেওয়া শুরু করল। সকাল এগারটায় সবাই আযান দিচ্ছে দেখে রিশাদ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। অনুভব করতে চেষ্টা করল, ভূমিকম্প হচ্ছে কি না। এ দেশে ভূমিকম্পের সময় মানুষ আযান দেয়। সে রকম কোন কিছু অনুভব করল না সে। পরে ভাবল, সম্ভবত কোন নবজাতকের আগমন ঘটেছে। নবজাতকের জন্ম উপলক্ষেও আযান দেয়া হয়। সে মিনহাজদের বাসার দিকে এগুতে লাগল। তাকে বাড়ির দিকে আসতে দেখে মুফিজুর রহমান নিশ্চিত হল, এটা আসল রিশাদ। আযান শুনে পাড়ার অনেকে জড়ো হয়েছে। মিনহাজ তাদেরকেও সাতকানিয়া হতে বান্দরবানের পুরো রিশাদ অংশ বর্ণনা করল। কয়েক দফায় বাঁধা দিতে চেয়েছে শাহীন। কিন্তু মিনহাজের আবেগের কাছে তা হার মেনেছে। সে কাহিনী শুনে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল। এমনকি রিশাদ নিজেও। এটা কিভাবে সম্ভব? এ দুই ঘটনার পর হতে সবাই রিশাদকে সন্দেহের চোখে দেখছে। সবগুলো চোখ জোড়া তার উপর নিবদ্ধ। রিশাদের মনে হচ্ছিল, তাকে সদ্য কোথা হতে ধরে আনা হয়েছে। সবাই গভীর আগ্রহ নিয়ে সে জন্য তাকে দেখছে। ক্রমশ তার মধ্যেও অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার মনে হল, তাকে কাদম্বিনির মত করে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হবে। নইলে ওরা তাকে ক্ষমা করবে না। অস্বস্থি বৃদ্ধি পাওয়ায় রিশাদ ওখান হতে বাড়ি ফিরে এলো।

রাতে খাবার টেবিলে বসেছে মফিজুর রহমান, মিনা, মিনহাজ, রায়হানা ও মালেকা। কিছুক্ষণ আগে আব্দুল আলিম ফোন করেছিল। জানতে চেয়েছিল তার বাবা-মা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, কেমন আছে? সবাই এক যোগে বলেছিল ভাল।

‘প্রবাসে অবস্থানরত ব্যক্তিকে মন্দ খবর দেয়া যায় না। গেলে আমি বলতাম, দেখ তোর ছেলেটা যা নষ্টের মূল হয়েছে।’ রায়হানা বলল।

স্ত্রীর কথার সূত্র ধরে মফিজুর রহমান বলল, ‘মিনহাজ সত্যি করে বল, বান্দরবান কেন গিয়েছিলে? আমি জানি, কিন্তু তোমার মুখ দিয়ে শুনতে চাই।’

মিনহাজ থতমত খেয়ে স্বীকার করল, তাতুমের সাথে দেখা করার জন্য তারা বান্দরবানে গিয়েছিল। গুপ্তধন উদ্ধারের গোপন মিশনে গিয়েছিল।

শুনে মালেকা বেগম প্রচন্ড ক্ষুব্ধ। সে দৌড়ে রান্না ঘরে গেল বেত খোঁজার জন্য। যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলল, ‘এ ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। রাখলে আমাদের বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না।’

রায়হানা পুত্রবধূকে সান্ত্বনা দিল।

‘তোকে কে বলেছে, আমাদের ধন সম্পদ দরকার?’ মালেকা পুত্রের কাছে জানতে চাইল।

‘না হলে, আমার বাবা বিদেশ যাবে কেন?’ পাল্টা জানতে চাইল মিনহাজ।

‘সে কথা।’ রায়হানা নাতিকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল, ‘শুন, তোমার বাবা ছিল লেখাপড়ায় তোমার মত ফাঁকিবাজ। সে বুঝতে চাইত না সময় কি? এর সদ্বব্যবহার কেন দরকার? তাকে সময় সম্পর্কে বুঝাতে গিয়ে আমি নিজে অনেক কিছু শিখেছিলাম, কিন্তু তাকে কিছু শেখাতে পারিনি। তুমিও তোমার বাবার মত ভুল পথে পা বাড়াচ্ছ। অসময়ে সম্পদের পিছনে দৌড়াচ্ছ। সম্পদ আর সম্মান খুঁজলে পাওয়া যায় না। তুমি যদি তাদের পিছনে দৌড়াও তারা পালিয়ে যাবে, আর যদি তুমি কঠোর পরিশ্রম কর, তবে তারা স্বত:স্ফূর্তভাবে তোমাকে ধরা দিবে। এখন ধরাকে সরা জ্ঞান করার দরকার নাই।’

রায়হানা কথা শেষ করতে না করতে মফিজুর রহমান বলল, মিনা তোমার জীবনের উদ্দেশ্য কি?

মিনা বলল, ‘আমি ডাক্তার হতে চাই।’

মফিজুর রহমান মিনহাজের কাছে জানতে চাইল, ‘তুমি কি হতে চাও?’

মিনহাজ বলল, ‘আমিও ডাক্তার হতে চাই।’

‘তুমি কেন ডাক্তার হতে চাও?’ মিনার কাছে জানতে চাইল মফিজুর রহমান।

‘আমি মানুষের সেবা করতে চাই।’ মিনা জবাব দিল।

‘তুমি কেন ডাক্তার হতে চাও?’ মিনহাজকে জিজ্ঞাসা করল মফিজুর রহমান।

‘আমিও মানুষের সেবা করতে চাই।’

তোমরা কেন গতানুগতিক কথা বলছ? জানতে চাইল মফিজুর রহমান।

‘ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছাটা কি গতানুগতিক?’ জানতে চাইল মিনহাজ।

আমাদের দেশে এটা গতানুগতিক জীবনের উদ্দেশ্য। এ দেশে ষষ্ঠ শ্রেণি হতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’ রচনায় ডাক্তার হওয়া ছাড়া আর কোন ভাল রচনা নাই। এর প্রভাবেই ছাত্ররা সবাই ডাক্তার হতে চায়। সব ছাত্র পরীক্ষার খাতায় একথা বমি করে দিয়ে আসে। এ দেশে অবশ্য অন্য একটা সমস্যা আছে। এখানে ছাত্রদের ঝোঁক এবং মেধা কোন বিষয়ে তা পর্যালোচনা করা হয় না, ফলে যথাযথ মেধা বিকাশের সুযোগ ছাত্ররা পায় না। অনেকে ইচ্ছেমত বিষয় নির্বাচন করে পরে হাহুতাশ করে। দেশে তো হাজার হাজার পেশা আছে। তোমরা শুধু ডাক্তার হতে চাইবে কেন? তোমাদের বুঝার জন্য আমি কয়েকটি পেশার নাম বলছি। আমি তোমাদেরকে এক সপ্তাহ সময় দিব। আগামী শুক্রবারে আমি জানতে চাইবো সত্যিকারভাবে তোমরা কে কি হতে চাও? এরপর দাদু ৫০টি পেশার নাম বলল,

ডাক্তার, স্থপতি, গণিতবিদ, জীব-বিজ্ঞানী, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, নৌ-বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, রসায়নবিদ, মনোবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, ঐতিহাসিক, পাইলট, গায়ক, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবি, বিচারপতি, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, পুলিশ, গায়ক, নৌ সেনা, নাবিক, কুটনীতিবিদ, চিত্রকর, চার্টার একাউন্টেন্ট, ক্রিকেটার, ফুটবলার, এ্যাথলেট, কবি, ঔপন্যাসিক, ছড়াকার, কলামিস্ট, কৃষিবিদ, চিত্রনায়ক, আমদানী-রফতানী কারক, সিএন্ডএফএজেন্ট, ব্যাংকার, গাইড, ধারা-ভাষ্যকার, অভিনেতা, গীতিকার, সৈনিক, বিজ্ঞাপন নির্মাতা, জাদুকর, কনসালট্যান্ট, কৃষক, জ্যোর্তিবিদ, প্রকাশক।

‘তবে পেশা তথা ক্যারিয়ার নির্বাচনের সময় আমাদেরকে স্বাধীন পেশা নির্বাচন করা দরকার। এ দেশে আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্য, সবাই চাকুরী খুঁজে অর্থাৎ চাকর হতে চায়। যে যত বেশি মেধাবী, সে তত বড় চাকর হতে চায়। এদেশে প্রথম শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন মি. ম্যাকলে। সে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার সময় মন্তব্যে লিখে ছিল, এই শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্য হল, এমন একদল লোক তৈরি করা যারা জন্মগতভাবে হবে ভারতীয়, চিন্তা চেতনায় হবে ব্রিটিশ। তাদের কাজ হবে কেরানীগিরি করা। ম্যাকলের সে শিক্ষানীতির ভূত আমাদেরকে এখনো মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমরা তার মানস-সন্তান। এই মানসিক পরাধীনতা-মূলক ক্যারিয়ার পছন্দ করার পথ হতে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। ক্যারিয়ার নির্ধারনের জন্য আমার মতে, বিদ্যালয়ে একটা সুনিদির্ষ্ট গাইড লাইন থাকা দরকার। দেশে কোন সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন নাই। এই জন্য দেখা যায়, দেশে অদ্ভুত পদ্ধতি গড়ে উঠছে। এটা দেখলে আমার আশ্চর্য লাগে।’

‘কি অদ্ভুত নিয়ম?’ জানতে চাইল মিনহাজ।

জবাবে দাদু বলল, ‘এদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ডাক্তারের ছেলে, ডাক্তার, শিক্ষকের ছেলে, শিক্ষক, আইনজীবিদের ছেলে আইনজীবি, পুলিশের ছেলে পুলিশ। এভাবে পিতার পেশাকে পুত্র অনুসরণ করে। এটা আমাদের দৃষ্টিশক্তির দৈন্যতার ফসল। শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতার সুষ্পষ্ট দলিল। মিনহাজ আমি তোমাকে সাতদিন সময় দিচ্ছি, তোমার জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ঠিক করার জন্য। মিনা তুমিও সাতদিন সময় পাচ্ছ তা করার জন্য।

দু’জনই ‘হ্যাঁ’ সুচক মাথা নেড়ে দাদুর প্রস্তাবে সম্মতি জানাল।

 

 

 

 

 

‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার কমিটি’ বৈঠকে বসেছে। যেহেতু তাদের তৎপরতার কথা ফাঁস হয়ে গেছে তাই তারা পাড়া ছেড়ে দু’মাইল দূরে এসে বৈঠকে বসেছে। আলোচনার এজেন্ডা গুলো পর্যায়ক্রমে সাজানো হয়েছে। মিনহাজ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, ‘কোন না কোন কারণে আমাদের তৎপরতার কথা ফাঁস হয়ে গিয়েছে। এখন আমরা দু’দিক হতে বিপদে আছি। প্রথমতঃ আমাদের তৎপরতার কথা ফাঁস হয়ে যাওয়াতে অন্য যারা গুপ্তধন খুঁজছে, তারাও আমাদের পথ অনুসরণ করে এগুতে পারে। দ্বিতীয়তঃ তাতুম নিজেই আমাদের জন্য এখন আস্ত বিপদ। সে নিজে এসে সব তুলে নিয়ে যেতে পারে। তার হাতে এটা উত্তোলনের চাবি রয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের করণীয় সম্পর্কে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। না হলে, আমাদের সামনে সব হারানোর ভয়। এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কি?

তাতুম কি কি বলেছে? সাবিবর জানতে চাইল- ‘আমরা যখন তার ওখানে পৌঁছলাম, তোমরা শুনে অবাক হবে, সে আমার নাম ধরে ডাকল। যখন তাকে সব খুলে বলা হল, সে ধ্যানে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্বীন এসে আমাদেরকে সালাম দিল। পরে দেখলাম, টেবিলে রাখা একটা পুতুল জীবিত হয়ে উঠেছে, যার দু’চোখে আয়নার টুকরো বসানো। সবাই দেখলাম, সে আয়নার মধ্যে রাশি রাশি সোনা ঝলমল করছে। আমরা পুতুলটির সাথে কথা বললাম। পুতুলটি আমাদেরকে জানাল, কোটি টাকার গুপ্তধন এখনো মাটির নিচে পড়ে আছে। পুতুলটা আরো জানিয়েছে, ঐ গুপ্তধন উঠানো সহজ কাজ নয়। কেউ যদি ঐ ধনের পাহারাদার জ্বীনদের খুশি না করে গুপ্তধনগুলোতে হাত দেয়, সাথে সাথে তার মৃত্যু হবার সম্ভাবনা আছে। ঐ জ্বীনদের সন্তুষ্ট করতে হলে সোনা-দানা দিতে হবে। তারা যদি আমাদের কাছ থেকে অল্প কিছু পায়, তবে ঐ জায়গা ছেড়ে চলে যাবে। এখন বল আমরা কি করতে পারি?

