আরো একটি কন্যা —- হাসান আজিজুল হক

অভিজ্ঞতা যত তীব্র আর উদ্বেগজনক হোক না, এ রকম ব্যাপার আজকাল এতই সাধারণ হয়ে এসেছে যে, তা নিয়ে বড়সড়ো একটা কথার অবতারণা একেবারেই অনর্থক। গতকাল নারায়ণ হৃদয়ালয়ে (কানাড়ি উচ্চারণে হৃদয়ালয়) আমার একটি এনজিওগ্রাম হলো। এসব এখন প্রায় নৈমিত্তিক চিকিৎসার অঙ্গ হয়ে গেছে। আমার এই তৃতীয়বার। হৃদযন্ত্রটা এমন ফুটিফাটা বদ্ধ অবস্থায় আছে যে, মেরামত করার জন্য একটি-দুটি স্টেইন্ট বসানো হলেও তা যথেষ্ট নয়। অন্যদিকে বাইপাস সার্জারি করা ঠিক হবে কি না বা হলেও তাতে উপকার দর্শাবে কি না, ডাক্তাররা নিশ্চিত নন। ডা. দেবী শেঠির চিকিৎসায় আছি ২০০৪ থেকে। ২০১০-এর অক্টোবরেও একবার এসেছিলাম। তখন তিনি একটা ব্যারেলের মধ্য দিয়ে আমাকে ঢুকিয়ে আধুনিকতম যন্ত্রে ‘সেনসোডাইন স্ক্যান’ করেছিলেন। রিপোর্ট দেখে বলেছিলেন এক বছর পরে অর্থাৎ গত অক্টোবরে আসতে। সঙ্গে একটি এনজিওগ্রাম দেশ থেকে করিয়ে আনতেও বলেছিলেন। সেটি আর হয়নি। এখন এই হৃদয়ালয়েই আর একটা এনজিওগ্রাম করাতে হবে। কাল সেটা হয়ে গেল। গতকাল খুব সকালে— আমি সাধারণত যে সময় ঘুম থেকে উঠি তার ঘণ্টা দুই আগেই— উঠিয়ে সেই হাসপাতালের কয়েদিমার্কা পোশাকটা পরিয়ে আমাকে একতলায় ক্যাথ ল্যাবের এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
অপেক্ষা করতে হবে। কতক্ষণ তা জানি না। ঠিক যেন ‘ওয়েটিং ফর গোডো’র একটা পরিস্থিতি এসে গেল। রোগীদের ঘরে বসানো হলো, অন্য যারা বসেছিলেন ওই এনজিওগ্রামের অপেক্ষায় তারা একেবারেই দেহাতি মানুষ। হয়তো অন্ধ্রের না হয় কর্নাটকের কিংবা তামিলনাড়– বা কেরালার। এদের চেহারা প্রায় আমাদেরই মতো। তবে বেশির ভাগই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। মাথায় ঘন চুল কোঁকড়া। চেহারায় অসম্ভব পরিশ্রমের ছাপ। বোঝা যায় এসব মানুষ কায়িক শ্রমে খুব সামান্যভাবে জীবনযাপন করেন। কী করে এই হাসপাতালে এসেছেন তার রহস্য উদ্ধার করা সম্ভব নয়। এদের তামিলদের মতো চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা নাক তেমন দেখা গেল না। অবশ্য আমি তো তামিলনাড়– সেইভাবে ঘুরে দেখিনি, জোর করে কিছু বলতে পারব না। অন্ধ্রের মানুষ কালো এবং ছোটখাটো। দারিদ্র্যলাঞ্ছিত চেহারা। তবে কর্নাটকের মানুষকে বেশির ভাগই সুপুরুষ বলে মনে হলো। সবাই কালো নয়। গৌরবর্ণের মানুষও অনেক দেখতে পাচ্ছি। মুখের ডৌলটা লম্বাটে ডিম্বাকৃতি। নাক বেশ চোখা। চোখও বড়সড়ো। এসব বৈশিষ্ট্য চমৎকার দেখা গেল মেয়েদের মধ্যে। মুটিয়ে যাওয়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা প্রচুর দেখলাম বটে