নোট ভাঙালে কাঁঠালপাতা—- মনোজ বসু

সাধুচরণ দিনমানে রেজেস্ট্রি-অফিসে দলিলপত্র লেখে, সন্ধ্যার পর ঠাকুরঘরে খিল এঁটে জপতপ সাধন-ভজনে মেতে যায়। ওরই মধ্যে কিঞ্চিত্‌ ঘুমিয়েও নেয় বইকি-নইলে আবার বেলা দশটায় অফিসে গিয়ে কলম ঠেলবে কি করে?
এক রাত্রে স্বপ্নের মধ্যে কে যেন বলল, জঙ্গলে কাঁটাবনের মধ্যে আমায় ফেলে দিয়েছে, বড্ড কষ্টে আছি। তুমি আমায় উদ্ধার করে নিয়ে যাও সাধুচরণ। ভোর হতে না হতে সাধুচরণ ছুটোছুটি করে জঙ্গলে গেল। পেয়ে গেল বিগ্রহ, ঠাকুরঘরে জলচৌকির উপর এনে বসাল। নাক নেই বিগ্রহের, মাথারও কিছু অংশ ভাঙা। সাধুচরণের বউ মনোরমা তাই নাম দিল বোঁচাঠাকুর। মায়ের দেখাদেখি মেয়ে সরলাও ঐ নামে বলে। তা বোঁচা হোন যাই হোন, ভারি জাগ্রত ঠাকুর- সাধুচরণ অনেক রকমে পরিচয় পেয়েছে।
দলিল লেখানোর লোক সবদিন সমান থাকে না। ভিড়ের চোটে কোনদিন সাধুচরণ চোখে অন্ধকার দেখে। আবার কখনো ফাঁকা ঘর হা-হা করে-ছঁুচোয় ডন কষে সেরেস্তার উপর। মাস গেলে মোটের উপর সত্তর-আশির ভুল নেই। তা ছাড়া বাড়ির লাগোয়া নারকেল-সুপারি আম-কাঁঠালের বাগান থেকেও আসে কিছু কিছু। চলে যায় মোটামুটি- সংসারে প্রাণী তিনটি, বাপ মা ও মেয়ে-বেশি টাকা লাগছে কিসে? সাধুচরণের পিসেমশায় সদর কালেক্টরির পুরানো আমলা। অনেকবার তিনি ডেকেছেন ঃ এসো, আমার অফিসে ঢুকিয়ে নিই। কিন্তু বোঁচাঠাকুর ফেলে সাধুচরণের নড়বার জো নেই।
চলে যাচ্ছিল বেশ একরকম। মনোরমা কিছুদিন থেকে বড্ড খিঁচিঁর-মিচির লাগিয়েছে ঃ সেয়ানা মেয়ে পাত্রস্থ করত হবে, খেয়াল আছে তোমার?
সাধুচরণ তাচ্ছিল্য করে বলে, মেয়ে জন্মেছে তো পাত্তর ওর আগে জন্ম নিয়ে আছে। ভাবছ কেন, তারাই খঁুজেপেতে বউ ঘরে তুলে নেবে।
মনোরমা বলে, এ মেয়ে খঁুজেপেতে নেবার মতন নয়। বোঁচাঠাকুর কষ্টিপাথরের, তোমার মেয়েও তো তাই। সাক্ষাত্‌ মা-কালী।
মা-কালীর মন্দটা কি হল? খোদ ভোলানাথ পাত্তর হয়ে এলেন। বউ বুকের উপর দাঁড়িয়ে, তবু তিনি একটিবার পাশ ফেরেন না। এমন শান্ত সভ্য পাত্তর ক’টা পাবে তুমি?
ছেঁদোকথায় মনোরমা ভোলে না। সেয়ানা মেয়ে ঘাড়ে নিয়ে কোন মা-ই বা ভোলে? বলে, মেয়ের গায়ের রং সোনায় ঢেকে দিলে তবে যদি পাত্তর এগোয়।
সাধুচরণ শিউরে উঠে বলে, যা দাম সোনার! দাম আবার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
মনোরমা বলে, বোঁচাঠাকুরকে নিয়ে বছরের পর বছর কাটাচ্ছ। চাকরি-বাকরিতে গেলে না। বলো তোমার ঠাকুরকে। কেমন জাগ্রত দেখি।
ভোলে নি মনোরমা। সকালবেলা উঠেই সাধুচরণকে প্রশ্ন ঃ বলেছিলে?
হুঁ-
জবাব কি দিলেন বোঁচাঠাকুর!
