চেতনা আমানত—আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

এখনো পুরোপুরি শীত আসেনি। তবে শেষ রাতে প্রচুর কুয়াশা ঝরে। ভোরে সবুজ পাতায় সোনালী আলোয় সেই শিশির বিন্দুর ঝলমলে দৃশ্য হৃদয়ে পুলক জাগায়। যেন হিরে খচিত সবুজ গালিচা। মাহি, তিশা, রাতুল ও মিঠু সেই সবুজ গালিচা মাড়িয়ে স্কুলের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। এত সকালে স্কুল! এ আর নতুন কি। শহরের সেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল গুলোর দাপট কাদা মাটির পলিল গাঁয়েও এর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। গত কয়েক বছর থেকে গ্রামে গ্রামে কিন্ডার গার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে মুসলিম শিশুর প্রাথমিক ও ঈমান গড়ার মূল ভিত্তি তথা হাজারো বছরের ঐতিহ্য মক্তবগুলো আজ হয়ে যাচ্ছে নির্জীব। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো কয়েক যুগ পরেই আগামি প্রজনম ‘মক্তব’ শুধু বইয়ের পৃষ্ঠায় খুঁজে পাবে (যদি বা তকদির ভাল হয়)। যে বয়সের কচিমুখগুলো মুখরিত হয়ে উঠতো কালিমা ত্বয়্যিবা পড়ে পড়ে এখন সে মুখে উচ্চারিত হয় ‘হাম্পটি, ডাম্পটি’, সারে গা মা পা’ ইত্যাদি।

হায় অভাগা জাতি। কবে হবে তোমাদের শুভ বোধদয়?

মাছ বাজার পেরিয়ে স্কুলের রাস্তায় পা দিতেই মাহি তিশাদের সামনে হাজির হয় জরিনা পাগলি। ত্রিশ চল্লিশ বয়সের মাঝামাঝি জরিনা পাগলির পাগল হওয়ার একটা রহস্য আছে। সে রহস্য আজ না হয় নাইবা জানা হলো। জরিনা তিশাদের শুনাতে থাকে-

আয় টুনা আয় টুনি-

ঘর বান্ধুম কোণা কুণি,

হেই ঘরে বিলাইর ছাও-

তাড়াতাড়ি লইয়া যাও।

লইয়া যাও, লইযা যাও-

তাড়াতাড়ি লইয়া যাও।

বিলাইর ছাও বিলাইর ছাও-

লইয়া যাও লইয়া যাও।

জরিনার পাগলামিতে তাল মিলায় ছেলে মেয়েরা। জরিনা তখন আরো উন্মাদ হয়ে পড়ে। গায়ের জরাজির্ণ ধুলোমাখা ময়লা বস্ত্র খুলে ছুড়ে ফেলে দেই অদূরে কোথাও। দুষ্ট ছেলে গুলো তখন হৈ হুল্লোড় শুরু করে। পাথর ছুড়ে মারে জরিনার গায়েব উপর। জরিনা ছেলেদের তাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। দুষ্ট ছেলে গুলো বেপরোয়া হয়ে উঠে। জরিনা প্রাণ বাঁচানোর জন্য দেŠড় দেয়। ছেলে গুলোও পিছে পিছে দেŠড়ায় আর ছড়া কাটে-

জরি পাগলি কই যায়

পরনেতে কাপড় নাই।

ক্ষুধার্থ জরিনা সামান্য দেŠড়েই হাঁপিয়ে উঠে। বাছিরের দোকান থেকে একটা কলা ছিড়ে খেতে শুরু করলে বাছির কড়া ধমক দিয়ে বলে- এই খাওনের সময়তো পাগল থাহনা, হে…..

কামের কথা কইলে পাগলামি দেহাও,

যা কইছি নইলে দিলাম কইলাম…..