ব্যাঙ্গালোরে, তবে তার অনুপাত যেন তুলনায় কম। মেয়েদের আমার অন্য রকমের সুন্দর লাগছিল। তাদের গড়নের বৈশিষ্ট্য হলো— অন্তত বালিকা থেকে মধ্যবয়সীদের দেখে তাই মনে হলো— কাঁকাল সরু; যেন হাতের মুঠোয় ধরা যায়। নিতম্ব নাতি প্রশস্ত, দুই সোজা দীর্ঘ পা। দেহের অনুপাতে পা দুটি লম্বা ও সরল। ঊর্ধ্বাঙ্গ যেন তুলনায় ছোটই। ভরা কলসের মতো বুক। গায়ের রং প্রায় মধুর মতো। কালোও প্রচুর আছে।
শ্রেণী নির্বিশেষে অপরিপাটি অবস্থায় এরা বাড়ি থেকে বেরুতে জানে না। জুঁই এবং ওই রকম সুগন্ধি নানা ফুলের মালা এদের খোঁপায় জড়ানো। চুল ঘনকৃষ্ণ, নিবিড় ও দীর্ঘ। যারা বেণি বাঁধেনি, বিনুনি করে চুলটা পিঠের ওপরে রেখেছে, মনে হয় কালো দীর্ঘ একটি আশ্চর্যসুন্দর সাপ নিতম্ব পর্যন্ত ঝুলে আছে। শাড়ির প্রচলন বেশ বেশি। সালোয়ার-কামিজের ঘটা এখানে নেই। বোঝা যায় এদের জীবন চলে বোধহয় আধুনিকতার মানদ-ে ঠিক নয়, ঐতিহ্যের ধারাক্রমে। কোথায় যেন একটা বর্তমানের সঙ্গে সুদূর অতীতের ঘোরলাগা রহস্য থেকে গেছে। রাস্তার ঝাড়–দারনিটিও এর ব্যতিক্রম নয়। পথের পাশে ফলমূল বেচতে আসা নারীরাও নয়। একটা সৌন্দর্যের পরিচর্যা যেন মনে হয় তাদের মজ্জাগত। সেই জন্যেই নাগরিক জীবনেও তেমন বিশৃঙ্খলা নেই, খেয়ালিপনা নেই। এটাতে আমি একটু অবাকই হয়েছি। জানি না এর সবটাতে আমি রং চড়িয়েছি কি না।
কোন কথা থেকে কোন কথা। ওই দেহাতি মানুষগুলোর সঙ্গে এখন একই ভাবনা নিয়ে বসে আছি। কথাবার্তা চালানোর উপায় নেই। কৌটোয় ছোলাভাজা ভরে নাড়া দিলে যেমন শব্দ বের হয় তাদের মুখের কথাগুলো যেন তেমনি করে ফুটতে ফুটতে বেরিয়ে আসে। এরা যখন ইংরেজি বলে তখনো মনে হয় কানাড়ি, তেলেগু, তামিল বা মালয়ালম বলছে। সবই অবশ্য আমার আন্দাজ।
অপেক্ষার সময় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। ঘরের ভিতরের আবছা অন্ধকারের মধ্যে এই সকালেই একটা নীরবতা জমাট বাঁধতে থাকে। ভীষণ অস্থির লাগে। যে অভিজ্ঞতা এর আগে দুবার হয়ে গেছে, এখন তার সামনে দাঁড়াতে এত অসহায় মনে হয় নিজেকে! কাজেই দেরিটা অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। একজনের নাম ডাকা হলো। ফাঁসির আসামির মতো সে উঠে দাঁড়াল। নিয়ে গেল তাকে। এই পরিবেশে মনে হলো লোকটা আর ফিরবে না। হাসপাতালের গহ্বরে ঢুকে চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন এবং অদৃশ্য হওয়ার কত গল্পই না আমরা পড়েছি। মার্কেসের ‘আমি কেবল টেলিফোনে কথা বলতে এসেছিলাম’ বা ‘বালির ওপরে তোমার রক্তরেখা’ গল্প দুটোর কথা আমার মনে পড়ল আর গল্প দুটিকে আমার বাস্তবসম্ভব বলে মনে হলো। ওই লোকটা তো ফিরছে না!