সব পর্যালোচনা পূর্বক তারা অনেক সিদ্ধামত্ম নিল। বৈঠক শেষে বিজয়ীর হাসি নিয়ে সবাই বাড়ি ফিরল।

 

 

 

 

 

‘আমি তোমাকে অনেক দায়িত্ব দিয়েছিলাম, তুমি কয়টা কথা মনে রেখেছ?’ দাদু জানতে চাইল।

‘কয়টা কেন? একটাই দিয়েছেন।’ জবাব দিল মিনহাজ।

‘এ অল্প বয়সে যদি সব ভুলে যাও, তবে কি হবে?’

‘দাদু, তুমি শুধু একটা সঠিক জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে সাতদিন সময় দিয়েছিলে।’

‘আরে না, তোমাকে কিছু প্রশ্নও দিয়েছিলাম, জানতে চেয়েছিলাম ১. পৃথিবীর সবচে মূল্যবান বস্ত্তটি কি? ২. কোটি টাকার গুপ্তধন কি? ৩. তুমি আমার কাছে সে অদ্ভুত প্রাণীর তথ্য জানতে চেয়েছে, যাকে বেঁধে রাখা যায় না। একে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে? এভাবে আমাদের মধ্যে কিছু অমিমাংসিত বিষয় রয়ে গেছে। বল এখন এগুলো কিভাবে সমাধান করা যায়?’

মিনহাজ জবাবে বলল, ‘আমি আমার ক্যারিয়ার নির্বাচন নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা ও পরামর্শ করেছি সবার সাথে। একেকজন একেকটা পরামর্শ প্রদান করে।’

মফিজুর রহমান বলল, ‘জীবন তোমার, তোমার ভাল-মন্দ তোমাকে বুঝতে হবে।’ তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তোমার জীবনের উপর যদি তোমার কর্তৃত্ব না থাকে, তবে বুঝতে হবে, তুমি এক সর্বনাশা পথে এগিয়ে যাচ্ছ। তোমার জীবনকে বুঝার জন্য তোমাকে আত্মবিশ্লেষণ করতে হবে। এটা খুব জটিল একটা কাজ। এক্ষেত্রে তোমাকে শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে, নিজের প্রশ্নমালা নিজেকে তৈরি করতে হবে। এবং তোমাকে সমাধান বের করতে হবে। তোমার অন্তর্নিহিত শক্তি কারো জানা নাই। তোমার অন্তর্নিহিত শক্তি পর্যালোচনা করতে গিয়ে অন্যরা বলবে, তোমার দ্বারা হয়ত কিছু করা সম্ভব না। কিন্তু তুমি জান, সম্ভব। তোমার জীবনের লক্ষ উদ্দেশ্য নির্ধারণের জন্য তুমি যদি তোমার সহকর্মীদের সাথে পরামর্শ কর, এটা হবে চরম বোকামী। তারা তো নিজেরা অন্ধ। একজন অন্ধ, আরেক অন্ধকে পথ দেখাতে পারে না। তুমি যখন তোমার জীবনের লক্ষ-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে যাবে, তোমাকে পরামর্শ করতে হবে তাদের সাথে, যাদের চোখ খোলা। যাদের দূরদৃষ্টি আছে। আমি তোমাকে কিছু নির্দেশনা দিতে চাই। তুমি কি রাজি?

‘দাদু, আমি রাজি। আমি আপনার পরামর্শ শোনার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছি। আপনি বলুন।’

দাদু বলা শুরু করল- ‘জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে তোমার যে বিষয়টা প্রথমে দেখা প্রয়োজন তা হলো বড় ছবি দেখা। যে যত বড় মনছবি দেখবে, তার বিষয় প্রীতিটাও তত বড় হবে।

‘বড় ছবি মানে?’ জানতে চাইল মিনহাজ।

বড় ছবি মানে উচ্চাকাঙ্ক্ষা। উপরে উঠার প্রথম ধাপ হচ্ছে উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা বড় স্বপ্ন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটা বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে পার, এখানে সাফল্য পাওয়াটা জটিল কোন বিষয় নয়। এদেশে এখনো প্রতিটি ক্ষেত্রে কম প্রতিযোগী রয়েছে। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে তুমি সহজে বৃহত্তর কিছুর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পার। তবে আমি এটাকে সুযোগ হিসেবে নেবার জন্য তোমাকে উদ্বুদ্ধ করছি না। আমাদেরকে পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে জর্জ বার্নার্ড শ’ এর উক্তিটি স্মরণ রাখা দরকার। তিনি বলেছেন,

যখনই তুমি দেখ কিছু

কেন?

তোমার প্রশ্ন হয়।

আমি স্বপ্ন দেখি তা

যা ছিল না কভু

তারপরও আমি শুধাই

কেন নয়?

এভাবে আমাদের চিন্তাধারার মধ্যে নতুনত্ব , সৃজনশীলতা এবং তা পাবার দুর্বিনীত আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে। তোমার এমন বৃহত্তর ও সুদূর প্রসারী চিন্তা-ভাবনা দেখে অনেকে তোমাকে ব্যঙ্গ করে বলবে পাগল। এমন দুর্গম পথে চলতে গিয়ে তুমি কখনো কখনো তীব্র সমালোচনা বা বিরোধিতার মুখে পড়বে। তোমাকে অযৌক্তিক মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করবে। এতে তোমার বিচলিত হবার কোন কারণ নাই। মনে রাখবে, যারা এ ধরনের চিন্তা-ভাবনায় মগ্ন ছিল, সম-সাময়িক সবাই তাদেরকে এভাবে অভিহিত করেছে। তবুও তারা তাদের সংকল্প হতে ন্যূনতম বিচ্যুত হননি। কলম্বাস শত বিরোধিতার মুখেও তার অভিযান ত্যাগ করেনি। এডমন্ড হিলারী, তেনজিংশেরপা মৃত্যুকে তুচ্ছ করে এগিয়ে গেছে। অরভিল রাইট ও উইলবার রাইটের পাখির পিছনে দৌড়া-দৌড়ি দেখে অনেকে অনেক মন্তব্য করেছে কিন্তু তারা সফল। পৃথিকৃৎ মানুষেরা যদি সমালোচনা শুনে তাদের পথ হতে সরে যেত, পৃথিবীতে সৃজনশীলতা বলে কিছুই থাকত না।

তারকা ছোঁয়া যায় না ভাবে, এ জগতের বেকুব জন,

জ্ঞানী লোকে তারকা ছুঁতে, দেয় যে সঁপে তারি মন।

এ পৃথিকৃৎ মানুষদের লক্ষ করে জজ বার্নার্ড শ’ বলেছে, অষষ ৎবধংড়হধনষব সধহ ধফধঢ়ঃযবসংবষাবংঃড়ঃযব ড়িৎষফ. ঙহষু ধ ভবuঁহৎবধংড়হধনষব ড়হবং ঢ়বৎংরংঃ রহঃৎুরহমঃড় ধফধঢ়ঃযব ড়িৎষফঃড় ঃযবসংবষাবং. অষষ ঢ়ৎড়মৎবংং রহঃযব ড়িৎষফ ফবঢ়বহফং ড়হঃযড়ংবঁহৎবধংড়হধনষব সবহ ধহফঃযবরৎ রহহড়াধঃরাব ধহফ হড়হ-পড়হভড়ৎসরংঃ ধপঃরড়হ. এরকম একজন মানুষ ছিল আব্রাহাম লিঙ্কন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তার বয়স যখন আট বৎসর তার বাবা তাকে হোয়াইট হাউস দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। তাকে হোয়াইট হাউজ দেখানোর পর জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি কি জান এ বাড়ির মালিক কে?’

‘আমি।’ জবাব দিয়েছিল আব্রাহাম লিঙ্কন।

‘কিভাবে?’ তার বাবা জিজ্ঞাসা করেছিল।

জবাবে সে বলেছিল, ‘আমি একদিন এর মালিক হব।’

একবার সে স্থানীয় মন্দিরে গিয়েছিল। একজন পাদ্রী বেহেশত এবং দোযখ সম্পর্কে আলোচনা শেষে জিজ্ঞাসা করেছিল, কারা বেহেশতে যেতে চাও? আব্রাহাম লিঙ্কন ছাড়া সবাই হাত উত্তোলন করেছিল। পাদ্রী তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি কোথায় যেতে চাও?’

‘আমি হোয়াইট হাউজে যেতে চাই।’ আব্রাহাম লিঙ্কন জবাব দিয়েছিল।

জীবনে যারা বড় হয়েছে, ছোট কাল হতে তারা বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখেছে। সংকল্প বা স্বপ্ন না দেখে কেউ আচমকা হিমালয় জয় করতে পারবে না। হিমালয় জয় করতে প্রয়োজন স্বপ্ন দেখা, পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম ও ঝুঁকি গ্রহণ। তোমাকে বুঝতে হবে উচ্চ আসন গ্রহণের পথটা মসৃণ কোন পথ নয়। এর জন্য প্রয়োজন-

স্বপ্ন

সংকল্প

পরিশ্রম

ঝুঁকিগ্রহণ

সময়ের সদ্বব্যবহার

স্বপ্নই আমাদের গন্তব্য স্থল নির্ধারণ করে। যে পুকুর পাড়ি দেবার স্বপ্ন দেখে, সে মহাসাগর পাড়ি দিতে পারবে না। যে মহাসাগর পাড়ি দেবার স্বপ্ন দেখে, সে পুকুরের গুরুত্ব অস্বীকার করে না। সে জানে এক হাজার মাইলের পদযাত্রা এক কদম দিয়ে শুরু হয়।

তারা যখন তাদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে খোশগল্পে মত্ত, এ সময় এসে হাজির হয় মিনা। মিনাকে দেখে দাদু জানতে চাইল, তুমি তোমার জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ?

মিনা জানাল, ‘আমি লেখক হবার সিন্ধান্ত নিয়েছি।’

তুমি কিভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছ যে, ‘তুমি লেখক হবে?’

‘দাদু, আনাফ্রাংকের ডায়েরী পড়ে আমি দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। সে ছোটকাল হতে স্বপ্ন দেখতো বড় লেখিকা হবার। সে জন্য সে কাজও শুরু করে দিয়েছিল। দুর্ভাগ্য যে, তাকে তের বৎসর বয়সে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। এত অল্প বয়সেও সে পৃথিবীতে বড় অবদান রেখে গেছে।’

‘যারা বড় স্বপ্ন দেখে তাদের ক্ষেত্রে এরূপ ঘটে। তারা সময়ের গুরুত্ব বুঝে। খুব দ্রুত কাজ শুরু করে দেয়।’

‘তবে তুমি যদি সত্যিই লেখক হতে চাও, লেখক হবার নিয়ম কানুন তোমাকে জানতে হবে। তুমি সে নিয়মাবলী কি জান?’ জানতে চাইল দাদু।

‘লেখক হবার জন্য নিয়মাবলী আছে নাকি?’ পাল্টা প্রশ্ন করল মীনা।

‘হ্যাঁ, লেখক হতে গেলে অনেক নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে।’

‘সে নিয়ম কানুন গুলো কি কি?’ জানতে চাইল মিনহাজ।

প্রথমতঃ যে জিনিসটি তোমার দরকার তা হলো, তোমাকে কাজটা করতে হবে বিবেকের দায়ে। লেখা হলো সমাজকে ফুটিয়ে তোলার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। যারা দায়বদ্ধতা হতে লিখে, আর যারা পেশা হিসেবে লেখে, তাদের দু’জনের চিন্তাধারা এক নয়। ইবনে তাইমিয়াকে যখন কারাগারে লেখার উপকরণাদি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন তিনি কয়লা দিয়ে দেয়ালে লিখেছিলেন। কারণ, তিনি বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। এটা নিরবিচ্ছিন্ন সাধনার ব্যাপার। কেউ যদি হুট করে দু’একটা ভাল লেখার জন্য বাহবা পেয়ে ভাবে, আমি এখন অনেক উচ্চস্তরের লেখকদের একজন, সে অনিবার্য পতন দেখবে শীঘ্রই। যে সবার তৃপ্তির জন্য সাহিত্য রচনা করবে, সে সাহিত্যিক হতে পারবে না। সাহিত্য হলো নিজের ভাবনাকে যথাযথ ভাবে প্রকাশ করা। সবার জন্য তুমি লিখবে কেন? সবাই তোমার লেখা পড়বে কেন? পড়লে পড়ুক, না পড়লে না পড়ুক, সত্য কথাই লিখবে। এভাবে এর প্রতি যদি দায়বদ্ধতা না থাকে, তবে সে সাহিত্যের অপমৃত্যু অনিবার্য। এজন্য দেখা যায়, জাত লেখকরা বরাবরই অসহায়। তাদের টাকা থাকে না, খুঁটির জোর থাকে না। তারা কারো দয়া দাক্ষিন্যও পায় না। তবুও তারা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে যায়। শেষ পর্যন্ত তারা বিজয়ী হয়।

