একটি গরুর রচনা—- কাজী মুহাম্মদ সোলাইমান

ইশ যদি গরু হতাম !—–স্বগতোক্তি করল মুন্না।

মুন্নার দীর্ঘদিনের গবেষণার ফল এ স্বগতোক্তি।

ধলিকে অনেকদিন যাবৎ গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছে মুন্নার বাবা মা। রাত বিরাতে এটির খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ে তারা। মুন্না অনেকদিন যাবৎ ব্যাপারটা খুব লক্ষ্য করে আসছে। হঠাৎ করে ধলির প্রতি তাদের মনোযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় নিজেকে অবহেলিত মনে করতে লাগল মুন্না। তার সমস্ত রাগ ধলির উপর। মা-বাবা রাতে যখন ধলির খোঁজ নেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ে, রাগে ফেটে পড়ে মুন্না। অনেকবার সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ধলিকে ছেড়ে দেবে। ধলি হারিয়ে যাবে দিগন্তে। তখন তাদের সব ভালবাসার অধিকারী হবে সে এবং শাহনাজ। শাহনাজ মুন্নার বোন। বয়স আর কত? ছয় মাস হবে। মুন্নার দৃঢ় বিশ্বাস, ধলির কারণে শুধু সে নয়, শাহনাজও অপত্যস্নেহ হতে চরমভাবে বঞ্চিত। ওরা যখন তখন শাহনাজকে বিছানায় রেখে ছুটে চলে ধলির খোঁজে। মা যখন বলে মুন্না, শাহনাজকে একটু দেখত বাবা, তখন তার রাগটা চরমে উঠে। ধলি মা বাবার কাছে শাহনাজের চেয়েও কেন বেশী প্রিয়, তা বুঝতে পারেনা মুন্না। এতটুকুতেই শেষ নয়। ধলির জন্য সর্বদা বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বাড়ির চাকর বসু ধলির টাটকা খাবারের খোঁজে পাড়ি জমান অনেক দূর। বসু  ব্যর্থ হলে বাবার তীব্র তিরস্কারের মুখোমুখি হয়। অথচ মুন্নাদের জন্য প্রতিদিন এভাবে টাটকা খাবার সংগ্রহ করা হয়না। এসব বিষয় চিন্তা করতে গেলে মনটাতে কষ্টের নদী বয়ে যায়। কিন্তু কাকে কি বলবে? যাকে অভিযোগ দিতে যায়, সে হাসে। বলে কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।  মুন্না মনের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ করল মায়ের কাছে।

‘মা আপনার কাছে কে বেশী প্রিয়? আমি, শাহনাজ না ধলি?’

‘মা হেসে বলল, কেন?’

‘কেন আবার? আপনি রাত বিরাতে ধলির খোঁজ খবর নেন, কিন্তু আমাদের কি কোন খোঁজ খবর নেন?’

‘পাগল ছেলে, আর কিছুদিন যাক। দেখবি ধলির নাম মুখেও আনব না।’ মা মিট মিট করে হাসে।

মায়ের উত্তরটা মুন্নার পছন্দ হয়নি। সে রাগে গর্জন করতে করতে বলল, ‘সে কিছুদিন পর কবে আসবে মা?’ এতে ক্লান্ত হয়নি মুন্না, চিৎকার করে বলল, ইশ, যদি গরু হতাম!

ছেলের শুষ্ক মুখপানে তাকিয়ে চমকে উঠল মা। ‘এ কি বলছ মুন্না?’

‘ধলি গরু হওয়ার কারণে এত স্নেহ পাচ্ছে,  আমি গরু হলে তা আমিই পেতাম।’

‘তুমি আমার সাত রাজার ধন। তুমি গরু হতে যাবে কেন?’ মায়ের চেহারায় কালো মেঘের আস্তরণ।

‘সাত রাজার ধন না কচু।’ ক্রুদ্ধ মুন্না বেরিয়ে গেল ঘর হতে।

মা স্বগতোক্তি করল, ‘হায়রে পাগল ছেলে আমার। এ সব তো তোমাদের জন্য।’

সকাল বেলার সূর্যটা আলো ছড়িয়ে হাসতে ছিল পৃথিবীর পানে চেয়ে চেয়ে। মৃদু সমীরণে গাছের পাতারা দোল খাচ্ছিল। মুন্না পুকুরের পাড়ে বসে ধ্যানমগ্ন মাছরাঙা পাখিটার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে নানান কথা ভাবছিল। কি আশ্চর্য রকম পাখি ওটা। চোখের পলকে উড়ে গিয়ে পানি হতে জ্যান্ত মাছ তুলে নিয়ে আস্ত খেয়ে ফেলে। এই তার খাবার। মরিচ, হলুদ, পিয়াজ, আদা, লবণ, আগুনে রান্না করা, কিছুই দরকার নেই। শুধু দরকার একটা মাছ। অথচ মানুষের খাবারে কত ঝামেলা। কত কষ্ট। একবেলা খাওয়ার জন্য কত ছুটাছুটি। ওদের খাবার নিয়ে কোন ভাবনা নেই। কোন রোগ শোক নেই। কোন কাপড়ের প্রয়োজন নেই। একদম সরল জীবন। ভাবতে ভাবতে একটা উপসংহারে এসে যাচ্ছিল মুন্না। কিন্তু ধলির কথা মনে পড়ায় মনের মধ্যে একরাশ ব্যথা ঝড়ো হাওয়ার মত উড়তে লাগল। মা বাবার সব ভালবাসা এটি দখল করে রেখেছে। গত রাত হতে মা বাবা দু’জনেই গোয়াল ঘরে অবস্থান করছে। সাথে বসু। সকালে ঘৃণায় ওদিকে যায়নি মুন্না। ভাবতে গিয়ে চোখের কোণে অশ্রু টলমল করে উঠল। তখনই ডাক শুনল মায়ের।

মুন্না দেখে যাও। মুন্না গিয়ে অবাক। ধলি মা হয়েছে। বাছুরটা ঠিক মায়ের মতই। ধলির গায়ের রঙ ধবধবে সাদা বলেই আববা এ গরুটার নাম দিয়েছে ধলি। বাছুরটাও ধবধবে সাদা। এটিকে ছোট ধলি বলা যাবে। ভাবল মুন্না। সদ্য প্রসূত বাছুরটি মায়ের পাশে শোয়ে আছে। মা এটির শরীর পরিষ্কার করে দিচ্ছে। মুন্না অবাক হয়ে বাছুরটির দিকে তাকায়। বাছুরটিও মুন্নার দিকে তাকায়। মনে হয় তাকে দেখে হাসছে ওটা। একটু পরে উঠে দাঁড়ায় বাছুরটি। মা ওটাকে সাহায্য করতে চায়। বাছুরটি মাথা নেড়ে প্রতিবাদ জানায়। কোন সাহায্যের প্রয়োজন নাই। এটি নিজেই উঠে দাঁড়াতে পারবে। মা ওখান হতে সরে দাঁড়ায়। ধলির উপর দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্রোধটা চোখের পলকে নিভৃত হয়ে ভালবাসার এক ফল্গুধারা বয়ে যেতে লাগল মুন্নার মনে। কিছুক্ষণ পর বাছুরটি ছুটাছুটি করতে শুরু করল। কি আশ্চর্য! এ বাছুরটির বয়স মাত্র ১৫/২০ মিনিট। এ ক্ষণিকের বয়সে এত ধাপাধাপি। মা ধলি ও বাছুরটিকে গোয়াল ঘরের বাইরে এনে রাখল। বাছুরটি উঠোনে এসে লাফালাফি শুরু করল। মুন্নার কোল ঘেঁষে দাঁড়াল। যেন মুন্নার সাথে মিতালি করতে খুব আগ্রহী ওটি। বাছুরটির তার প্রতি এত আগ্রহ দেখে মুন্নার আনন্দ দেখে কে?

শাহনাজের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। অন্যদিন শাহনাজের আওয়াজ শুনামাত্র ছুটত মুন্না। আজ সে দিকে কোন খেয়াল নেই তার। মা বসুকে বলল, শাহনাজকে নিয়ে আস। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে মুন্না। সে চায় না, তার বোনকে বসু কখনো স্পর্শ করুক। মা বাধ্য হয়ে ঘরে গিয়ে শাহনাজকে নিয়ে আসে। মুন্না শাহনাজের সাথে বাছুরটার তুলনা করে দেখে। তফাতটা অনেক। ছয়মাস বয়স হলেও শাহনাজ এখনো হামাগুড়ি পর্যন্ত দিতে পারে না। এত বয়স হবার পরও কেন শাহনাজ হাঁটতে পারেনা? বাছুরটি ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে কীভাবে হাঁটতে পারে? মুন্না তাকিয়ে দেখল, বাছুরটি ঘাস খাওয়ার চেষ্টা করছে। তা দেখে মনের মধ্যে প্রশ্নের বন্যা বইতে লাগল। শেষ পর্যন্ত সে মাকে প্রশ্ন করল, মা, ছোট ধলি হাঁটছে, দৌড়াছে, এটা এত তাড়াতাড়ি এগুলো শিখল কোত্থেকে? শাহনাজ এত বয়স হওয়ার পরও হাঁটতে পারেনা কেন?

‘তুমি বড় হয়ে এসব জানতে পারবে।’ মা জবাবে বলল।

‘মা, আমি কখন বড় হব?’

‘ঐ তো আর কয়েকদিন পর। তুমি তোমার বাবার মতই বড় হয়ে যাবে।’

‘মা, সে কথা তো আপনি অনেকবার বলেছেন, কিন্তু বড় হলাম না তো। ছোট ধলি তো একদিনেই বড় হয়ে গেল।’

‘কী বললে?’

‘এ গরুটার নাম দিলাম ছোট ধলি।’

‘বাহ খুব সুন্দর নাম তো।’

‘ভাইয়া, তুমি কী গরু হতে চাও?’ জানতে চাইল বসু।

‘এই তুই কথা বললি কেন?’ চেঁচিয়ে উঠল মুন্না।

‘ছিঃ, মুন্না, এভাবে কি কথা বলে?’