বোধহয় অনন্তকাল পরে ওই হেঁটে যাওয়া লোকটাকে স্ট্রেচারের ওপর মৃতবৎ যৎকিঞ্চিৎ হয়ে গিয়ে করিডরে পড়ে থাকতে দেখতে পেলাম। একটা সুচ ফুটিয়ে কী করতে পারা যায়! এইরকম করে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ মানুষটি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরে এক ইংরেজি জানা অশীতিপর গোয়ানিজ ভদ্রলোকের সঙ্গে— ইনি নিশ্চয়ই স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন কিংবা নামকরা আইনজীবী— কথা শুরু হয়ে গেল আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দিনের বাস্তব জগৎটা ফিরে এলো। ইংরেজ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার পর ফরাসিদের মতো গোয়া দামনদিউ থেকে পর্তুগিজদের মেরে তাড়িয়ে দেয়নি।
ভদ্রলোককে কথায় পেয়ে বসল। ভারতবর্ষের সুন্দরতম জায়গা হচ্ছে গোয়া, হয়তো সারা পৃথিবীর মধ্যে। কেন সেখানে যাব না আমি? হিন্দু-খ্রিস্টান আর মাত্র দুই শতাংশ মুসলমান সেখানে কেমন করে বাস করছেন সেটা দেখার জন্যও আলাদা করে সে দেশে যাওয়া উচিত। বাহান্ন ভাগ হিন্দু, দুই ভাগ মুসলমান বাকি সব খ্রিস্টান। মিলেমিশে একাকার। দামন, দিউ গুজরাটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। গোয়া আলাদা রাজ্য। সেখানে তো যেতেই হয়!
কী আশ্চর্য! ভুলেই গিয়েছি, এখানে কী জন্য বসে আছি। আমি যতটা পারি বাংলাদেশের কথা সাতকাহন করে বলে গেলাম। এর একটু পরে ওই ভদ্রলোককে ডেকে নিয়ে গিয়ে কোনো একটা ক্যাথ ল্যাবে ঢুকিয়ে দিল ওরা। ঘরে আমি এবার একা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অস্বস্তিকর, ভয়ংকর একটা নিস্তব্ধতা, বিচ্ছিন্নতা একাকিত্ব আর সামনে উপস্থিত একটা শরীরহীন বিবর তৈরি হয়ে গেল। ভীষণ শীত করছে। হাসপাতালের ঢিলে পোশাকের তলায় ঠা-া ঘরে কখন কাঁপতে শুরু করেছি নিজেই জানি না। এর সবটাই ঠা-ায় নয়। কেন ডাকে না, কেন খাড়া করে দিচ্ছে না অভিজ্ঞতাটার সামনে? কেন আগের দুবারের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম।
তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ডাক পড়ল। এলোমেলো পায়ে নার্স মেয়েটির পিছন পিছন হাঁটছি। চোখে পড়ল গোয়ানিজ বৃদ্ধটিকে স্ট্রেচারে শুইয়ে করিডরে আনা হচ্ছে। হাঁ করে আছেন ভদ্রলোক। প্রায় দন্তহীন মুখের ওপরের পাটির দুটি লম্বা দাঁত উঁচু হয়ে রয়েছে। দুই গালের জায়গায় বড় বড় গর্ত। বেঁচে আছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু আমি পাশ দিয়ে যেতেই চোখ মেলে আমার দিকে চেয়ে শীর্ণ একটা হাত তুলে সামান্য হাসলেন। আমি ভিতরে ঢুকে গেলাম। বড় বড় যন্ত্রে ঘরটি ঠাসা। ঘরের ভিতরে মাঘ মাসের ঠা-া। তারপর যা হয় আরকি— সাদা কাগজ পেতে আমাকে শুইয়ে ওই প্রচ- ঠা-ার মধ্যেই বিবসন করে ফেলা হলো। চারপাশে বালিকা আর যুবতী নার্সগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হয় একজনের দয়া হলো। বড় বড় কাগজ এনে একেবারেই না ঢাকলে নয় এমন করে শরীর ঢেকে দিল। নগ্ন, শীতার্ত— অনিশ্চয়তার ঠিক মাঝখানে রয়েছি আমি। শুরু হয়ে গেল ডাক্তার আর নার্সের প্রস্তুতি। খুঁটিনাটি কাজের অন্ত নেই। যন্ত্রগুলো কি বেঁকে বসেছিল?