‘সাহিত্যের মূল উপদান কি হবে?’ জানতে চাইল মিনা। সে গভীর মনোযোগ দিয়ে দাদার কথা শুনছে।

মিনার এ আগ্রহের দিকে তাকিয়ে দাদা বলল, তোমার আগ্রহ দেখে আমি নিশ্চিত তুমি পারবে। তোমার প্রশ্নের জবাব দিতেও আমার ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। সাহিত্যের প্রধান এবং একমাত্র উপকরণ হচ্ছে মানুষ। মানুষকে বাদ দিয়ে সাহিত্য হয় না। হওয়ার প্রশ্ন আসে না। যে লেখক মানুষকে পাঠ করতে পারবে না, তার লেখক হবার যোগ্যতা নাই। আর মানুষকে জানতে হলে মানুষের সাথে মিশতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে আসা এবং মানুষের সাথে মিশবার যোগ্যতা সম্পূর্ণ আলাদা জগত। যে যত বেশী মানুষের সাথে মিশতে পারবে, মানুষকে পাঠ করতে পারবে, সে তত বেশী সফল হবে। পুস্তক হতে আহরিত জ্ঞান ও সমাজ হতে লব্ধ জ্ঞান সম্পূর্ণ আলাদা। লেখক হতে হলে সমাজের নাড়ির স্পন্দন শুনতে হবে। সমাজকে জানলে সাহিত্যে সমাজের প্রকৃত ছবি তুলে ধরা যায়। সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন হওয়া সাহিত্যের জন্য চরম ক্ষতির কারণ। সফল লেখক হতে হলে মানুষ সম্পর্কে আগ্রহ থাকতে হবে। মানুষের সাথে মেলামেশা করা সোনার খোঁজে গর্ত করার মত। যদি কেউ এক তোলা সোনা পেতে চায়, তাকে টন টন মাটি অপসারণ করতে হয়। কেউ যখন এ খনন কার্য চালিয়ে যায়, সে ময়লা আবর্জনা খুঁজছে না, সে সোনার খোঁজ করছে। তুমি মানুষের সাথে মেলামেশা করবে সাহিত্যের সোনার খোঁজে, আবর্জনার জন্য নয়। সোনা প্রকৃতিতে এভাবে পাওয়া যায় না, এটা তৈরি করতে হয়। সাহিত্য নামক সোনা খুঁজতে গেলে এসব মনে রাখতে হবে।

‘প্রকৃত লেখকের পরিচয় কি?’ জানতে চাইল মিনহাজ।

প্রকৃত লেখকের পরিচয় হলো, তার মধ্যে নিজস্বতা থাকতে হবে। প্রকৃত লেখা কখনো উদ্ধৃতির সংকলন হবে না। যা উদ্ধৃতির সংকলন, তাহা পান্ডিত্য চর্চা ছাড়া আর কিছু না। সাহিত্য চর্চা ও পান্ডিত্য চর্চা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। যারা পান্ডিত্য চর্চা করে তাদের লেখার মধ্যে নিজস্বতা পাওয়া যায় না। যিনি অন্যের অনুকরণ করে কিছু লিখতে চায়, তার দ্বারা সাহিত্যের সেবা করা সম্ভব না। যতীন্দ্র মোহন বাগচী যথেষ্ট প্রতিভাধর একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সবসময় রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করতে গিয়ে নিজের প্রতিভাকে বিকশিত হবার সুযোগ দেননি।

দাদুর কথা শুনতে শুনতে বাইরের দিকে তাকালো মিনহাজ। দেখল শাহীন দূর হতে তাকে ইশারা করে বাইরে আসতে বলছে। শাহীনকে দেখার পর হতে উশখুশ করতে লাগল মিনহাজ। এদিকে দাদু লেখকের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে।

মিনা প্রশ্ন করলো, ‘দাদু সাহিত্য সম্পর্কে আপনি এত বিষয় জানলেন কোথায়?’

জানব না কেন? আমি সাহিত্যের একান্ত ভক্ত। সাহিত্য নিয়ে আমি ব্যাপক অধ্যয়ন করেছি। জবাব দিতে দিতে দাদু কিছুক্ষণ নিরবে মিনহাজের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মিনহাজ ছটফট করে যাচ্ছে। পালিয়ে যাবার জন্য পথ খুঁজছে।

‘মিনহাজ, তুমি এমন করছ কেন?’ দাদু জানতে চাইল।

‘দাদু, আমার কিছু কাজ আছে। আমাকে যেতে হবে।’ বলল মিনহাজ।

‘আচ্ছা, তোমার যদি বাইরে কাজ থাকে, যাও।’

মিনহাজ ওঠে গিয়ে শাহীনের সাথে সাক্ষাৎ করল।

শাহীন তাকে জানাল, ‘দুঃসংবাদ আছে। আমাদের সব সাধনা শেষ হয়ে গেছে।’

‘কি হয়েছে?’ জানতে চাইল মিনহাজ।

‘চল, গেলেই বুঝবি।’

তারা ছুটল উল্লুক ভিটার দিকে।

 

 

 

 

 

অনেকে জড়ো হয়েছে এখানে। গভীর আগ্রহ নিয়ে গর্তটা দেখছে। বিশাল গর্ত। প্রায় পাঁচ ফুট গভীর। গর্তের আশেপাশে মাটি ফেলা হয়নি। মাটি গুলো আরো দশ হাত দূরে নিয়ে ফেলা হয়েছে। সকাল হতে সবাই আসছে সে গর্ত দেখার জন্য। পুরো পাড়ায় এটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। কে এই গর্ত খুঁড়ছে?

আলমের বাবা ক্ষুব্ধ। তার ক্ষেতের বিশাল অংশ নষ্ট করে ফেলেছে এ গর্ত খননকারীরা। সকালে এসে এটা দেখার পর হতে সে একনাগাড়ে গালি দিয়ে যাচ্ছে সবাইকে। অভিশাপ দিয়ে তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠিকে ধ্বংস করছে। মিনহাজ যখন গর্তটা দেখল, দুরু দুরু করে কেঁপে উঠল তার বুক। গর্তটা তার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিল মুহূর্তের মধ্যে। বুকের মধ্যে চলতে থাকা সে যন্ত্রণা-তরঙ্গ বিস্ফোরিত হয়ে দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে চাইলেও নিজেকে সম্বরণ করল সে।

নিজের দুঃখ পাথর-চাপা দিয়ে সে আলমের বাবার দুঃখে শরীক হল। আলমের বাবাকে পরামর্শ দিল সম্ভাব্য সব স্থানে অভিযান চালিয়ে গর্ত খননকারীদের খুঁজে বের করার জন্য। এ নিয়ে দু’দিন যাবত অনেক গুপ্ত অভিযান পরিচালনা করল তার ‘‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার কমিটি।’ কোন ক্লু তারা খুঁজে পায়নি। দুদিন পর দেখা গেল গর্তটা আরো অনেক বড় ও গভীর হয়ে গেছে। বুকে সাহস পেল মিনহাজ। হয়ত তারা এখানো কোন কিছু খুঁজে পায়নি। আলমের বাবা একজন শ্রমিক এনে গর্তটা ভরাট করে দিল। জরুরী বৈঠকে বসে ‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার কমিটি’ সিদ্ধান্ত নিল তারা আবার বান্দরবান যাবে। তান্ত্রিকের সাথে দেখা করে দ্রুত গুপ্তধন উদ্ধার করবে। আর এক মুহূর্তও বিলম্ব করা যাবে না। যদিও তারা তাতুমের কাছে স্বপ্ন নিয়ে যাচ্ছে, তাদের আশা-নিরাশার পেন্ডুলাম সমানভাবে দোল খাচ্ছে।

স্কুল হতে এসে বাইরে যাচ্ছিল মিনহাজ। উদ্দেশ্য খেলাধুলা। চৌকাঠের বাইরে পা রাখতেই ডাক দিল মফিজুর রহমান। মিনহাজ চল, স্কুলে যাই।

শোনামাত্র বুক ধড়ফড় করে ওঠে মিনহাজের। প্রথমে যেতে অস্বীকার করে সে। দাদা, আমি মাত্র স্কুল হতে আসলাম, আবার যাব?

‘হ্যাঁ, তোমাকে যেতেই হবে। প্রধান শিক্ষকের নির্দেশ।’ বলল মফিজুর রহমান।

‘না, আমি যাবো না। আপনি যান।’ জবাব দিল মিনহাজ।

ততক্ষণে ওখানে এসে হাজির হয়েছে মালেকা। দাদার সাথে ছেলের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখে ক্ষেপে যায় মালেকা। মায়ের অবস্থা দেখে শেষ পর্যস্ত স্কুলে যেতে বাধ্য হল মিনহাজ। প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢোকা মাত্র তিনি প্রথমে মিনহাজকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মিনহাজ, আজকে স্কুলে আসনি কেন?’

শুনে হতবিহবল মফিজুর রহমান। অনেকক্ষণ মিনহাজের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ‘ও তো স্কুলে আসার জন্য বের হয়েছিল, স্যার।’ পরে মিনহাজকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে মিনহাজ?’

‘আপনি বসুন।’ প্রধান শিক্ষক মফিজুর রহমানকে অনুরোধ করলেন।

চেয়ার টেনে বসতে বসতে মফিজুর রহমান প্রধান শিক্ষককে লক্ষ করে বললেন, ‘আমার নাতি অতি শীঘ্রই কোটি টাকার মালিক হয়ে যাবে।’

শুনে হাসলেন প্রধান শিক্ষক। ‘কিভাবে?’

ইদানিং গুপ্ত ধনের সন্ধানে নেমেছে আমার নাতি। ওর নেতৃত্বে কমিটিও গঠিত হয়েছে। কমিটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার।’

আরেক বার হাসলেন প্রধান শিক্ষক। এবার রূদ্রমূর্তি ধারণ করে বললেন, ‘মিনহাজ বল, আজকে স্কুলে না এসে কোথায় গিয়েছিলে?’

স্যারের রুদ্রমূর্তি দেখে ভয় পেয়ে গেল মিনহাজ।

প্রধান শিক্ষক এবার বললেন, ‘আমি জানি তুমি কোথায় গিয়েছিলে। কিন্তু তোমার নিকট শুনতে চাই।’

মিনহাজ স্বীকার করল, সে স্কুল ফাঁকি দিয়ে পাহাড়ে গিয়েছিল। ওখানে একজন তান্ত্রিক আছে, তার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য।

‘তান্ত্রিক কি কি করেছিল, কি কি বলেছিল সব বল।’

স্যারের নির্দেশ শুনে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায় মিনহাজ। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে।

‘ঠিক আছে, গুপ্ত ধন কখন হাতে পাচ্ছ, তাই বল?’

‘স্যার, আমরা তাকে বলেছিলাম রাতে কাজ করতে হবে, সে রাতে কাজ করতে রাজি নয়, সে জন্য আমাদের সাথে তার বনিবনা হয়নি।

‘শুন মিনহাজ, আমি যদি তোমাকে গুপ্ত ধনের সন্ধান প্রদান করি, তুমি কি তা খুঁজে বের করতে পারবে?’

‘মিনহাজ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।’

‘বল, পারবে কি না? না হলে আমি অন্য কাউকে তা বাতলে দেব।’ প্রধান শিক্ষক বললেন।

‘আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব।’ জবাব দিল মিনহাজ।

এ গুপ্তধন পেতে হলে তোমাকে দুটি বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে। এর আগে আমি তোমাকে এক আলৌকিক চোরের কাহিনী বলব, তোমাকে বলতে হবে ঐ চোরটা কে?

একটা গ্রাম। সবকিছু তাদের ঠিক মতো চলছিল। একদিন গ্রামে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। সেখানে এসেছিল এক বৃদ্ধ লোক। তিনি গ্রামবাসীদের ডেকে বললেন, হে মানুষ, তোমরা কি বোকা! তোমাদের বোকামী দেখে আমি সত্যিই আশ্চর্য্যান্বিত। তোমাদের বাড়িতে প্রতিনিয়ত চুরি হচ্ছে, অথচ তোমরা জান না। বিজ্ঞ লোকটি খাতা কলম বের করে হিসাব কষলেন। সবাই দেখল বিজ্ঞ ব্যক্তিটি ঠিক কথাই বলেছে। তারা সজাগ হয়ে গেল। যে করে হোক এই চোরকে পাকড়াও করতে হবে। পুরো গ্রাম জুড়ে পাহারা বসানো হল। কিছু দিন পর বিজ্ঞ লোকটি আবার আসলো। এবার গ্রামের সবার মুখে তৃপ্তির হাসি। ঐ লোকটি এবার তাদেরকে উপহাস করতে পারবে না। বিজ্ঞ লোকটি খাতা কলম নিয়ে হিসাব করে দেখালেন, চোর ঠিকই সব চুরি করে নিয়ে গেছে। গ্রামবাসীরা প্রার্থনা করলেন হে মহান অতিথি আপনি বলুন, এ ভয়ঙ্কর চোরকে কিভাবে পাকড়াও করা যাবে।

শুনে বৃদ্ধ বললেন, খুবই সহজ কাজ। ঐ চোরের সাথে পাল্লা দিয়ে চল। তবে, তোমাদের ক্ষতি কমে যাবে। জীবনও সুন্দর হবে। বলতো ঐ চোরটা কে?