‘সে আমার সাথে কথা বলবে কেন?’ ফোঁসে ওঠে মুন্না

বসু অবস্থা বেগতিক দেখে ওখান হতে সটকে পড়ল। বাছুরটি মুন্নার দিকে এগিয়ে আসল। কি যে এক বন্ধুত্বের সূচনা বাছুরটির সাথে মুন্নার।

ধলি পানি দেখলে ভয় পায়। মনে হয় যমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওটি। বাবা যখন জমিতে চাষ দেওয়ার পর ধলি ও বলদটিকে গোসল করানোর চেষ্টা করে, ওরা কেউ নামতে চায় না। ওদেরকে পুকুরে নামাতে গিয়ে বাবাকে গলদঘর্ম হতে হয়। কয়েকদিন পর ছোট ধলিকে পুকুরে নামাতে চেয়েছিল মুন্না। বাছুরটি দৌড়ে গিয়ে তার মায়ের কাছে আশ্রয় নেয়। মুন্না অবাক। বাছুরটা কিভাবে বুঝতে পারল, পানি ওদের জন্য ভীতিকর। অথচ সেদিন বাড়িতে কি লঙ্কাকান্ড ঘটাল শাহনাজ। রাত্রে বিদ্যুৎ ছিলনা। মা চেরাগ জ্বালিয়ে রান্না করছিল। শাহনাজ ছিল বিছানায় শোয়া। কীভাবে যে সে চেরাগের কুপির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল আগুন ধরার জন্য, মা কিছুই বুঝতে পারেনি। আর একটু হাত বাড়ালেই আগুনে হাত পুড়ত তার। কিন্তু তার আগেই দেখে ফেলে মা। ফলে রক্ষা পায়। শাহনাজ মোটেও বুঝতে পারল না যে, আগুন তার জন্য ক্ষতিকর। আর বাছুরটা! এটি এত বুদ্ধি পেল কোথায়?

কয়েকদিন পর হতে প্রতি রাত্রে এক গ্লাস করে দুধ পেতে লাগল মুন্না। মা-বাবাও পান করে। এমনকি বসুও এক গ্লাস পায়। বাকী গুলো বিক্রির হয়। বসু বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করে আসে সে দুধ। তাতে তাদের আর্থিক অবস্থা পরিবর্তন হতে লাগল। মা মুন্নাকে সুন্দর একটা সাইকেল কিনে দিল। এর জন্য মাকে সে দীর্ঘদিন যাবৎ বিরক্ত করে আসছিল। এখন সে শাঁ শাঁ করে সাইকেল চালায়। ধলি তাদের অনেক উপকার করে যাচ্ছে। এর বিনিময়ে নিচ্ছে কি? তার জন্য কোন পোশাক কিনতে হয় না। তাকে ঘাস ভুষি ছাড়া কোন খাবার খাওয়াতে হয়না। এটি দিয়ে চাষ করা হয়। এত উপকারী একটা প্রাণী। তাকে বেতনও দিতে হয়না। অন্যদিকে বসুকে সকাল দুপুর বিকাল ও রাত্রে খাবার দিতে হয়। মাসের শেষে বেতন দিতে হয়। দু’তিন মাস পর পর কাপড় দিতে হয়। এত কিছুর পরও বসু থাকতে চায়না। মাঝে মাঝে কোথায় চলে যায়।

মুন্না ভাবে আর ভাবে। ভাবতে ভাবতে তার চিন্তার খেই হারিয়ে যায়। সে কি যেন একটা উত্তর খোঁজে পেতে চায়। কিন্তু বুঝতে পারেনা তার প্রশ্নটা কি আর উত্তরটা কি?

বিদ্যালয়ে শিক্ষক কাশেম স্যার তাদেরকে বাড়ির কাজ দিয়েছিল গরুর রচনা। রাত্রে পড়তে বসে মুন্না দেখল, বইয়ের রচনাটি অসম্পূর্ণ। এখানে বলা হয়েছে গরু একটি গৃহপালিত জন্তু। এটির কিছু শারীরিক বর্ণনা আছে। এটির হাত, পা, কান,চোখ, দাঁত, লেজ ইত্যাদির বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এটি লেজের সাহায্যে মাছি তাড়ায়। এটি দিয়ে হাল চাষ হয়। গরুর দাঁত, হাড় দিয়ে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরি হয়।

: এটি একটি অসম্পূর্ণ রচনা ভাবল মুন্না। সে সিদ্ধান্ত নিল এমন অসম্পূর্ণ রচনা সে লিখবেনা। স্যারের খাতায় বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা সে লিখে দিয়ে আসবে। ছোট ধলির কাহিনীটাও বাদ দিবেনা রচনা হতে। স্যারের খাতায় একটা ফাটাফাটি গরুর রচনা লেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে কাহিনী সাজিয়ে ফেলল মুন্না। বিশেষ করে ছোট ধলির কাহিনীটা সাজাল। ওটি জন্মের পর হতে কীভাবে হাঁটতে পারে? কীভাবে নিজের খাবার দাবার চিনতে পারে? পানি দেখলে কেন ভয় পায়? শাহনাজ কেন এসবে ব্যর্থ? যে উত্তরগুলো পাবার জন্য মা তাকে বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে। সেভাবেই পরীক্ষার খাতায় কাহিনীটা বর্ণনা করেছে সে। খাতায় প্রশ্ন রেখেছে, গরু বাছুর জন্মের সাথে সাথে প্রচুর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হয়, চলাফেরার ব্যাপারে আত্মনির্ভশীলতা অর্জন করে, পনর মিনিট পরেই এটা দৌঁড়াতে পারে। কিন্তু মানব সন্তান তা পারেনা কেন? এতে প্রমাণিত হয় মানুষের চেয়ে গরু উত্তম প্রাণী। এ গরুর পক্ষাবলম্বন নিয়ে এক চরম বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো তাকে। স্যার সবার উত্তরপত্র গুলো বণ্টন করছিল। যখন মুন্নার পালা আসল তখন খুব রসিকতা করে বলল, এখন খাতা নিতে আসবে বিশিষ্ট গরু বিশারদ।

পুরো শ্রেণীকক্ষে হাসির রোল পড়ল। মুন্নাও হাসছিল। এরপর স্যার বলল, মুন্না, বিশিষ্ট গরু বিশারদ এদিকে এসো। তখন তার ইচ্ছা হলো মাটি ফেটে ভিতরে ঢুকে যেতে। কিন্তু তাতো সম্ভব না। তাই স্যারের কাছে তাকে যেতে হলো খাতা নেওয়ার জন্য। গরু নিয়ে তার গভীর পর্যবেক্ষণের ফলাফল তার জন্য হিতে বিপরীত হলো। তার উপাধি হলো গরু বিশারদ। ছেলেরা তাকে গরু বিশারদ বলে ক্ষেপাতে লাগল। এর কয়েকদিন পরেই ঘটল আরেকটি  মারাত্মক দুর্ঘটনা।

মুন্না অংকে বরাবরই কাঁচা। আনিছ স্যারের ঘন্টা চলছিল। স্যার একটা অংক কয়েকভাবে বুঝালেন। সবাই অংকটা বুঝল। কিন্তু মুন্না অংকটা আয়ত্ব করতে পারলনা। স্যার ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, তুমি একটা আস্ত গরু। ফলাফলটা হলো আরও মারাত্মক। মুন্নার উপাধি গরু বিশারদ থেকে হয়ে গেল গরু। এভাবে মুন্না সবার কাছে গরু হিসেবে পরিচিত পেল। এ এক মারাত্মক উপাধি। প্রতিটি মুহূর্তে বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। আড়াল হতে প্রায়শ গরু গরু চিৎকার ভেসে আসে তার কানে।

সে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে। দূর হতে কেউ একজন বলে উঠল, ঐতো গরু, গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছে। অন্য জন বলে উঠল, গাড়িতে যাবে কেন? গরুর গাড়ি নাই? কেউ কেউ আড়াল হতে চিৎকার দেয়, ‘গরু ভাই’। দুপুরে খেয়ে যখন বিদ্যালয়ে পৌঁছে, তখন বইয়ের ভিতর চিরকুট পাওয়া যায় ‘গরু ভাই’। আর কত সহ্য করা যায় অত্যাচারের মাত্রা। মাঝে মাঝে একলা হলে ঝর ঝর করে কেঁদে নিজেকে হালকা করার চেষ্টা করে সে। এ নিয়ে মাকে বলার চেষ্টা করে, কিন্তু বলতে গেলে  লজ্জা এসে তাকে ঘিরে ধরে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিল, এ শিক্ষালয়ে আর নয়। সে এমন এক দূরবর্তী বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, যেখানে এ দুর্গন্ধ পৌঁছার সুযোগ নাই। হঠাৎ করে মুন্নার এমন সিদ্ধান্তের কথা শুনে মা তো ভারি অবাক।

‘মুন্না, কেন তুমি এ পাঠশালা ত্যাগ করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছ?’ -মা প্রশ্ন করল।

‘মা, এখানকার লেখাপড়া ভাল না, ভাল জ্ঞান অর্জন করতে হলে ভাল প্রতিষ্ঠানে পড়তে হবে’

‘আমার মনে  হচ্ছে অন্য কোন কারণ আছে। তুমি আমাকে আসল কথা বল’

‘না, আমি এখানে পড়বনা। আমার একদম ভাল লাগেনা।’

‘কেন?’ -ঝাঁঝালো প্রশ্ন করল মা।

‘মা, আমি কি গরু? আমার কি চারটি পা, দুটি শিং, একটি লেজ আছে।’ -ক্রুদ্ধস্বরে বলল মুন্না।

মুন্না সব কথা খুলে বলল মাকে। বসু মুখ ফসকে বলল, ‘চাচী, ভাইয়া তো প্রায় বলে, ইশ, যদি গরু হতাম!’ মুন্নার হাতের কাছে ছিল একটা লাঠি। তা দিয়ে সে দৌড়াতে শুরু করল বসুকে।

সব শুনার পর বাবা বললেন ‘ঠিক আছে, আমার ছেলের ওখানে পড়া উচিত হবেনা।’

‘তুমি কেন এ বিদ্যালয় ত্যাগ করতে চাচ্ছ?’ জানতে চাইল প্রধান শিক্ষক (প্রশি)।

প্রশির প্রশ্ন শোনার পর কিছুক্ষণ নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকল মুন্না। তার বাবাও বাকরুদ্ধ। একসময় বাবার নয়নদ্বয় অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। বাবার চোখে অশ্রু দেখার পর নিজেকে আর সামলাতে পারলনা মুন্না। শিশুর মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তারা এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি যা মুখে ব্যক্ত করা যায় না। বাবার মুখ দিয়ে অনেকক্ষণ কোন কথা বের হল না। নীরবে মুন্নার দিকে তাকিয়ে রইল।  অবশেষে বাবা চোখ মুচে সব কথা খুলে বলল। আমার মুন্নাকে সবাই গরু ডাকে। আর এর জন্য দায়ী আনিছ স্যার ও কাশেম স্যার।

