রমযানের শুরু থেকে যেন বর্ষার ঘনঘটার স্পর্শ। আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণ মাসের ঝিরি ঝিরি বর্ষার আগমন থেমে থেমে যেন শীতল পরশ হাত বুলিয়ে যায়। সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে সূর্যের অস্ত্বিত্ব যেন বিলীন হয়ে গেছে। সকাল সাড়ে ন’টা বাজে এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি রাহাত। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ঘড়ির ঘন্টার কাঁটা নয়য়ের ঘর পার হয়ে গেছে। আমি ততক্ষণাত বিছানা থেকে হুড়মুড় করে উঠে বসি। রাহাতকে ডাক দিই কোন সাড়া শব্দ নাই। দু’হাত দিয়ে নিজের চোখ কচ্ছলিয়ে আবার ও ঘড়ির কাটার দিকে তাকায়। হ্যা আমিতো সত্যি দেখছি সকাল সাড়ে ন’টার বেশি বাজে। সর্বনাশ আজকে মাহেল স্যারের একটা গুরত্বপূর্ণ ক্লাস মিস্ হয়ে যাবে…..।
‘রাহাত ও শাফিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সাবজেক্টে ৪র্থ বর্ষে পড়ে। তারা দু’জনে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে একই রুমে থাকে। দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি বছর তারা কখন যে পার করে চলেছে তা মনে থাকে না। রাহাত গ্রামের ছেলে সে মেহেরপুর থেকে এসেছে আর শাফিন শহরের ছেলে রাজশাহী থেকে এসেছে। তাদের দু’জনের পরিচয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে আসার সময় ট্রেনের ভিতর। তারপর বিশ^বিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া তাও আবার একই ডিপার্টমেন্টে। কাকতালীয় হোক আর সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় হোক তাদের আবার দেখা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যাত্রার দিনে। এরপর বন্ধুত্ব আরো মধুর থেকে গাড়ো হয়ে ওঠে দু’জনের মধ্যে। এরপর একসাথে হলে ওঠা। একই রুমে দু’জনে থাকার সম্মতিতে তারা পেয়ে যায় দু’সিটের একটি রুম।’
যাহোক প্রতিদিন তারা ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রাখে কিন্তু আজ কারোরই মনে ছিলনা। ভোরে সাহরী খেয়ে ফজরের নামায শেষ করে তারা দু’জনে ঘুমিয়ে পড়েছিল। মাহেল স্যারের ক্লাস ছিল সকাল সাড়ে ন’টায়। কিন্তু ঘুম থেকে উঠতেই সাড়ে ন’টা পার। ক্লাসে ৫ মিনিট দেরী হলে স্যারের রাগ দেখে কে। দেরী হলেও ক্লাসে যেতে হবেই আজ। তবুও রমযান মাস বলে কথা। আমি মনে মনে চিন্তা করি রমযান মাস রহমতের, মাগফেরাতের ও নাজাতের মাস। রাহাতকে এক ঝটকায় তুলে দিয়ে আমি ওয়াশ রুমের দিকে দৌড় দিলাম। ১০ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে আমরা যতক্ষণাত ক্লাসরুমের দরজার সামনে ততক্ষণাত ঘড়ির কাটা ১০টার ঘরে। স্যার ক্লাসের ভিতর লেকচার দিচ্ছেন।
রাহাত ‘মে আই কাম ইন স্যার বলতেই স্যার ঘুরে বলে ইয়েস কাম ইন।’ স্যার রাহাত ও শাফিনকে জিগ্বেস করল, ‘হোয়াই আর ইউ লেট ইন মাই ক্লাস?’ যেহেতু রোযা আছে তাই তারা মিথ্যা বলতে পারলো না। উত্তরে তারা বলল, ‘সরি স্যার, উই ওয়ার স্লিপিং আফটার টেকিং সাহরী।’ স্যার জবাবে বললেন, ‘ওকে, টেক ইওর সিট।’ তারা দু’জনসহ ক্লাসের সকলে আশ্চর্য হলো মাহেল স্যারতো অন্য সময় হলে ক্লাসে ঢুকতেই দিত না। যাকে কিনা মাহেল স্যার না বলে সবাই ঘায়েল স্যার বলে ডাকতো। আজকে দু’জনকে ঘায়েলতো দূরে থাক সে কিনা কিছুই বললো না রাহাত ও শাফিনকে। পিছনের বেঞ্চে বসে মনে মনে আল্লাহকে থ্যাংকস জানালো রাহাত ও শাফিন।
