কয়েক বছর আগে ডিম নিয়ে একটি লেখা ছিলো আমার। শুনেছি লেখাটি পড়ার পর অনেকেই নাকি ডিম থেরাপী করেছেন নিজে অথবা বাচ্চাদের জন্য। তবে এবার তাদের জন্য সতর্কবাণী। ডিমে আছে উচ্চ কোলেষ্টোরল। যা হৃদরোগীদের জন্য বিপদজনক। সুতরাং যারা হৃদপিন্ড সমস্যায় জর্জরিত তারা ডিমকে রাখুন ১০০ গজ দূরে। আর যাদের হৃদয়ঘটিত কোন উপন্যাস, গল্প বা সামান্য ছড়া-কবিতাও নেই তারা খেতে পারেন। তবে মানিব্যাগ নয় বাজারের ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে যেতে হবে; কারণ ডিমের হালি ৫০ টাকা! সাধারণ মানুষ এখন ডিমকে সসম্মানে দূরে রাখছে হৃদয় নয় পকেট বাঁচাতে। অনেক ভেবে চিন্তে দেখলাম এবার কলা নিয়ে লিখি। সারা বছর পাওয়া যায় এমন ফল হিসেবে কলার বিকল্প নেই।
সদ্য সমাপ্ত বাজেট এর পরে কলা বিষয়ক লেখাটাই যুক্তিযুক্ত। আসুন বিদেশী ফল আঙ্গুর, আপেল, মাল্টার বদলে কলা খাই। কলা খেয়ে ত্বকের সৌন্দর্য বাড়াই। কলার ভুবনটা সমৃদ্ধ। কাঁচা কলা, চাঁপা কলা, সবরী কলা, কাবুলী কলা, সাগর কলা, কাঁঠালী কলা, কবরী কলা কত বিচিত্র নাম! এছাড়া আছে চিত্রকলা, নৃত্যকলা, শিল্পকলা ও নাট্যকলা। এই ফাঁকে কলার গুণাগুণটা জানিয়ে রাখি। আপেলের চেয়ে কলায় শর্করা দ্বিগুণ, ভিটামিন ‘এ’ পাঁচগুণ, ফসফরাস তিনগুণ। এছাড়া প্রচুর পটাশিয়াম আছে, যা ডাইরিয়ার তীব্রতা কমায়। ঋউঅ বলে কলা স্ট্রোক ও উচ্চ রক্তচাপ কমায়। আবার ফ্রুকটোজ এবং সুক্রোজ থাকায় এনার্জী বৃদ্ধি করে। আর প্রচুর পরিমাণে আয়রণ থাকায় রক্তস্বল্পতা দূর করে। আর অাঁশ সমৃদ্ধ হওয়ায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। তবে যারা ডায়েট কন্ট্রোল করতে চান তারা কলা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন।
চিত্রশিল্পী যেমন তার মডেলকে সামনে রেখে চিত্রকর্ম করে আমি ভাবলাম এক ডজন কলা এনে সামনে রেখেই কলা বিষয়ক লেখাটা শেষ করি। খিদেয় রসনার রসদ জোগাবে আবার লেখারও রসদ জোগাবে। তাই মামাত ভাই আকাশকে পাঠালাম কলা আনতে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি আকাশ হলো কিপ্টুস নম্বর ওয়ান। তালপাতার সেপাই ফিগার। রিক্সা ভাড়া বাঁচাতে বাজারের ব্যাগ মাথায় করে আনে আর বাজারের কোথায় কখন সস্তা কি জিনিস বিক্রি হচ্ছে তার খবর রাখে। তো কিছুক্ষণ পর ও ফিরে এল মুখখানা আমসত্ত্ব, স্যরি কলাসত্ত্ব করে (কলা নিয়ে যেহেতু লেখা)। বললাম কি হলো- কলা কই? বললো কলার ডজন নববই টাকা। কলা খাওয়া লাগবেনা। এখন থেকে কলার খোসা খাবেন। এরপর জানি ওকে বলেও লাভ নেই। কারণ এতো টাকা দিয়ে ও কখনোই কলা কিনতে পারবে না। তার আগে হয়ত হার্টফেল করবে। বললাম ঠিক আছে কলা লাগবে না তুই কলার খোসা কিনে আন। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটায় কি আর করা। আবার একটু পর ফিরে এল সেই কলাসত্ত্ব মুখ করে। বললো ছাগল মালিকেরা লাইন ধরে কলার খোসা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। আমার ছাগল নেই বলে লাইনে দাঁড়াতে দেয়নি।
