বাস্তবতার অন্তরালে—নাহিদা আফরোজ

 

দরজায় ‘ঠক ঠক’ শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় সাইফের। ‘‘উহ্! ছুটির দিনেও যে একটু ভালো করে ঘুমাবো তার কোন উপায় নেই। সপ্তাহের ৬টা দিনেই পড়াশুনা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে- ভালো করে একটু বিশ্রাম নেয়ারও সুযোগ হয়ে উঠে না। সকালের ঘুম না ভাঙতেই মনে পড়ে কোচিং, প্রাইভেট, কলেজের কথা, তারপর কি আর থেমে থাকা যায়, হন্যে হয়ে ছুটতে হয় একটার পর আরেকটার পেছনে।’’

ঘুম মাখানো চোখে হেলেদুলে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। দরজা খুলতেই চমকে উঠে সাইফ। ‘‘কি ব্যাপার দারোয়ান চাচা, এত সকালে তুমি আমার রুমে?’’ দারোয়ান হলুদ বর্ণের একটি কাগজ সাইফের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘এত সকালে তোমার ঘরে কি আর স্বাদে আমি বাপু? কিছুক্ষণ আগে তোমাদের গ্রাম থেকে এক লোক এসে এই কাগজটি আমার হাতে দিয়ে বলল তা, ‘‘তোমার কাছে যেন পৌঁছিয়ে দিই।’’

লোকটাকে দেখতে খুবই বিষণ্ণ মনে হলো, নিশ্চয় কাগজে খুব জরুরী কিছু লেখা আছে।’’

সাইফ মৃদু হাসতে হাসতে বলল- ‘‘গ্রাম থেকে যখন তখন নিশ্চয় বাবাই লিখেছে।’’ কি আর লিখবে? প্রতিবারের মত এবারও হয়ত লিখেছে- ‘‘হোস্টেলে থেকে এত পড়াশুনা করার দরকার কি? তার চেয়ে বরং গ্রামে ফিরে আয়, বাপ-দাদার জমিদারী বুঝে নে। আমিও বুড়ো হয়েছি। কখন কি ঘটে যায় তার কোন নিশ্চয়তা নেই।’’

পেছন থেকে মেহিদ এসে বলল- ‘‘একা একা দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কি এত বকছিস?’’

হাতের কাগজ খুলতে খুলতে সাইফ বলল- ‘‘নবাবপুর থেকে বাবার চিঠি এসেছে। সেটাই পড়ছিলাম।’’ চিঠি পড়তে পড়তে একসময় সাইফের হলুদ বর্ণের চেহেরায় কালো বর্ণের ছাপ দেখা দিল। কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে, তার ফ্যাকাসে মুখ দেখে মেহিদ বলল- ‘‘কি হয়েছে তোর? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কোন দুঃসংবাদ?’’

সাইফ তড়িঘড়ি কাপড়-চোপড় গুছাতে গুছাতে বলল ‘‘হ্যাঁ, বাবার শরীর খুব খারাপ, আমাকে এখনই রওনা হতে হবে, তোর তো এখন পরীক্ষা চলছে, পরীক্ষা শেষে আমাদের জমিদার বাড়িতে অবশ্যই আসবি।’’

সাইফ ও মেহিদ খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ছোট বেলা থেকেই তারা দু’জন একই হোস্টেলে, একই রুমে, একসাথে পড়ালেখা করে এসেছে। বিরাট জমিদারের একমাত্র ছেলে সাইফ। আজকাল এমন জমিদার খুব কমই দেখা যায়। এখনও নবাবপুর গ্রামটা সাইফের বাবার কথায় উঠা-বসা করে। তবে, অন্যান্য জমিদারদের মত তিনি অত্যাচারী নন, বেশ নীতিবান এবং হৃদয়বান ব্যক্তি।

পরীক্ষা শেষে মেহিদও গ্রামে ফিরে আসে। এভাবে দু’জনের দূরত্বের মাঝে কেটে গেল অনেক সময়, মেহিদের গ্রাম থেকে নবাবপুর খুব বেশী দূরে নয়। পাশাপাশি গ্রাম বললেই চলে, একসময় মেহিদ যাত্রা শুরু করে জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। সাইফ মেহিদকে দেখে বিশ্বাসই করতে পারছিল না ‘‘আরে মেহিদ, কত দিন পর দেখা, আমি তো বিশ্বাসই করতে পারিছ না যে- তুই সত্যি সত্যিই আমাদের জমিদার বাড়িতে আসবি।’’

মেহিদ হাসতে হাসতে বলল- ‘‘খুব কাছাকাছি গ্রামেই আমরা থাকি। এত কাছে থেকেও তোর সাথে দেখা করব না। তা কি হয়? তা কেমন চলছে তোর জমিদারী? তোর বাবাকে দেখছিনা যে, কোথাও বের হয়েছে নাকি!’’

