ঠক শিয়ালের বন্ধু বক —– সমর ইসলাম

নানাভাইয়ের কাছ থেকে গল্প শোনার মজাই আলাদা। তালহা তাই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায় না। বিন্তি ও কচি তাদের দাদার কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছে। সুযোগ পেলেই তালহার কাছে এমন রসিয়ে রসিয়ে বলবে যে, লোভ হয় তাদের মতো করে গল্প বলার। কিন্তু তালহা তো নানাভাইকে কাছে পায় খুবই কম। যে দু’চারটা শুনেছে সেগুলো তো বিন্তি কচিরা আরও আগেই শুনেছে। ওসব গল্প বললে ওরা বলবে এটা আমরা জানি। দাদার কাছ থেকে শুনেছি। তালহার মতলব হলো নানাভাইয়ের কাছ থেকে এমন একটা গল্প শোনে শিখে নেয়া যা মামাতো বোন কচি ও বিন্তি জানে না। তাই এবার নানাভাই বেড়াতে এলে তালহা আবদার জানালো এমন একটা গল্প বলতে যা এর আগে কচি ও বিন্তিকে শোনানো হয়নি।
নানাভাই তো মহাবিপাকে। কচি ও বিন্তি তো সারাক্ষণ দাদাকে কাছে পায়। তাদেরকে খুশি করতে কখন যে কোন গল্প বলেছেন তা কি আর মনে করে রেখেছেন নাকি! তবুও তালহার পীড়াপীড়িতে তিনি কতক্ষণ গুম মেরে থেকে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। আজ এমন একটা গল্প তোমাকে শোনাবো যা এর আগে কাউকে বলিনি। ঠিক আছে?
তালহা মহাখুশি। নানাভাইয়ের চুলহীন মাথায় হাতে একটু আদর বুলিয়ে দিয়ে বললো, আচ্ছা! এবার তাহলে শুরু করুন।
এরপর নানাভাই ঝেড়ে কেশে বলতে লাগলেন-
এক বনে ছিল এক ধূর্ত শিয়াল। সে ছিল যেমনি ধূর্ত তেমনি শঠ। অন্যকে ঠকিয়ে সে আনন্দ পেতো। তার সাথে চালাকি করে কেউ পেরে উঠতো না। সকলকে ঠকানোই ছিল যেন তার কাজ। তাই তার সাথে কেউ বন্ধুত্ব করতে চাইতো না। শিয়াল সমাজ তো দূরের কথা, অন্য কোন পশু-পাখিও পারত পক্ষে তার কাছ ঘেঁষতো না। এ নিয়ে তার মনেও ছিল ভীষণ দুঃখ।
একদিন এই ধূর্ত শিয়ালটি পড়ে গেল মহাবিপদে। কি একটা মরা খেতে গিয়ে গলায় আটকালো একটা কাঁটা। এমনই জটিল অবস্থা যে না ভেতরে যাচ্ছে আর না বের করতে পারছে। ব্যথায় তো শিয়াল কেঁদে কেটে অস্থির।
বনের ধারে ছিল একটা জলাধার। তার কিনারে বসে কাঁদছিল শিয়াল। ধূর্তামি ও শঠতার কারণে তার এই বিপদের দিনে কেউ তাকে উদ্ধারে এগিয়ে এলো না। অনেকেই দূর থেকে দেখে দেখে কেবল হাসে। কাছেও আসে না। একটু সমবেদনাও জানায় না। রাগে দুঃখে শিয়ালের ভেতর থেকে আরও প্রচন্ড বেগে কান্না আসছিল। আহা! তার যদি একটা বন্ধু থাকতো, তাহলে নিশ্চয়ই তার এই বিপদের দিনে এগিয়ে আসতো। এসব ভেবে ভেবে সে কুঁই কুঁই করে কাঁদতে লাগলো।