সব শুনে প্রশিও খুব বিব্রত বোধ করলেন। সে দু’শিকক্ষকে ততক্ষনাৎ তলব করল। কাশেম স্যারকে বলা হলো রচনাটি সহ আনার জন্য। প্রশি রচনাটি পড়ার পর বলল, মুন্না তুমি তো অসাধারণ রচনা লিখেছ। তুমি যদি তোমার কোন পরীক্ষায় রচনাটি লেখ, কোন জ্ঞানী শিক্ষক যদি তোমার নিরীক্ষক হয়, আমি নিশ্চিত সে তোমাকে দশে দশ মার্ক দিবে। আবার বলি, উক্ত শিক্ষককে অবশ্যই জ্ঞানী হতে হবে। প্রশির কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলল কাশেম স্যার। শিক্ষকের সাথে জ্ঞানী শব্দটা যোগ করে তাকে হেয় করছে প্রশি। প্রশি মুন্নাকে বলতে লাগল, তোমার মধ্যে আমি সৃজনশীলতা দেখতে পাচ্ছি। তুমি যদি এ সৃজনশীলতার ধারা ধরে রাখতে পার, আমি নিশ্চিত তুমি জীবনে অনেক উন্নতি করতে পারবে। এরপর প্রশি সব শিক্ষককে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসল। অনেকক্ষণ পর দরজা খুলে বেরিয়ে আসল সবাই। প্রশি ঘোষণা দিল, তোমার কোন ভয় নেই মুন্না। কেউ যদি তোমাকে বিব্রত করে তবে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। শুনে মুন্নাও তার আবেদনপত্র প্রত্যাহার করে নিল। মুন্নার বাবাও ভয়ংকর বিপদ থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

শাহনাজ হামাগুড়ি দিতে শিখেছে বলে মায়ের মধ্যে আনন্দের সাথে সাথে উদ্বেগও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাড়ি হতে অল্প দূরত্বে তাদের পারিবারিক পুকুর। ঐ পুকুরটাই তাদের সমস্ত উদ্বেগের কারণ। না জানি কখন দুর্ঘটনা ঘটে, সে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল সবার মনে। আতঙ্ক দূর করার জন্য বাড়ির সামনে ও পিছনে কাঠ দিয়ে খিল এঁটেঁ দিতে বাধ্য হয়েছে বাবা। শাহনাজকে নিয়ে শুধু একটা আতঙ্ক থাকলেই সারা যেত। হরেক রকমের আতঙ্ক তাদের মধ্যে ভর করে আছে। কখন আবার আগুনে হাত দেয়, কখন আবার মল খেয়ে ফেলে, কখন দা-চুরিতে হাত দিয়ে হাত পা কেটে পেলে, কখন খাট থেকে পড়ে যায়, কখন মুন্নার বই ছিঁড়ে পেলে, বাবার চশমাটা ভেঙে কাচ খেয়ে ফেলে, আরো কত রকমের আতঙ্ক তাদের হৃদয়ে ভরে আছে। কিন্তু বাছুরটা নিয়ে একটা আতঙ্ক। এটি যাতে মাতৃদুগ্ধ খেয়ে না ফেলে। এটি তা খাওয়া মানে মুন্নাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি। সে জন্য এটাকে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শতকরা হিসাবে আতঙ্কের পরিমাণ ১০০% বনাম ১০%। শুধু গরুর ক্ষেত্রে যে আতঙ্কমুক্ত তা নয়। বাড়ির হাঁসের পাচঁটা ডিম তা দিতে দিয়েছিল মুরগিটিকে। ডিম ফুটে বেরিয়ে আসল পাঁচটা ফুটফুটে ছানা। সে গুলো কি সুন্দর! নরম নরম পালক। শরীরে হাত বুলালে খুব আরাম লাগে। মুন্না ওগুলোকে আদর করছিল। ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। ওরা কেমনে বুঝতে পারল যে সামনে পুকুর আছে।  ছুটতে লাগল সেদিকে। মুন্নাতো ভয়ে অস্থির। ওরা যদি ডুবে মারা যায়। সে ওদের পথ আগলে রাখল। ওরা রাগে তাকে কামড় দিতে চায়। মা দৌড়ে আসে। বলে, মুন্না ওদের যেতে দাও। কিছু হবে না। মুন্না রেগে বলল, তাহলে শাহনাজের জন্য এত উদ্বেগ কেন? ও পুকুরে যাবে বলে, পুরো ঘর ঘিরে রেখেছেন কেন? শাহনাজ কি ওদের চেয়ে অধম।

‘ওটা ওদের স্বভাব। ওরা আজন্ম সাতাঁরো। তুমি ওদের পথ করে দাও।’ -মা অভয় দিল।

মুন্না ভয়ে ভয়ে পথ করে দিল। ছানাগুলো পানি দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে। ওরা মনের আনন্দে সাঁতার কাটতে লাগল শান্ত দিঘির বুকে। কি আশ্চর্য! ওরা এতো চমৎকার সাঁতার শিখলো কোত্থেকে? অথচ তাকে সাঁতার শেখার জন্য তিনমাস যাবৎ লড়াই করতে হচ্ছে। এখন একটু একটু সাঁতার কাটতে পারে। বেশিক্ষণ সাঁতার কাটলে পেটের মধ্যে পানি চালান হয়। সে জন্য পুকুরের মাঝখানে যেতে বললে তার বুক কেঁপে উঠে আতঙ্কে।

মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। সেদিন প্রধান শিক্ষক খুব গর্ব করে বলল সে কথা। স্যারের মুখে এ কথাটি শোনার পর হতে মুন্নার মনটা কেমন যেন উসখুস করতে লাগল। মুন্না বিষয়টি জানায় শিবলুকে। তার কাছে জানতে চায়, মানুষ কীভাবে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ?

‘তোর কী মনে হয়?’ জানতে চাইল শিবলু।

‘আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না যে, মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ।’

‘কীভাবে?’

‘শারীরিকভাবে বিচার করলে দেখা যায়, মানুষের শরীর অধিক অরক্ষিত। শারীরিকভাবে খুব দুর্বল। ফলে তার শরীরকে রক্ষা করতে তাকে ব্যয় করতে হয় কাড়ি কাড়ি টাকা। যা অন্য কোন প্রাণীর জন্য প্রযোজ্য নয়।’

‘ব্যাপারটা বুঝলাম না।’

‘না বুঝার কি আছে? এইতো সহজ হিসাব। আমাদের শরীরে শীতে গরম পোশাক, গরমে হাল্কা পোশাক, বর্ষায় মধ্যমানের পোশাকসহ বিভিন্ন প্রকারের পোশাক দরকার হয়। মানুষকে ঘামের দুর্গন্ধ হতে বাঁচতে সাবান দিয়ে গোসল করতে হয়। পাউডার, স্নো আরো কত কি ব্যবহার করতে হয়। গরুর এসব কিছুর দরকার হয়না। আমাদেরকে একবেলা আহার জোগাড় করতে গিয়ে কতই না কষ্ট করতে হয়। কিন্তু গরুর শুধু ঘাস হলেই চলে। গরু বাছুর জন্মের পর হতে হাঁটতে পারে, কিন্তু মানব শিশুর হাঁটা শিখতে লাগে এক বৎসরেরও বেশী। গরু কুল জন্মের সাথে সাথে সব কিছু বুঝতে পারে। তাদের জন্য কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ বুঝতে পারে। তাদের রোগ হয় কম, আর মানুষের কত রোগই না হয়। মানুষের চোখের জ্যোতি কমে যায় বলে চশমা ব্যবহার করতে হয়, ওদের তা দরকার হয়না।

‘সত্যিই তো। এতগুলো বিষয় আমি আগে খেয়াল করিনি। তুই গরু বিশেষজ্ঞতো তাই তোর পক্ষে এত চিন্তা করা সহজ। তবে তোর কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে গরুই সৃষ্টির সেরা। আচ্ছা এত কিছুর পরও কাউকে গরু বললে ক্ষেপে যায় কেন, দোস্ত?’

‘রাখ তোর পাজলামো। শুধু কি এখানেই শেষ। মানুষ মরলে তার কোন মূল্য নাই। লাশটা কবরে রাখা হয়। আর গরু মরলে এটির চামড়া, হাড়, দাঁত প্রভৃতি নানা কাজে লাগে।

‘আসলে আমাদের এ বিষয়ে স্যারের সাথে কথা বলা দরকার।’ -বলল শিবলু।

পরদিন প্রশির ঘন্টায় শিবলু তার কাছে জানতে চাইল, স্যার কে আশরাফুল মাখলুকাত, মানুষ না গরু?

‘হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন?’ -জানতে চাইল স্যার। উনি ভারি বোকা বনে গেছেন এ প্রশ্ন শুনে।

‘স্যার আমাদের কাছে এমন কতকগুলো প্রমাণ আছে, যাতে বুঝা যায়, মানুষ নয়, গরুই সৃষ্টির সেরা।’

‘যেমন?’

শিবলু গতকালের মুন্নার অংশটা বলার পর আরো যোগ করল, গরুর কোন কিছুই ফেলনা নয়। আর মানুষের মৃত্যু দূরে থাক, বৃদ্ধকালে পৌঁছলেই তাকে অন্যের গলগ্রহ হতে হয়। সে আরো বলত  কিন্তু মন্টু বলতে লাগল।

‘তাইতো সত্য। গরুর বিষ্টা পর্যন্ত ফেলনা নয়।’

স্যার বলল, ‘ঠিক আছে। তোমরা মানুষ আর গরুর পার্থক্যের উপর একটা রচনা লিখে আন। যে সর্বোচ্চ পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবে, তাকে আকর্ষণীয় পুরস্কার প্রদান করা হবে।’

বিকেলে বাড়ি ফিরে মুন্না ছুটল ধলির নিকট। হাতে খাতা ও কলম। আজ সে মানুষ ও গরুর মধ্যে অনেক গুলো পার্থক্য বের করবে। তার হৃদয়ে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। প্রশি তার গতকালের বক্তব্য ‘যেখানে সে মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বলেছিল’ তা হতে সরে এসেছে, তার যুক্তির কাছে হার মেনে। এ এক বিশাল সাফল্য। সে ধলিকে পর্যবেক্ষণ করছিল আর তার সাফল্য নিয়ে হাসছিল। এ সময় সেখানে এসে হাজির হলো বসু। বসু দূর হতে অনেকক্ষণ মুন্নাকে গোপনে লক্ষ্য করল। মুন্না নিজে নিজে হাসছে আর ধলিকে দেখে কি যেন লিখছে। গোয়াল ঘরে এসে এরকম কান্ড করা  মানে নিশ্চিত পাগলামি। বসু দৌড় দিল মুন্নার মায়ের কাছে। গিয়ে চিৎকার করে বলল, চাচী, আপনার মুন্না পাগল হয়ে গেছে। দেহে যান। শুনে মায়ের মনে হল, সে যেন বজ্রাহত হয়েছে। তার শরীর কাঁপতে শুরু করল। দাঁড়ানোর শক্তি হঠাৎ লোপ পেল। তবুও দৌড় দিল। সে দৌড়ে আসতে চাইলেও বসু থামিয়ে দিয়ে বলল, চাচী, এহান তেকে দেহেন। চাচী সেখানে দাঁড়িয়ে গেল। কিছুক্ষণ মুন্নাকে দেখে মনে করল, তার ছেলে সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। তাই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল মা। মুন্না পিছনে ফিরে দেখল, তার দিকে চেয়ে মা কাঁদছে। চিৎকার দিয়ে বলল, মা কী হয়েছে? কে মারা গেছে? মুন্না এভাবে কথা বললেও মায়ের কান্না থামল না। আরো বেড়ে গেল। মায়ের কাছে ছুটে আসল মুন্না। আবার বলল, মা কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?