এতক্ষণে ওদের দয়া হলো। কে যেন একটা কম্বল এনে আমার গলা পর্যন্ত ঢেকে দিল। তারপরের নীরস বর্ণনার আর প্রয়োজন নেই। মাত্র দশ মিনিট যেন অনন্তকাল। তপ্ত লাগছে হৃৎপি-। একবার মনে হলো দম বন্ধ হওয়ার অনুভূতি হচ্ছে। শেষ হয়ে গেলে কোনো রকমে পোশাকটা আবার পরিয়ে কম্বলচাপা দিয়ে লম্বা করিডরে এনে স্ট্রেচার রেখে নার্সটি যে কোনদিকে চলে গেল! কতক্ষণ পরে ডাক্তারি ঠুলিতে মুখঢাকা একটি প্রায় কিশোরী নার্স আমার দিকে ঝুঁকে পড়ল। নাক-মুখ কিছুতেই বোঝা গেল না। শুধু দেখলাম, আয়ত উজ্জ্বল কালো একজোড়া চোখ। এই চোখজোড়াই যেন মেয়েটির গোটা অস্তিত্ব। সে ইংরেজিতে বলল, বাবা, এখন আমি তোমাকে সিসিইউতে নিয়ে যাব। সেখানে তোমাকে তারা ঘণ্টাছয়েক রাখবে। বারে বারে তোমার রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের চিনি মাপবে। একটা ইসিজি মেশিন মাথার কাছে থাকবে। হয়তো রাত আটটার দিকে তোমাকে তোমার ঘরে দিয়ে আসব। খুব আনন্দের সঙ্গে লঘুপায়ে মেয়েটি স্ট্রেচার ঠেলছে। দীর্ঘ করিডোর পার হলো। একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে আরো চওড়া করিডর বেয়ে মেয়েটি সিসিইউতে আমাকে দিয়ে দিল। একটু পরে চলে আসার সময় সে আবার তার চোখ দুটি আমার মুখের কাছে এনে বলল, আমি সব সময় তোমার কাছে আছি। মুখের ঠুলিটা সে একবার খুললে পারত! সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর তাকে একবারও দেখিনি। এবার দায়িত্ব নিল সিসিইউয়ের নার্সরা। অনেকেই আসছিল আমার কাছে। তবে আমার দায়িত্ব ছিল একটি বাইশ তেইশ বছরের যুবতীর ওপর। তখন আমি অনেকটা ধাতস্থ হয়েছি। ওরা শরীরে নানারকম নলটল লাগিয়ে ফেলল। তীব্র খিদেবোধ হচ্ছে। এখন কিছুই খেতে দেবে না বলল। হাতের যেখানটায় সুচ বেঁধানো হয়েছে সে জায়গাটার তুলো সরিয়ে ক্ষতের মুখটা আঙুল দিয়ে টিপে ধরে আছে একটি মেয়ে। রক্ত চোঁয়াচ্ছে। সে প্রাণপণে টিপে ধরে আছে জায়গাটা। আমাকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করছে— তোমার কি ব্যথা হচ্ছে?
বারে বারে আমি বলছি, না।
একটানা প্রায় পনের মিনিট সে সুচ ফোটানোর জায়গাটা টিপে ধরে রইল, তোমার ব্যথা হচ্ছে না?