আত্মশুদ্ধির ও ধৈর্য রক্ষার মাস হচ্ছে পবিত্র রমযান মাস। দীর্ঘ এক বছর পর মুসলমানদের জন্য ফিরে আসে পবিত্র মাহে রমযান। মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে গুরত্ব ও তাৎপর্য পূর্ণ এ মাহে রমযান। এ মাসে আল্লাহর সস্ত্তষ্টি অর্জনের জন্য ছোট বড় সকলে মিলে সাহরী, ইফতারি ও তারাবীর নামায আদায় করে। রমযান মাসের আকর্ষণীয় এ সব বিশেষ মহূর্ত গুলোর দিকে সকলের আগ্রহ থাকে সমস্ত মাস জুড়ে। ইফতারির আনন্দ যেন সকলকে অন্যরকম অনুভুতি দেয়। আর তা যদি হয় বন্ধুদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের রুমে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ছাত্র জীবনে ইফতার বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনে আনন্দময় ও স্মৃতিময় হয়ে ওঠে। পরিবারের বাবা মা, আত্মীয় স্বজন ছেড়ে ক্যাম্পাসে ইফতার সবার মাঝে সম্পর্কের বন্ধনকে সুসংহত করে।
যাহোক রমযান মাস শুরু হলেও আমাদের ক্লাস বন্ধ হয়নি। ২০ রমযান না হলে আমাদের ছুটি মিলছে না। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়ে আমাদেরকে হলে রমযানের অধিকাংশ সময় পার করতে হয়। বাবা মা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে ইফতার ও সাহরী করা পুরো রমযান ধরে করা হয়ে ওঠেনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে।
ইতোমধ্যে রমযানের ৭টি রোযা পার করে ফেলেছে রাহাত ও শাফিন। দু’জনের গলায় গলায় বন্ধুত্ব। একসাথে কাসে যাওয়া, ঘুরতে বেড়ানো, রমযানে সাহরী ও ইফতার করা তাদের কখনো যেন মিস্ না হয়। সে জন্য তারা ছুটির পর বাসায় চলে গেলে একে অপরের অনুপস্থিতি প্রচন্ডভাবে অনুভব করে।
রমযানের প্রথমদিন থেকে সন্ধ্যাবেলায় লক্ষ্য করা যায় ক্যাম্পাস জুড়ে ইফতারের আমেজ ও উৎসব। ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার, অডিটোরিয়াম, ক্যাফেটেরিয়া, মুক্ত মঞ্চ, তপনদার দোকান, ভাবীর দোকান, মিজান ভাইয়ের দোকান, লাইব্রেরীর নিচে. কটকা স্মৃতিসৌধে, গোল চত্তর, সালাম ভাইয়ের দোকান, সিদ্দিক ভাইয়ের দোকান, সুফিয়ান ভাইয়ের দোকান, শাহীন ভাইয়ের দোকান, সাগর ভাইয়ের দোকান, জলিল ভাইয়ের রেস্ট্রুরেন্ট এমনকি হলের ক্যান্টিন, ডাইনিং, গেস্টরুমে সব জায়গায় দলবেঁধে বন্ধুদের চলে ইফতারের আয়োজন। আবার কেউ কেউ বন্ধুরা মিলে হলের রুমে আয়োজন করে ইফতার পার্টি।
এখানে আপনজন নেই তবে সম্পর্কের বন্ধনটা থাকে অটুট। ইফতারের আগে চলে বন্ধুদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা আর আড্ডা। কেউ কেউ ইফতারের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হলের সামনের দোকানগুলোতে দেখা যায় ইফতারী কেনার প্রতিযোগিতা। ইফতারের সময় শুধু মুসলমান বন্ধুরাই এক সাথে বসে না বরং অন্যান্য ধর্মাবালম্বীরাও ইফতারে শরিক হয়ে সকল রকম সাম্প্রদায়িকতা ভুলে ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
সারাদিন অপেক্ষার পালা শেষে বিকেল থেকে চলে ইফতারীর প্রস্ত্ততি। সারাদিন ধরে গুড়িগুড়ি মুষলধারে বৃষ্টি নামলেও ইফতারের আনন্দের ভাটা মোটেও পড়েনি আজ। চারপাশ জুড়ে চলে পবিত্রতার আত্মশুদ্ধি। ছাত্রীরাও তাদের নিজের হাতের রান্না করা খাবার দিয়ে আয়োজন করে ইফতার পার্টি।