মিনহাজ বলতে পারল না, ঐ চোরটা কে? প্রধান শিক্ষক তাকে দুদিন সময় দিল। কড়া নির্দেশ দিয়ে বলল, যদি এখন হতে একদিনও স্কুল ফাঁকি দাও, তবে তোমার দেহের চামড়া আর থাকবে না।

দাদু স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল।

রিশাদকে পাওয়া যাচ্ছে না। দুপুরে সে ভাত খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। এখন রাত আটটা। সবখানে খোঁজা হয়েছে। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে সবখানে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছে। রফিকের খোঁজে অনেকে দৌড়ে গিয়ে জানতে পারল, সে তার এক আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে গেছে। রিশাদের মায়ের রিশাদ, রিশাদ আর্তনাদ পুরো বাড়ি প্রকম্পিত করে তুলছে। অনেকে টর্চ মেরে গাছের শাখায় শাখায় তাকে খুঁজতে লাগল। কেউ কেউ পুকুরে নেমে গেল জাল হাতে। এদিক ওদিক খেপ মেরে দেখছে, যদি মৃত পাওয়া যায়। ভয়ে সবাই অস্থির। তবে কি রিশাদকে শেষ পর্যন্ত জীন পরী তুলে নিয়ে গেছে? নাকি ছেলেধরা নিয়ে গেছে? বাড়ির প্রতিটি আনাচে কানাচে খুঁজেও যখন তাকে পাওয়া গেল না, কয়েকজন টর্চ হাতে উল্লুক ভিটায় চলে আসল। টর্চের আলো জ্বেলে জ্বেলে যখন তারা আসতে লাগল, দেখা গেল কারা যেন পালিয়ে যাচ্ছে। তারা আরও কাছে এসে দেখতে পেল, রিশাদ মাটির উপর শুয়ে আছে। তার হাত পা, চোখ-মুখ শক্ত করে বাঁধা। রিশাদের সব বন্ধন খুলে দেওয়া হল। উঠে দাঁড়াল সে।

মফিজুর রহমান জানতে চাইল, ‘রিশাদ, কারা তোমাকে এভাবে বেঁধে রেখেছে?’

রিশাদ বলল, ‘আমি বলব না। বললে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’

সবাই বলল, বল রিশাদ, তোমার আর ভয় নেই। ওরা পালিয়ে গেছে।

রিশাদ চিৎকার করে বলল, না আমি বলব না। তোমাদের মধ্যে তারা মিশে আছে। ঐ তো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে।

কেউ কিছু দেখতে পেল না।

 

 

 

 

 

আলমের বাবার মন খারাপ। অনেক টাকা ব্যয় করে সে বিভিন্ন ফসলের বীজ লাগিয়েছিল উল্লুক ভিটায়। ক্ষেতের কিছু অংশ গুপ্তধন অন্বেষণকারীদের দ্বারা নষ্ট হয়েছিল। চূড়ান্ত ফলাফলে বলা যায়, ভাল ফসল হয়নি। সব শ্রম ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় হা হুতাশ করছিল আলমের বাবা। এমন বাজে ফলাফলের জন্য সে দোষারোপ করছিল গুপ্তধন অমেবষণকারীদেরকে। ঐ পথ দিয়ে বাজারে যাবার সময় তার অবস্থা দেখে থমকে দাঁড়াল মফিজুর রহমান।

‘তোমার এ অবস্থা কেন?’ মুফিজুর রহমান আলমের বাবাকে প্রশ্ন করল।

‘এ অভিশপ্ত ভিটা আমার সর্বনাশ করল। এত কষ্ট করে ফসল লাগালাম, কোন লাভ হলো না।’

কি কষ্ট করেছ? আমি দেখলাম রেডিমেড জমিতে তুমি হঠাৎ ফসল লাগানোর সিদ্ধামত্ম নিয়েছ। শেষ পর্যন্ত তাই করেছ। এভাবে কি সফলতা পাওয়া যায়? সাফল্য দৈবক্রমে পাওয়া যায় না। সফলতা বিরামহীন ও পরিকল্পিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আসে। যে সফলতা না পেয়ে তুমি হা হুতাশ করছ, তা তোমার ইচ্ছার তালিকায়ও ছিল না। মানুষ যা সহজে পায়, তা সহজে হারায়। তুমি যদি এখানে পরিকল্পিত ভাবে কিছু করতে, নিশ্চয় কোন একটা ফল পেতে। এখন তুমি নিজেও জান না, কেন তুমি ব্যর্থ হয়েছ?

‘চাচা, যারা গুপ্তধনের জন্য এখানে চষে বেড়িয়েছে, তারা আমার সর্বনাশ করেছে।’ বলল আলমের বাবা।

‘তোমার কথার সাথে আমি একমত হতে পারলাম না আলমের বাপ। ওরা তোমার ক্ষতি করতে যাবে কেন? ওরা তোমার চোখ খুলে দিয়েছে। তাদের বদৌলতে তুমি পরিত্যক্ত ভিটায় চাষাবাদের সিদ্ধামত্ম নিয়েছ। স্কুলে পাস করতে হলে যেমন লেখাপড়া জানতে হয়, তদ্রূপ কৃষিতে সফল হতে হলে, কৃষির জ্ঞান থাকতে হয়। এ জ্ঞান নাই বলেই তুমি ব্যর্থ হয়েছ। তুমি আগামী বৎসরের জন্য ভাল করে প্রস্ত্ততি নাও, দেখবে মাটি হতে গুপ্ত ধন বের হয়ে তোমাকে ধরা দিচ্ছে।

‘কি যে বলেন চাচা, আমি গুপ্তধন খুঁজছি না।’

‘তুমি বুঝছ না যে, তুমি গুপ্তধন খুঁজছ।’

‘কিভাবে?’

উত্তর খুব সহজ। তুমি তো চাও ভাল ফলস হোক। এই যে ফসল তা মাটিতে লুকায়িত। যে সম্পদ লুকায়িত তাই গুপ্তধন। তুমি পরিকল্পিতভাবে কাজ কর, প্রকৃত গুপ্তধন তোমার পদ চুম্বন করবে। আলমের বাবাকে উপদেশ দিয়ে বাজারের দিকে পা বাড়াল মফিজুর রহমান।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বান্দরবান গেল মিনহাজ, শাহীন ও আশরাফ। এবার তাদেরকে চূড়ামত্ম অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তারা প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করেছে। কোন শক্তি এবার তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তারা আদনানের বাড়ি পৌঁছে জানতে পারল, আদনান বাড়িতে নাই। সে স্কুলের জুন খেলায় অংশ নেবার জন্য অনুশীলনে গেছে। আদনানের মা মেহমানদেরকে বসতে দিয়ে নাসত্মা তৈরি করতে চলে গেলেন। শাহীনও তার পিছনে পিছনে রান্নাঘরে গিয়ে বসল।

‘খালাম্মা, আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। আমাদের হাতে অনেক কাজ।’ শাহীন বলল।

‘তোমরা আমার মেহমান, করতে হবে না বললেই হলো। তোমার মা কেমন আছে?’

‘ভাল।’

গতবারও তোমরা তিনজন এসেছিলে এবারও সে তিনজনই এলে। কারণটা কি?

শাহীন কিছুক্ষণ ইতসত্মত করার পর বলল, ‘একটা কাজ আছে খালাম্মা।’

‘কি এমন কাজ যে বার বার আসতে হচ্ছে, বল? আমি তোমাদের সাহায্য করব।’

শাহীন সব খুলে বলল।

‘বেকুব কোথাকার, কে বলেছে তোমাদের ঐ গুপ্তধন খুঁজতে। তোমাদের এখনও টাকার পিছনে দৌড়ার বয়স হয়নি। তোমাদের এখন লেখা পড়া শেখার বয়স। এ ভাবে আত্মহত্যা করার কোন অর্থ আছে?’ চেঁচিয়ে উঠল শাহীনের খালাম্মা।

‘আত্মহত্যা! আমরা আত্মহত্যা করছি? কি বলছ খালাম্মা? তুমিও দাদুর সুরে কথা বলছ।’

‘তোমরা যা শুরু করেছ তা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই না।’ আদনান গতবার আমাকে তোমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছিল। আমি কিছু বলিনি, তোমরা খারাপ মনে করবে সেজন্য। আমি ওদেরকে কিছু বলব না। তোমাকে বলতে চাই, তোমার উচিত প্রকৃত গুপ্তধন খুঁজে নেওয়া। এভাবে নকল গুপ্তধনের পিছনে দৌড়ে কোন লাভ নেই। সময় খুব মূল্যবান বস্ত্ত, তা এভাবে নষ্ট করার কোন অর্থ হয় না। সময়ের কাজ সময়ে না করলে, পরে পসত্মাতে হয়। তোমার এ সময়টা হলো লেখাপড়ার সময়, সম্পদ খোঁজার সময় নয়। বাল্যকালে লেখাপড়া করাটা হলো সময়ের ফোঁড়। এখন যদি লেখাপড়ায় এক ফোঁড় দাও, তবে ভবিষ্যতে তোমার দশ ফোঁড় রক্ষা হবে। যে সময়টা এখন চলে যাচ্ছে, এই সময়টা কি জীবনে আর কখনো ফিরে আসবে? হাজার প্রার্থনা করলেও প্রভু এটা আর ফিরিয়ে দেবে না। এই প্রার্থনা আল্লাহ্ জীবনেও কবুল করবে না। যে একটা সেকেন্ড চলে যাচ্ছে, এটা এমন সম্ভাবনাময় একটা সময়, তুমি যদি এই সময়টাকে কাজে লাগাও, তুমি অবশ্যই প্রকৃত গুপ্তধন হাতে পাবে। আর যদি তুমি এটাকে কাজে না লাগাও, সময় তোমার উপর প্রতিশোধ নেবে।’

‘সময় কিভাবে প্রতিশোধ নেবে?’ জানতে চাইল শাহীন।

সময়ের প্রতিশোধ খুব মারাত্মক। সে কাউকে ছাড়ে না। যারা কাজ করে না, কুঁড়ে স্বভাবের কারণে সময় নষ্ট করে, তারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এটা হলো সময়ের প্রতিশোধ। প্রত্যেক কাজ ঠিক সময় করতে হবে। বর্ষাকালে শীত কালীন ফসল লাগালে হবে না। শীতকালে বর্ষাকালিন ফসল হবে না। ছাত্র জীবন লেখাপড়ার শ্রেষ্ঠ সময়। যারা এই সময় লেখাপড়া শিখবে না, তাদের জন্য অনেক দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। তোমাকে একটি কবিতা বলি তোমার খালাত ভাই আদনান লিখেছে তার খাতায়। সে টেবিল হাতড়ে একটা খাতা বের করে তা হতে কবিতাটি শাহীনকে শুনাল।

মনে রেখ, আজকের দিবস

এ শুধু জীবন নয়, গৌরবময় মহাদিন।

তাবৎ পৃথিবী বিক্রি করেও শোধ করা যাবে না

এর এক বিন্দু ঋণ।

এর মধ্যে নিহিত আছে বেঁচে থাকার সত্যতা।

পৃথিবীর তাবৎ বাসত্মবতা

বেড়ে উঠার আনন্দ, কর্মের চমৎকারিতব , শক্তির সব গৌরব গাথা।

গতকালটা স্মৃতির ঝরাপাতা,

আগামীকাল মোহাচ্ছন্ন স্বপ্ন, সত্য শুধু আজ।

কর্মময় আজ, গতকালকে বানায় নান্দনিক,

আগামীকালের মাথায় পরায় তাজ।

আজই সত্য, একশত ভাগ সত্য,

আগামীকাল এক চরম মিথ্যা মায়া।

চাই এ দিবসের সদ্বব্যবহার,

এ দিবসে যাতে না থাকে আগামীকালের ছায়া।

সময় যে ভাবে চলে যাক না কেন, আমরা তা আর জীবনেও ফেরত পাব না। সময় যদি নষ্ট কর, জীবনে দুযোর্গ নেমে আসবে। তোমার সব সম্ভাবনাকে ধুলিস্যাৎ করে দেবে। সময় হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্ত্ত। তুমি কেন সে সম্পদ পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেবে? ভুলের রাজ্যে বসবাস করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তুমি ভুল পথ হতে সরে যাও। মূর্খদের সাথে আড্ডা দিলে, তারা তোমাকেও মূর্খ বানিয়ে ছাড়বে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, তোমরা যার কাছে যাওয়ার জন্য এসেছ, সে বিভিন্নভাবে প্রতারণার ফাঁদ পেতে মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করে। এখন কি করবে তুমি বল?’ কথা শেষ করে আদনানের মা নাসত্মা নিয়ে এসে বারান্দায় পরিবেশন করল। সবাই যখন নাসত্মা খাচ্ছিল, এ সময় আদনান এসে হাজির। আদনানকে দেখে তারা দারুণ উৎফুল্ল হয়ে উঠে। আদনান তাদেরকে দেখেও না দেখার ভান করে মধ্য কক্ষে চলে গেল। আদনানের এ আচরণ দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে গেল।

আদনানের মা ডাক দিল, ‘আদনান, তোর খালাত ভাই এসেছে। এ দিকে আয়।’

‘না, মা আমার ভাল লাগছে না।’ ভিতর হতে জবাব দিল আদনান।

মা অনেক অনুরোধ করলেও আদনান তাদের সামনে আসেনি। এক সাথে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।

মিনহাজরা চলে আসতে চাইলে আরো একদিন থাকার অনুরোধ করল আদনানের মা। তারা রাজি হয় নি। খালাম্মা শাহীনকে ভিতরে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমরা কি আবার তাতুমের কাছে যাবে নাকি?’