‘বাবা, তোর কী কোন সমস্যা হয়েছে? তুই কী ঠিক আছিস?’ জানতে চাইল মা। মা মাঝে মাঝে মুন্নাকে তুই সম্বোধন করে কথা বলে।

‘কী বলতে চাচ্ছেন?’

মা মুন্নাকে জড়িয়ে ধরে। বাবা তোমার কোন সমস্যা হয়নি তো।

‘আমার সমস্যা মানে?’

‘বাইয়া, তুমিতো পাগল হইয়া গেচ।’ -বলল বসু।

‘কী? কী বললি?’

বসুর কথা শোনামাত্র মুন্নার রাগ চরমে উঠে গেল। সে দৌড় দিল গোয়াল ঘরের দিকে। এক মুঠো গোবর হাতে  নিয়ে তাকে আসতে দেখে বসু সেখান হতে উদাও। মুন্না ফিরে এসে দেখে, মা মাটিতে ফেলে দেওয়া খাতা ও কলম কুড়িয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

‘ওখানে খাতা কলম নিয়ে কী করতেছিলে, বাবা?’ -জানতে চাইল মা।

‘ও সে কথা। স্যার বলেছে, যে গরু ও মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ পার্থক্য বের করতে পারবে, তাকে আকর্ষণীয় পুরস্কার দেওয়া হবে। তাই আমি পার্থক্যগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করতে ছিলাম।’

‘কিন্তু হাসছিলে কেন?’

স্যার গতকাল বলেছিল, মানুষ সৃষ্টির সেরা। কিন্তু আমার যুক্তির কাছে হার মেনে আজ স্বীকার করল, মানুষ সৃষ্টির সেরা নয়। গরু সৃষ্টির সেরা। সেজন্য হাসছিলাম।

‘তোমার কী কী যুক্তি ছিল, আমাকে কী বলবে?’ মা বলল।

মুন্না তার সবগুলো যুক্তি মায়ের কাছে তুলে ধরল। মা হেসে বলল, তোমার ভুল হচ্ছে, বাবা।

‘কী ভুল?’

‘কী ভুল তা আমি তোমাকে বলবনা। তুমি যদি নিজেই খুঁঁজে বের করতে পার, তবে তোমাকে আমিও একটা আকর্ষণীয় পুরস্কার দিব।’

‘কিন্তু প্রশিতো এমন কথা বললনা।’

‘ওনার ইচ্ছা তুমি নিজের ভুল নিজেই ধরে নিবে, সেজন্য তোমাকে একদিন সময় দিল।

‘ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করব আমার ভুল ধরার জন্য।’ -মুন্না হাসল।

মা বুঝল মুন্নার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেনি। তাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বলল দেখ, তুমি তোমার ভুল ধরতে পার কিনা। মুন্না আবার ছুটল গোয়াল ঘরের দিকে।

রাতে পড়ার টেবিলে বসে মুন্না দেখল, মানুষ ও গরুর নানা পার্থক্যে তার খাতা ভরে গেছে। মুন্না সেগুলো একবার পড়ে নিল।

০১. মানুষের দুটি হাত আছে। গরুর কোন হাত নেই।

০২. গরুর চারটি পা আছে। মানুষের পা হলো দুটি।

০৩. গরু ঘাস খায় আর মানুষ খায় ভাত।

০৪. গরুর লেজ আছে। যা কোন মানুষের নেই।

০৫. গরুর সারা শরীরে চুল আছে। আর মানুষের চুল আছে শুধু মাথায়।

০৬. গরু কথা বলতে পারেনা। আমরা কথা বলতে পারি।

০৭. গরু জন্মের সাথে সাথে তাদের ভাল-মন্দ বুঝতে পারে, যা মানুষ পারেনা।

০৮. গরু মারা গেলে তার মাংস ছাড়াও সব কিছু কাজে আসে। কিন্তু মানুষ মারা গেলে কোন কিছুই কাজে আসেনা।

০৯. মানুষ গরু খায় কিন্তু গরু মানুষকে শিং মেরে আহত করে।

১০. গরুর দৃষ্টি শক্তির কোন সমস্যা হয় না, কিন্তু মানুষের দৃষ্টি শক্তির সমস্যা হয় বলে চশমা পরতে হয়।

১১. গরুকে পোশাক পরতে হয়না, মানুষকে পোশাক পরতে হয়।

১২. গরু নোংরা পরিবেশে থাকতে পারে, মানুষ থাকতে পারেনা।

১৩. গরু দিয়ে হালচাষ করা হয়, মানুষ গরুকে দিয়ে এ কাজ করায়।

১৪. অতীতে বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার জন্য মানুষের ভরসা ছিল গরুর গাড়ি।

১৫. মানুষ লেখাপড়া করে শিক্ষিত হওয়ার জন্য, গরুকে শিক্ষিত হতে হয়না।

১৬. গরু বিভিন্ন কাজ করে বলে বেতন দিতে হয়না, বেতন দিলেও মানুষ রাখা খুব কষ্টের।

১৭. মানুষ অন্ধকারে ভয় পায়, গরু ভয় পায়না।

১৮. গরু নিরামিষ ভোজি প্রাণি। মানুষ সর্বভুক প্রাণী।

১৯. গরুর দাঁত একপাটি, আর মানুষের দু’ পাটি।

২০. গরু অর্থনৈতিক জীব আর মানুষ সামাজিক জীব।

২১. গরু শরীরে বিভিন্ন স্থান নাড়াতে পারে, যা মানুষের পক্ষে অসম্ভব।

রাতে মা তার পার্থক্যগুলো পড়ার পর বলবে ‘বাহ, মুন্না চমৎকার রচনা হয়েছে। তারপরও আমার মনে হচ্ছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে উল্লেখ করা হয়নি।

‘মা, কি এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি এড়িয়ে যাচ্ছি, যা নিয়ে আপনি লুকোচুরি খেলছেন।’

‘তা তোমার প্রশির জন্য রেখে দিলাম।’ আর একটা কথা শুন বাবা, মানুষ আর গরুর পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য এভাবে খাতা কলম নিয়ে গোয়াল ঘরে ধরনা দিতে হয়না। কেন হয়না, তাও প্রশির কাছে জেনে নিও। আমি বললে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

মুন্না মাকে চেপে ধরল। মা আপনাকে বলতেই হবে। ওদিকে মাও কিছুতেই রাজি না। মুন্না মাকে জানিয়ে দিল, আপনি যদি এ রহস্য ফাঁস না করেন, তবে রাতে আমি কিছুই খাবনা। আপনি কান্নাকাটি  করলেও খাবনা। মুন্নার জেদ দেখে মা শেষ পর্যন্ত আপোষের পথে গেলেন। বললেন, ঠিক আছে, আমরা একটা মাঝামাঝি পর্যায়ে যেতে পারি। আমি তোমাকে গরু নিয়ে একটা চমৎকার গল্প বললে ভাত খাবে তো। তোমার যদি বুদ্ধি থাকে তুমি এখান হতে দুটি উত্তর পেয়ে যাবে। কিন্তু আমি একটা উত্তর ছাড়া অন্য উত্তরগুলো বলবনা।

‘মুন্না মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।’

বনি ইসরাঈল নামক একটা জাতি ছিল। তাদের নেতা নবী মুসা। একদিন ঐ গোত্রের এক লোক নিহত হলো। লোকটা ছিল খুব ধনী। সন্তান বলতে ছিল শুধু একটা মেয়ে। একদিন সকালে দেখা গেল ঐ লোকটা নিহত হয়েছে। তার লাশ পড়ে আছে মাঠে। কিন্তু খুনি কে কেউ শনাক্ত করতে পারলনা। তার ছিল এক ভ্রাতুষ্পুত্র। ঐ ভ্রাতুষ্পুত্রটি তার পিতৃব্য হত্যার বিচার চেয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে লাগল। শেষ পর্যন্ত ঐ বিচারটা আসল নবী মুসার কাছে। নবী মুসা বললেন, তোমরা যদি আল্লাহর নামে একটা গরু জবাই করে তার এক টুকরো মাংস দ্বারা ঐ মৃত ব্যক্তিকে আঘাত কর, তবে ঐ মৃত ব্যক্তি নিজেই খুনির নাম বলে দিবে। বনি ইসরাঈলিরা ছিল সাংঘাতিক একটা জাতি। তারা বলল, তুমি কী আমাদের সাথে মশকরা করছ?

মুসা বলল, আমি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই।

তারা বলল মুসা, তোমার প্রভুকে ডেকে বল, গরুটা  কেমন?