পাশের জলাধারে মাছ শিকারে ব্যস্ত ছিল এক সাদা বক। শিয়ালের কণ্ঠ শোনে প্রথমটায় চমকে ওঠে। নিশ্চয়ই কোন কুমতলব আছে ব্যাটার। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলো এটা কোন ধোকাবাজের গলা নয়; বরং বিপদে পড়া এক আর্তের আহাজারি। তাই ভালো মনের সাদা বক গলা বাড়িয়ে বাড়িয়ে দেখে নিল শিয়ালের অবস্থাটা। তারপর এক পা দুই পা করে কাছেই চলে গেল।
শিয়ালের এমন বিপদকালে এই প্রথম কেউ কাছে এলো। তাই বককে দেখে শিয়ালের কান্না আরও বেড়ে গেল। কঁকিয়ে কঁকিয়ে জানালো তার কষ্টের কথা। তার এই বিপদের দিনে কেউ যে এগিয়ে এলো না সে কথাও জানাতে ভুললো না। শুনে বকের বড্ড মায়া হলো। আহা! বেচারা শিয়াল। সুস্থ থাকতে কত দুরন্ত আর দস্যিপনাই সে করে। বাঁশঝাড়ের বাসায় বসে কি আর তা দেখে না বক। অবশ্যই দেখে। ঐ গেরস্থ বাড়ির নাদুস-নুদুস ছাগলের বাচ্চাটা একা কী কৌশলেই না ধরে এনে খেয়েছে সে। অন্য শিয়ালদের ভাগও দিয়েছে। কিন্তু কেন যে তাকে এমন এড়িয়ে চলে অন্যরা এটা তখনও বোকা বকের অজানা।
যাই হোক, বক তার প্রতি সহমর্মিতা দেখালো। এই বিপদ থেকে উদ্ধারে এগিয়ে এলো। তার লম্বা ঠোঁটখানা ঘুরিয়ে শিয়ালকে আদেশের সুরে বলল, বড় করে হা করো দেখি?
শিয়াল তার কথামত বড় করে হা করলো। তারপর বক তার লম্বা ঠোঁট সমেত শিয়ালের গলায় ঢুকিয়ে দিয়ে দেখতে লাগলো কোথায় কাঁটা বিঁধেছে। বক দেখতে পায়নি তার আগেই শিয়ালের গলার ভেতরে ঢুকে যাওয়া ঠোঁট গিয়ে লাগে আটকে যাওয়া হাড্ডিতে। অমনি শিয়াল কঁকিয়ে বলে উঠে, হ্যাঁ হ্যাঁ এটাই কাঁটা। তুমি ভাই ঠোঁট দিয়ে ভালো করে ধরে দেখো, টেনে বের করতে পার কি না। উঃ! আ-উঃ!! তুমি ভাই আমাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করলে সারা জীবন তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো। আমার আন্তরিক বন্ধুত্ব তুমি পাবে।
: আহা! চেঁচিয়ো না তো! তোমার কিচ্ছু চাই না আমি। এ বিপদে তোমাকে সাহায্য করা আমার নৈতিক কর্তব্য। আরও হা করো, হ্যাঁ হ্যাঁ, আ..আ…!! এই যে, এই যে তোমার গলায় বেঁধা কাঁটা। নাও, এবার একটু আরাম করে নাও।
শিয়ালের চোখে পানি এসে গেল। তা যতটা না বকের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার চেয়ে বেশি বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার আরামে ও আনন্দে। শিয়াল একটুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ খেকিয়ে উঠলো, আমার গরীবালয়ে তোমার দাওয়াত বন্ধু। বলো, কবে যাবে চারটা ডাল-ভাত খেতে।
তালহা এ পর্যায়ে হেসে ফেলে নানাভাইকে প্রশ্ন করে বসে, বক আর শিয়ালেও ডাল-ভাত খায় না কি?
নানাভাই বলে উঠেন, তাই তো! খায় নাকি? তারপর শোধরে নিয়ে বলেন, না খাক, তাতে আমাদের কি! ওটা একটা কথার কথা আর কি। ওরা ওদের ভাষায় বলেছে আর কি, আর আমি বলছি আমাদের ভাষায়। আন্ডারস্ট্যান্ড?