‘না খালাম্মা, সোজা বাড়ি চলে যাব। তোমার কথা শোনার পর আমি সব বুঝতে পেরেছি।’

সেখান হতে বের হয়ে তারা ঠিকই পাহাড়ের পথ ধরল। চিনতে কষ্ট হলেও ঠিকই তাতুমের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হল তারা। বাড়ির বারান্দায় ঘণ্টা খানেক বসল। তাতুমের কোন সাড়া শব্দ নাই। তার সহকারী মালেককেও দেখা যাচ্ছে না। ভিতর হতে মাঝে মধ্যে কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।

‘ব্যাপারটা কি?’ প্রশ্ন করল মীনহাজ।

‘আমিও তো কিছু বুঝছি না।’ জবাব দিল আশরাফ।

তারা আরো ঘণ্টাখানেক সেখানে বসে বসে অতিবাহিত করার পর তাতুম বেরিয়ে এসে তাদের পরিচয় জানতে চাইল। এতে তারা আরো আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল।

প্রথমে পরিচয় দেবার পরও তাদেরকে চিনতে পারল না তাতুম। শেষে জানতে চাইল কি উদ্দেশ্যে তাদের আগমন। তারা তখন তাদের এলাকার গুপ্তধন, গতবারের এখানে আগমন, গর্ত খনন সব খুলে বলল। তাতুম তাদেরকে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কি জান গুপ্তধন কি?

মিনহাজ বলল, ‘যে ধন গুপ্ত বা লুকায়িত আছে, তাই গুপ্তধন।’

শুনে হেসে দিল তাতুম। বলল, ‘তোমাদের ব্যাখ্যাটা সঠিক, কিন্তু তোমাদের চেষ্টা-প্রচেষ্টা ভুল। আমি কি তোমাকে প্রকৃত গুপ্তধনের সন্ধান দেব?’

‘দিন।’ বলল আশরাফ।

একটা মানুষ যখন পৃথিবীতে আগমন করে, পৃথিবীর ছোঁয়া লাগামাত্র তীব্র চিৎকারে কেঁদে ওঠে সে। তখন তার চরম অসহায় অবস্থা। মাতৃস্নেহের ছায়ায় ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে শিশুটি। ধীরে ধীরে সে উপুড়, হামগুড়ি, সর্বশেষ হাঁটতে শিখে। তারপর সে দৌঁড়তে, খেলতে শিখতে শিখতে এক সময় লেখা পড়ার উপযোগী হয়ে উঠে। বাবা-মা তাকে স্কুলে পাঠায়। ধীরে ধীরে সে আরো বেড়ে উঠতে থাকে। বাবা মা সবকিছু উজাড় করে দেয় তার জন্যে। মাতা-পিতার এসব প্রচেষ্টা, এ চাওয়ার অর্থ কি তোমাদের জানা আছে?

‘তারা চায় যে, আমরা শিক্ষিত হই।’ জবাব দিল মিনহাজ।

‘তোমরা শিক্ষিত হলে তাদের লাভ কি? তোমাদের লাভ কি? তোমরা শিক্ষিত হচ্ছ মানে, তোমরা নিজেদেরকে চিনতে পারছ। তোমাদের মধ্যে যে অফুরমত্ম সম্ভাবনা আছে, তা বিকশিত হচ্ছে। এ সম্পদটাই হচ্ছে তোমাদের গুপ্তধন। তোমরা যে সম্পদের পেছনে দৌড়ছ, তা এক মিথ্যা মায়া। এর মাধ্যমে তোমাদের সময় ক্ষয় হচ্ছে। তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছ। তোমাদের উচিত প্রকৃত গুপ্তধন বের করে নেওয়া। তোমরা জাতির ভবিষ্যৎ। তোমরা যদি নিজেরা অন্ধকারে হাবুডুব খাও, জাতিকে পথ দেখাবে কিভাবে? মরিচিকার পেছনে দৌড়ে কোন লাভ নেই। এতে সময়ের অপচয় হবে, কিন্তু চূড়ামত্ম ফলাফল হবে শূন্য।

‘আমাদের হাতের কাছে যা আছে, তা আমরা হারাতে চাই না। এটা পাওয়া মাত্র আমরা আমাদের অভিযান গুটিয়ে ফেলব।’ শাহীন বলল।

শোন, তোমার হাতের কাছে যা আছে, তা হল সময়। তুমি সময়ের সদ্বব্যবহার কর, এতে জাতি উপকৃত হবে। একটা দিন অপচয় করাতে শুধু তোমার ক্ষতি নয়। তোমার নিজের দিন কর্মবিহীন যাওয়াতে তোমার যেমন ক্ষতি হল, তেমনি জাতি তোমার নিকট হতে ঐ দিন কিছু পেল না। জীবনে এমন একটা দিন অতিবাহিত করলে, যা খুব খারাপ। তুমি গুপ্তধন পাওয়া হতে একদিন পিছিয়ে গেলে। তোমাদের মধ্যে যে সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে তা কোটি টাকার গুপ্তধন। তোমরা কেন সে মহামূল্যবান গুপ্তধনকে অস্বীকার করে তথাকথিত গুপ্তধনের পিছনে দৌড়াচ্ছ?

তারা নিরাশ হয়ে তাতুমের বাড়ি হতে ফিরে আসতে লাগল। তারা যখন পাহাড় ছেড়ে বাস স্টেশনে পৌছে দেখে, আদনান কার সাথে কথা বলছে। তাদেরকে দেখে আদনান বাড়ির পথ ধরল।

‘শাহীন, তোর খালাত ভাই এমন করছে কেন? সে এবং তাতুম মিলে কি সব কিছু নিয়ে গেল নাকি? মিনহাজ বলল।

‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ জবাব দিল শাহীন।

আজ বার্ষিক পরীক্ষার ফল বের হবে। এ নিয়ে চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে মিনহাজ। সে একা স্কুলে যেতে চায়, কিন্তু দাদা নাছোড়বান্দা। তার সাথে দাদুও স্কুলে যাবে। শেষ পর্যমত্ম দু’জনে স্কুলে রওয়ানা হল। স্কুলে পৌঁছামাত্র প্রধান শিক্ষক তাদেরকে ডেকে তাঁর কামরায় নিয়ে গেল। প্রথমে মিনহাজকে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কি আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছো?

মিনহাজ চুপ করে রইল।

প্রধান শিক্ষক বললো, ‘আমি ভালো করে বুঝেছি, তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওনি।

‘স্যার, আপনি কিভাবে জানেন?’ জানতে চাইল মিনহাজ।

তোমার পরীক্ষার ফলাফল দেখে আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি সে চোরের সন্ধান পাওনি। সে তোমার নিকট হতে অনেক কিছু চুরি করে নিয়ে গেছে।

‘আমার কাছ থেকে ঐ চোর চুরি করেছে? প্রশ্ন করল মিনহাজ।

‘হ্যাঁ, তোমার কাছ থেকে।’

কিভাবে?’

সে তোমার সব নিয়ে গেছে। এর পরিণতি হলো, তুমি পরীক্ষায় ফেল করেছ।

আমার নাতি পরীক্ষায় ফেল করেছে? মাথায় দু’হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো মুফিজুর রহমান। তাকে খুব ক্লামত্ম দেখাচ্ছে।

‘আপনি এমন করছেন কেন? এত অল্পতে ভেঙ্গে পড়লে কি চলবে?’

আমি আমার ছেলেকে কি জবাব দেব? আমার নাতি এখনো সোনার খোঁজে আছে।

মিনহাজ, প্রধান শিক্ষক বলতে লাগলেন, ‘তথাকথিত গুপ্তধন না খুঁজে নিজে সোনা হয়ে যাও, সর্বত্র তোমার মূল্যায়ন হবে। এক টুকরো সোনা যদি একশত বৎসর নোংরা কাদার মধ্যে থাকে, তবুও তার স্থান হবে গলায়। এভাবে সমাজে তোমার মূল্যায়ন হবে। তুমি মানুষ হও।’

‘আমি তো মানুষ।’ বলল মিনহাজ

সবাই মানুষ, কিন্তু তোমাকে সত্যিকার মানুষ হতে হবে। তুমি দুধের মত না হয়ে, পনিরের মত হতে চাও। যদি দুধ পানির মধ্যে ফেলে দাও তা মিশে যাবে। যদি পনিরকে পানির মধ্যে ছেড়ে দাও, তা মিশবে না। উভয়ই দুধ। প্রক্রিয়াজাত করার পর পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। তুমিও মানুষ, অন্যান্য মানুষের সাথে প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে পার্থক্য সৃষ্টি করতে হবে। সবাই মানুষ, এটা অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু একজন মানুষের সাথে যদি গরু, ছাগল, ভেড়ার জীবনের সাথে পার্থক্য না থাকে, তবে তাকে মানুষ বলা সমীচিন নয়। গরু, ছাগল, ভেড়ার জীবন একটা নির্দিষ্ট চক্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তোমার জীবনও যদি একটা চক্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তোমার আর গরুর মধ্যে পার্থক্য কি? তুমি ফেল করেছ, হতাশ হবার কিছু নাই। এটা তোমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত। নতুন উদ্যমে কাজ শুরু কর, দেখবে সফল হচ্ছ। যদি নয়বার ব্যর্থ হয়ে দশবার ফিরে আসো, তবে তুমি সফল হবেই। আব্রাহাম লিঙ্কন একজন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি একুশ বৎসর বয়সে ব্যবসা আরম্ভ করে ব্যর্থ হয়েছিলেন, বাইশ বৎসর বয়সে তিনি আইন পরিষদের নির্বাচনে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তার বয়স যখন চবিবশ বৎসর তিনি আবার ব্যবসায় মনোনিবেশ করলেন। চৌত্রিশ বৎসর বয়সে তিনি কংগ্রেস নির্বাচনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পরে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সিনেট নির্বাচনেও ব্যর্থ হলেন। এ ব্যর্থ মানুষটা শেষ পর্যমত্ম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন। এখন তুমি কি মনে করো, আব্রাহাম লিঙ্কন একজন ব্যর্থ মানুষ?

‘না, স্যার।’

‘কেন নয়?’

