বিধ্বস্ত মানব—নাহিদা আফরোজ

মেঘলা আকাশ, মেঘগুলো কালো চাদরে জড়িয়ে নিয়েছে পৃথিবীকে, আকাশে মেঘের ছুটাছুটি। একটু পরেই বৃষ্টি নামবে, আকাশ জুড়ে দ্রুত মেঘের পদচারণ, কখনো শোনা যায় মেঘের বিদ্যুৎ চমকানোর গর্জন।

আকাশের এমন করুণ অবস্থা দেখে বুকটা দুরুদূরু কেঁপে উঠে আক্কেল আলীর। একমুহূর্তও দেরি না করে তাড়াতাড়ি দোকান-পাট বন্ধ করে পা বাড়ায় সামনের দিকে, মেঘলাময়ী আকাশের নিচে শহরের বিস্তীর্ণ রাজপথ ধরে, একাকী পায়ে হেঁটে চলেছে সে। প্রতিদিনের মত আজও বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছে। তবে, অন্যান্য দিনের চাইতে আজ যে রাত একটু গভীর হয়েছে তা আন্ধকার আকাশ-টা দেখেই বুঝে নিয়েছে আক্কেল আলী, তার হাতে তো আর ‘‘ঘড়ি’’ নামক যন্ত্রটি নেই, যা দেখে সে সময় নির্ণয় করতে পারবে। নুন আনতে যার পানতা ফুরায় তার আবার ঘড়ি। গরীবদের দুই বেলা পেট ভরে খেতে পারলেই চলে। তাদের জীবনে কোন বিলাসিতার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু আক্কেল আলীর তো দুই বেলায় খাওয়ার ভাগ্যই জুটে না। একবেলা কোন রকমে খেলেও আর এক বেলা উপোস করে কিংবা শুকনো মুড়ি খেয়েই কাটিয়ে দিতে হয়, আক্কেল আলী কেবলই নিজের কথায় ভাবে না। পরিবারের চিন্তাটা তাকে সব সময়ই তাড়া করে বেড়ায়, ঘরে বউ এবং এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়েই তার অভাবের সংসার।

আক্কেল আলীর উপর তাদের কত অভিযোগ, কত নালিশ, ছেলে মেয়েরা খেতে না পেয়ে মাঝে মাঝে বাবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। সারাদিন পরিশ্রম করে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে আক্কেল আলী যখন গভীর রাতে বাড়ি ফিরে তখন বউ তার কানের পাশে ঘ্যান ঘ্যান করে বলে উঠে এক বেলা খাওয়াইলে দুই বেলা যদি না খাওয়াইয়া রাখবা তয় বিয়া করছিলা ক্যান? বিয়ার আগে কত কথাই তো কইতা। বিদেশী-শাড়ি দিবা, সুগন্ধী স্নো, পাউডার, দামী, গয়না, আরো, কত কি! অহন তিন বেলা পেট ভইরা খাওয়াইতেও পারনা। যে ভালা কইরা খাওয়াইতে, পরাইতে পারে না। অমন বেটার বিয়া না কইরাই জীবন কাটাইয়া দেওয়ন উচিত।

বউয়ের বকুনি-সহজ-সরজ আক্কেল আলীর মনটাকে আরো বিষিয়ে তোলে। বউকে সে কি করে বুঝায় যে, সারাদিন পান-সিগেরেট বিক্রি করে যা পায় তা দিয়ে এক কেজি চালের চাইতে বেশি কিছু পাওয়া যায় না।

আজও আক্কেল আলী এক কেজি চাল কিনল, এতক্ষণে বাড়ির সবাই নিশ্চয় তার পথ পানে চেয়ে আছে, কিংবা ছেলে-মেয়েরা না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে, গ্রামের কাদা মাখানো মেঠো পথ ধরে হেঁটে চলেছে সে, সন্ধ্যার পর পরই গ্রামের লোকজন তেমন একটা রাস্তায় বের হয়না, তাও এখন বৃষ্টি-বাদলের দিন, তাই চারদিকটা নীরব নিস্তব্ধ। বউয়ের দেয়া সেই হারিকেনটিও মিটমিট করে জ্বলছে, হয়ত তেল শেষ হয়ে এসেছে, এখন ভালোভাবে বাড়ি পৌঁছতে পারলেই হয়।

হঠাৎ আক্কেল আলী দেখল ছোট এক গলিতে অসহায় এক লোককে কারা যেন তাড়া করছে, বিষণ্ণ লোকটিকে দেখে বড্ড মায়া হলো তার। না জানি কেনই বা এত গুলো লোকজন একজনকে তাড়া করছে? আক্কেল আলী দূর থেকে ব্যাপারটা কিছুক্ষণ লক্ষ্য করল, কিন্তু তেমন কিছুই বুঝল না।

এক সময় কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে লোকটার কাছে ছুটে গেল আক্কেল আলী, অস্থির কণ্ঠে বলল, ‘‘ভাই, সবাই আফনারে তাড়াইতাছে ক্যান?’’

মুহূর্তেই লোকটি আক্কেল আলীর হাতে কাগজের একটি প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ভৌ দৌঁড় দিল। সাথে সাথেই পথচারীর পঞ্চাশ জোড়া হাত ধুমাধুম শব্দে পড়তে লাগল তার সারা শরীরে।

রক্তাত্ব আক্কেল আলীর আর কিছুই মনে নেই, জ্ঞান ফিরেই সারা শরীরে ব্যথা অনুভব করল। চোখ খুলে দেখল মোটা লাঠি হাতে গোঁফ ওয়ালা এক লোক বলছে, ‘‘বলল, এই মাল তুই কোথায় পেয়েছিস? এই মাল তোকে কে দিয়েছে তোর সাথে এই কাজে আর কারা কারা জড়িত?’’

আক্কেল আলীর অসহায় চোখ কেঁদে কেঁদে বলল, ‘‘বিশ্বাস করেন স্যার; আমি কিছুই জানি না, এক লোক আমারে ———–।’’

কথা শেষ করার আগেই লাঠির কয়েক ঘা পড়ল আক্কেল আলীর পিঠে। কেউই তার কথা বিশ্বাস করল না। পুলিশের ডান্ডার পিটুনি খেয়েও কিছুই বলতে পারল না আক্কেল আলী।

তার বউ-বাচ্চারাও পুলিশের পা ধরে কত কান্নাকাটি করেছে, ‘‘হেই কিছু জানে না, হেই কোন মাল-টাল চিনে না, হেরে ছাইড়া দেন, হেই না থাকলে আমগো না খাইয়া মরণ লাগবো।’’

কিন্তু কেউই তাদের কষ্টের কথা গুলো শুনতে চাইল না, বুঝতে চাইল না, শুধু অপরাধহীন অশ্রুজলের করুণ আর্তনাদ।

এর কয়েকদিন পর প্রতিটি পত্রিকায় হ্যাডলাইন করা হল, ‘‘হেরোইন প্রাচারকারী আক্কেল আলী পুলিশের আঘাতে নিহত।’’

সাধারণ জনতার কাছে আজো অজানা এবং রহস্যই রয়ে গেল আক্কেল আলী সত্যিই কি হেরোইন প্রচারকারী ছিল?

দুঃখিত!