সে বলল, এটা বেশী বয়স্ক  হবেনা আবার বাছুরও হবেনা। দুয়ের মাঝামাঝি। তোমাদের যা বলা হয়েছে তা করে ফেল।

তারা বলল, তোমার প্রভুর কাছে জিজ্ঞাসা কর, এর রংটা কী রকম হবে।

মুসা বলল, এর রং হবে হলুদ। যা দেখে দর্শক আনন্দ পাবে।

তারা আবার বলল, মুসা তোমার প্রভুকে বল, আসলে গরু কেমন হবে? এ গরু নিয়ে আমাদের মাঝে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি ইচ্ছা করলে আমরা সঠিক পথ খুঁজে পাব।

মুসা বলল, এটা এমন হবে যে, তা কোন চাষাবাদ ও পানি সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়নি। এক কথায়, তা হবে নিখুঁত।

তারা বলল, তুমি এতক্ষণে সঠিক তথ্য নিয়ে এসেছ। তারপর তারা এমন গরুর খোঁজে ছড়িয়ে পড়ল। খুঁজতে খুঁজতে তারা এমন একটি গাভীর সন্ধান পেয়েছিল যা ক্রয় করতে গিয়ে তাদেরকে ঐ গাভীর ওজনে স্বর্ণ প্রদান করতে হয়েছিল। ওটার এক টুকরো মাংস দিয়ে মৃত ব্যক্তিকে আঘাত করা হলে, মৃত ব্যক্তিটি কিছুক্ষণের জন্য জীবিত হয়ে খুনির নাম বলা মাত্র আবার মারা গেল।

এ গল্পের মধ্যে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে। যেমন, বেশি বাড়াবাড়ি করার পরিণাম খুবই খারাপ । তারা বেশি বাড়াবাড়ি না করলে, যে কোন গরু জবাই  করলেই চলত। কিন্তু তা না করার ফলে, তাদেরকে চড়া দামে গরু কিনে কোরবানি দিতে হয়েছে। সুতরাং আমি চাই, আমার মুন্না বনি ইসরাঈলিদের মত বাড়াবাড়ি না করুক। মায়ের কথা শুনার পর বিনা বাক্য ব্যয়ে নৈশআহারে গেল মুন্না।

তোমরা এখানে যে সব বর্ণনা দিয়েছ, তা সবই শারীরিক। শারীরিক দিক হতে মানুষ খুবই অসহায় একটা প্রাণী। এতই অসহায় যে তাকে প্রতিনিয়ত নানা প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর তফাতের ক্ষেত্রটা শুধু শারীরিক নয়, বুদ্ধি ও বিবেকবৃত্তিক। এ বুদ্ধি ও বিবেকের  কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা। আবার আমরা যদি মানুষকে শুধু সৃষ্টির সেরা বলি, তাও ভুল। সৃষ্টির নিকৃষ্ট জীবও মানুষ। আমি আমার বক্তব্যে যাওয়ার আগে তোমাদের সবার লিখার সারাংশ উপস্থাপন করতে যাচ্ছি।———স্যার সবার বক্তব্যের সারাংশ উপস্থাপনের পর বলল, মানুষের সাথে গরুর আরো অনেক তফাত আছে। যে তফাত গুলোকে মানদন্ড হিসাবে ব্যবহার করে মানুষ হয়ত সৃষ্টির উৎকৃষ্টতম নয়ত সৃষ্টির নিকৃষ্টতম জীবে পরিণত হয়। যেমন ধর চুল। যা পশুর ক্ষেত্রে আমরা পশম বলে থাকি। এ চুল যদি অহংকার প্রকাশের কারণ হয়, এটা তোমার জন্য ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই নয়। আবার নোংরা ও উকুন ভর্তি চুল গুলো শারীরিক ক্ষতির কারণ। এবার ধর, জিহবা। এটার ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে বুঝা যায় কে ভদ্র আর কে অভদ্র মানুষ। এই জিহবা দ্বারা আমরা খাবার খাই আবার কথা বলি। এটা দিয়ে আমরা  গালিও দিতে পারি। আমরা যদি ভাল কথা বলি তবে আমরা সভ্য মানুষ আবার যদি খারাপ কথা বলি তবে আমাদের অবস্থানটা কোথায় চিন্তা করেছ? পৃথিবীর আর কোন জীব জন্তু গালি গালাজ করতে জানেনা। অর্থাৎ আমরা তখন  প্রাণীকুলের মধ্যে সব চেয়ে অধম প্রাণীতে পরিণত হই। আমরা হই আস্তাকুঁড়ের বাসিন্দা। গরুদের হাত নেই বলে যেমন ইচ্ছা তেমন কাজ করতে পারেনা। আমাদের হাত আমাদের ধ্বংস বা উন্নতির কারণ হতে পারে। এই হাতের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে তুমি আত্মউন্নয়ন, সমাজ উন্নয়ন বা বিশ্ব উন্নয়নে অপরিসীম অবদান রাখতে পার। আবার অপব্যবহার অর্থাৎ চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রাহাজানি, লুণ্ঠন, ঘুষ গ্রহণ, মারামারি প্রভৃতি অনৈতিক কাজের মাধ্যমে নিজ এবং সমাজকে কলুষিত করার মাধ্যমে মানুষের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হতে পার।

গরুর সাথে আমাদের যেটা মৌলিক ব্যবধান তা হলো বুদ্ধিবৃত্তি। তোমরা অনেকে বলেছ গরু জন্মের সাথে সাথে তাদের প্রয়োজনীয় ভাল-মন্দ গুলো বুঝতে পারে। তা ঠিক। কিন্তু এতটুকুতেই তার জ্ঞান সীমাবদ্ধ। এরপর হতে তার জ্ঞানের কোন বিকাশ ঘটেনা। মানুষের দোলনা হতে মৃত্যু পর্যন্ত জ্ঞানের বিকাশ ঘটানোর সুযোগ রয়েছে। মানুষের জ্ঞানের ব্যবহার মানুষকে মাপবার শ্রেষ্ঠতম মাপকাঠি। এ জ্ঞানের অপব্যবহার করে হিটলার ষাট লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছে। সে হয়েছে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মানুষ। পৃথিবীতে গরু ছাগলের জন্য কোন আইন আদালত নেই। আইন আদালত সব মানুষের জন্য। কেন? কখনো কি ভেবে দেখেছ? এভাবে চক্ষু, কান, পা তথা প্রত্যেকটি অঙ্গের সাথে মানুষের ভাল মন্দ জড়িত। এগুলোর সদ্ব্যবহার মানুষকে শ্রেষ্ঠতম মানুষে পরিণত করে আর এসব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের  খারাপ ব্যবহার মানুষকে নিকৃষ্টতম জীবে পরিণত করে। তোমরা যদি শারীরিকভাবে চিন্তা কর তবে দেখতে পাবে শারীরিক দিক দিয়ে  মানুষ এমন শত সহস্র অসুবিধার সমুনখীন হয়, যা অন্য কোন প্রাণীর সম্মুখীন হতে হয়না।  এককথায় বলা যায়, মানুষ সৃষ্টির সেরা শারীরিক কারণে নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক কারণে।

স্যার তার বক্তব্য শেষ করার পর আজকের রচনার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করল। দুর্ভাগ্য মুন্নার। তাকে পিছনে ফেলে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার জিতল শিবলু। স্যার মুন্নাকে বলল, তুমি যে তফাত গুলো লিখেছ সবগুলো শারীরিক। শারীরিক দিক হতে বিবেচনা করলে জলে তিমি আর স্থলে হাতি হত সৃষ্টির সেরা জীব। আর উভয়দিক হতে বিবেচনা করলে তিমিই হত সৃষ্টির সেরা জীব।

পুরস্কার না পাওয়ায় মুন্নার মন খুব খারাপ। তার সব রাগ গিয়ে পড়ল বসুর উপর। প্রশি মুন্নার কাছে জানতে চাইল, তুমি নিজের বিবেচনায় বল, তুমি পুরস্কার পাওনি কেন?

‘স্যার বসুর জন্য।’

‘বসু কে?’

‘ও আমাদের বাড়ির চাকর।’

‘ও আবার কি করল?’

‘গতকাল আমি যখন গোয়াল ঘরে গিয়ে গরু ও মানুষের তফাতগুলো দেখতে ছিলাম, ও তখন আমাকে বিরক্ত করছিল। আজ আমি তাকে দেখে নেব স্যার।’

‘কি? কি বললে?’

‘না, স্যার।’

শুন, তুমি এতক্ষণ ছিলে উৎকৃষ্ট মানব। যে মুহূর্তে তোমার মনের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা প্রকাশিত হলো, তখন হতে তুমি হয়ে গেলে সৃষ্টির নিকৃষ্টতম জীব। তোমার মধ্যে এখন পশুত্বের আনাগোনা! স্যারের কথা শুনার পর মুন্নার শরীর দিয়ে ঘাম বিচ্ছুরিত হতে লাগল দরদর করে।

‘তোমরা কী এখন বুঝতে পারলে, কখন মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত আর কখন সৃষ্টির নিকৃষ্টতম জীব?’ -জানতে চাইল প্রশি।

হ্যা, সমস্বরে জবাব দিল সবাই।

প্রশি দেখল মুন্নার চোখ দিয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ছে। তা দেখে সে এগিয়ে গেল তার দিকে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তুমি যখন তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ, এখন তুমি আবার সৃষ্টির সেরা জীবে পরিণত হয়েছ। শুনে মুন্নার চোখে ফুটে উঠল হাসির ঝিলিক। তখন প্রশি বলল, শুন তুমি কাশেম স্যারের জন্য যে রচনাটি লিখেছিলে, তাতে তোমার একটা প্রশ্ন ছিল, যার উত্তর তুমি খুঁজতেছিলে। আজ তুমি সে উত্তরটা পেয়ে গেলে। শেষ কথাটি বলি, মানুষ ও গরুর পার্থক্য নির্ণয়ের জন্য খাতা কলম নিয়ে গোয়াল ঘরে যাবার দরকার নাই। তোমার যদি যথাযথ জ্ঞান থাকে, তবে টেবিলে বসে এ পার্থক্যটুকু বুঝতে পারবে।

‘মুন্না মনে মনে বলল, মায়ের কাছে চাওয়া প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে গেলাম।’

এরপরই মুন্নার হতবাক হবার পালা। প্রশি তাকে জানাল, মুন্না কাশেম স্যারের জন্য তুমি যে গরুর রচনাটি লিখেছিলে তা উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ নিবার্চিত হয়েছে। শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠল সে।

