সূচনাঃ
সম্পর্কসূচক যতগুলো শব্দ আমরা জানি, তার মধ্যে ‘ভাই’ শব্দটি খুবই নৈর্ব্যক্তিক ও আপেক্ষিক। স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ—ভাই ঢাকা-মক্কা, প্রাচীন-অর্বাচীন, কৃতী-দুষ্কৃতী নির্বিশেষে উপর্যুপরি ব্যবহৃত এবং স্বীকৃত।
ভাইয়ের রকমফেরঃ
দ্বিন-ইসলামের দুর্দিন ঘোচাতে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে সদা প্রস্তুত জিহাদি ভাই।
দীক্ষাদাতার কাছে আগত গ্রহীতা, লঘু-গুরু যাই হোক, তারা একে অন্যের গুরুভাই।
ওদিকে সুতা, লতা বাহুডোরে বেঁধে সৃষ্ট বন্ধনকে আমরা বলি রাখিভাই।
আবার বঙ্গমুলুকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমকারী ব্যক্তিটি বাংলাভাই। আমার মতে, তার নাম হওয়া উচিত ছিল ‘বাংলার ভয়’।
শ্যালিকামহলে একই সঙ্গে শিহরণ ও হরণের দোলা দিয়ে যাওয়া মানুষটি—দুলাভাই।
সভা-সমিতিতে ভাইঃ
পথসভা, জনসভা, ধর্মসভা, মিছিল-মিটিং, বক্তৃতা-বিবৃতি ইত্যাদি অনুষ্ঠানে অনেক বক্তা সম্বোধনে ‘ভাই’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। হবু বক্তারাও দৃষ্টি আকর্ষণের এই সার্বজনীন ঐতিহ্য মেনে চলবেন—বাংলাভাষীরা এমন আশাই পোষণ করেন।
তবে সাতই মার্চের রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু দেশবাসীকে ‘ভাই’ বলে যে অভয় দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসে অমর-অক্ষয় হয়ে থাকবে।
ভাষণের তৃতীয় লাইনে দেশমাতৃকার জন্য নিবেদিতপ্রাণ বঙ্গসন্তান যেভাবে ‘ভাই’ শব্দে উচ্চারিত—
“ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।”
এভাবে দশম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ, চতুর্দশ প্যারায় দফায় দফায় ‘ভাই’র ব্যবহার লক্ষণীয়।
বিমাতার ছেলে কার্যকলাপে অসৎ হয়ে নাকে খত দিলেও গৎ বাঁধা বুলিতে সে সৎভাই।
স্ত্রীর ভগ্নিপতি—ভায়রাভাই। যাকে নিয়ে প্রচলিত লোকপ্রবাদ—
“কুটুমের মধ্যে ভায়রা, মাছের মধ্যে খয়রা।”
ভাই পারিবারিক মণ্ডলেঃ
বয়সের ধারাবাহিকতায় পরিবারে ভাইদের স্বভাব ও প্রভাবে পার্থক্য থাকে বিস্তর এবং পারিবারিক চলিতরীতি অনুযায়ী তা দৃষ্টান্তবত্। বড়র দায়-দায়িত্ব বড়। পিতৃত্ব না থাকলে তার কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব বেড়ে যায়। মেজোর মাজেজা দেখা যায় মেজাজ ও একগুঁয়েমিতে। ওদিকে জীবনের অনেকটা অংশই কেটে যায় ছোটদের ছোটাছুটিতে।
গানে-শ্লোগানে ভাইঃ
ভাই আছে মনে-প্রাণে; পাশাপাশি ভাই থাকে গানে-শ্লোগানে।
‘হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই’—অসাম্প্রদায়িক শ্লোগানে এর জবাব নাই।
প্রভাতফেরিতে—‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’—গানটি প্রতি শহীদ দিবসে কোরাসে গাওয়া হয়।
মামার, শালা, পিসারও ভাই। তার সাথে কোনও সম্পর্ক নেই।
গানটি গীত হবার প্রায় আড়াই যুগ পরে এসেও সমকালীন শ্রোতাদের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করছে।
ঢাকাইয়া ছবির গান—‘আমার ছোট ভাইটি মায়ায় ভরা মুখটি’—আজও অনেক মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
‘এই সুন্দর ফল, সুন্দর ফুল, মিঠা নদীর পানি’—গানটির প্রথম অংশে—‘তুমি কতই দিলে রতন/ভাই-বোরাদার পুত্রস্বজন।’
