ভাঙা কপাল—– আহসান সাইয়েদ

আনোয়ারের মা জাল বুনছিল। পেছন থেকে হঠাৎ ছেলের ডাক শুনে চমকে উঠে ফিরে তাকায়। না চাইতে পাওয়ার এক দুর্লভ আনন্দের আলো তার সারামুখে ছড়িয়ে পড়ে। নানা কষ্টের অভিজ্ঞতার চিহ্ন অাঁকা মুখে অকৃত্রিম হাসি দেখে আনোয়ারের ভাল লাগে। ঝুঁকে পড়ে মাকে সালাম করে। মা আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে ছেলেকে একটুখানি জড়িয়ে ধরে চিৎকার করতে লাগলেন-ঃ

দিলরুবা, দিলরুবা……

দেখ কে এসেছে!

দিলরুবা আনোয়ারের মেঝ বোন। বিয়ে হয়েছে প্রায় সাত বছর আগে। নাইয়র এসেছে। আনোয়ার খুশী হল। দিলরুবা আসলে সালাম করল। মা দিলরুবার দিকে তাকিয়ে বলে- তোর আশা পূরণ হয়েছে। একটি অনুচ্চ দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে দিলরুবা বলে, কতদিন ধরে দেখি না। ভালই হল তুই এসেছিস, বলেই তার ছেলেমেয়ের নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে- আফরোজা, রকীব তোর মেঝ মামা এসেছে। এরপর কাপড় ছাড়তে ছাড়তে আনোয়ার বারবার পশ্চিমের কামরার পর্দার দিকে তাকাচ্ছিল। পশ্চিমের জানালা দিয়ে বয়ে আসা বাতাসে পর্দাটা একটু একটু দুলছে। তবে পর্দার দুলুনি তার লক্ষ্য নয়। বরং সে ভাবছে অভ্যন্তরে যে একজন আছে তার নড়াচড়ার আলামত দেখতে পাচ্ছেনা কেন? অন্যরকম এতক্ষণে ভেতর থেকে ভেসে আসত একটি সুন্দর লজ্জা লজ্জা ভাবের স্নেহমাখা একটি স্বর। স্বরটি তার ভাবির। ভাবি বলতেন- মেঝভাই, আস্সালামু আলাইকুম।

মাকে জিজ্ঞেস করে মা ভাবি নেই?

না বাপের বাড়ি গেছে। সাথে আরও যোগ করেন- ওদের কি, যেমন ইচ্ছে তেমন চলে। তারপর আনোয়ারের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করেন,ঃ

কিন্তু তুই কেমন করে এলি? তোর পরীক্ষা না?ঃ

না মা, পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে। মার চোখে অবাক চাহনি।ঃ

বলিস কি, আবার বন্ধ হয়ে গেছে?ঃ

হ্যাঁ মা, আবার মার্শাল ল’ দিয়েছে, ‘হ্যাঁ না’ ভোট হবে। এজন্য দেশের সকল ইউনিভার্সিটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।ঃ

ছেলেরা এর বিরুদ্ধে কিছু করে না?ঃ

করে না মানে, আন্দোলন করতে গিয়ে কতজন মরেছে। মার স্বরটা নরম হয়ে আসে- তবুও সরকার শুনে না? এখন তোদের পরীক্ষা কবে হবে?ঃ

কি জানি আরও মাস কয়েক লাগতে পারে। কথাটা শুনে মা কি একটা বলতে চেয়েছিলেন। কি মনে করে আবার কথা ঘুরিয়ে ফেললেন। রান্নাঘরের দিকে চেয়ে বড় গলায় বললেন-ঃ

কই, একটু শরবৎ হলো না এখনও?

মার মুখে এক ধরনের বিষাদের রেখা ফুটে উঠতে দেখে আনোয়ার। তার মার হৃদয় ফুঁড়ে যে কথাটি বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল তা যেন সহসা বুঝে ফেলে- মা নিশ্চয় তার খরচের কথা চিন্তা করছে। হয়তো মনে মনে হিসেব করে ফেলেছিলেন আনোয়ারকে আর টাকা দিতে হবে না। পরীক্ষার পর বরং সেই দেবে। এমন কি সে চাকরি করলে ঘরের কোন দিকে কত খরচ করবে তার একটা তালিকা তৈরি করে ফেলাটাও তার মা’র জন্য বিচিত্র নয়।