বিকেলে বাড়ি ফিরে মুন্না জানতে পারল শাহনাজ আজ প্রথম মা বলে ডেকেছে। তাই মা দারুন উৎফুল্ল। তার চেহারা দিয়ে রাশি রাশি হাসি ঝরে ঝরে পড়ছে। মায়ের হাসি দেখে মুন্নাও দারুণ খুশি। সে মাকে তার পুরস্কার প্রাপ্তির কথা বলল। এতে মা আরো খুশি হলো। বাবা যখন সব শুনতে পেল তিনিও ভীষণ খুশি। বাবা ঘোষণা দিল, আজ রাত্রে দারুণ ভোজ হবে। রাত্রে সবাই খেতে বসেছে। এসময় আসল বসু। আজ সারা দিন সে ছিলনা। তাদের বাড়িতে গিয়েছিল। তাদের বাড়ি বেশি দূরে নয়। তার বাবা অন্যের জমি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের নুন আনতে পানতা পুরায় অবস্থা। সে জন্য বাধ্য হয়ে বসুকে এখানে কাজ করতে হয়। তবে বসু সবসময় ওখানে যায়না। আজ তার বাবা খবর দিয়েছে বলে গিয়েছিল। এখন ফিরে এসেছে। নানাপদের রান্না হয়েছে আজ। গরুর মাংস, ইলিশ মাছ, বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা, শাক, আরো আছে দই। মা বসুকে দেখে বলল, তাড়াতাড়ি এসে খেতে বস। আজ আমাদের ঘরে খুশি উপচে পড়ছে। আমার মেয়ে আজ আমাকে মা ডেকেছে, বলেই শাহনাজকে এগিয়ে দিল বসুর দিকে। শাহনাজকে কোলে নিয়ে বসু তাকাল মুন্নার দিকে। উদ্দেশ্য মুন্নার প্রতিক্রিয়া দেখা। শাহনাজকে বসুর কোলে দেখলেই মাথা ঘুরে যায় মুন্নার। না, আজ মুন্না নীরব। তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষ ও পশুর পার্থক্য সূত্র। মানুষের চরিত্রে পশুত্ব থাকলে সে মানুষ নিকৃষ্ট প্রাণীর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে যায়। রাগও একটি পশু প্রবৃত্তি। স্যার বলেছিল গরুর মত হলে সারা যায়। যাদের বুদ্ধি বিবেচনা কম, যারা কারো অনিষ্ট করেনা, ওরা বুদ্ধিগত দুর্বলতার কারণে গরুর সম গোত্রে পরিণত হয়। যারা অন্যের ক্ষতি করে, কারো প্রতি হিংসা বিদ্বেষ পোষণ করে, তারা গরুর চেয়ে নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়। আমি কেন গরুর চেয়ে নিকৃষ্ট হব? আমাকে উৎকৃষ্ট হতে হবে। বসুর প্রতি কোন বিদ্বেষ রাখা যাবেনা। মুন্না মনে মনে চিন্তা করছিল। আর তার দিকে তাকিয়ে ছিল মা, বাবা ও বসু। মুন্নার কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে বসু বলল, ভাইয়া কী আজ  বালো হয়ে গেচ? শুনে মা আবার হাসল। বলল, বসুর প্রতি আজ তুমি যে ব্যবহার করেছ, তাতে আমি খুব খুশি। বাবা বলল, তুমি যদি আজ বসুর প্রতি কোন খারাপ ব্যবহার করতে তবে তোমার জন্য একটা পুরস্কার এনেছিলাম তা বসুকে দিয়ে দিতাম।

বসু জানতে চাইল ‘হঠাৎ করে  ভাইয়াকে পুরস্কার কেন?’

‘তোমাকে তো এখনো সে কথা বলা হয়নি। আমার মুন্না রচনা প্রতিযোগিতায় সারা উপজেলার মধ্যে প্রথম হয়েছে। সে খুশিতে ওর আজ এই আয়োজন।

‘কি পুরস্কার এনেছ বাবা?’ জানতে চাইল মুন্না।

‘একটা নতুন জামা।’

‘বাবা আমার তো অনেক জামা আছে, আমি আমার পুরস্কারটা বসুকে দিয়ে দিলাম।’

শুনে খুব খুশি হল বাবা। বলল, এখন দেখছি আমার মুন্না মানুষ হচ্ছে।

মুন্না বসুকে বলল ভাইয়া, তুমি লেখাপড়া করনা কেন?

‘কি! আপনি আমাকে ভাই ডেকেছেন? আর্শ্চয হয়ে যায় বসু। সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এ যেন ভুতের মুখে রাম নাম। অনেকক্ষণ মুন্নার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে বসু।

ভাইয়া, তুমি জাননা, লেখা পড়া না করলে মানুষ ও পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকেনা।  যে লেখাপড়া জানেনা সে মূর্খ। গরুর মতই। তুমি মানুষ হয়ে গরু থাকবে কেন? চল আগামীকাল থেকে আমার সাথে বিদ্যালয়ে চল।

‘আলহামদুলিল্লাহ, আমার মুন্না তো মানুষ হচ্ছে।’ -বলল মা।

‘চাচী, মুন্না ভাই তো মানুষ, মানুষ আবার মানুষ হয় কীভাবে?’ -জানতে চাইল বসু।

‘এতদিন তোমার সাথে তার আচরণ দেখলে মনে হত, তার চেয়ে ধলি উত্তম। তোমার প্রতি তার ছিল প্রচন্ড হিংসা। হিংসা মানুষকে পশুর চেয়েও অধম করে ফেলে। এটা শয়তানের কুমন্ত্রনা। পশুত্ব। আজ তার মধ্যে মনুষ্যত্ব ফিরে এসেছে। সে এখন সত্যিকারের মানুষ। আগে ছিল মানুষরূপি পশু। তার এ মনুষ্যত্ব দেখে আমি খুব খুশি হলাম। এতক্ষণ আমার মধ্যে ছিল দুটি খুশি, এখন আরো একটি যোগ হয়ে আমার  মধ্যে তিনটি খুশি। একজন মায়ের জীবনে এ ধরনের খুশি খুব কমই আসে। আজ আমার কি যে ভাল লাগছে তা বুঝাতে পারবনা।

‘মা আপনি কী বসুকে বিদ্যালয়ে পাঠাবেন? জানতে চাইল মুন্না।’

‘বসু তুমি কী বিদ্যালয়ে যেতে চাও? বসুর কাছে জানতে চাইল মা।

‘হ্যা, চাচী আমার লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছা।’ -জবাব দিল বসু।

‘ঠিক আছে, তোমাকে আগামীকালই বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছি।’ -বলল আববু।

শুনে সবাই খুশি হল। শাহনাজও যেন এতে খুশি। সে খুব হাসছে।

মুন্না ও বসু হাটে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য বসুর জন্য বই কেনা। সে আগামীকাল হতে বিদ্যালয়ে যাবে। অজ্ঞানতার কালো চাদর সরিয়ে জ্ঞানের আলোর মখমলে চাদরে নিজেকে উদ্ভাসিত করতে চায় সে।  আজ রাত্রে চাচীর কাছে প্রথম পাঠ নিবে বসু। তার মধ্যে আনন্দ লহরী খেলে যাচ্ছে। তাকে পথ দেখাতে পারায় মুন্নাও খুশি। তারা গল্প করতে করতে এগুচ্ছিল। পথে প্রশির সাথে তাদের সাক্ষাৎ।

‘মুন্না কোথায় যাচ্ছ?’ জানতে চাইল প্রশি।

‘স্যার, বাজারে যাচ্ছি। বসুর জন্য বই কিনব।’

‘ও কে? বসু গত রাতে পাওয়া পোশাকটা পরেছে। তাকে চাকরের মত লাগছে না। তোমার ভাই না কি?’

‘ওই তো বসু।  আমার ভাই।

‘বসু, যার কথা তুমি আমার ঘন্টায় বলেছিলে। বসু, তোমার নামটা আগে মুন্নার কাছে শুনেছি। তোমার নামটা আমার স্মরণে আছে। বলল প্রশি।

‘স্যার ওকে আমাদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেব।’ -বলল মুন্না।

‘খুব ভালো কথা। মুন্না তুমি দেখছি শুধু নিজে মানুষ হচ্ছনা, সাথে বসুকেও মানুষ করার জন্য লড়াই শুরু করে দিয়েছ।’

‘স্যার আমাকে দোয়া করেন। যাতে আমি মানুষ হতে পারি।’ -বলল বসু।

‘অবশ্যই দোয়া। তুমি আগামীকালই মুন্নাকে নিয়ে আমার সাথে দেখা করবে। তোমাকে আমি ভর্তি করিয়ে দিব। কোন টাকা লাগবেনা। দেখি আমিও মানুষ হতে পারি কিনা।’ -হেসে উঠল প্রশি।

প্রশি চলে গেল। আনন্দে বসুর চোখ অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে গেছে। সে বুঝতে পেরেছে পৃথিবীতে এখনো অনেক ভালো মানুষ আছে। আর শিক্ষা মানুষকে মানুষ করে। লেখাপড়া না জানার কারণে এখনো সে মনুষ্যরূপি জন্তু। যে ধলির চেয়েও অধম। সুতরাং মানুষ হবার এ সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারানোর কোন অর্থই নেই। কিন্তু আমি পুরো শিক্ষা শেষ করতে পারবো তো? মনে মনে ভাবল বসু। যদি না পারি তবে সে হবে অর্ধেক মানুষ। অর্ধ মানুষ। অর্ধেক কাজ জীবনে কখনো সফলতা এনে দিতে পারেনা। অর্ধেক কাজ অর্ধেক ফলও প্রদান করেনা। তারা কথা বলতে বলতে সামনে এগুচ্ছিল। কিছু দূর যেতেই রনির সাথে তাদের সাক্ষাৎ। রনি বসুদের পাড়ার ছেলে। বসুর সমবয়সী। আবার মুন্নার সহপাঠি।

‘বস, তাড়াতাড়ি বাড়ি যা’—–ডাক দিল রনি।

‘কি হয়েছে?’ জানতে চাইল বসু।

‘তোদের বলদটার অবস্থা ভালো না। কি করবে তোর বাবা বুঝতে পারছে না।’ শুনে বসুর আর হাটে যাওয়া হলোনা। ওখান হতে মুন্নাকে ফিরিয়ে দিয়ে বাড়ির পথ ধরল সে।

এক সপ্তাহ পর বসু ফিরে এল। এর মধ্যে মুন্নার বাবা একবার গিয়ে দেখে এসেছিল তাকে। তাদের বলদটার অবস্থা খুবই খারাপ। বসুর বাবা ও বসু দুজনে মিলে বিভিন্ন গরু চিকিৎসকের  কাছে নিয়ে গেছে তাদের বলদটিকে। কিন্তু এটির অবস্থা উন্নতি হবে বলে মনে হচ্ছিলনা। এ অবস্থা দেখে মুন্নার আববা পরামর্শ দিলো, যেন অল্প সুস্থ হলে ওটাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এতে কিছুটা হলেও ক্ষতি পূরণ হবে।  বসু জানাল, এ উপদেশটা মেনে চলা হয়েছে। সেবা শুশ্রূষার ফলে ওটার অবস্থা কিছুটা উন্নতি হবার পর ওটা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এ কয়েকদিনে বসুর শরীরের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। তার চেহারা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তাকে চেনাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বসুর উপর দিয়ে যদি এ ঝড়টা আরো এক সপ্তাহ যেত, তবে তার অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি হত। বসুকে দেখে সবার চিনতে কষ্ট হলেও শাহনাজ তাকে ঠিকই চিনতে পারল। তার আওয়াজ শুনা মাত্র শাহনাজ তার কোলে ঝাপিয়ে পড়ল। শাহনাজ কখনো এভাবে মুন্নার কোলে ওঠেনি।

‘মা, শাহনাজ তো কখনো এভাবে আমার কোলে উঠেনা’—অনুযোগ করল মুন্না।

‘তোমার কোলে উঠবে কেন, বাবা? তুমি কি কখনো তাকে ঠিকমত কোলে নিয়েছ? উল্টো বসু কোলে নিলে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। তোমার ভয়ে শাহনাজকে সে তোমার সামনে কখনো কোলে নিতনা। অথচ, বসু তো সারাদিন শাহনাজকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।’