এখানে বাংলা ‘ভাই’র সাথে ইংরেজি ‘ব্রাদার’ যোগে সৃষ্ট যৌগিক শব্দ ‘ভাই-ব্রাদার’, শুধু ‘ভাই’র তুলনায় কত দূরপাল্লার তা বোঝা শক্ত।
প্রবাদ-প্রবচনে ভাইঃ
‘ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই / আঁটাআঁটি হলেই লাঠালাঠি’—বাংলা প্রবাদ।
ভিয়েতনামী প্রবাদ—‘ভাই-বোন হাতপায়ের মতোই অন-রঙ্গ’।
হিন্দি প্রবাদ—‘তরী পারাপারে ভাইকে সহযোগিতা করলে নিজেও তীর খুঁজে পাবে’।
আফ্রিকান প্রবাদ—‘বসবাস কর ভাইয়ের মতো, ব্যবসা কর আগন্তুকের মতো’।
ধাঁধায় ভাইঃ
মায়ের নাম লতাবতী, ভায়ের নাম সোনাবতী, ভাইয়ের নাম ঠেঙ্গা।
দক্ষিণ ত্রিপুরার এই ধাঁধায় মা, বোন ও ভাই যথাক্রমে পান, চুন, সুপারি।
‘ভাই গো ভাই/এক পুরিয়া বাঁশ কোথায় পাই’—জলপাইগুড়ির এ ধাঁধার উত্তর—ঢ্যাপের ডাঁটা।
মনীষীদের চোখে ভাইঃ
ইজরেল জংউইল—‘একটা ভাই সৃষ্টি করতে দুটো মানুষ লাগে’।
জেম ব্যাপটাইজ—‘ভাই প্রকৃতি প্রদত্ত বন্ধু, উনি আরও যোগ করছেন। আমি আত্মাকে খুঁজি কিন্তু তাকে কোথাও দেখিনা। আমি ঈশ্বর খুঁজছি কিন্তু তিনি আমাকে প্রতারিত করেন না। আমি আমার ভাইকে খুঁজি এবং সর্বত্র তাকে দেখি।’
ইংলিশ বংশোদ্ভূত মার্কিন অভিনেতা বব হোপ—‘আমি ছয় ভায়ের মধ্যে বেড়ে উঠেছি। সেজন্য আমি শিখেছি কীভাবে বাথরুমের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।’
আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং—‘আমরা শূন্যে ওড়া শিখেছি পাখির মতো, সমুদ্রে সাঁতার কাটা শিখেছি মাছের মতো। কিন্ত আমরা এখন অব্দি সহজ নান্দনিক জীবন-যাপন শিখিনি ভাইদের মতো।’
ভাইয়ের দাদাগিরিঃ
কেরোসিন শিখা বলে মটির প্রদীপে,
ভাই বলে ডাকো যদি গলা দিব টিপে;
হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা,
কেরোসিন বলে ওঠে—‘এসো মোর দাদা’।
উপর্যুক্ত কবিতায় ভাইয়ের দাদাগিরির যে চিত্র পাওয়া যায়, সেই দাদাগিরি সমকালীন দাদাদের গিরায়-গিরায় সমভাবে উপস্থিত। বড়ভাইরা বড় ভয়ের পরিবর্তে বরাভয় প্রদান করে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকে। যেমন কোরান শরীফের প্রথম বাংলা অনুবাদক—ভাই গিরিশচন্দ্র।
রঙ্গ কৌতুকে ভাইঃ
একটি ছোট বালক তার বাড়ির কাছের পুলিশ ষ্টেশনে গিয়ে বলল—
“আমরা তিন ভাই একই ঘরে থাকি। বড় ভায়ের সাতটা বিড়াল, মেজোর তিনটে কুকুর আর সেজোর একটি ছাগল আছে। এই প্রাণীগুলো একসঙ্গে অবস্থানের ফলে থাকার ঘরটা দুর্গন্ধে ভরপুর। প্লিজ স্যার, আপনি এমন ব্যবস্থা নিন যাতে নারকীয় পরিবেশ থেকে আমি মুক্তি পেতে পারি।”
বৃত্তান শুনে পুলিশ অফিসারটি বলল—“তোমাদের ঘরে কোন জানালা আছে?”
বালক তড়িৎ উত্তর দিল—“তা তো অবশ্যই।”
অফিসারের সন্দিগ্ধ কণ্ঠ—“আপনি কী যে বলেন?”
বালক—“জানালা খুলি আর আমার পায়রাগুলো উড়ে যাক।”
উপসংহারঃ
‘ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধনে যদিও পৃথক হয় নারীর কারণে।’
ভাই-ভাই বন্ধন কোনো নারী, নর বা বানরের কারণে মন্দন না হয়—এই প্রত্যাশাই থাকবে ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের কাছে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।