শরবৎ খেতে খেতে দরজার কব্জাতে টাঙ্গানো জালটার দিকে নজর গেল আনোয়ারের। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে সে, মা জাল বুনে। একটা জাল বুনে দিলে কতইবা পায় আর। তবুও সামান্য ক’টা টাকাও মা’র কাছে অনেক। আনোয়ারের হৃদয়টা হাহাকার করে উঠে। সে যেন স্পষ্ট দেখতে পায়-তার শরীরের উপর দিয়ে দুঃখ ও অনুতাপের স্রোতধারা কলকল করে বয়ে চলছে অবিরাম। এখন মার বয়স হয়েছে। অসুখে অসুখে নিঃশেষ হয়েছে শক্তি। তারপরও জাল…। জালের ছিদ্রগুলোকে সহসা তার ভাঙা কপালের এলোপাথাড়ি ছিদ্র বলে মনে হয়। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। মনের ঝড় কাউকে বুঝতে দেয় না।

অসময়ে আনোয়ারকে দেখে বিস্মিত হলেন তার বাবাও। খুশীতে উজ্জ্বল দাঁতবিহীন মাড়ি দেখিয়ে এমনভাবে হাসলেন যে, সে হাসির প্রতিটি কম্পনে আনোয়ার তার বাবার অফুরান বাৎসল্য অনুভব করে। রাতে খেতে বসে বাবা আনোয়ারের পাতে এটা-সেটা তুলে দিচ্ছন, মাও পাশে বসে। এক টুকরো গোশত তারপর বাবার দিকে চেয়ে বলেন- গোশতগুলো বহুতদিন খেলাম, বরকত হয়েছে।

খাওয়া শেষে বাইরে এসে দাঁড়ায় আনোয়ার। উঠোনে চাঁদের আলো। কাঁঠাল গাছের পাতার ফাঁক গলে পড়া চাঁদের আলো ছোট রাস্তায় আলো-অাঁধারির আলপনা এঁকেছে। সেই আলপনায় পা রাখল আনোয়ার। আহ! কতদিন হয় এমন চাঁদনী রাত দেখে না সে। ফুরফুরে হাওয়ার কেমন ঠান্ডা আমেজ। জুলফির উপরে একটু একটু কাঁপছে চুল। চারদিকে নীরবতা। কী এক মায়াময় পরিবেশ তাকে আচ্ছন্ন করল। এ যেন শহুরে মেহমান পেয়ে প্রকৃতি তার সমস্ত আদর উপচে দিয়েছে। একটু দাঁড়িয়ে সৃষ্টির অফুরান দীপ্তি খানিকটা আহরণ করে নেয় সে। পাড়ায় ক’জন সঙ্গী আছে তার। এ মুহূর্তে তাকে পেলে ভীষণ খুশী হবে ওরা। আনোয়ার কাঁঠাল গাছের ফাঁকে ফাঁকে আলো-ছায়াঘেরা পথে পা বাড়ায়। হঠাৎ তার মনে হল- একঘেঁয়ে শহুরে জীবনে প্রচন্ডভাবে হাঁপিয়ে উঠা তার বিক্ষুব্ধ হৃদয় এমনই এক মুক্তির জন্য ভীষণ অস্থির ছিল। আজ তা পেয়ে আনন্দে উদ্বেল হয়ে হলুদ পাখির মত উড়ে যেতে চাইছে। মনে মনে বলেন- খুব ফূর্তিতে কাটানো যাবে ছুটিটা।

সত্যি সত্যি ক’দিন বেশ ফূর্তিতে কেটেছে আনোয়ারের। তবে সব আনন্দই বাইরে। ঘরে ঢুকলেই কেমন যেন লাগে তার। মা’র চেহারা রুক্ষ। মরা মাছের মত ফ্যাকাশে বাবার চেহারা। ঘরের চারদিকে একটা হাহাকার ভাব। ক্রমশ তার মন আচ্ছন্ন হয়ে যায়। হঠাৎ সে যেন দেখতে পায় ঘরের চারদিকে অসংখ্য ছিদ্র। সেই ছিদ্র থেকে বেরিয়ে আসছে কালো কালো সাপ। হিস হিস শব্দ। আনোয়ারের কানে আঘাত খেয়ে সর্বাঙ্গে মিশে যাচ্ছে সেই শব্দ। সে এলোমেলো হয়ে যায়।

