ইলুসোনা অনেক অনেক রাগ করেছে। ভাত খায়নি, কথা বলছে না কারও সঙ্গে। সে এখন গালে হাত দিয়ে বসে আছে বারান্দার এক কোণে। কারণ তার লাল পুতুলটার মাথা আজ ভাই ভেঙে ফেলেছে। যে পুতুলটা মামা তাকে জন্মদিনে কিনে দিয়েছিল। ইলুদের এক চিলতে বারান্দায় টবে মা অনেক রকম ফুলের গাছ লাগিয়েছে। ওদের দুই ভাই-বোনেরই ফুল খুব পছন্দ। মন খারাপ হলেই ইলু ফুলদের সঙ্গে মন খারাপের গল্প করে। এখন আগস্ট মাস। প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি থাকে। ইলু মন খারাপ করে বৃষ্টি দেখে। মা-বাবা সবাই সকাল সকাল অফিসে বেরিয়ে গেছে। মা যখন অফিসে বেরিয়ে যায় ইলুর খুব মন কেমন করে। দাদু-দিদু এখন তাদের বাসায়। তারা নানা রকম গল্প করে ইলুর মন ভোলানোর চেষ্টা করে। তবুও মা আসার অপেক্ষায় পথের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। ইলুর বেশ ক’জন বন্ধু। টিয়ে বন্ধু, গোল্ড ফিশ বন্ধু, কাক বন্ধু, পিঁপড়ে বন্ধু, টিকটিকি বন্ধু, চড়ুই বন্ধ, ফুল বন্ধু। ঢাকা শহরে ফুল-পাখিদের তেমন কেউই তো থাকে না, তাই অনেক বেশি বন্ধু হবে কি করে! কিন্তু মা যখন ওদের মাসে দুবার রমনা পার্কে বেড়াতে নিয়ে যায়, তখন বেশ ক’রকমের পাখি আর ফুল ইলুর বন্ধু হয়ে যায়। কিন্তু যখন বাসায় ফিরে আসে, তখন বন্ধুরা খুব মন খারাপ করে। ওরও মন খারাপ হয়। গত বছর শীতকালে মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল ওরা। বিকেল হলেই মুগলি মাসি ওদের দুই ভাই-বোনকে মাঠে ঘুরতে নিয়ে যেত। মাঠজুড়ে হলুদ রঙা ফুল, আর ছোট ছোট সবুজ সবুজ গাছ। মুগলি মাসি বলে, হলুদগুলো সরিষা ফুল আর সবুজ গাছগুলো বিভিন্ন রকম ফসল। হলুদ ফুল বড় হয়ে ফল হয় আর তা থেকে হয় সরিষা দানা। সেই সরিষা দানা দিয়ে তেল হয়। মুগলি মাসি ইলুকে বাড়ি ফিরে তেলও দেখায়। ইলু অবাক হয়ে বলে_ ‘ফুল কি করে তেল হয় মুগলি মাসি’ ওর কথা শুনে বাড়ির সবাই হেসে কুটি কুটি। মা বলে_’ইলুসোনা সরিষা ফুল দিয়ে কিন্তু মজার মজার নাশতাও তৈরি হয়।’ ইলু আরও অবাক হয়। বলে_ ‘কেন তোমরা এত সুন্দর সুন্দর ফুল দিয়ে রান্না কর। তুমি জানো না ওরা আমার বন্ধু। ওদের কেন কষ্ট দাও।’ বাসার সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে। ইলু মুখ গোমড়া করে। দাদু নানা গল্প শুনিয়ে তারপর ইলুর মান ভাঙায়। দাদু চেম্বার থেকে এসেই খেয়ে দেয়ে প্রতিদিন ওদেরকে গল্প শোনাতো। প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প। দাদুর ভা-ারে কত কত গল্প_ টোনাটুনির গল্প, রাক্ষসের গল্প, শিয়াল-বেজির গল্প, সাত ভাইয়ের গল্প। এখন ইলুদের বাসায় দাদু-দিদু বেড়াতে এসেও প্রতিদিন ওদের দুই ভাই-বোনকে গল্প শোনাতে হয়। সকালে দাদু বলেছে আজ বিশেষ একটা দিন। আজ ইলুকে সে নতুন একটা গল্প শোনাবে। এত মন খারাপের মধ্যেও ইলুর হঠাৎ দাদুর নতুন গল্প শোনানোর কথা মনে পড়ে যায়। ইলুর চোখে-মুখে এখন খুশির আভা।
সন্ধ্যার সময় ইলু দাদুর পেটের ওপর বসে পড়ে। পাশে ভাই। মান ভেঙে ভাই এখন ওর বন্ধু। পেটের ওপর বসে গল্প শুনতে বেশি ভালো লাগে ওর। দাদু গল্প শুরু করে_ পৃথিবীর এক প্রান্তে সুন্দর একটা রাজ্য ছিল। সেই দেশে যে রাজা ছিল সে ছিল সবার বন্ধু। ছোট্টমণিদের সে খুব আদর করত। ফুল পাখি দিয়ে ঘেরা ছিল সে রাজ্য। বনের পশুপাখি ফুল সবাই তার বন্ধু ছিল। সেই দেশেরই এক প্রান্তে বসবাস করত এক দল রাক্ষস। রাজা মনে করত রাক্ষস হলেও ওরা তো ভালো মানুষের রাজ্যে থাকে, তাই ওরা কখনও কারও ক্ষতি করবে না। রাজা সেই রাক্ষসদেরও ভালোবাসত। সেদিন ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। রাক্ষসেরা এক সঙ্গে জড় হয়ে রাজার বাড়ি ঘিরে ফেলল। ইয়া বড় বড় হয়ে উঠল রাক্ষসের দাঁত, নখ, মুখ। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মতোই রাক্ষসের গায়ের রঙও কালো ছিল তাই তারা রাতের অন্ধকারের সঙ্গে মিশে রাজার ঘরে প্রবেশ করল…। দাদুর মুখে রাক্ষসের বর্ণনা শুনে ইলু দাদুকে জড়িয়ে ধরে। ‘ভয় করছে ইলু সোনা? গল্প বলা থামিয়ে দেব?’ ইলু ভয়ে ভয়ে বলে_ ‘না দাদু শুনব।’ দাদু পুনরায় বলা শুরু করে_ ‘এক সঙ্গে ওরা অনেক রাক্ষস ছিল। সবাই এক এক করে বাড়ির মানুষগুলোকে খাওয়া শুরু করল। একে একে তারা ্বাড়ির আঠারো জন মানুষকে খেয়ে ফেলল। ওদের মধ্যে তোমাদের মতোই একটা ছোট্ট সোনামণি ছিল। রাক্ষসদের দেখে ভয়ে তার কি কান্নাকাটি! সে তার মাকে জড়িয়ে ধরল। রাক্ষসরা তাকেও টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল। প্রথমে ওর ঘাড় মটকে দিল তারপর…। ইলুর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরছে। ‘কেন দাদু কেন এত মানুষকে রাক্ষসরা খেয়ে ফেলল! রাজাতো ওদের ভালোবাসত!’ দাদুর মুখে কোন উত্তর নেই। দাদুর চোখও জলে ভরে উঠেছে। সে ঝাপসা দেখছে। ইলু ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে দাদুর মুখ ধরে বলে_ ‘বড় হয়ে আমি সব রাক্ষসকে মেরে চাঁদের দেশ থেকে বন্ধু রাজাকে নিয়ে আসব দাদু।’
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।