প্রতিদিনের মতো আজও ইফতারের জন্য ছোলা, মুড়ি, পিয়াজু, আলোর চপ, বেগুনী, কলা, জিলাপী, আপেল, খেজুর, শরবতসহ আরো অনেক কিছু কিনে এনেছে রাহাত। হলের রুমে বসে প্রতিদিনের ন্যায় ইফতারের আয়োজন করে তারা। রাহাত ও আমি প্রতিদিন অন্য বন্ধুদের ইফতারের দাওয়াত দিই। এটা যেন আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। একসাথে ৭-৮ জন এক রুমে বসে ইফতার আমাদের মধ্যে অন্য রকম আনন্দ ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। আজ মুকিত, শ্যামল দাস, নাজিদ, পাপল চাকমা, রবি, খালেকসহ আরো অনেককে দাওয়াত দিয়ে একসাথে ইফতারী সামনে নিয়ে বসেছি। ইফতারের আগে সকলে মিলে মোনাজাত করি। মোনাজাতে রাহাত, রবি ও নাজিদের চোখ বেয়ে পানি চলে আসে।
ইফতার পরে মাগরিবের নামায শেষ করে সকলে গোলচত্তরে বসে একে অপরকে জিজ্ঞেস করছে। আমি, রাহাত ও নাজিদকে জিজ্ঞেস করি, কিরে বন্ধু মোনাজাতের সময় কাঁদছিলে কেনো তোরা? বাসার কথা মনে পড়ছিল বুঝি? জবাবে তারা দু’জনে বলে ওঠে, বন্ধু আগামী বছর হয়তো আমরা এভাবে একসাথে সবাই মিলে একরুমে বসে এমন তৃপ্তিময় ইফতার করতে পারবো না। কারণ আগামী রমযানের অনেক আগেই আমরা শেষ করতে যাচ্ছি আমাদের অনার্স লাইফ। সো সবাই কে অনেক অনেক মিস করবো। কথাগুলো সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। এরইমধ্যে রাহাতসহ সকলের চোখের কোণে পানির চিকচিক কণা জমে ওঠেছে। মাত্র কয়েকমাস পর তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতে হবে এমনটা ভাবতেই সবার মাঝে চাপা কান্না অনুভব হতে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘‘শেষের কবিতা’’ উপন্যাসের ‘গ্রহণ করেছ যত, ঋণী করেছ আমায়, হে বন্ধু বিদায়’ এমন একটি উক্তি মনে হতেই আমার মন বিষণ্ণ হয়ে ওঠে।
গতবারের রমযানে আমি ও রাহাত খুলনা মেডিকেল হসপিটলে পরিচিত বড় ভাইয়ের আত্মীয় এক মুমুর্ষূ রোগীকে রক্ত দিতে যাই। রাহাতের রক্তের গ্রুপ ও পজিটিভ আর আমার এবি পজিটিভ। রোগীর ও পজিটিভ হওয়ায় রাহাতকে রক্ত দিতে হলো। রোযা থাকার পরও সে রক্তদিতে সম্মত হয়েছিল। এর আগেও রাহাত ও আমি কয়েকবার রক্ত দিয়েছি। কারণ আমরা অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্তদান সংগঠন ‘বাধঁন’র সদস্য। রক্ত দিয়ে রাহাত উঠে আমার দিকে আসতেই সে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। অবাককান্ড এমনতো এর আগে হয়নি। আমি ভয় পেলাম না সাহস নিয়ে রাহাতকে তাড়াতাড়ি ধরে বেডে শুয়ে দিই। তারপর যিনি রক্ত নিয়েছিলেন তিনি এসে বললেন, ‘ভয় পাবেন না। ২০ মিনিট শুয়ে রেস্ট নিন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ আমি রাহাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। আর বন্ধুত্বের গভীর আকর্ষণ বোধ করছিলাম। এই রাহাত কত কাছের বন্ধু, কত আপন। একবার আমার প্রচন্ড জর হয়েছিল। প্রায় মাঝে মাঝ জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলাম। সেবার ওষধে খুব একটা কাজ হচ্ছিল না। এই সেই রাহাত যে সারারাত জেগে আমার মাথায় পানি ঢেলেছিল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল।
এরই মধ্যে রাহাত শাফিনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কিরে শাফিন কি ভাবছিস?’ শাফিন সম্বিত ফিরে পেয়ে বলে, কিরে এখন কেমন লাগছে বন্ধু? রাহাত জবাবে বলে, ‘চল তাড়াতাড়ি হলে চল, তারাবীর নামায ধরতে হবে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।