ভাবলাম কলা নিয়ে কলকলানির এখানেই ইস্তফা দিবো কিন্তু হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এল। কলা বাদ দিয়ে কলার খোসা নিয়েও তো লিখতে পারি। এতোদিন ডায়েরিয়ার রোগী এলে পাকা কলা অথবা কাঁচা কলার তরকারি খেতে বলতাম এখন কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগী এলে কলার খোসার ভর্তা খেতে বলবো। আর কলার খোসার ঔষধি গুণাগুণও কম নয়। যাদের মশার কামড়ে এলার্জী তাদের কামড়ের স্থানে খোসা ঘসে দিলে ফোলা এবং জ্বালাপোড়া দুটোই কমবে। তবে যাদের কলার খোসার আচার (আছাড়) খাওয়ার সুখানুভূতি আছে তারা আমার লেখায় মর্মাহত হবেন না। কারণ আমি জানি যারা এই আচার (আছাড়) খায় তাদের মধ্যে ছোটরা খেলে কান্না পায়। বড়রা খেলে লজ্জা পায় আর বয়স্করা খেলে কষ্ট পায়। সোহেল রানা বীর ভাইকে বলছি কলার খোসা থেকে কোন ওষুধ তৈরি করা যায় কি না প্লীজ দেখুন। তবে দামটা নাগালের মধ্যে রাখুন।
গত কিছুদিন আগে ফার্মেসী থেকে আম্মুর জন্য ১টি ট্যাবলেট কিনলাম ১০০ পিস। যেহেতু প্রতিদিন খেতে হয় বেশী করে কিনে রাখি। যখন দাম দিতে গেলাম দাম চাইলো পূর্বের চারগুণ। মনে হলো দোকানদার আমাকে ঠকিয়ে বেশি টাকা নিতে চাইছে। রীতিমত চ্যালেঞ্জ করলাম তাকে। কি ভেবেছো আমি ওষুধের দাম জানিনা। কত কিনলাম এই ওষুধ। ছেলেটি কথাগুলো গায়েই মাখলোনা উপরন্তু বত্রিশটি দন্ত বিকশিত করে আমাকে বলল আপা এক বক্স পুরোই তো নিয়েছেন ঐ বাক্স এর গায়ে দাম লেখা আছে দেখেন। অবাক হয়ে দেখলাম পূর্বের মূল্যের উপর বড় একটি ক্রস চিহ্ন আর পাশে নতুন মূল্য। পারেও বটে বাংলাদেশ। ১০ টাকার জিনিস ১৫ হতে পারে, ২০ হতে পারে কিন্তু যদি এক দৌড়ে ৮০ হয়ে যায় তাহলে আমাদের মত সাধারণ মানুষদের বোবা হয়ে যেতে হয়। দোকানদার ছেলেটার হাসিমুখ বলে দিচ্ছিল এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। নতুন বক্সে নতুন মূল্য লেখার মত সময় তাদের হাতে নেই। সিদ্ধান্ত যখন হয়েছে দাম বাড়াবে পুরাতন বক্সেই নতুন মূল্য বসিয়ে দিচ্ছে। আমি নির্বিকার।
গত ঈদে আম্মু ৮টি শাড়ি উপহার পেয়েছিলেন। কিন্তু আলমারী খুলে দেখি মাত্র ১টার ভাঁজ খোলা হয়েছে। বাকী ৭টি পড়েই আছে। কারণ হিসেবে আম্মু বলল শাড়িগুলো যেভাবে পেয়েছি; পেটিকোট, ব্লাউজ সেভাবে পাইনি। আর কাপড়ের দাম যেভাবে বেড়েছে কেনার মত মানসিকতা কমে গেছে। মনের দুঃখে তাই নতুন কাপড় কেনাও হয়নি। শাড়ি পরাও হয়নি। ভাবছি আগামী ঈদে শাড়ির বদলে কয়েকগজ কাপড় কিনে দেবো।
এই প্রসঙ্গে বলি বিখ্যাত সাহিত্যিক মার্কটোয়েনের বাড়িতে তার এক বন্ধু গেল। গিয়ে দেখল বাড়ি ভর্তি অসংখ্য বই এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে। বন্ধুটি অবাক হয়ে বললো এতো বই সংগ্রহে তোমার অথচ শেলফে রাখনি। মার্কটোয়েন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল ‘‘বইগুলো যেভাবে সংগ্রহ করেছি, বড় শেলফ তো সেভাবে সংগ্রহ করা যায় না!’’