ঠাকুর-দেবতার জবাব কি নগদ নগদ পাওয়া যায়? ভাল করেই বলেছি, শুনলেন তিনি। নিশ্চয় ব্যবস্থা করবেন।
তাগাদা মনোরমার লেগেই আছে ঃ কি করলেন তোমার ঠাকুর? ব্যবস্থা কবে আর করবেন-মেয়ে বুড়ো হয়ে গেলে তখন?
একদিন রেগেমেগে বলল, বোঁচার খুব মজা দেখছি। পুজোভোগে নিত্যিদিন পুরো আধুলি খসাচ্ছেন! কাজের কথা উঠলে তখন কানে শুনতে পান না। স্পষ্টাস্পষ্টি বলে দিও, সময় আজকের দিনটা। এর মধ্যে কিছু করলেন তো ভাল, নয় তো কাল আমি ঢেঁকিশালে নিয়ে ঠাকুরকে ঢেঁকিতে কুটব।
সাধুচরণ ঘাবড়ে গিয়ে সে রাত্রে বোঁচাঠাকুরের কাছে খুব অনুযোগ করল ঃ তোমার বড্ড দোষ ঠাকুর, ভক্তের কথা কানে নিতে চাও না। আগে যেখানে ছিলে, সেখানেও ঠিক কথা শোন নি-তারা মাথা ফাটিয়ে নাক কেটে বনবাস দিয়েছিল। এবারে ঢেঁকির পাড় দেবে তোমার উপর, কুটে ছাতু-ছাতু করবে- বউ শাসিয়ে রেখেছে। মুখে যা বলেছে কাজেও ঠিক তাই করবে, রাতের মধ্যে যদি ব্যবস্থা না করো। চেনো না ওকে, সাংঘাতিক মেয়েমানুষ।
বোঁচাঠাকুরেরও ভয় ধরে গেছে। সাধুচরণ ঘুমোতে না ঘুমোতে স্বপ্নে এসে বললেন, তোর গামছাটা ছুঁয়ে রেখে যাচ্ছি। সকালবেলায় উঠোনের কাঁঠালতলায় ঐ গামছা পেতে দিবি। তিনটে কাঁঠালপাতা পড়বে, পড়েই দশ টাকার নোট হয়ে যাবে। মেয়ের বিয়েয় লাগবে কত রে?
আহ্লাদে সাধুচরণ দিশা করতে পারে না। কিছু বাড়িয়ে দিয়েই বলল, হাজার খানেক-বিড় বিড় করে একটু হিসাব নিয়ে বোঁচাঠাকুর বললেন, একমাস চারদিন লাগবে, কুড়ি টাকা আরও বেশি থেকে যাবে। পাতিস তাই। তারপরে গামছার আর গুন থাকবে না।
সাধুচরণ তাড়াতাড়ি বলে, দয়াই যখন করলেন টাকাটা ডবল করে দিন-দু’হাজার। জিনিষপত্রের দর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিয়ে পাকাপাকি হতে হতে হয়ত দেখব, দর ওদিকে দুনো-তেদুনো হয়ে গেছে। তখন আবার টাকা টাকা করে বেড়াও। বোঁচাঠাকুর ভক্ত-বাঞ্ছা পূরণ করে দিলেন ঃ বেশ, মঞ্জুর। দু-হাজারে লাগছে দু-মাস সাত দিন। যাকগে, গামছার পরমায়ু আমি আড়াই মাস করে দিচ্ছি। খুশি তো?