শুধু নিজ বাড়িতে নয়, পাড়ার আরও ক’জনের বাড়ির অভিজ্ঞতাও তাকে ভীষণ ভাবিয়ে তোলে। যেখানে ক’দিন আগেও সে দেখেছে স্বাচ্ছন্দপূর্ণ ঘরবাড়ি, সেখানে আজ শুধু অভাব অভাব। একখন্ড ভয়াল মেঘ যেন বিশাল পাখনা মেলে ক্রমে অন্ধকার করে দিচ্ছে পুরো গ্রামটাকে। ভাত না হয় নাই জুটল, পানিও জুটবে না? তৃষ্ণায় মারা পড়ব নাকি, সারা পাড়ার অনেকগুলো টিউবওয়েলের মধ্যে মাত্র দুটি থেকে একটু একটু পানি পড়ে। পুকুর শুকিয়ে মাঠ। জলশূন্য ডলুখাল গতি হারিয়ে এলিয়ে দিয়েছে গা। দুঃখের আতিশয্যে কিংবা সত্যিকারের ভয়ে তার বাবা সেদিন বলেছিলেন, না জানি আমাদেরকে আবার সেই কারবালার মত ‘পানি’ ‘পানি’ করতে হয়। সব ভাবনার অতল থেকে একটি কথাই আনোয়ারের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে হায় নদীমাতৃক বাংলাদেশ!

সেদিন রাতে খুব খিদে পেল আনোয়ারের। মাগরিবের নামায পড়েই রান্নাঘরের দিকে আসে সে, দেখে তার মেঝ মা ও বোন ও রান্না করছে। সে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে বলে- মা, আজ কি রান্না হচ্ছে? তার মা পাকঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন- পরীক্ষা চলছে, পরীক্ষা। তোর বাবা বেশী নেক্কার মানুষতো, তাই অভাব দিয়ে আল্লাহ্ পরীক্ষা করছেন। বেগুন ছাড়া আজ আর কিছু নেই!

কিছু না বলেই আনোয়ার নিজের কামরায় চলে এল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বাতি না জ্বালিয়ে অন্ধকারে পড়ে থাকল। চাঁদের এক টুকরো আলো জানালা দিয়ে ঘনিষ্ঠ সহচরের মত তার পাশে শুয়ে পড়েছে। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না আনোয়ার। আকাশের দিকে তাকায়। শুভ্র থালার মত চাঁদটি অদ্ভুত এক সম্মোহনে তার দিকে চেয়ে আছে। আনোয়ার চোখ ফিরিয়ে নেয়। কেমন জানি লাগছে তার। একেকবার মনে হচ্ছে হৃদয়প্রান্তরে কোথাকার ঝড়ো হওয়া প্রবল বেগে বয়ে যাচ্ছে বার বার। মনের সূক্ষ্ম তন্ত্রীতে আঘাত লাগছে তার। এমন দুঃসময়ে সহসা মনে পড়লো ক’জন বন্ধুর কথা। ওরাও বাড়ি গেছে ছুটি কাটাতে। ওরাও কি তার মত অসহায়ভাবে নির্মম এক পরিস্থিতির মোকাবেলা করছে? হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ হয়।

ভাবনা থেকে মুক্তি পেল আনোয়ার। দরজা খুলেই বুকটা ধক করে উঠল তার। এক হাতে একটা প্যাকেট অন্য হাতে তরমুজের থলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেঝ দুলাভাই। ঝড়ের আঘাতে কেঁপে ওঠা গাছের মত তার মনটা কেঁপে উঠল, সেই সাথে মনে পড়ল মার কথাটা- ‘আজ বেগুন ছাড়া আর কিছু নেই।’

খেতে বসলে দেখল এক পেয়ালায় বেগুন অন্যটাতে তিনটে মুরগীর ডিম। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল আনোয়ার। ঘরে ছিল না বাইরে থেকে আনা হয়েছে এতটা হিসেব করা অনর্থক মনে হল তার। কিন্তু ডিমটা খেতে গিয়ে তার কেমন যেন খটকা লাগল। তার বাবা ঝোল আর আলুর টুকরোই তুলে নিচ্ছেন। অবশিষ্ট ডিমটা কিছুতেই নিচ্ছেন না। এমনকি সে তুলে দিলেও না।

খাওয়া শেষে আনোয়ার দেখল তার বাবা ডিমের পেয়ালাটা নিয়ে রান্না ঘরে গিয়ে মাকে বলছেন- নাও ডিমটা তুমি নাও। তুমিতো যা তা দিয়ে খেতে পার না।

দরজার এক পাল্লায় নিজেকে একটু আড়াল করে এসব দেখছিল আনোয়ার। বাবা ঘুরে দাঁড়াতেই সরে গেল সে। খড়মের আওয়াজ তুলে বাবা চলে গেলেন। আলমিরার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো আনোয়ারকে দেখতে পেলেন না একটুও।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!