এইভাবেই টিপে ধরে থাকায় আমার সত্যিই ব্যথা করছিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটি! রক্ত বন্ধ হচ্ছে না কেন? সাধারণত আমার রক্ত সহজেই জমাট বাঁধে।
সে বলল, না, পুরো দু-ঘণ্টা লাগবে রক্ত বন্ধ হতে। রক্ত জমাট না বাঁধার ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে তোমাকে।
মেয়েটি রোগা পাতলা বেঁটে। স্বাস্থ্য ভালো নয়। আমি খুব টেনে টেনে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলাম, সে কোথাকার মেয়ে?
বলল, কেরালার।
তোমার ভাষা তো মালয়ালম?
হ্যাঁ।
কানাড়ি বলতে পারো?
পারি।
তামিল বলতে পারো?
পারি, এসব প্রায় একই ভাষা।
তা তোমার ইংরেজিটাও মনে হচ্ছে তোমাদেরই কোন ভাষা।
হ্যাঁ, আমাদের উচ্চারণ এইরকম।
দেখছি কথায় কথায় মেয়েটি তার নিজের হাতের যন্ত্রণা ভুলে যাচ্ছে। কিন্তু কতক্ষণ সে আর এভাবে চালাতে পারবে? একসময় বলল, আমি বরং ব্রাদারকে ডাকি, ওর গায়ে জোর আছে। ও রক্ত বন্ধ করতে পারবে।
একজন সুদর্শন পুরুষ এসে দাঁড়াল। তুলোটুলো সব সরিয়ে রেখে টিপে ধরে রইল ছিদ্রের মুখ। একবার করে বুড়ো আঙুল সরায় আর দেখে নেয় রক্ত কতদূর। তার বিরক্তি নেই। এটা বন্ধ করে তবে আমি যাব। শেষের দিকে সে তুলোর তলায় গজের মতো কাপড় লাগিয়ে কেবলই ঘষতে থাকে আর জিজ্ঞেস করে, ব্যথা লাগছে? ঘষার চোটে আমার চামড়া ছনছন করছে। সেটা তাকে বলতে গিয়ে ‘ছনছন করা’-র ইংরেজি খুঁজে পেলাম না। রাবিং টু মাচ, গ্রেটিং, ইরিটেটিং এসব কথা মনে এলো, ছনছন করার ইংরেজি পাওয়া গেল না। মনে হয় ঘণ্টাখানেক ধস্তাধস্তির পরে রক্তটা থামানো গেল। সে খুব ভালোভাবে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলে গেল, রক্ত বন্ধ হয়েছে।
ততক্ষণে জায়গাটার সঙ্গে আমি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। বিছানার তিনদিকে যে ধপধপে সাদা পর্দা রয়েছে সবগুলো টেনে দিলেই আমি নিজে যেন একা ঘরে রয়েছি। নানা কাজে নার্সরা আসছে, কেউ রক্তের চিনি পরীক্ষা করবে, কেউ প্রেসার মাপবে। ঘরভর্তি রোগী। এক মহিলা হেঁড়ে গলায় ‘উরে বাবারে’ ‘উরে বাবারে’ বলে চিৎকার করছে। মনে হয় বাঙালি। সবকিছু ভুলে ওই রকম বাবারে মারে বলতে একমাত্র বাঙালিরাই পারে। আর এরা আছে সর্বত্র! একটি নার্সকে জিজ্ঞেস করি—
ওই মহিলা চেঁচায় কেন?
ইনজেকশনের সুচ দেখে ভয় পাচ্ছেন।
জিজ্ঞেস করলাম, ফোটানোর আগে না পরে?