রসুন যাবেন না-। খুশি হচ্ছে না সাধুচরণ, মন খঁুত খঁুত করছে। আট আনা রেটে দলিল লেখে, সে মানুষের নজর কত আর মোটা হবে। একটা মোটা অঙ্কের টাকা বলতেই পারছে না প্রাণখুলে। বলল, খরচার সঠিক আন্দাজ পাচ্ছিনে বাবা। বউ বলছে, কালো মেয়ে সোনা দিয়ে মোড়ক না করলে কেউ ঘরে তুলবে না। সে তো মবলক টাকার ব্যাপার। একটু দিন সময় দয়াময়, কাগজ-কলম নিয়ে বসি। তারপরে বলব।
বোঁচাঠাকুর বললেন, স্বপ্ন হয়ে কতক্ষণ আর বাতাসে ভাসব। কষ্ট হচ্ছে বাপু, আমি চলে যাই। ধীরে সুস্থে তুমি ফর্দ করে ফেল। আমি কোন সময়ের মেয়াদ বেঁধে যাচ্ছিনে। গামছা যদ্দিন ইচ্ছা পেতো-পাতলেই তিনখানা করে নোট, তিন দশকে তিরিশ টাকা।
বর দিয়ে বোঁচাঠাকুর অন্তর্ধান করলেন। কখন সকাল হবে, সাধুচরণের সবুর সইছে না। মনোরমাকে ডেকে তুলে সমস্ত বলল। বলে, মেয়ের বিয়ের ভাল সম্বন্ধ দেখ। রাজা-বাদশার বেটা এনে জামাই করো না-টাকার অসুবিধা নেই, যত ইচ্ছে খরচ করব। মাস গেলে হাজার টাকা, বছরে বারো হাজার, আট বছরে লাখ। যাবত্‌ চন্দ্র-সূর্য তাবত্‌ এই রোজগার-ঠাকুর সীমানা বেঁধে যাননি। বোঁচাঠাকুর বলে তুমি আর তোমার মেয়ে হেনস্থা করতে, তারই করুণাটা দেখ এইবার।
পূবে ফরসা দিতেই সাধুচরণ কাঁঠালতলায় গামছা পাতল। জোড়হাত করে বসে আছে গামছা সামনে রেখে। সরলাও উঠে পড়েছে- মা-মেয়ে অদূরে গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে। অদ্ভূত কাণ্ড, ধন্য বাবা বোঁচা ভগবান! টুপটুপ করে তিন কাঁঠালপাতা গামছার উপরে পড়ল, পড়া মাত্রেই ঝকঝকে নোট- ছাপা হয়ে এই মাত্র বেরিয়ে এলো, মনে হবে। নোট তিনখানা তুলে পেড়ে বাক্সয় রাখা ছাড়া আর কিছু করবার নেই। গামছা পেতে সারাক্ষণ বসে থাকলেও আর নোট পড়বে না।
দলিল লেখার কাজে সেই দিনই ইস্তফা। নিত্যিদিন তিন-তিনখানা নোট আসছে, গোটা তিনেক টাকার আশায় কেন আর কলম পিশে মরতে যাবে? ঐ সময়টা সাধুচরণ অতিরিক্ত ভজন-পূজন নিয়ে থাকবে।
মনোরমা বলে, কাজ ছাড়লে, সংসার চলবে কিসে?
সাধুচরণ বলে, রাত পোহালেই তিরিশ টাকা। অভাব কি আমাদের। মেয়ের বিয়ের কাজেই কেবল নোট ভাঙানো হবে, এমন কথা ঠাকুরের সঙ্গে হয় নি।
পাঁচ দিনে দেড়-শ টাকা হল। কর্তা-গিন্নি মনের সুখে মাসকাবারি লম্বা ফর্দ বানাল। ফর্দ ও নোটের গোছ নিয়ে সাধুচরণ দোকানে গেছে। একমণ চাল কিনল। মাপজোপ সারা করে দাম দেবার জন্য পকেটে হাত ঢুকিয়েছে- হরি, হরি! যে নোটখানা তোলো কাঁঠালপাতা। বেকুবির একশেষ। দোকানির কাছে আমতা আমতা করে ঃ টাকা আনতে ভুল হয়েছে। রইল চাল, এখুনি এসে দাম মিটিয়ে নিয়ে যাব।
দোকানি চেনে সাধুচরণকে। বলে, আসবে না মশায়, ধাপ্পা দিচ্ছ কেন? কত বড় দেনেওয়ালা, জানতে বাকি নেই। সাধুচরণ শিকদার একসঙ্গে একমণ চাল কিনছে- আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম।
ঘাড় হেঁট করে সাধুচরণ বাড়ি ফিরল। সোজা ঠাকুরঘরে।
ধাপ্পা দিয়েছ ঠাকুর? আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন। পানাপুকুরে ছঁুড়ে ফেলব-এখুনি।
রাগ না চন্ডাল! জলচৌকির আসন থেকে তুলে ধরেছে বিগ্রহকে। হঠাত্‌ মনে হল একতরফা বিচার উচিত্‌ হবে না-ঠাকুরেরও কিছু বলার থাকতে পারে। মুশকিল হয়েছে, আদালতের আসামি টরটর করে জিজ্ঞাসার জবাব দেয়- ঠাকুরদেবতার সে ক্ষমতা নেই। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নেই কেবল ওঁরা। অতএব ঘুম না আসা অবধি বোঁচাঠাকুরের কৈফিয়ত শোনা যাচ্ছে না। রাগ চেপেচুপে থাকো সেই অবধি-উপায় কি?