পরদিন তিশা ও মাহি তার ছোট চাচাকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। স্কুলের দক্ষিণ পাশের কাঠ বাগান দৃষ্টি পড়ল তিশার। তিশা মাহিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে-

ভাইয়া ঐ যে জরি পাগলি,

হুম, ঘুমাইতাছে।

চল ক্ষ্যাপাই। মিঠু পেছন থেকে বলে উঠে।

ছোট কাকা মাছুম বলে, একি বলছ তোমরা? সাবধান কখনো এমন করোনা। এতে পাপ হবে।

মিঠু; তোমার মা যদি এমন হতেন তবে কি পারতে তোমার মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করতে! নিশ্চয় পারতে না। জেনে রাখ মায়ের পায়ের নিচেই সন্তানের বেহেশত।

কিন্তু ওতো পাগলি। মিঠু ক্ষিণ কণ্ঠে বলে।

ভুল, উনি পাগলি না। উনি অসুস্থ।

কি হয়েছে ওনার? তিশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় মাসুমের দিকে।

ওনার চেতনা লোপ পেয়েছে? মানে মাহির অবাক জিজ্ঞাসা।

হ্যাঁ, ওনার চেতনা বিস্মৃত হয়েছে। চেতনা হচ্ছে বুঝ, জ্ঞান, বিবেক ইত্যাদি। সূর্য উদিত হলে আমরা যেমন বুঝতে পারি সকাল হয়েছে আবার অস্ত গেলে বুঝি রাত নেমেছে। কীভাবে আমরা বুঝি জান?

হ্যাঁ, আমাদের চোখ দিয়ে সব কিছু দেখি বলে, মিঠু বলে থামল।

সম্পূর্ণ ঠিক হয়নি তোমার কথা। চোখ দিয়েই সব কিছু সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন জ্ঞান বা চেতনার। যাদের সেই জ্ঞান আছে তাদের দু’চোখ না থাকলেও তারা ঠিকই বুঝতে পারে কখন রাত আর দিন হচ্ছে। সেই জ্ঞান নামক চেতনার অভাবেই আজ জরিনার মতো মানুষ মানুষের নিকট উপহাসের পাত্র।

তোমরা কি জান কাদের নিকট তাদের চেতনা আমানত রাখা হয়েছে? না চাচ্চু- মাহি ও তিশার সরল জবাব।

তাদের চেতনা আমানত রাখা হয়েছে আমরা যারা চেতনা শীল ও জ্ঞানী তাদের কাছে। তাই আমাদের উচিত এই সমস্ত মানুষদের উপহাসের খেলনা না বানিয়ে তাদের পাশে সহমর্মিতার হাত বাড়ানো। তাদের সুস্থ করে তোলা। অথচ আমরা তাদেরকে ব্যাঙ্গ করেই যেন আনন্দ পাই। তাই তাদের চেতনা আমানতের পরিবর্তে খেয়ানত হচ্ছে, ফলে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে এই সহজ সরল মানুষগুলো।

আমরা কি তাঁদের সুস্থ করে তুলতে পারবো? মাহির প্রশ্ন।

অবশ্যই পারবে। আর এজন্য প্রয়োজন তাদের প্রতি তোমাদের গভির ভালবাসা। তোমাদের একটু একটু ভালাবাসায় তারা খুঁজে পাবে তাদের নিজের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি। আর তখনই বাস্তবায়িত হবে আমাদের প্রতি অর্পিত এই মহান দায়িতব। একটি জীবন খুঁজে পাবে তার নতুন ভুবন। তাই এসো আমরা আজ থেকে ওনাদের পাশে সন্তান হয়ে দাঁড়াই। যেন তারা বুঝতে না পারে স্বজন হারা বেদনা। ফুটে উঠুক ঝলমলে সোনালী আলোর ঝলক।

মাহি, তিশা, মিঠু ও তাদের বন্ধুরা ছোট চাচা মাসুমকে সাথে নিয়ে জরিনার কাছে যায়, জরিনার পরনে একটুকরো কাপড় যা তার মাতৃঙ্গ ঢাকার জন্য যথেষ্ট নয়। মাসুম তার গায়ের চাদর জরিনার গায়ে জড়িয়ে দেয়।

তিশার আলতো পরশে জেগে উঠে জরিনা। চোখ খুলে তাকায় তিশাদের প্রতি। মিঠু, মাহি ও তাদের বন্ধুরা তাদের সকালের নাস্তা জরিনার হাতে দিয়ে বলে, তোমার জন্য এনেছি, তুমি খেয়ে নাও। আর হে তুমি পাগল নয় আমাদের মতোই মানুষ। তোমার প্রতি এমন ব্যবহার সভ্য মানুষের অসভ্য আচরণ। এখন থেকে তুমি আমাদের ‘বন্ধু’। জরিনা পুনরায় চোখ বন্ধ করে যেন তার এই স্বপ্ন ভেঙ্গে না যায়। তার এ স্বপ্ন আবার ভেঙ্গে যাবে নাতো?….

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!