হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রঃ) – পর্ব ১০
হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রঃ) – পর্ব ৯ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
৪৮. এক ধনী ব্যক্তি সুফী-সাধক ছাড়া আর কাউকে দান করতেন না। কেননা, তিনি বলতেন, আল্লাহ্র ধ্যান ছাড়া তাঁদের অন্য দিকে লক্ষ্য থাকে না, কিন্তু অভাবগ্রস্ত হলে তাঁর ধ্যান-নিমগ্নতায় বিঘ্ন ঘটে। সুতরাং হাজার হাজার দুনিয়াদার মানুষকে সাহায্য করার চেয়ে একজন আল্লাহ্র পথের পথিককে দান করাই শ্রেয়। হযরত জুনায়েদ (রঃ) একথা শুনে বললেন, এটি খাঁটি আল্লাহ্ প্রেমিকের কথা।
যাই হোক, ঐ দাতা মানুষটি এভাবে দান করে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেল। তখন হযরত জুনায়েদ (রঃ) তাঁকে কিছু অর্থ দান করে বললেন, এ দিয়ে আপনি ব্যবসা-বাণিজ্য করুন।
কেননা আপনার মতো লোকের পক্ষে ব্যবসা করায় কোন ক্ষতি নেই। বরং তার প্রয়োজন আছে।
৪৯. হজ্জে গমনের পথে সৈয়দ নাসেরী নামে এক ব্যক্তি বাগদাদে এসে হযরত জুনায়েদ (রঃ)-এর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি নাসেরীকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কোথা থেকে আসছেন? নাসেরী বললেন, গীলান থেকে।
-আপনি কোন বংশের লোক?
– হযরত আলী (রঃ)-এর।
তিনি দু’খানি তরবারি দিয়ে যুদ্ধ করতেন। একখানি তরবারি ব্যবহৃত হত নফসের বিরুদ্ধে। অন্যখানি কাফেরদের মোকাবিলায়। আপনি কোন তরবারি চালনা করেন?
একথা শুনে সৈয়দ আর স্থির থাকতে না পেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। বললেন, আমার এবারের হজ্জ এখানেই সম্পন্ন হল। দয়া করে আমাকে আল্লাহ্র পথ দেখিয়ে দিন। হযরত জুনায়েদ (রঃ) বললেন, আপনার বুকখানি হল আল্লাহ্র খাসমহল। কাজেই এর মধ্যে কোন অপবিত্র জিনিসকে স্থান দেবেন না। তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই সৈয়দ নাসারী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
তত্ত্বজ্ঞানী হযরত জুনায়েদ (রঃ)-এর উপদেশগুলি জটিল। কিন্তু প্রাণিধানযোগ্য। তিনি আপন শিষ্যগণকে বলেছিলেন।
১. দাসগণের সাধনার পথে শত্রুরা প্রতিবন্ধকতার জাল বিস্তার করে। যেমন-ধোকা, মোহ, অনুগ্রহ ইত্যাদি। অতএব, এ পথে অগ্রসর হতে হলে জালগুলির উদ্দেশ্য অনুধাবন করা দরকার। প্রয়োজনে জাল ছিন্ন করার জন্য বীর পুরুষ হতে হবে।
২. সাধকের চোখে যখন আল্লাহ্র মাহাত্ম্য-মহিমা প্রকাশিত হয়, তখন তাঁর কাছে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ অন্যায় বলে মনে হয়। তিনি যখন আল্লাহ্র অভিজাত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দর্শন করেন, তখন তাঁর শ্বাস বিন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। আর তাঁর চোখে যখন প্রচণ্ড ভীতি প্রকট হয়, তখন তাঁর ভয়ে শ্বাস গ্রহণকে তিনি ধর্মবিরুদ্ধ বলে মনে করেন।
৩. আল্লাহ্ প্রেমে ব্যাকুল হয়ে দরবেশ আক্ষেপের যে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তা প্রভু ও দাসের মধ্যবর্তি পর্দা জ্বালিয়ে দেয়।
৪. দাস দু’শ্রেণীর। (ক) দাসত্ব জ্ঞানের বিদ্যা যারা অর্জন করেছেন। (খ) যারা আল্লাহ্ তত্ত্বের জ্ঞানলাভ করেছেন।
৫. কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ কর। যে অনুসরণ করে না কেউ যেন তারও অনুগামী না হয়। কেননা, রাসূলে করীম মানুষকে যে পথ দেখিয়েছেন তাই উত্তম পথ। অন্য পথ ভ্রান্ত। নিকৃষ্ট।
৬. প্রভু ও দাসের মধ্যে সমুদ্রতূল্য অন্তরায় হল চারটি। যথাঃ (ক) দুনিয়া- যা পার হতে গেলে ত্যাগ প্রয়োজন। (খ) মানুষ- মানুষকে সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকাই হল মানুষের বাঁচার উপায়। (গ) শয়তান- তার সঙ্গে শত্রুতা করে বাধা দূর করতে হয়। (ঘ) রিপু- রিপু বিরুদ্ধাচরণ করে এই অন্তরায় অপসারিত করতে হয়।
৭. শয়তান ও রিপুর প্রলোভনের মধ্যে পার্থক্য এই যে, ‘লা হাওলা’ কলেমা পাঠ করে শয়তানের ছলনা থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়। কিন্তু রিপুকে তাড়ানো খুবই কঠিন। সে যা চায় তা না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই হটে না। কখনও কখনও হয়তো বা উদ্দেশ্য পূরণে সে বিরত হয়, কিন্তু অচিরেই লুপ্ত বা সুপ্ত আকাঙ্খাকে সে পুনরুজ্জীবিত করে। অতএব, রিপু শয়তান অপেক্ষা প্রবল। আর এর মোকাবিলা করার জন্য পীরের নিকট দীক্ষা নিতে হয়।
৮. আকৃতির দ্বারা নয়, মানুষ পরিচিত হয় তার সৎ স্বভাবের জন্য।
৯. আল্লাহ্কে যে কখনও চিনতে পারে না, সে কখনও সুখী হতে পারে না।
১০. আল্লাহ্ পাকের গভীর রহস্য তার বন্ধুগণের অন্তরে নিহিত থাকে।
১১. জাহান্নামের আগুন দগ্ধীভূত হওয়া অপেক্ষা আল্লাহ্র প্রতি উদাসীন থাকা কঠিনতর।
১২. প্রকৃত বুদ্ধিমান সে-ই, যে নির্জনতা পছন্দ করে।
১৩. যে জ্ঞান দৃঢ় বিশ্বাস পর্যন্ত, যে দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহ-ভীতি পর্যন্ত, সে আল্লাহ-ভীতি পুণ্যকর্মের চর্চা পর্যন্ত, যে পুণ্য কর্ম বিশুদ্ধতা পর্যন্ত, যে বিশুদ্ধতা প্রতি কাজে আল্লাহ্র জ্যোতি পর্যন্ত না পৌছায় তার কোন মূল্য নেই। তা দ্বারা কোন সুফল পাওয়া যায় না।
১৪. দুনিয়া ছেড়ে নির্জনতা অবলম্বন দ্বারা যেমন ঈমান নিরাপদ থাকে তেমনি পরিতৃপ্তিও লাভ করা যায়।
সূত্রঃ তাযকিরাতুল আউলিয়া