‘কারণ তিনি চূড়ামত্ম সফলতা পেয়েছেন।’

‘এটাই সফলতার সংজ্ঞা। তাই বলা হয় সাফল্য হচ্ছে ৯৯% ব্যর্থতা।’

‘মিনহাজ বলোতো তোমার সমস্যাটা কি?’ তিনি জানতে চাইলেন।

‘হাবিব স্যার বারবার বলে আমার মাথায় নাকি কিছুই নাই।’

হাবিব স্যার যদি এরকম বলে থাকে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করব। তোমার মাথায় সব ঠিক আছে। প্রভু সবাইকে সমান মেধা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সমস্যা হচ্ছে ব্যবহার বিধিতে। যে যার মেধাকে যত বেশি ব্যবহার করে, তার মেধার উজ্জ্বলতা তত বাড়বে। ব্যবহার কম হলে, মরিচা আক্রামত্ম হবে। হাবিব স্যার এ কথা বলাতে তোমার মধ্যে হয়ত কিছুটা নিরুৎসাহিতা সৃষ্টি হয়েছে। কারো ঠুনকো কথায় যদি তোমার একটা বৎসর নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সর্বনাশ। শোন, একবার এক পিতা ও পুত্র বাজার হতে গাধা কিনে আনছিল। বাবা গাধার উপর আরাম করে বসে আছে, ছেলে তা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পথে একজন বলল দেখ, বাবা গাধার উপর আরাম করে বসে আছে, ছেলে তা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এমন মমত্মব্য শোনার পর পিতা গাধা হতে নেমে গিয়ে পুত্রকে বসিয়ে দিয়ে গাধা টেনে নিয়ে যেতে লাগল। কিছুদূর যাওয়ার পর একজন বলল, কি বেয়াদব ছেলে? বাবাকে গাধা টানতে দিয়ে নিজে আরামে বসে আছে। পথিকের এমন মন্তব্য শুনে বাবা ও গাধার উপর সওয়ার হয়ে এগুতে লাগল। কিছুদূর অগ্রসর হবাব পর আরেকজন বলল, কি আর্শ্চয ! একটা গাধার উপর দু’জন মানুষ। এ মমত্মব্য শোনার পর দু’জনই নেমে গেলো। কিছুদূর এভাবে যাবার পর আরেকজন বলল, দেখ গাধা থাকতে দুই বেকুব হেঁটে যাচ্ছে। এবার ক্ষুব্ধ পিতা-পুত্র গাধাটা বেঁধে লাঠির সাহায্যে কাঁধের উপর নিয়ে হাঁটতে লাগল। তাদের এ কর্মকান্ড দেখে সবাই হাসতে লাগল। পথিমধ্যে একটা সাঁকো পাড়ি দেবার সময় গাধাটি হাত-পা ছোঁড়া আরম্ভ করল ভয়ে। তারা ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে গাধাটি নদীতে পড়ে গেল।

তারা যদি কারো কথায় কান না দিত এ বিপদ হতো না। তাই বলছি, মানুষের কথায় কান দিতে নেই। সাধনা করে যাও, তুমি সফল হবে। তুমি যদি এবার পাস করতে সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে। ফেল করাতে তোমাকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকতে হচ্ছে। তোমার জীবনের একটা বৎসর নষ্ট হল, শুধু তোমার কারণে। এটা তোমার ভিত্তি কাল। ভিত্তি যত মজবুত হবে, প্রাসাদের উচ্চতা তত বেশি হবে। যদি ভিত্তি দুর্বল হয়, উঁচু প্রাসাদ নির্মাণ করা অসম্ভব। করলে যে কোন সময় ধ্বসে পড়বে। পৃথিবীর সমসত্ম সুউচ্চ ভবনের ভিত্তি খুব শক্ত। জীবনে উত্থান পতন থাকবেই। এই জন্য হতাশ হওয়া যাবে না। হতাশাকে দু’পায়ে দলে এগিয়ে যেতে হবে। এটা হলো সফলতার মৌলিক সূত্র। প্রভু আকাশ সবর্দা নীল রাখে না। আমাদের পুরো জীবন পুষ্পময় থাকে না। আকাশেও প্রতিদিন সূর্য থাকে না। মেঘ-বৃষ্টি ও প্রতিদিন থাকে না। বৃষ্টির শেষে রংধনুর দেখা মেলে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। সব দুঃখ তরঙ্গ অতিক্রামত্ম করতে প্রভু আমাদের মধ্যে শক্তি প্রদান করেছে। রাতে বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছে। দিনে আলোর ব্যবস্থা করেছে। তুমি কি স্টিফেন হকিংয়ের নাম শুনেছ? তার পুরো শরীর পঙ্গু, শুধু হাতের দুটো আঙ্গুল আর মাথাটা সচল। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। এ অবস্থায় তিনি সারা বিশ্বকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে। পরিশ্রম করে যাও, সফল হবে। তুমি কি এখন চোরটাকে শনাক্ত করতে পেরেছ?

না স্যার। জবাব দিল মিনহাজ।

আরে বেকুব, সময়, সময়।

সময়ের মূল্য বুঝে যদি যাও কাজে

প্রতিষ্ঠিত হবে তুমি জগতের মাঝে।

সময় হচ্ছে এক নীরব ঘাতক। বরফের মত তা ক্ষয়ে যাচ্ছে। তোমার জীবনকেও ক্ষয়ে দিচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্ত হচ্ছে এক একটা জীবন। সময় নষ্ট করা মানে জীবন নষ্ট করা। আমাদের দেশে একটা কথা আছে, ৯টার ট্রেন কয়টায় আসে? এটা আমাদের সময় সম্পর্কে অসাবধানতার ফসল। জীবনকে পরিমাপ কর। তুমি বুঝতে পারবে, তুমি কি হারাচ্ছ? কেউ যদি ষাট বৎসরের জীবন পায় তার জীবনের মোট ঘণ্টা হলো ৫,২৫,৫৮৫ ঘন্টা। সংখ্যাটা খুব বড় মনে হলেও মোটেই বড় নয়। শৈশবের অপরিপক্কতার মধ্যে তার পাঁচ বৎসর চলে যায়। বাকী থাকে পঞ্চান্ন বৎসর। মানুষের পরিমিত ঘুমের পরিমাণ ৭ ঘণ্টা। এক বৎসরে ঘুমায় ২৫৫৫ ঘন্টা বা ১০৬ দিন। আমরা যদি দুপুরের বাড়তি ঘুম সহ অন্যান্য ঘুম ধরি, ধরতে পারি একজন মানুষ এক বৎসরে ঘুমান ১২১ দিন অর্থাৎ বৎসরের তিন ভাগের এক অংশ। এ হিসেবে ঘুমের মধ্যে মানুষ কাটায় ১৯ বৎসর, বাকী থাকে ৩৬ বৎসর। দাঁত ব্রাশ, টয়লেট, গোসল, খাওয়া, পত্রিকা পাঠ, টিভি দেখা, কাপড় পরা, যাতায়াত, আড্ডা, চা-নাসত্মা, যানজট, বিশ্রাম, ইত্যাদিতে দৈনিক তিন ঘন্টা ব্যয় হলে ১ বৎসরে ব্যয় হয় ১০৯৫ ঘন্টা (যা ব্যসত্ম মানুষের হিসাব, যারা টিভি দেখার সুযোগ পায় না) বা ৪৬ দিন, অর্থ্যাৎ ৮ বৎসর। থাকে ২৮ বৎসর। এভাবে যদি অন্যান্য কাজ গুলোর হিসেবে নিয়ে আস, তবে দেখবে জীবনটা একটা মিথ্যা মায়া। তুমি যদি সময়কে না বুঝ, জীবনকে বুঝতে পারবে না। সময় খোদার পক্ষ হতে পবিত্র আমানত। এটার সদ্বব্যবহার না করা মানে, নিজেকে ধ্বংস করা। তুমি কি এখন হতে ঠিক মত লেখাপড়া করবে?

জি স্যার, এবার আর ভুল হবে না। জবাব দিল মিনহাজ।

তার এ জবাব শুনে দাদুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। তারা ফিরে গেল বাড়িতে।

 

 

 

 

 

তুমুল বির্তক হচ্ছে, রিশাদকে নিয়ে নয়। এবার বির্তকের বিষয়বস্ত্ত শাহীন। সবার সন্দেহের আঙ্গুল এখন তার দিকে। অঙ্গুলি তার দিকে নিদের্শিত হওয়াই স্বাভাবিক। কিছুক্ষণ আগে সে চলে গেছে ঝগড়া করে। তাদের বিতর্কের বিষয়বস্ত্ত ছিল গুপ্তধন। শাহীন গুপ্তধন নিয়ে তার নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে, আমি তোমাদের দলে আর নাই। আমরা একটা মিথ্যা স্বপ্নের পিছনে দৌড়াচ্ছি, আর নিজের গুপ্তধনকে অবহেলা করছি। যেন রিশাদের আরেকটি রূপ।

‘নিজের গুপ্তধন মানে?’ আশরাফ প্রশ্ন করেছিল।

‘নিজের মধ্যে থাকা প্রতিভা। আমরা যদি আমাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারি তবে, কত গুপ্তধন আমাদের হাতে আসবে তার ইয়ত্তা নেই। ভাগ্যের চাবিটি আমাদের হাতে, তাতে আমরা জং ধরিয়ে রেখেছি।’ জবাব দিল শাহীন।

তোর গুপ্তধন নিয়ে তুই থাক, তুই তো বিশ্বাসঘাতক। রিশাদ নয়, আমরা তোকে বুঝতে পারিনি। মিনহাজ বলল।

‘আমি বিশ্বাসঘাতক মানে?’ প্রশ্ন করল শাহীন।

‘নয়তো কি? তোর খালাত ভাই আদনান আমাদের দেখে কথা বলল না। তুই খালাম্মার সাথে অনেকক্ষণ গল্প গুজব করলি। তাতুম আমাদেরকে চিনল না। এখন নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হলি। এসব কি বুঝায়? শিহাব বলল।

‘ঠিক আছে আমি যখন বিশ্বাসঘাতক, ভাল মানুষের সাথে থাকব কেন?’ উঠে চলে গেল শাহীন।

শাহীনের এ বিশ্বাসঘাতকতার জন্য সবাই হতাশ। তাকে শায়েসত্মা করলে রিশাদকে বেঁধে রাখার ঘটনা বেরিয়ে আসবে। মতামত দিলো আলম।

সাবিবর বিতর্কের অবসান ঘটাতে বলল, ‘এখন ঐ সব বাদ দাও, আমরা আমাদের শেষ চেষ্টা করি। অতীতের জন্য অনুশোচনা করে নিজেকে ধ্বংস না করে বর্তমানকে কাজে লাগাও, এতে ভবিষ্যৎটা সুন্দর হবে।

আমার মনে হচ্ছে, সবকিছু ওরা নিয়ে গেছে। আমাদের ঐ সোনা পাওয়ার আগ্রহ ছিল, কিন্তু ঠিক সময়ে কাজ শুরু না করাতে সব হারালাম। সে জন্যই বলে, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। এখন দেখি দশ ফোঁড় নয়, হাজার ফোঁড় দিলেও লাভ হবে না। আমাদের সময় জ্ঞান নাই বলে, আমরা ব্যর্থ হলাম। আজ হতে সব বাদ। এখন দরকার সময় মত লেখাপড়া করে নিজেকে মানুষ করা। বলল মাহবুব।

আমরা যদি তাকে লোভনীয় প্রসত্মাব দেই, তখন বুঝতে পারবো, ব্যাপারটা কি? আসলে কি সব হাওয়া হয়ে গেছে? মিরজাফররা সব সময় মুখে মধু, অমত্মরে বিষ এ নিয়ম অনুসরণ করে। ওদের ধরা সহজ নয়। সে যদি এত চতুর না হয়। এত জনকে ফাঁকি দিল কিভাবে? শিহাব হতাশ মনে বলল।

‘রাখ ওসব ভারী কথা।’ মিনহাজ বলা শুরু করল। ‘এখন আমরা কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করে দেখি আসলে সব খোয়া গেছে কিনা? যদি মনে হয় যে তা এখনো ঐ গুপ্তধন উদ্ধার হয়নি, তবে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। এই এক সপ্তাহ আমরা সবগুলো খুঁটে খুঁটে দেখব। যদি তা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে আমরা অভিযানে নামব। না হলে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করব।’

তারা কতকগুলো পূর্ণ সিদ্ধামত্ম নিল। শাহীন ও রিশাদকে নজরদারীতে রাখা, উল্লুক ভিটায় কোন গুপ্ত তৎপরতা হচ্ছে কিনা দেখা ইত্যাদি, ইত্যাদি। পরবর্তী বোরবারে পুনরায় বৈঠকে বসার সিদ্ধামত্ম নিয়ে চলমান সভাটি শেষ করল ‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার কমিটি।’

মিনহাজ এই স্কুলে আর যাবে না। সে জুনিয়র ছাত্রদের সাথে আর ক্লাস করবে না। মুফিজুর রহমান তাকে অনেক বুঝিয়েছে। সে কিছু বুঝতে চায় না। তার বক্তব্য একটাই ঐ স্কুলে আর যাবে না। শেষ পর্যমত্ম মুফিজুর রহমান তার কাছে আত্মসমর্পণ করে, তাকে নিয়ে এলো শহরে। চিমত্মা করলো, নাতি যদি পাড়ার দুষ্ট চক্রের কাছ হতে আলাদা হয়ে যায়, তবে তার মাথা হতে সব ভূত পালিয়ে যাবে। ইতোমধ্যে শাহীন তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তাকে তার বাবা শহরে পাঠিয়ে দিয়েছে। রিশাদ প্রথম হতে তার ভুলের ব্যাপারে সচেতন ছিল।

আনন্দলহরী স্কুল। ধীরে ধীরে মিনহাজ গিয়ে সভাকক্ষে ঢুকে চেয়ার টেনে বসল। বিশেষ ক্লাসের আয়োজন করা হয়েছে ছাত্রদের নিয়ে।