: ইয়েস, প্রসিড ইউ। বলল তালহা।
: হ্যাঁ, যা বলছিলাম! শিয়াল এমন করে ধরলো, বক ব্যাটা আর কি করে। অগত্যা একটা তারিখ মতো দাওয়াত কবুল করে সে।
কিন্তু কয়লা ধুলেই কি আর ময়লা যায়? যায় না, তেমনি বদলায় না কোন প্রাণীর স্বভাবও। শিয়ালেরও বদলায়নি তার ধূর্তামি স্বভাব।
নির্ধারিত দিনে বক বেশ খোশ মেজাজে দাওয়াত খেতে এলো শিয়ালের আস্তানায়। শিয়াল তাকে খুবই যত্ন করে বসালো। মুখে যতটুকু পারে মধুর বুলি আওড়িয়ে খাবারের জন্য ডাকলো। বক খেতে বসে দেখলো ঝোল জাতীয় খাবার নিতান্ত চ্যাপ্টা দুটো বাসনে করে উপস্থিত করা হয়েছে। তার একটি বাসন নিজের দিকে টেনে নিয়ে শিয়াল বললো, আমি আবার স্যুপ জাতীয় খাবার পছন্দ করি কি না! হে. হে. হে! নাও দোস্ত খেয়ে নাও। আমার মতো চেটেপুটে খেয়ে নাও। আশা করি ভালো লাগবে।
বক তো নির্বাক। একে তার লম্বা সরু ঠোঁট, তার উপর তরল খাবার তাও আবার চ্যাপ্টা বাসনে। তার পক্ষে খাওয়া সম্ভব, তুমিই বলো?
তালহা দুই দিকে মাথা দোলালো। তারপর…?
তারপর বক কতক্ষণ চ্যাপ্টা প্লেটে ঠোঁট ঘষে ক্ষিধে নিয়েই বিদায় হলো। তবে যাবার আগে তাকে দাওয়াতের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে তার নিজের বাড়িতেও শিয়ালকে দাওয়াত করে গেল। ধূর্ত শিয়ালকে আচ্ছা মতো জব্দ করাই এখন বকের আসল কাজ। দাওয়াত করে এসে অবধি সে কেবল ভেবেই চলল কি করে এর উপযুক্ত বদলা নেয়া যায়। অবশেষে বুদ্ধি একটা পেয়েও যায়।
তালহার যেন আর তর সইছে না। প্রশ্ন করে বসলো, কী বুদ্ধি নানাভাই?
: সেটাই তো বলছি, শোন। শিয়ালও এলো নির্দিষ্ট দিনে বকের বাড়িতে দাওয়াত খেতে। যথারীতি মৌখিকভাবে ভালো ভালো কথা বলে ডেকে নিলো খাওয়ার টেবিলে। সেও রান্না করেছে তরল খাবার। আর পরিবেশন করেছে বোতল জাতীয় পাত্রে। মেজবান বক মেহমান শিয়ালকে উদ্দেশ্য করে বললো, দোস্ত! তুমি সেদিন বলেছিলে না তরল খাবার তোমার বেশ পছন্দ। তাই তোমার পছন্দের খাবারই তৈরি করলাম। যদিও তুমি আমাকে দাওয়াত দিয়ে আমার পছন্দের খাবার তৈরি করনি। কিন্তু আমি তা করিনি, বরং তোমার পছন্দকেই গুরুত্ব দিয়েছি। তা বন্ধু খাও, আশা করি বেশ মজা হয়েছে।
শিয়াল তো হতভম্ব। কি আর করবে। তার বাড়িতে দাওয়াত খাওয়ার সময় বক যেমন চেয়ে চেয়ে দেখেছে আর শিয়াল চেটেপুটে সাবাড় করেছে দু’প্লেট খাবারই ঠিক তেমনি আজ শিয়াল কেবল চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো সরু বোতলে লম্বা ঠোঁট ঢুকিয়ে চুকচুক করে সুস্বাদু তরল খাবার খেতে বককে। দাওয়াত খেতে আসা ক্ষুধার্ত শিয়ালের সে কি আফসোস! খাবারের সুগন্ধে তার পেটটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠে। কিন্তু সরু বোতলের মুখে তার মুখ ঢুকানোর প্রশ্নই আসে না। তাই সে কেবল জিহবা দিয়ে কতক্ষণ চেটেপুটে নিজের ধূর্ততা ও শঠতার কথা ভেবে এক রাশ লজ্জা নিয়ে বকের বাড়ি থেকে বিদায় নিল।
নানাভাইয়ের কাছ থেকে শোনে এই গল্পটা যখন কচি ও বিন্তির সামনে তালহা বলতে যাচ্ছিল তখন ওরা একটুখানি শুনেই বলে উঠে- তালহা ভাইয়া! আমরা এটাও জানি…!

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!