সাইফ মলিন চেহারা নিয়ে বলল, ‘‘বাবা আর বেঁচে নেই। সমস্ত জমিদারী আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন’’- কথার এক পর্যায়ে সাইফের অশ্রুসিক্ত দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। মেহিদ তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল, ‘‘আরে বোকা, এতে কান্নার কি আছে? কারো বাবাই আজীবন বেঁচে থাকে না। এই আমার দিকে চেয়ে দেখ- খুব ছোট বেলায় আমার বাবা মারা গেছেন। তারপরওতো আমি হাসি মুখে বেঁচে আছি, সবকিছু হারিয়েও বাস্তবতাকে সাথী করে বেঁচে থাকতে হয়, এসব কথা রেখে চল্ তোর জমিদার বাড়িটা ঘুরে দেখি। আমার জীবনে এতবড় বাড়ি আমি কোনদিন দেখিনি।’’

সাইফ মেহিদকে সাথে নিয়ে সমস্ত জমিদার বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখাল, কতটা রুম যে এই জমিদার বাড়িতে আছে তা হিসাবের ঊর্ধ্বে। চাকর বাকর, হাতি শালার হাতি, ঘোড়া শালায় ঘোড়া, সবকিছু মিলে যেন এক রাজকীয় অবস্থা।

একসময় মেহিদ বলল, ‘‘আর কত কি দেখাবি? হাঁটতে হাঁটতে একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেলাম।’’ সাইফ হাসতে হাসতে বলল, ‘‘সবে তো শুরু হলো, এখনও অনেক কিছু বাকি আছে, আর তুই এরই মধ্যে ক্লান্ত হয়ে গেলি, এখন আমার ঘরে চল্ খাওয়া-দাওয়া শেষে আবার বের হবো।’’

মেহিদ-সাইফের ঘরে ঢুকে আরো বিস্মৃত হয়ে গেল, এটা কি ঘর নাকি স্বপ্নরাজ্য! দেয়ালের প্রতিটি কণা কারুকাজ দিয়ে সাজানো, দেয়ালের চারিদিকে রঙ-বেরঙের পুরনো রাজা-বাদ্শাহ্, নবাব-জমিদারদের ছবি, ঘরের আসবাবপত্র সবই রাজকীয়, আধুনিক যুগে এসব অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

খাবার মুখে দিতে দিতে সাইফ বলল- ‘‘ঐ যে উত্তর দিকের ছবিটা দেখছিস, সেটা আমার দাদার দাদা সাহেবের ছবি, বাবার মুখে শুনেছি- এই জমিদারী তিনিও বংশধর সূত্রে পেয়েছিলেন, দক্ষিণ দিকের যে ছবিটা দেখছিস- সেটা আমার দাদার ছবি, আর পশ্চিম দিকেরটা আমার বাবার। তারা এখন কেউই বেঁচে নেই। আমাদের পুরনো লাঠিয়ালের মুখে শুনেছিলাম উত্তরসূরী ক্ষেত্রে জমিদারদের মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে এক অবিশ্বাস্য বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। তার পরই জমিদারদের মৃত্যু হয়। আমার বাবার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।’’

মেহিদ চিন্তিত স্বরে বলল- ‘‘মৃত্যুর পূর্বের ঘটনাটা কি?’’ সাইফ নিচু স্বরে বলল- ‘‘ঐ যে সোনালী রঙের কাঠের টেবিলের উপর একটা মাটির তৈরি পাখি দেখতে পাচ্ছিস, এটা জমিদারদের পূর্বসূত্র ধরেই এসেছে। এটা অসাধারণ একটি পাখি। মাঝে মাঝে মাটির পাখিটি ডেকে উঠে। তারপরই জমিদারদের মৃত্যু হয়। আমার বাবার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।’’

মেহিদ অট্টহাসি হেসে বলল- ‘‘ঐ সব পুরনো দিনের ভিত্তিহীন কথা-বার্তা। সবই কুসংস্কার। আধুনিক যুগের ছেলে হয়ে এই সব ওল্ড মডেলের কথা কেন যে বিশ্বাস করিস তা ভেবেই আমার কাছে অবাক লাগছে…।’’

মেহিদের কথা শেষ না হতেই মাটির পাখিটি ডেকে উঠে ‘কুহু কুহু’ শব্দে, হতভম্ব হয়ে যায় দু’জনই। নতুন বিপদের আভাস পায় তারা,

হঠাৎ, সাইফের চিৎকার শুনে তার দিকে ফিরে তাকায় মেহিদ, দেওয়ালে টাঙ্গানো পাথরের তৈরি তার বাবার ছবিটি নি:শব্দে ভেঙ্গে পড়ে সাইফের মাথায়, রক্তাক্ত সাইফ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। মেহিদ পাথর হয়ে অপলক দৃষ্টিতে যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে, সব কিছুই যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তার। ক্ষীণ শব্দে রক্তাক্ত সাইফ মেঝেতে আর্তনাদ করছে। একসময় সেই শব্দটিও যেন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে জমিদার বাড়ির চার দেয়ালের অন্তরালে মিশে যেতে লাগল।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!