এই হল বিখ্যাত জনের অবস্থা। আর আমাদের মতো অখ্যাত জনের অবস্থা তো করুণ হবেই- এতো স্বাভাবিক। অফিস থেকে আসার পথে তালশাঁস কিনলাম। তিন চোখ পাঁচ টাকা। পরের দিন ভাবলাম আজ কিছু কিনে অফিসে গিয়ে সবাই মিলে খাবো। কিন্তু দাম জিজ্ঞেস করতেই বললো তিনচোখ ১০ টাকা। অবাক হয়ে বললাম, গতকালই তো আপনার থেকে পাঁচ টাকাই নিলাম। লোকটি শুষ্টং কাষ্টং নিরসং মুখে বললো কালকের দিন আর আজকের দিন কি সমান? ভাবলাম কাল হয়ত তার বিশেষ কোন দিন ছিলো তাই ৫০%-ছাড় দিয়েছিল। হাটা শুরু করলাম। মনে হলো পেছন থেকে লোকটা ডাক দিবে। আপা নিয়ে যান কিছু ছাড় দেবো। কিন্তু না দেশ যে ডিজিটাল হয়ে গেছে। ক্রেতাকে ডাকাডাকি করে দেবার কোন ইচ্ছেই তার নেই। অফিসে ওষুধ কোম্পানীর লোক আসে। কেউ বলে আপা এই ওষুধটার দাম বাড়িয়েছি। বেশী করে প্রেসক্রাইব করে দেবেন। নইলে মার্কেটিং করবো কীভাবে। আবার কেউ বলে আমাদেরটার দাম কম। প্লীজ আমাদেরটা প্রেসক্রাইব করবেন। (যদিও সেসব কোম্পানির ওষুধে কাজ হয় কিনা সন্দেহ)। দু’জনকেই সাপোর্ট দিতে হয় ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।
বর্তমান সময়ের ফরমালিন যুক্ত মাছ-গোশত আর কীটনাশক যুক্ত শাক সবজি খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। কিন্তু সুস্থ হওয়ার জন্য যে ওষুধ খাবে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগীতায় মানুষের সুযোগটুকু ওষুধ কোম্পানী বোধ হয় রাখতে চাইছে না। বাঁচার অধিকার তাদের যাদের ব্যাংকের লকার আর বালিশের কভার ভর্তি টাকা আছে। নির্মল বাতাসের অভাব শহরে। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড ও সীসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি। ১.৫ বছরের শিশুকে মা ডাক্তারের কাছে এনেছে দাঁত উঠেনি বলে। ডাক্তার বললো বাচ্চার গায়ে বেশি বেশি রোদ লাগাতে হবে। মা বললো যেখানে রোদের অভাবে কাপড় শুকাই গ্যাসের আগুনে সেখানে রোদ পাব কোথায়? ডাক্তার বললো- এমনিতে না পেলে কিনতে হবে। কিন্তু রোদ চাই। যেখানে বাড়ন্ত বাচ্চাকে প্রতিদিন একটা ডিম একটা কলা দেওয়ার সামর্থ্য নেই সেখানে অনেক বাবা-মায়েরা রোদ কেনার মত বিলাসিতা কিভাবে করবে। মাথা গোজার একটা ঠাঁই পেতে হলে চলে যায় বেতনের অর্ধেক টাকা। বাকি টাকায় সংসারের সব চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয়।
ছোট বেলায় গল্প শুনেছিলাম, লাট সাহেব আসে স্কুল পরিদর্শনে। তার কুকুরের একটি পা ভাঙা। জানা গেল তার এই তিনপাওয়ালা কুকুরের পেছনে মাসে খরচ হয় পঁচাত্তর টাকা আর স্কুলের পন্ডিতমশাই তার ৮জনের সংসারে ভরণ পোষণ মেটানোর জন্য বেতন পান পঁচিশ টাকা। মানে লাট সাহেবের কুকুরের এক পায়ের সমান। বর্তমান বাজার উচ্চবিত্তদের দখলে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের ফুটপাতের জিনিস খুঁজতে হয়। আর সস্তার তিন অবস্থা তো হবেই। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়-
হে মহাজীবন আর কলা নিয়ে কাব্য নয়
এবার কলার খোসা গদ্যে আনো-
কলার পুষ্টিগুণ স্বাদ ভুলে যাও
খোসার ভিতরে ফাইবার আছে মানো।
প্রয়োজন নেই কলাবতী স্নিগ্ধত্বক-
কলা তোমায় আজ হতে দিলাম ছুটি
ক্ষুধার রাজ্যে সবকিছু রসগোল্লা
কবিতার খাতা যে মনে হয় রুটি।
সবশেষে এবারের ঈদের জন্য একটি রেসিপি দিলামঃ
প্যানকেক উইথ ব্যানানাঃ ১কাপ আটা, ১/৪ চামচ লবণ, ২ চামচ চিনি, ১/২ চামচ বেকিং পাউডার, ডিম ১টা, ২টি কলা অল্প দুধে ভালভাবে মিশিয়ে গোলা করতে হবে। তারপর ফ্রাইপ্যানে তেল গরম করে তাতে এক হাতা গোলা দিয়ে ভালভাবে চারদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। এবার মৃদু অাঁচে বসিয়ে রাখুন। একপিঠ বাদামী হলে উল্টিয়ে অন্য পিঠ দিন। দুই পিঠ হয়ে গেলে বেশ হয়ে গেলো মজাদার প্যানকেক উইথ ব্যানানা। এবারের ঈদে সকালের নাস্তা হিসেবে আইডিয়াটা কিন্তু মন্দ নয়।
আর একটা প্রতিজ্ঞা করি আমরা, ‘‘কলা খেয়ে কলার খোসা যেখানে সেখানে না ফেলে ডাস্টবিনে ফেলব।’’
যেন কারো কলার খোসার আচার (আছাড়) খাওয়ার সৌভাগ্য না হয়। সবার এবারের ঈদ হোক কলাময়, কল্যাণময়। সেই কামনায় শেষ করছি আজকের এই কলকলানি।
কলকাকলিতে মুখর হোক সবার হৃদয়।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।