‘আমার বোন  কেমন শুকিয়ে গেছে।’ -বলল বসু।

‘তার কি হয়েছে বুঝতে পারছিনা, বসু। মা বলল। সে কিছুই খেতে চায়না। আমরা ডাক্তার দেখিয়েছি কিন্তু কোন পরিবর্তন আসছেনা। মা আরো যোগ করল, শুধু শাহনাজ কেন, ধলিকে দেখে এস। সে হাড়ে হাড়ে তোমার অনুপস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরেছে। ’

চাচীর মুখে এ কথা শোনার পর বসু ছুটল ধলির উদ্দেশে। হ্যাঁ, কয়েকদিনে অনেক শুকিয়ে গেছে ধলি। হয়ত কাঁচা ঘাসের অভাবে তার এ অবস্থা। তাই কাঁচা ঘাস সংগ্রহের জন্য ছুটল বসু।

এ কয়েকদিনে প্রশি বসুর কয়েকবার খোঁজখবর নিয়েছে মুন্নার কাছে। তার  আশঙ্কা ছিল, বসু হয়ত আর আসবেনা। কারণ বসুর মধ্যে একটা বন্যতা এসে গিয়েছে। শিক্ষা এমন একটা বিষয়, যা ছোট কাল হতে শুরু করাতে পারলে ভাল। না হলে ঐ ছেলেকে বিদ্যালয়মুখি করা খুব কষ্টের। কিন্তু প্রশির সে আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে ফিরে আসল বসু। তার মধ্যে মানুষ হবার দৃঢ় প্রত্যয় শিকড় গেড়েছে অনেক গভীর পর্যন্ত। যার মধ্যে মানুষ হবার গভীর বাসনা অঙ্কুরোদগম হয়, তাকে আর দমিয়ে রাখা যায়না। সে সর্বদা ছুটবে জ্ঞানের পথ ধরে। তার কাছে বয়সটা গৌণ হয়ে দাঁড়ায়। মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষা। পৃথিবীর কোন ব্যাকরণ  তার জন্য প্রযোজ্য হয়না। বসু এসে ভর্তি হলো তৃতীয় শ্রেণীতে। প্রশি বসুকে অভয় দিয়ে বলল, বসু তুমি যখনই কোন কিছু বুঝবেনা, আমার কাছে চলে আসবে। আমার দরজা তোমার জন্য সর্বদা খোলা। এমনকি তোমার যদি বিশেষ আর্থিক সহায়তার দরকার হয়, তাও ব্যবস্থা করবো। তোমার দায়িত্ব হলো পড়া। মুন্না বললো, স্যার আমি তাকে প্রতিদিন পড়াবো।

প্রশি উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো, মুন্না তুমি যদি তাই করো, তবে মানুষ হবার পথে তুমি আরো একধাপ এগিয়ে যাবে। তুমি হবে জাতি গড়ার কারিগরদের মধ্যে অন্যতম। আমি চাই, তুমি এ পথে এগিয়ে যাও।’ স্যারের মুখে এ কথা শোনার পর মুন্নার উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। সে বসুকে নিয়মিত তালিম দিতে লাগল। ফলে বসু লেখাপড়ায় দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগল। তার এ অগ্রগতি দেখে সবাই খুব খুশি। প্রশি সেদিন সবাইকে ডেকে মুন্নার সে অমর কৃতিত্বের কথা তুলে ধরে বলল, আমাদের প্রত্যেক ছাত্ররাই যদি একজন নিরক্ষর ব্যক্তিকে মানুষ করার দায়িত্ব নেয়, বাংলাদেশ থেকে নিরক্ষতার অন্ধকার তাড়াতে চার/পাঁচ বৎসরের বেশি সময় লাগবে বলে আমার মনে হয়না। আমাদের সমাজে তখন মনুষ্যরূপি গরু একটাও থাকবেনা। মুন্নার এ আদর্শ হোক আমাদের সবার জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

১০

পৃথিবীবাসি সুখ নামক একটা বস্ত্তর সন্ধানে ব্যস্ত সৃষ্টির প্রথম দিন হতে। সুখের খোঁজে মানুষের এ পথ চলা একদিনের জন্যও থেমে থাকেনি। সবাই সুখ চায়। কিন্তু ফলাফলে এটা প্রমাণিত যে, সুখ মরীচিকা ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা বিবি হাজেরার পানির খোঁজে সাফা ও মারওয়া পর্বতে দৌড়াদৌড়ির মত। মানুষ প্রতিবারই মরীচিকাকে পানি ভেবে আশায় বুক বেঁধে দৌড়ায়। একদিকে ব্যর্থ হওয়ার পর অন্যদিকে যায়। সেদিকে ব্যর্থ হওয়ার পর আবার এদিকে আসে। এ যে দৌড়াদৌড়ি এতেই মানুষ তৃপ্ত। যদি তৃপ্ত না হত, তবে আর কখনও দৌড়াতোনা। মরীচিকা জেনেও মানুষ দৌড়ায় সুখ নামক রত্নের খোঁজে। দৌড়তে দৌড়তে অনেকে হয়ত এক অাঁজলা পানি পায়। এ ক্ষুদ্র পাওয়াটাই অন্যের জন্য, বা নিজের সারা জীবনের জন্য সুখ স্মৃতি হিসেবে রক্ষিত হয়। এটাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু এ পাওয়াটা ক্ষণস্থায়ী। অনেকটা বুদবুদের মত। তাই তো মানুষের জীবন ঘিরে আছে প্রচুর ছন্দপতন। অর্থাৎ সুখ দুঃখ মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। না হলে তো এমন হবার কথা নয়। বসুর সাহচর্য পাবার পর ধলির কিছুটা স্বাস্থ্য ফিরে ফেলেও, সমস্ত সেবা শুশ্রূষাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ছোট ধলির অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে লাগল। ছোট ধলি কি রোগে আক্রান্ত হয়েছে বুঝা যাচ্ছেনা। কয়েকটা পশুডাক্তার পরিবর্তন করার পরও দেখা গেল ফলাফল শূন্য। মা-বাবা, মুন্না বসু সবাই বাছুরটাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। বসুর উদ্বেগটা আরো বেশী মনে হয়। ইতোমধ্যে সে বাড়িতে এ রকম একটা সমস্যা সমাধান করে এসেছে। এখানে এসে তাকে একই সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। দিন দিন কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে ছোট ধলি। খাওয়া দাওয়া মোটামোটি বন্ধ। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সেদিন ছোট ধলিকে পুকুরে নামাল বসু। নামাতে গিয়ে বসু আর মুন্নার ঘাম ঝরেছে। কিন্তু নামার পর মুন্নাকে অবাক করে দিয়ে বাছুরটা সাঁতার কেটে পুকুরটা পাড়ি দিল। এটা কীভাবে সম্ভব? গরুটার বয়স আর কত হবে? বড়জোড় দু’মাস। অবশ্য গরুটার কোন জন্ম তারিখ লিখে রাখা হয়নি। যেমনটি লিখে রাখা হয়েছে মুন্না ও শাহনাজের জন্য। গরু পানি দেখলে ভয় পায়, আবার পানিতে নামলে সাবলীল ভাবে সাঁতার কাটতে পারে। ভারী আশ্চর্য তো। তার মধ্যে পুরনো সূত্রটা মাথাছাড়া দিয়ে উঠল। সে আবার জন্ম পরবর্তী জ্ঞান নিয়ে ভাবতে লাগলো। সে এতদিন সাঁতার শিখার পরও তার মধ্যে পূর্ণতা আসেনি। ছোট ধলি এত পূর্ণ জ্ঞান পেল কোত্থেকে?  মানুষ শিখে শিখে গরুর সমকক্ষ জ্ঞান অর্জন করে, সুতরাং গরু মানুষের চেয়ে উত্তম না হয়ে পারেনা।

সব শুনে মা বলল, তোমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল মুন্না। দেখ ছোট শিশুরা পানিতে পড়লে মারা যাচ্ছে। আবার তোমাকে সাঁতার শিখতে গিয়ে ৭/৮ বৎসর অপেক্ষা করতে হচ্ছে, এটা ঠিক। কিন্তু গরুর শেখা আর তোমার শেখার মধ্যে একটা মৌলিক তফাত আছে। তাদের সহজাত জ্ঞানটা এতটুকুতেই শেষ। আর তুমি যদি সাঁতার শেখার মধ্যে উৎকর্ষতা অর্জন করতে পার, তবে তুমি সাঁতার কেটে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে পারবে। আবার তোমার শিক্ষার মধ্যে পরিপূর্ণতা থাকলে তবে তুমি বিভিন্ন সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে। যা গরুর পক্ষে সম্ভব না। তুমি কত রকমের যে সাঁতার কাটতে পারবে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু গরুর সাঁতার শুধু এক রকমের। যা তার সহজাত জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত।

যে সহজাত জ্ঞানের জন্য তুমি মানুষ অপেক্ষা গরুকে শ্রেষ্ঠ বলছ, মানুষের মধ্যেও সে সহজাত জ্ঞান আছে। চোখের দিকে ধুলি বালি কিছু আসতেই, তুমি কোন কিছু চিন্তা না করে চক্ষু বন্ধ করে পেল। ভয় পেলে কোন কিছু চিন্তা করার আগে দৌড় দিচ্ছ, খুশিতে হেসে উঠছ, এগুলোও মানুষের সহজাত জ্ঞান। আবার দেখ যে শিশুটা কিছুই বুঝেনা, সে মায়ের কোলে গিয়ে তার কান্না বন্ধ করে হেসে দিচ্ছে। এগুলোকে উপেক্ষা করার সুযোগ নাই। আল্লাহ প্রাণীদেরকে সহজাত জ্ঞান বেশী দিয়েছেন আর মানুষদেরকে কম দিয়েছেন।

‘মানুষের ক্ষেত্রে কেন এরকম হবে?’ -জানতে চাইল মুন্না

‘কারণ মানুষকে সৃষ্টির সেরা হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাকে দেওয়া হয়েছে বিবেক বিবেচনা। সে বিবেক বুদ্ধি প্রয়োগ করে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করুক, এটাই প্রভুর ইচ্ছা।’ -জবাব দিল মা।

‘মা, মানুষ খারাপ বলেই মানুষের জন্য আইন  আদালত দরকার হয়, কারণ মানুষেরা নানা রকম নোংরা কাজ করে, কিন্তু গরু নোংরা ময়লার মধ্যে থাকলেও কোন নোংরা কাজ করেনা। তাই তার জন্য আইন আদালত দরকার হয়না।’ -বলল মুন্না।