সে বলল, আগে, দেখেই।
আমি তখন এতটাই ভালো বোধ করছি যে, চারপাশে রোগীদের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য দেখে মজা পেতে শুরু করেছি। মেয়েগুলো যখনই কোনো কারণে কাছে আসছে জিজ্ঞেস করছি, তারা কোন রাজ্যের মেয়ে? ব্যতিক্রমহীনভাবে তারা বলছে, কেরালার মেয়ে। আমার দায়িত্বে থাকা নার্সটি কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, তোমার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে? সকাল থেকে কিছু খাওনি। এখন তোমাকে আমরা হালকা খাবার— দুধ রুটি দেব। এই মেয়েটির বয়স একটু বেশি, শ্যামলা রং, তেমন সুশ্রী নয়, তবে মুখের ভাবটায় আর চোখের চাহনিতে কেমন একটা মায়া আছে। মানুষকে দু-হাত দূরে দাঁড়িয়ে কাজ করতে দেখলেও কোনো যোগাযোগ টের পাওয়া যায় না, কিন্তু কোনো কারণে মানুষটি একটু ছড়িয়ে পড়লে, যেমন আপনাকে খাবারটুকু এগিয়ে দিচ্ছে, জ্বর দেখবার জন্য কপালে হাত দিয়ে মুখে থার্মোমিটার দিয়ে দিচ্ছে, দেখা যাবে এক আশ্চর্য যোগাযোগ তৈরি হয়ে গেছে। ঠিক বোঝানো কঠিন। কোথায় যেন আপনার ভাঁড়ারে কিছু মজুদ হচ্ছে। মানবিক বললে এইটুকু বোঝায় বলে আমার মনে হয়। সে মেয়ে ইসিজির পর্দার দিকে চোখ রেখে রেখাগুলো দেখতে দেখতে বলল, আমরা এখন আপনার হার্টবিটটা গুনে দেখছি। ওটা সবকিছুর হিসাব রাখবে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কোন রাজ্য থেকে এসেছো? কেরালা। এবার আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম। তোমরা প্রায় সবাই দেখছি কেরালা থেকে এসেছো। নার্সিংয়ে বিএসসি পাস করে তোমরা এতজন এখানে এসেছো। তোমাদের রাজ্যে কাজকর্ম পাওয়া কি কঠিন? খানিকটা। খুব ভালো তো নয় আমাদের রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থাটা। সবাই কাজ পায় না। এখানে কাজ পাওয়া অনেক সহজ। আমরা ন-হাজার রুপিতে চাকরি শুরু করি।
তুমি কি তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে এখানে থাকো? মানে তোমার পরিবারের সঙ্গে এখানে থাকো?
না। মেয়েটির মুখ ম্লান হয়ে গেল।
বাবা-মা কেরালাতেই থাকেন, ভাই-বোনও। আমি এখানে একা থাকি। হোস্টেলে।
তোমাদের অন্য সব মেয়েরাও কি এখানে কাজের জন্য এসেছে?
হ্যাঁ, আমরা সবাই হোস্টেলে থাকি বা নানা জায়গায় থাকি। অবসর একটুও পাই না। এই বলে সে চলে গেল। ফিরল সামান্য কিছু খাবার নিয়ে।
আমি কি খাইয়ে দেব?
কথা বলার শুরুতে সে ‘আপ্পা’ না কি একটা শব্দ করছে যার মানে হতে পারে বাবা বা কাকা। সে বলল, আমি বরং তোমাকে খাইয়েই দিই। তোমার তো ডান হাতে ক্ষত। আঙুল নাড়াচাড়া করতে পারবে কিন্তু কব্জি আরো ঘণ্টাদুয়েক বাঁকাতে পারবে না। তখন আমার তীব্র খিদে পেয়েছে। পাউরুটি ছিঁড়ে দুধে ডোবাতে গিয়ে কব্জিটাকে একটু বাঁকাতেই হলো। মণিবন্ধ শক্ত করে ব্যান্ডেজ করা। মেয়েটি বলল, না, ওভাবে তুমি খেতে পারবে না। সে তখন রুটি দুধে ডুবিয়ে পাখিকে খাওয়ানোর মতো করে আমাকে খাইয়ে দিল। তারপরেই ওষুধ। তারপরেই রক্তচাপ মাপা। এসব করে চারপাশের পর্দা ঠিকমতো টেনে দিয়ে বলল, এখন বিশ্রাম নাও, ছ-টার পর তোমাকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে সাততলায় তোমার ঘরে রেখে আসব।
তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে ঘণ্টাদুয়েক কাটলে মেয়েটি আবার এসে বলল, চাইলে তোমাকে কফি দিতে পারি। বুঝতে পারছি বাইরে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামছে। একটু কফি বা চা খেতে পারলে খুবই ভালো হয়। কিছুক্ষণ পর কফি নিয়ে এলে এই তাকে প্রথম জিজ্ঞেস করলাম,
তোমার নাম?