বিষয় ‘‘এসো কুড়িয়ে তুলি কোটি টাকার গুপ্তধন, বদলে ফেলি জীবনের রং।’’ প্রণোদনার ক্লাস এটি। শিরোনামটা পড়ে হেসে দিল মিনহাজ। সে যখন শিরোনামটি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে ছিল, হঠাৎ চমকে উঠল সে। কখন তার পাশে শাহীন এসে বসেছে, খেয়ালও করেনি।

‘কি ব্যাপার মিনহাজ। ঐ শিরোনাম দেখে কি পাগল হয়ে গেলি।’ শাহীন তাকে বিদ্রুপের সুরে বলল।

‘তুইও এই স্কুলে ভর্তি হলি?’ কথার জবাব এড়াতে চাইল মিনহাজ।

সকাল দশটায় অনুষ্ঠান শুরু হল। প্রধান শিক্ষক তার বক্তব্যে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদেরকে মানুষ করা। আমরা প্রকৃতিতে দেখতে পাই, প্রাণীদের জন্মের সাথে সাথে সহজাত বুদ্ধির খুব দ্রুত বিকাশ ঘটে। হাসের বাচ্চা জন্মের সাথে সাথে পানিতে সাঁতার কাটতে পারে। গরু বাছুর দৌড়াতে পারে। তারা তৎক্ষণাৎ তাদের ভাল মন্দ বুঝতে সক্ষম হয়। কিন্তু তাদের এ বিকাশ দ্রুত থমকে যায়। তাদের মধ্যে বুদ্ধির তারতম্য দেখা যায় না। মানুষের জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার জীবনে আত্মবিকাশের পথ কখনো রুদ্ধ হয় না। সে জন্য শিক্ষার কোন সমাপ্তি নাই। এর পরিধি জন্মলগ্ন হতে আরম্ভ করে মৃত্যু পর্যমত্ম। এমনকি একজন লোক মৃত্যুর পরও মানুষের শিক্ষার অন্যতম উৎস হতে পারে, যদি ঐ মানুষ পৃথিবীকে সেরূপ কিছু দিয়ে যায়। একবার এক জ্ঞানী মৃত্যু সময় উপস্থিত হলে তাকে দেখার জন্য এলাকার বিখ্যাত জ্ঞানীগণ গেলেন। তাদের মধ্যে এমন এক বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হলো, যা ঐ মৃত্যুপথ যাত্রী জ্ঞানী লোকটির জানা ছিল না। সে আলোচনা শোনার পর ঐ মুমূর্ষু জ্ঞানীটি বলল, শুকরিয়া, মৃত্যুর আগে একটা জ্ঞান শিখলাম। আমাদের জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা এমন হওয়া উচিত। তুমি যত জানবে, তোমার আত্মবিশ্বাস তত বাড়বে। তুমি যদি কিছু না জান, তবে তুমি হবে আত্মবিশ্বাস শূন্য। আত্মবিশ্বাস না থাকলে, সবকিছু তাসের ঘরের মতো উড়ে যায়। যদি কারো মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া যায়, তাকে যুদ্ধ করে পরাজিত করার দরকার হয় না। সে এমনিতেই আত্মসমর্পণ করে। মানুষের জীবনে উন্নতির জন্য দরকার,

কৌশলগত দক্ষতা।

মানসিক দক্ষতা।

জ্ঞানগত দক্ষতা।

এই সব দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তোমাদের উচিত কিছু অনুপ্রেরণামূলকও কিছু শিক্ষামূলক বই পাঠ করা। এসব বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া। আর ডায়েরীতে নিজের মত করে টুকে রাখা। জীবনে এগিয়ে যাবার জন্য দরকার আত্ম-চালিত হবার ক্ষমতা। তোমরা তোমাদের মেধার দ্বারা তা অর্জনে নিবেদিত হও। তোমরা হাতের কাছে সব সময় দুটি নথি রাখবে।

প্রধান নথি।

নিয়ন্ত্রক নথি।

প্রধান নথি হবে বিভিন্ন উক্তির, কথা, ইতিহাস, শিক্ষার সংকলন। নিয়ন্ত্রক নথি হবে তোমার জীবনের বিভিন্ন দিকের সংকলন। এভাবে তুমি বিভিন্ন দিক হতে প্রাপ্ত আত্মোন্নয়নের নির্দেশিকাগুলো সংকলন করে নিজের উন্নতি সাধন করতে পারবে।

সাঈদ স্যারও তার বক্তব্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিলেন। তিনি তার বক্তব্যে বললেন, আমরা অনেক কথা শুনি আর অনেক কথা বলি। কথা বলা, কথা শোনা, নোট করে রাখা, সব কিছুর ঊর্ধ্বে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাসত্মবায়ন। এ সত্যটাকে আমরা আমাদের জীবনে বাসত্মবায়ন করব। আমরা আমাদের কর্মের ক্ষেত্রে ঘঅঞঙ হবো না, অঘঞ হবো। আমি ঘঅঞঙ এবং অঘঞ এর গল্প বলছি। একবার এক বাংলাদেশি আমলার সাথে একজন জাপানি কথা প্রসঙ্গে বলল, আপনারা হলেন ঘঅঞঙ সদস্য, আমরা হলাম অঘঞ.

বাংলাদেশি বলল, আপনি ভুল বলছেন, আমরা ঘঅঞঙ সদস্য না। জাপানি বলল, আপনারা অবশ্যই ঘঅঞঙ সদস্য। ঘঅঞঙ মানে হলো ঘড় অপঃরড়হ,ঃধষশ ড়হষু আর অঘঞ হলো, অপঃরড়হ, ঘড়ঃধষশ। আমরা ঘঅঞঙ সদস্য না হয়ে অঘঞ হবো। আমরা যদি কাজের ব্যবস্থাপনা করতে না পারি, অমত্মত অব্যবস্থাপনা যাতে না করি। এক বাংলাদেশি এক বিদেশির কাছে নিজেদের দায়িত্বে করার জন্য কিছু কাজ চেয়েছিল।

বাংলাদেশি বলল, আমাদের কিছু কাজ দিন, যাতে আমরা ব্যবস্থাপনা করি।

সে বলেছিল, তোমরা ব্যবস্থাপনা জান না।

বাংলাদেশি এবার বলল, আমাদের অব্যবস্থাপনা করার সুযোগ দিন।

সে জবাবে বলেছিল, তোমরা অব্যবস্থাপনার কাজও জান না। তোমাদেরকে স্যারদের প্রদত্ত উপদেশ গুলো মেনে চলার কাজ এখনি শুরু করতে হবে। তোমাদেরকে জানতে হবে গতকালটা ইতিহাস হয়ে গেছে, আগামীকাল হচ্ছে সম্ভাবনা, আজকের দিনটি শুধু সত্য। এখন হতে এসো কাজে লেগে যাই। দেশটাকে সুন্দর ভাবে সাজাই। আমরা আজ হতে প্রতিটি মুহূর্তকে সদব্যবহারের ব্যাপারে সজাগ হব। কারণ, আমরা যদি সময় নষ্ট করি, সময়ও আমাদেরকে আসত্মাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে। সময় এমন এক গুপ্তধন, যাকে আমরা প্রতিনিয়ত দূরে ঠেলে যাচ্ছি।’

শাহীন মিনহাজকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘গুপ্তধন কি এখন বুঝতে পেরেছ?’

মিনহাজ নীরব থাকল। কিছুক্ষণ পর মুখ ঘুরিয়ে দেখে, শাহীন নাই। তার আসনে বসে আছে অপরিচিত একজন। ভয়ে শরীরের সব লোমকূপ জেগে উঠল মিনহাজের। মিনহাজ মনে মনে বলল, এতক্ষণ যাকে দেখলাম সে কে? এসব কি হচ্ছে।

জানুয়ারির এ হিমেল দিনেও তার শরীর অস্বাভাবিক ঘেমে উঠল।

 

 

 

 

 

বিশ্বাসঘাতক চক্রের সন্ধান পেয়েছে মিনহাজ। ঐ চক্রটি শাহীন, রিশাদ বা আদনানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠেনি। এ চক্রটি গড়ে উঠেছে তাদের মাধ্যমে, যাদের নিয়ে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ করেনি মিনহাজ। ধরা পড়েছে হঠাৎ করে। শহর থেকে মিনহাজ সরাসরি বান্দরবানে যাচ্ছিল। সাতকানিয়া হতে এমন কয়েকজন গাড়িতে উঠল তাদেরকে দেখে মিনহাজ হতভম্ভ হলেও বুদ্ধি হারায়নি। গাড়িতে মাথানিচু করে নিজেকে আড়াল করল সে।

ওরা বান্দরবানের গাড়িতে উঠল কেন? তাদের উদ্দেশ্য কি? মনে মনে ভাবল মিনহাজ।

টাল সইতে পারছিল না সে। তবুও নিজেকে সামলে নিল। সবাই হাসাহাসি করছে। মীর জাফরের হাসি কি এরকম ছিল? আরেকবার ভেবে নিল মিনহাজ। বান্দরবান এসে গাড়ি থামলে তারা নেমে পড়লো। ওরা কিছুদূর যাওয়ার পর বাস হতে নেমে এলো মিনহাজ। উদ্দেশ্য চুপি চুপি তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করা। কিন্তু বিধিবাম। শিহাবের নজরে পড়ে যায় মিনহাজ। মিনহাজকে দেখে বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে গেল শিহাব। সাথে সাথে সাবিবর, মাহবুবও।

‘আরে মিনহাজ! তুই এখানে?’ জানতে চাইল শিহাব।

‘তোরা এখানে কেন?’ পাল্টা প্রশ্ন করল মিনহাজ।

‘এদিকে বেড়াতে এলাম। এ আর কি, বিশ্বটাকে দেখা।’ বলল মাহবুব।

‘সত্যি বলছিস?’ মাহবুবের কাছে জানতে চাইল মিনহাজ। ‘যদি তাই হয় তবে, সবাই মিলে দেখি।’

‘তুই কেন এসেছিস মিনহাজ? তুই তোর কাজে যা।’ বলল সাবিবর।

আমার কোন কাজ নেই, তোরা যখন এসেছিস, আমি তোদের নিয়ে ঘুরব।’ বলল মিনহাজ।

প্রথমে গোপন করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নিল।

সাবিবর জানাল, তারা তাতুমকে ম্যানেজ করে ফেলাতে সে মিনহাজদের সাথে আর যেতে রাজি হয়নি।

শিহাব বলল, আমরা কয়েকটা অভিযান চালিয়েছি, কিন্তু সব ব্যর্থ হয়েছে। তাতুম বলেছে, এবার চূড়ান্ত পদ্ধতিটা অবলম্বন করলে সুফল পাওয়া যাবে। তা জানতে বান্দরবান এসেছি। মিনহাজ তাদেরকে ক্ষমা করে দিল। মিনহাজসহ সবাই মিলে গেল তাতুমের আস্থানায়। তাতুম জানাল, আমি জ্বীনদের সাথে কথা বলেছি। তারা তেমন বেশি কিছু চায় না, তাদের দাবী শুধু আড়াইশ গ্রামের মতো সোনা। এগুলো ফেলে সব দাবী তারা ছেড়ে দিবে। দেখ তারা চায় মাত্র আড়াইশ গ্রাম, বিনিময়ে আমাদেরকে দিবে প্রায় দশ কেজির মত সোনা। তোমরা কি রাজি?

‘এত স্বর্ণ আমরা কোথায় পাব? এতো অনেক টাকার স্বর্ণ।’ মাহবুব বলল।

মিনহাজ বাঁধা দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি রাজি। আমি ব্যবস্থা করব। আপনি কখন যাচ্ছেন বলেন?’