‘এটাও তোমার ভুল ধারণা, মুন্না। মানুষের তার বুদ্ধি বিবেক ব্যবহারের উপর স্বাধীনতা আছে। সে ইচ্ছা করলে তার বুদ্ধি ব্যবহার করে ভাল কাজ করতে পারে আবার ইচ্ছা করলে বুদ্ধি ব্যবহার করে খারাপ কাজ করতে পারে। মানুষ খারাপ কাজ করুক এটা সমাজ চায়না। আবার একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের হাতে নির্যাতিত হোক, তাও সমাজের কাম্য নয়। সে জন্যই এই আইন আদালত। তাছাড়া, মানুষের অনন্ত সম্ভাবনা আছে। সে সম্ভাবনাময় মানুষের কোন ক্ষতি হোক তাও সমাজ চায়না। তাই তো সে অন্যায়ের স্বীকার হলে সমাজ এগিয়ে আসে প্রতিকার করার জন্য। পক্ষান্তরে গরুদের কোন সম্ভাবনা নাই। তাদের সম্ভাবনা হলো শরীর বেশি মোটা তাজা হলে, মালিক বেশি দাম পাবে। ওরা পৃথিবীর উপকারের জন্য কোন কিছু সৃষ্টি করেনি। করতে পারবেও না। ওদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের জন্য। ওরা শেষ পর্যন্ত মানুষের খাদ্যে পরিণত হয়। তুমি কি খেয়াল করে দেখেছ, একজন মানুষ মারা গেলে বা একজন মানুষ নিহত হলে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে। পুরো এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। কিন্তু কোরবানির দিন লক্ষ লক্ষ গরু মারা হলেও কোন চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়না। কেন? এটা তোমার ভেবে দেখা উচিত।

‘গরু মারা গেলেও একটা দাম থাকে, কিন্তু মরা মানুষের কোন দাম নাই। এতে কি বুঝা যায়না, গরু  সৃষ্টির সেরা?’ -আবার প্রশ্ন করল মুন্না।

‘মানুষের শরীর পবিত্র বলেই যেখানে সেখানে তা ফেলে রাখা যায়না। তার অসম্মান করা যায়না। তাই তো মৃত্যুর পর মানুষকে কবরস্ত করা হয়। এমনকি জীবিত মানুষগুলো চেষ্টা করে মৃত মানুষটা যেন সামান্যতমও কষ্ট না পায়।’

‘মা, স্যার বলেছিল, গরু ছাগলের জন্য কেন আইন আদালত নাই তা ভেবে দেখার জন্য, আমি যখনই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতাম, আমার মনে হতো, গরু উত্তম বলেই গরুর জন্য কোন আইন আদালত নেই।’

‘এখন আশা করি সঠিক উত্তরটা পেয়েছ।’ -বলল মা।

শাহনাজের অসুখটা কিছুতেই ভাল হচ্ছিলনা বলে মা বাবার মধ্যে উদ্বেগ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। একদিকে শাহনাজ অন্যদিকে ছোট ধলি। ফলে মুন্নাদের পারিবারিক অবস্থা ক্রমশ তথৈবচ আকার ধারণ করছে। সে রাত্রে শাহনাজের অবস্থা আরো খারাপ হলো। সে মা মা কান্না করতে করতে পুরো ঘর ব্যাকুল করে তুলল। কেন এমন করছে শাহনাজ? এদিকে বাবাও বাড়িতে নেই। দুদিন হলো শহরে গেছে। ছোট ধলির জন্য একটা ভাল পশু চিকিৎসকের খোঁজে সেখানে গেছে বাবা। শাহনাজের অবস্থা বেগতিক দেখে মুন্না ও বসুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল মা। ডাক্তারের পরামর্শ  অনুযায়ী শাহনাজকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়া হল। মুন্না হাসপাতালে বসে বসে ছোট ধলির কথা চিন্তা করতে লাগল। মা ছোট ধলির কথা বিলকুল ভুলে গেছে। মাকে স্মরণ করে দেয়া দরকার। এতগুলো মানুষের সামনে মুন্না লজ্জায় কিছু বলতে পারলনা মাকে। মুন্নার একটু ঘুম ঘুম ভাব এলে একটা খালি সিটে শুয়ে পড়ল। পাশে বসু। গভীর রাত্রে তার ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখল, মা  পাথরের মত বসে আছে শাহনাজের পাশে। মা একটুও ঘুমায়নি। তার মধ্যে ঘুমের কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছেনা। মুন্নার মনে পড়ল ছোট ধলির কথা। চারিদিকে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। মুন্না মায়ের কাছে গিয়ে বলল, মা বসুকে বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। না হলে ছোট ধলির বেশী ক্ষতি হতে পারে।

‘না—-মা অনেকটা চিৎকার করে বলল, শাহনাজের অসুখ বেশী। বসুকে এখানে দরকার।’

‘চাচী, এখানে মুন্না থাকুক, আমি বাড়ি যাই।’ -বসু বলল।

‘বললাম তো দরকার নেই। এ রকম শত শত ধলি মারা যাক, তাতে আমার কিছু আসে যায়না। কিন্তু শাহনাজের সামান্য ক্ষতি হলে আমি পৃথিবীতে বাঁচবনা।’ -জবাব দিল মা।

‘মা ছোট ধলি মারা গেলে আমাদের ক্ষতি হবে তো।’ -বলল মুন্না।

‘ঐ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দুদিনও লাগবেনা।’ -মা বলল।

‘মা একি বলছ? -বলল মুন্না।’

‘আর একটা কথা বলেও আমাকে বিরক্ত করবিনা।’ -রূঢ় কণ্ঠে জবাব দিল মা।

মুন্না আর কোন কথা বলল না। ঘুমাতে চলে গেল। শেষ রাত্রের দিকে ঘুম ভাঙ্গলে দেখল বাবাও হাসপাতালে এসে গেছে। তাদেরকে আরও চারদিন হাসপাতালে থাকতে হল। এ চারদিনে একটি বারের জন্যও বাড়িতে যায়নি মা। বাবা দোকান থেকে খাবার এনে দিয়েছে। মা তাই খেয়েছে এখানে বসে। মুন্না মাঝে মাঝে বাড়ি গিয়েছে। কিন্তু সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করে আবার ফিরে এসেছে হাসপাতালে। বসু বাড়িতে গিয়ে নিয়মিত  গরুগুলোর যত্ন করেছে। সন্ধ্যা হলে সেও হাসপাতালে এসে রাত্রি যাপন করেছে। তারা রাত্রে কখনো বেড না পেলে, মেঝেতে ঘুমিয়েছে। চতুর্থদিন সকালে বাবা এসে জানাল, ছোট ধলি মারা গেছে। খবরটা শুনে মুন্নার মনটা বিষণ্ণতায় ভরে উঠলেও মায়ের মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেলনা। পরে বসু বাড়ি গিয়ে লাশ খালে ফেলে আসলো। এর দু’দিন পর শাহনাজ ছাড়া পেল হাসপাতাল হতে।

১১

এক সপ্তাহ পর মুন্না ও বসু বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। তারা একটু আগে ভাগেই ঘর হতে বের হয়েছে। কারণ মুন্নার ইচ্ছা ছোট ধলির লাশটা দেখা। তারা খুবই চিন্তিত। কিন্তু উপায় ছিলনা বলে তাদেরকে অনুপস্থিত থাকতে হয়েছে। শাহনাজের অসুখ তাদেরকে বিদ্যালয় গমন হতে নিভৃত রেখেছে। বাবা দু’জনকে দুটি ছুটির দরখাস্ত লিখে দিয়েছে। মুন্না ভাবছিল, এই কয়দিন বিদ্যালয়ে না যাওয়াতে তারা অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এই ক্ষতি সহজে পূরণ হবার নয়।  কিছুদূর যাওয়ার পর বসু বলল, ভাইয়া ওদিকে চল। ওখানেই ছোট ধলির মৃতদেহ ফেলে ছিলাম। হাতে ইশারা করে দেখিয়ে দিল বসু। সে আরো বলল, দেখো ভাইয়া, আকাশে অনেক শকুন উড়ছে। নিশ্চয় ঐ পচা লাশটা খাওয়ার জন্য ওরা উড়াউড়ি করছে। মুন্না আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে একঝাঁক শকুন আকাশে উড়ছে। তারা হাঁটতে হাঁটতে খালের নিকট পৌছে দেখল, একটা পচা মরা গরু পড়ে আছে। শরীরের উপর কোন চামড়া নেই। ওখানে পোকা কিলবিল করছে। তারা সেখানে পৌঁছার পর আরো দুটি শকুন আকাশে উড়াল দিল। দুটো কুকুর মাংস নিয়ে টানাটানি করছে। একটু দূরে কয়েকটা কাক মাংসের লোভে বসে আছে।

‘এ অবস্থা কেন, ওটার?’ -জানতে চাইল মুন্না।

‘কসাইরা চামড়া তুলে নিয়ে গেছে।’ -জবাব দিল বসু।

দৃশ্যটা খুব বিদঘুটে মনে হলো মুন্নার। ফলে ওখানে বেশী অপেক্ষা না করে তারা বিদ্যালয়ের পথ ধরল। কিছুদূর যাওয়ার পর, তাদের কানে দু’জন টোকাই ছেলের কথা ভেসে আসলো। তারা ওটার হাড়গুলো কুড়িয়ে দোকানে বিক্রি করার ব্যাপারে আলোচনা করছে।

‘এই তো পশু জীবন।’ -মুন্না মনে মনে বললো। তার মধ্যে মানুষ ও পশুর তফাতটা আজ জলের মতই স্বচ্ছভাবে ধরা পড়েছে। সে বুঝতে পেরেছে মারা গেলে কেন মানুষকে কবর দেওয়া হয়।

প্রশির কক্ষ। ছুটির দরখাস্ত নিয়ে ওখানে প্রবেশ করল মুন্না ও বসু। প্রশি জানতে চাইল, মুন্না এতদিন বিদ্যালয়ে আসনি কেন? ’

মুন্না সব ঘটনা খুলে বলল।

প্রশি তাদের ছুটির আবেদন মঞ্জুর করলেন। জানতে চাইল, তোমরা দু’জন খালের ধারে দাঁড়িয়ে কী করছিলে?

‘আমাদের বাছুরটা মারা গিয়েছে। ওটার লাশ দেখতে গিয়েছিলাম।’ -জবাব দিল মুন্না।

‘দেখছ তো লাশটার অবস্থা’ -বলল প্রশি। এটাই ওদের শেষ পরিণতি। ওরা তো আর মানুষ নয় যে, লাশটা খুব সম্মানের সাথে দাফন করা হবে। এখানেই প্রমাণিত হয়, মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!