ঠাকুরও ঘুমিয়ে আছেন। ঝিমুনি আসতে না আসতে আবির্ভাব। সাধুচরণ গর্জে উঠল ঃ চালাকি পেয়েছ বোঁচাঠাকুর? গুচ্ছের নোট দিয়ে যাচ্ছ, ভাঙাতে গেলে কাঁঠালপাতা। এত তোয়াজে রেখেছিলাম-ঠেলা বুঝো এবারে, পানাপুকুরে পচাপাঁকে ডোবাব ।
ঠাকুর সভয়ে বলেন, বুড়ো হয়ে গেছি বাবা, সব কথা গুছিয়ে বলার হঁুশ থাকে না। রোজ সকালে নোট পেয়ে যাচ্ছ- যতগুলো দরকার সম্পূর্ণ নিয়ে নাও। কি পরিমাণ নেবে, হিসাবটা তোমারই উপর ছেড়ে দিয়েছি। নেওয়া শেষ হয়ে গেলে গামছা পুড়িয়ে ফেলবে কোন দিন যাতে আর নোট কুড়ানোর উপায় না থাকে। টাকাকড়ির ব্যাপারে কুবের হর্তাকর্তা, তাঁর হুকুমে চলতে হয়, তোমার জন্য চিরকেলে টাকশাল বানিয়ে দিতে তিনি নারাজ। সেই জন্যে গামছা পোড়াতে বলেছেন। পোড়ানো হয়ে গেলে নোট আর তখন কাঁঠালপাতা হবে না।
তারপর থেকে সাধুচরণ নির্গোলে নোট কুড়িয়ে যাচ্ছে, মনোরমাও সরলার বিয়ের সম্বন্ধ দেখছে। ধীরে সুস্থে দেখা হচ্ছে- যত দেরি হয় ভাল, নোট বেশি জমবে। খরচা আরম্ভের ঠিক আগে গামছা আগুন দেবে। দিলেই তো হয়ে গেল- সিকিখানা নোটও বাড়বে না তারপর।
বিয়ের না হয় সবুর সইবে, সংসার-খরচের উপায়? বাড়ি বন্ধক দিয়ে সাধুচরণ মনোরমার হাতে টাকা এনে দিল। বলে কষ্টেসৃষ্টে চালাও, চেপেচেপে খরচ করো। এ টাকা ফুরোলে কি বন্ধক দেবো জানি নে।
মনোরমা খুশি নয়। বলে, কাজটা ভাল হল না। বাড়ি থেকে যেদিন দূর করে দেবে, পথে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না।
সাধুচরণ অভয় দিয়ে বলে, বাড়ি বিক্রি করি নি, বন্ধক দিয়েছি। টাকা ফেরত দিলেই খালাস হয়ে যাবে। টাকা তো ঘরেই আছে। গামছা পোড়ানোর ওয়াস্তা- মিনিট খানেকের বেশি লাগবে না।
বোঝাচ্ছে বউকে ঃ পোড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নোট কুড়ানোও ইতি। মেয়ের বিয়ের মবলগ খরচা। তাছাড়া আমরা কতকাল বাঁচব, ঠিক ঠিকানা নেই। বাঁচলে খাওয়া-পরার ব্যাপার আছে। এইসব ভেবেই বেশি করে নোট জমাচ্ছি।
মনোরমা এসব বুঝবে না। পোড়াও, পোড়াও- রব তুলেছে। সরলার বিয়ের জন্যেই তো ঠাকুরের কাছে দরবার। দশ টাকার নোটে নোটে ছয়লাপ, কাঠের বাক্সের আধাআধি ভরে নেছে- তবু সাধুচরণ গা করে না। সে দেখে, সকাল হলেই তিরিশ টাকা, গামছা পোড়ানো মানে বাঁধা রোজগার খতম। মেয়ের বিয়ে থাক কিছুদিন চাপা।
ঘটকের খোশামুদি করে অথবা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে মনোরমা দু-একটা সম্বন্ধ আনে, সাধুচরণ ছুতোনাতায় নাকচ করে দেয়। এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া। মনোরমা বলে, বুঝেছি, ঐ গামছা থাকতে কোনদিন আমার মেয়ের বিয়ে হবে না। গামছা আমিই পোড়াবো।
সাধুচরণের ভয় হল, দিল বা সত্যি সত্যি উনুনে ঠেলে। গামছা দিবারাত্রি সে এখন কোমরে বেঁধে রাখে- ধুতি-জামা গামছার উপরে। নিশ্চিন্ত। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে একটুখানি মেলে ধরে নোট তিনখানা নিয়ে নেয়। আবার কোমরে বাঁধে।