ব্রিজিত।
তুমি তাহলে খ্রিস্টান?
আমরা এখানে যারা আছি তারা প্রায় সবাই খ্রিস্টান।
হিন্দু তো কম নয় কেরলায়?
হ্যাঁ, দেশের জনসংখ্যার বড় ভাগই হিন্দু।
তোমাদের যে ভয়ংকর বর্ণপ্রথা ছিল সে কি এখনো আছে? নিম্নর্গের প্রান্তীয় মানুষরা রাতের অন্ধকারে চলাফেরা করত যাতে তারা কারো চোখে না পড়ে— এসব কি আছে এখনো? কেরালাকে আমার অত্যন্ত কাছের মনে হয়। হয়তো দু-তিনটি বামপন্থী রাজ্যের একটি বলে। তুমি কি অরুন্ধতী রায় পড়েছো? খুব বড় লেখক। বর্ণপ্রথার ভয়ংকর ছবি আছে তার লেখায়। পড়েছো ‘গড অফ স্মল থিঙ্গস’?
অরুন্ধতী রায়ের নাম শুনেছি। তার বই পড়িনি। সাহিত্যে আমার আগ্রহ নেই।
আমার মুখের দিকে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, এত কথা শুধোচ্ছো কেন?
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, তুমি কি জানো তুমি একটি নোবল প্রফেশনে আছো? তুমি নিশ্চয়ই জানো,
তোমাকে কতসব জিনিস ত্যাগ করতে হবে?
সে সামান্য মাথা নেড়ে বলল — জানি, বাঁচতে হবে আমাকে। দাঁড়াতেও হবে নিজের পায়ে।
ছ-টার পর ব্রিজিত এসে বলল, বাবা, এখন তোমাকে তোমার ঘরে দিয়ে আসব। সব ঠিকঠাক আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি নিজে আমাকে রেখে আসতে যাবে? সে বলল, অবশ্যই। আমাকে তো তোমার দায়িত্বও বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হবে। এই যে, স্ট্রেচার এসে গেছে। তুমি কব্জি না বাঁকিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে স্ট্রেচারে শুয়ে পড়ো।
স্ট্রেচার করিডর দিয়ে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিরাট লিফটার মধ্যে স্ট্রেচার ঢোকানো হলো। আমার ঘরে গিয়ে দেখি কিছুই তৈরি নেই। বিছানার চাদরটাও পাতা হয়নি। সে ওখানকার নার্সদের সঙ্গে খুবই তর্কাতর্কি শুরু করল, তোমাদের তো বলা হয়েছে, রোগী এখানে ছ-টায় আসবে। কিছুই তৈরি নয় কেন? ঘরটাকে ঠিকঠাক করতে যত সময় লাগল সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি বিছানায় শুয়ে পড়লে সে বলল — বাবা, এইবার আমাকে যেতে হবে।
তাকে শুধু বললাম, নার্সদের কাজই হলো রোগীর সেবাযত্ন করা। সেটা নিখুঁতভাবেই করা যায় নানা উপায়ে। তার মধ্যে একটি মাত্র খাঁটি উপায় হচ্ছে, প্রাণের তাপের সঙ্গে কাজ করা। এসো। কত দূরের মেয়ে তুমি! কন্যার মতোই লাগছে তোমাকে।
কী আশ্চর্য! মেয়েটির চোখ দুটি ছলছল করছে। আমার দু-পা স্পর্শ করে সে বলল, এমন করে বলবেন না। আমাকে আশীর্বাদ করুন। আমি ভগবান বুঝি না। আপনাদের আশীর্বাদকেই ভগবান বলে মনে করি।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!