তাতুম ক্যালেন্ডার দেখে বলল, পরশু অমবস্যার রাত। অমবস্যা মানে জ্বীনদের রাজত্ব। তোমরা ঐ দিনের জন্য প্রস্ত্ততি নিতে পার।

সিদ্ধান্ত হল, পরশু অমবস্যার রাতে অভিযান চালাবে। রাত ঠিক একটা হতে শুরু হবে তাদের অভিযান। তারা সবাই খুশি মনে বাড়িতে ফিরে আসল।

শাহীনের বাড়িতে গেল মিনহাজ। উদ্দেশ্য শাহীন সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া। শাহীনের মা সব কথা শুনে বলল, বাবা মনে হয় তুমি ভুল কিছু দেখেছ। শাহীন তোমার স্কুলে ভর্তি হয়নি।

‘কি যে বলেন চাচী। আমি নিজের চোখকে তো অবিশ্বাস করতে পারি না।’

‘শাহীন ঐ স্কুলে যাবার কথা নয়, মনে হয় তোমার ভুল হচ্ছে।’ আবার বলল মহিলা।

‘সে অনেকক্ষণ আমার পাশে বসেছিল চাচী, পরে আমাকে না বলে চলে গেল। মনে হয় সে আমার উপর ক্ষুব্ধ।’

‘আমার ছেলে ওখানে যাবার প্রশ্নই আসে না।’

তারা যখন আলোচনায় রত, ঐ সময় সেখানে এসে হাজির হলো শাহীন। সে শহর হতে ফিরে এসেছে।

সব শুনে শাহীন হেসে বলল, ‘এটা তোর দৃষ্টির ভুল ছাড়া আর কিছু নয়। আমি ওখানে যাব কেন? আমারও তোর স্কুলের মধ্যে কমছে কম দশ কিলোমিটার দূরত্ব। কোথায় খাতুনগঞ্জ আর কোথায় বন্দরটিলা। তোদের স্কুল আমি কখনো দেখিনি, নামও শুনিনি।’

‘তাহলে আমার পাশে এক ঘন্টা বসেছিল ওটা কে?’ ভাবল মিনহাজ।

‘একবার রিশাদ, একবার শাহীন, এসব কি হচ্ছে? পাড়ার এ জ্বীন ভূত কি আমাদের শেষ করে দিবে। এদের তাড়াতে কিছু একটা করা দরকার। প্রথমে স্বর্ণগুলো তুলে নিই, তারপর তাদের চৌদ্দগোষ্ঠী এখান হতে তাড়াব।’ মনে মনে ভাবল মিনহাজ।

‘ওসব কিছু না। তোমার কল্পনার ফসল।’ জবাব দিল শাহীনের মা।

বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রাকিবুল আনসারি। তার চেম্বারের ওয়েটিং রুমে বসে আছে মিনহাজ ও মফিজুর রহমান। তারা চিকিৎসা নিতে এসেছে। রোগী মিনহাজ। দাদু শেষ পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পেরেছে মনোচিকিৎসায় মিনহাজকে স্বর্ণরোগ হতে ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ। অনেক রোগী বসে আছে আশে পাশে। মিনহাজ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে দাদু, দাদু, দেখ রিশাদ ও শাহীন। ওরা আমার দিকে চেয়ে হাসছে। দাদু ভাল করে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। উপস্থিত অন্যান্য লোকেরাও বলল এটা মিনহাজের দৃষ্টিভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। মিনহাজ বলল, তারা দুজনে তার দিকে চেয়ে মিটি মিটি হাসছে। মিনহাজের দৃষ্টিগোচর হবার পর দু’জনে উঠে চলে গেছে। তবে কি রিশাদ ও শাহীনের মধ্যে কোন গোপন অাঁতাত হয়েছে? মনে মনে ভাবল মিনহাজ। এ ঘটনার পর তারা প্রচন্ড উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

এক সময় তাদের ডাক পড়ল। ধীরে ধীরে চেম্বারে ঢুকে গেল দু’জন। ঘটনার আদ্যোপামত্ম শুনে ডা. আনসারি বলল, ‘এটা মানসিক ব্যাধি, তাদের নিয়ে অতিরিক্ত কল্পনার ফল। এ বিষয়টার মোহমুক্তি ঘটলে ঐ দৃশ্যগুলো আর দেখা যাবে না। শুধু চেষ্টা করতে হবে তাদের নাম হৃদয় হতে মুছে ফেলতে। নিশ্চয় তাদের নিয়ে কোন দুশ্চিমত্মা মিনহাজের হৃদয়ে ভর করে আছে।’ ডাক্তারের কথাগুলো অলৌকিক বা সম্পূর্ণ মিথ্যা মনে হল তাদের।

 

 

 

 

 

আজকের দিনটা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। দিনটা যত দ্রুত ফুরিয়ে যাবে, তত মঙ্গল। কিন্তু প্রকৃতি যেন আজ তার স্বভাব বিরোধী কাজ করছে। দিনটাকে টেনে টেনে লম্বা করে দিচ্ছে। উত্তেজনায় সবাই কাঁপছে। মিনহাজ পরামর্শ দিল, ‘চল একটা কাজ করি, ফুঁক দিয়ে সূর্যটা নিভিয়ে ফেলি।’ তার কথা শুনে সবাই হেসে উঠল।

‘সব কি রেডি?’ সবার কাছে জানতে চাইল মিনহাজ।

‘হ্যাঁ।, জবাব দিল আশরাফ।

আশরাফ সব বের করে মাটিতে রাখল। সে চারিদিকে তাকাল।

তোমার কি খবর? সাবিবরের কাছে জানতে চাইল মিনহাজ।

আমিও প্রস্ত্তত।

সব বের কর।

সাবিবর সব বের করে সামনে রাখল।

তাদের দেখে আলম, মাহবুব ও শিহাব সব বের করে সামনে রাখল।

সব মিলে আড়াইশ গ্রামের মত হবে। প্রাক্কলিত ওজন করল মিনহাজ।

বলছিলাম ‘‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার’’ কমিটির শেষ বৈঠকের কথা। তারা রাতের করণীয়গুলো ঠিক করার জন্য বৈঠকে বসেছে। তাতুমের দেখা শোনা, অবস্থান, গুপ্তধন প্রাপ্তির পর করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা তাদের কমিটির বিলুপ্ত ঘোষণা করে ফিরে গেল বাড়িতে।

গভীর রাত। গর্ত খনন শেষ। তাতুম সব স্বর্ণ মাটি খুঁড়ে বের করে এনে মিনহাজকে বলল, ‘এই ধর তোমার সাধনার পূর্ণতা।’ এতগুলো স্বর্ণ একসাথে দেখে সবাই খুশিতে আত্মহারা। খুশিতে তারা নাচতে শুরু করল। তাতুমকে এখান হতে এক কেজি স্বর্ণ দিয়ে দিল মিনহাজ। খুশিতে টগবগ করে উঠলো তাতুম। তাদেরকে ধন্যবাদ দিতে দিতে গাঁটটা গুছিয়ে চলে গেল সে। আশরাফ, মাহবুব, সাবিবর, শিহাব ও আলম সবাইকে নিয়ে একটা বিশাল বাড়ি কিনতে যাচ্ছে মিনহাজ। পথে দেখতে পেল রিশাদ ও শাহীন দাঁড়িয়ে আছে, তাদের পিছনে দাদু।

‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ? দাুদ তাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল।

‘কেন দাদু? এই দেখ।’ মিনহাজ স্বর্ণের থালাটি তাদের সামনে খুলে ধরল।

‘এত স্বর্ণ…দাদু, রিশাদ ও শাহীন চিৎকার করে উঠল।

‘আপনি তো চেয়েছিলেন, আমরা যেন এ সব না পায়, এখন কে সত্যি?’ দাদুকে বলল মিনহাজ। ‘আর ঐ দু’জনতো কত ষড়যন্ত্র করল আমাদের বিরুদ্ধে।’

সবাই খিলখিল করে হেসে উঠল। তাদের হাসি দেখে কেমন যেন আনমনা হয়ে গেছে এ তিনজন।

‘এখন কোথায় যাচ্ছ?’ দাদু মিনহাজের কাছে জানতে চাইল।

‘একটা বিশাল বাড়ি কিনব। ওখানে থাকবো আমরা, এই কমিটির সদস্যরা।’

তারা চলতে শুরু করল। তাদের পানে হা তাকিয়ে আছে দাদু। যেন তার গালের ভিতর মশা মাছি ঢুকছে আর বের হচ্ছে। তারা এ তিনজনকে টা টা দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছে।

এমন সময় ঘুম ভেঙ্গে গেল মিনহাজের। চিৎকার চেচাঁমেচিতে একে একে জেগে উঠল সবাই। আশরাফ, মাহবুব, সাবিবর, আলম ও শিহাব। জেগে দেখে প্রতিবেশীরা দাঁড়িয়ে টর্চ, কুপি, চেরাগ হাতে নিয়ে। প্রথমে বুঝতে পারেনি মিনহাজ। কি হচ্ছে? সে কোথায় ঘুমিয়ে আছে? চেতনা পুরোপুরি ফিরে আসার পর তারা ছুটল উল্লুক ভিটার দিকে। পেছনে পেছনে প্রতিবেশীরাও। এদিক ওদিক সবখানে তাতুমকে খুঁজল তারা। তার অস্তিত্ব পাওয়া গেল না কোথাও। শুধু পড়ে আছে একটা গাঁট ও কিছু ছেঁড়া ফাঁটা কাপড়।

‘কোথায় সে? সর্বনাশ! সে আমাদের সব নিয়ে পালিয়েছে।’ চিৎকার করে উঠল মিনহাজ।

‘সব মানে ?’ প্রশ্ন করল মফিজুর রহমান।

‘মায়ের সব সোনা…….’’

‘বলো কি, ভাইয়া ? চিৎকার দিল মীনা।

‘হ্যাঁ….দাদু…..’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মিনহাজ।

সে কান্নায় শরীক হয়েছে আশরাফ, সাবিবর আলম ও মাহবুব। সবার সর্বনাশ ঘটেছে। সম্পদ হারানোর যন্ত্রণায় কেঁদে উঠল মালেকাও। খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সে প্রতারণার কাহিনী। সবাই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল তাতুমের খোঁজে। কিন্তু নিরাশ হয়ে ফিরে আসল সবাই। অনেকে মফিজুর রহমানকে পরামর্শ দিল বিভিন্ন স্থানে খোঁজ খবর নিতে মানুষ পাঠানোর জন্য। রাজি হলো না সে। বলল, ‘সে হল প্রতারক, এতগুলো স্বর্ণ পাওয়ার পর সে কোথায় পালিয়ে যাবে, তার ইয়ত্তা নাই।’ তিনি মিনহাজকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। মাথা নিচু করে বসে আছে মিনহাজ।

‘মিনহাজ, তুমি কি লাখপতি হতে পেরেছ?’ দাদু তাকে প্রশ্ন করল।

‘দাদু আমার ভুল হয়ে গেছে।’ কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিল মিনহাজ।

‘শুন, তুমি ভেবেছিলে তুমি খুব বুদ্ধিমান আর আমরা বোকা। এখন কি বুঝেছ? যে নিজেকে বেশি বুদ্ধিমান মনে করে, সে বড় বোকা। এতদিন তোমাকে অনেক উপদেশ দিয়ে বুঝাতে চেয়েছি, এখন তো আর উপদেশ দিয়ে কিছু বুঝাতে হবে না। সব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছ। তবুও শেষ বারের মত কিছু উপদেশ দিচ্ছি। তোমাকে আমি যে প্রাণীটার কথা বলেছিলাম, ঐ প্রাণীটা আর কিছু না, সময়। হেডস্যার তোমার কাছে যে চোরের পরিচয় জানতে চেয়েছিল তাও সময়। হয়ত তুমি যথাযথভাবে সময়কে ব্যবহার করবে, নয়ত সময় তোমার জীবনকে চুরি করে নিয়ে যাবে। সে নিরব চোর। নিরব ঘাতক। আর এ সময়ই হচ্ছে জীবন। সময়কে সেকেন্ড হিসাব করে সদ্বব্যবহার করতে হবে। এ জন্য তোমার উচিত সময়ের হিসাব রাখা। তুমি একটা রুটিন তৈরি করে জীবনের খোঁজ খবর নাও। তখন বুঝতে পারবে, সময় কিভাবে ব্যয় হচ্ছে। তুমি যদি সঠিক ভাবে জীবনের হিসাব রাখ, অতি শীঘ্র প্রকৃত গুপ্তধন খুঁজে পাবে।

সকাল দশটা। মিনহাজ চলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম শহরে। মা-দাদী, মীনা হতে বিদায় নিয়ে সে চলে যাচ্ছে। মফিজুর রহমান তাকে এগিয়ে দিতে দিতে একটা কবিতা শুনাল-

যখন তুমি এসেছিলে ভবে

কেঁদেছিলে তুমি শুধু, হেসেছিল সবে।

এমন জীবন করিতে হইবে গঠন

মরণে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন।

হাঁটতে হাঁটতে তারা রাস্তার উপর এসে গেছে। তাদের দেখে একটি রিকশা এসে দাঁড়ালো সেখানে। রিকশায় উঠতে উঠতে মিনহাজ দাদুকে বলল, দাদু আমার জন্য দোয়া করুন। এবার আমি লেখা-পড়ার মধ্য দিয়ে প্রকৃত গুপ্ত-সম্পদ খুঁজে নেব। রিক্সায় উঠে বসল সে। রাতের যন্ত্রণা এখনো তার চোখে। রিকশা চলতে লাগল সম্মুখ পানে। তাকে বিদায় দিয়ে মফিজুর রহমান বাড়ির পথ ধরল। আসার সময় পেছনে ফিরে দেখে মিনহাজ রিকশার পিছনের পর্দা তুলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মফিজুর রহমান যথাসম্ভব জোরে চিৎকার করে বলল, সময়, সময়।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!