মনোরমা ওদিকে ভাইকে খবর দিয়ে এনেছে। ভাই-বোনে লেগে পড়ে একটা সম্বন্ধ পাকাপাকি করে ফেলল। বিয়ে মাঘ মাসে- খাটাখাটনি যত-কিছু মনোরমার ভাইই করবে, সাধুচরণ শুধু টাকা দিয়ে খালাস।
কিন্তু মাঘে সাধুচরণের ঘোর আপত্তি। মাঘ মাসে বিয়ে হয়ে কোন এক পিসিমা নাকি বিধবা হয়েছিলেন, সেই থেকে এ বংশের মেয়ের মাঘে বিয়ে দেওয়া নিষিদ্ধ। অনেক কাকুতি মিনতির পর পাত্রপক্ষ শেষটা রাজি হলেন। মাঘে নয়, বিয়ে ফাল্গুন মাসে। সেই ফাল্গুনও এসে গেল যে। বিয়ের কেনাকাটা আগেভাগে করতে হবে, টাকা দাও। অর্থাত্‌ পোড়াও গামছা। সাধুচরণ আজ-না-কাল করছে- দিনটা গেলেই তিরিশ টাকা। বলা নেই কওয়া নেই-দুম করে সে পাত্রের বাড়ি গিয়ে পড়ল। পাত্রের বাপের হাত জড়িয়ে ধরে সকাতরে বলে, বিষম এক ঝামেলায় পড়ে গেছি। বিয়ে ফাল্গুনেও নয়, বোশেখে।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পাত্রের বাপ রুষ্টমুখে বলল, বিয়ে দেবো আমি ফাল্গুনেই। অন্য সম্বন্ধ দেখা আছে। সে মেয়ে অনেক ভাল। আপনি আসুন-গে যান- নমস্কার!
কি টোপ ফেলবে, সাধুচরণ সবিস্তার ভেবেচিন্তে এসেছে। বলল আপনার অসুবিধা বুঝতে পারছি। রাগ করবেন না, পণের দিক দিয়ে আমি হাজার টাকা বাড়িয়ে দেবো এই বাবদে।
পাত্রের বাপ মনে মনে হিসাব করল ঃ ফাল্গুনে আর বোশেখে কি-ই বা এমন তফাত্‌? ফোকটে হাজার টাকা এসে যাচ্ছে, ক্ষতি কি!
আর সাধুচরণও খতিয়ে দেখেছে ঃ দু মাসে মোটামুটি আঠার-শ কুড়িয়ে তুলব। তার মধ্যে হাজার টাকা বেড়িয়ে গেলেও আট-শ আমার নিট মুনাফা। কে দেয়?
কথাবার্তা পাকা করে সাধুচরণ বাড়ি ফিরছে। বড়নদী পথে পড়ে, নৌকোয় পার হচ্ছে। বাঁক ঘুরে হঠাত্‌ স্টিমার এসে পড়ল- স্টিমারে নৌকোয় ঠোকাঠুকি। নৌকো ডুবল, সাধুচরণ খরস্রোতে ঝাঁপাঝাঁপি করছে। তারপর আর-কিছু সে জানে না।
চেতনা ফিরলে দেখে সে হাসপাতালে। চরের উপর পড়ে ছিল, জেলেরা উদ্ধার করেছে।আরে আরে, কোমরে গামছা কই? সর্বনাশ হয়েছে, ঢেউয়ের ধাক্কায় ধাক্কায় গেরো খুলে গামছা ভেসে গেছে কোথায়।
সরলার বিয়ে আজও হয়নি। দেনার দায়ে বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে, মনোরমাদের বড় কষ্ট। কিন্তু কাঠের বাক্স ছাড়েনি। বাক্স দশ টাকার নোটে ভরতি। হলে হবে, ভাঙানো যায় না- ভাঙাতে গেলে কাঁঠালপাতা। তবু আশায় আশায় মনোরমা একখানা নোট আঁচলে বেঁধে দোকানে চলে যায়। আঁচল খুলে কাঁঠালপাতা। কতবার চেষ্টা করে দেখেছে- কাঁঠালপাতা ছাড়া কিছু নয়। আর সাধুচরণ পাগলের মতন নদী-কিনারে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। হঠাত্‌-বা জলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে দেখে। না, গামছা নয়- শেওলা, ঘাস-পাতা…

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!