এক ঠকের পাল্লায় তিন ঠক —জসিম উদ্দিন– সপ্তম পর্ব

ঠক পীর আগে থেকেই অনুমান করে নিলেন যে তারা এবার কি রকম উত্তেজিত হয়ে আসবে। তিনি এবারও তাদেরকে রুখতে একটি বুদ্ধি আটলেন। তিনি তার উঠোনে কবরের মতো করে একটি গর্ত খুঁড়লেন। তার বউকে শিখিয়ে দিলেন, শোন তারা এবার খুব রেগে মেগে আসবে। আমার কিংবা তোমার কোনো কথাই শুনবে না। আমি এই গর্তের মধ্যে ঢুকে বসে থাকব। আর তুমি বসে বসে কাঁদবে। তারা আমার কথা জানতে চাইলে বলবে যে, তোমাদের পীর বাবা দুনিয়া ছেরে চলে গেছেন। তবে তিনি তোমাদের সমস্যাগুলি সমাধান করার একটি পন্থা বলে দেবেন। তোমরা কবরের ওপরে কান লাগিয়ে শুনো গিয়ে। এই বলে ঠক পীর গর্তের ভিতরে ঢুকে গেলেন। গর্তে ঢুকার আগে তিনি একটি ছুড়ি সাথে করে নিয়ে ঢুকলেন। আর তার বউকে বললেন এবার তুমি গর্তের উপরে চাটাই দিয়ে তার উপর মাটি দিয়ে ঢেকে দাও। আর ঢাকার পূর্বে গর্তের মাছে একটি ফুটো রেখে দিও। তার বউ তাই করল।
ভাদু, যদু আর মধুকে উত্তেজিত অবস্থায় লাঠি সোটা নিয়ে আসতে দেখেই ঠকের বউ তারাতারি বসে পড়ল এবং হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগল।
তারা রাগান্বিত অবস্থায় এসেই হুমকি ধুমকি দিয়ে চিৎকার করতে লাগল, ঠকের বাচ্চা বেরিয়ে আয়, আজ তোর ঠকামো বের করব। আজ তোর শেষ দিন। তোকে মেরে তবেই আমরা এখান থেকে যাব। আজ আর কোনো কথা আমরা শুনব। এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করার সময় তারা দেখল তার বউ বসে বসে কাঁদছে। তারা চিৎকার করে বলে উঠল এই ঠকের বউ কই তোর স্বামী? তাকে বেরিয়ে আসতে বল। আজ তার সাথে আমাদের শেষ বোঝাপড়া আছে। ঠকের বউ আরো জোড়ের হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, কিন্তু বাবারা তোমাদের পীর বাবা তো বাইরে আসতে পারবে না।
ভাদু চিৎকার করে বলে উঠল বাইরে আসতে না পারলে আমরা ভিতর থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসব। ঠকের বউ কাঁদতে কাঁদতে বলল বাবারা তোমাদের পীর বাবা গত রাতেই মারা গেছেন। এই কথা শুনে তারা তিনজনই কিছুটা দমে গেল। ঠকের বউ আবার বলল, তিনি মারা যাওয়ার পূর্বে আমাকে বলে গেছেন যে তোমরা অনেক সমস্যাই ভুগছ। আর তাই তিনি বলে গেছেন তোমরা এলে তার কবরের ওপরে কান রেখে শুনতে উনি তোমাদের পরামর্শ দেবেন। যাতে তোমাদের সকলের সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।
এই কথা শুনে তারা একটু শান্ত হলো। ভাদু বলল শোন আমি তোদের সবার বড়, আর আমার বউ সবার আগে মরেছে, তাই আমি সবার আগে যাব গিয়ে বাবার পরামর্শ শুনে আসব। তারাও সম্মতি দিল।
ভাদু তখন বাবার কবরের ওপরে যেখানে আগে থেকেই একটি ফুটো করে রাখা হয়েছিল সেখানে তার কান রাখল। ভিতরে থাকা ঠক বাবা তখন তার বাম হাত দিয়ে কান ধরে রেখে ধারালো ছুরি দিয়ে কচাৎ করে এক টানে কান কেটে দিল।
ভাদু ব্যথায় চিৎকার করতে গিয়েও করল না। সে ভাবল, আমার একার কান কাটা থাকবে আর তারা দুজন কান নিয়ে থাকবে তা কখনোও হতে পারে না। সে মনে মনে বলল তাদের দুজনের কানও কাটানো দরকার। তাহলে সবাই একই থাকব। এই ভেবে সে এক হাতে তার কান চেপে ধরে উঠে দাড়াল। আর ব্যথায় অস্থির হয়ে শুনেছি শুনেছি বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে বাড়ির পথে যেতে লাগল।
যদু ও মধু তখন ভাবতে লাগল ভাদু তো সব শুনেছে। এখন তো সে তার বউকে ঠিক করে ফেলতে পারবে তাই এত তারাতারি দৌড়ে চলে গেল। মধু তড়িঘরি করে কবরের কাছে ছুটে যেতে চাইলে যদু বলল, দাঁড়া মধু দ্বিতীয়বারে আমি আমার বউকে জবাই করেছি তাই এবার আমার পালা। আমি আগে যাই বলেই সে এক দৌড়ে কবরের কাছে গিয়ে তার কান ছিদ্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। ঠক সাহেব তার কান ধরেও একই ভাবে কচাৎ করে একটানে ছুরি দিয়ে কেটে দিল।
কান কাটার পরই অসহ্য যন্ত্রনায় কান চেপে ধরে যদু সব বুঝতে পারল যে, ভাদুরও ঠিক একই অবস্থা হয়েছে। কিন্তু সে সবার কান কাটানোর জন্য কিছু না বলে দৌড়ে চলে গেছে। সে ভাবল আমাদের দুজনের কান কাটা থাকবে আর মধু কান নিয়ে ঘুরে বেড়াবে এটা হতে পারে না। তাই সেও তার কান চেপে ধরে শুনেছি শুনেছি বলে চিৎকার করতে করতে বাড়ির দিকে দৌড়েতে লাগল।
মধুর যেন আর তর সইছে না। সে ভাবল তাদের দুজনের বউ তো ঠিক হয়ে যাবে, তাই সে তৎক্ষনাৎ ছুটে গিয়ে কবরের কাছে কান দিল। আর সঙ্গ সঙ্গে ঠক বাবাজী তার কান ধরে কচাৎ করে এক টানে কেটে দিল।
মধু সাথে সাথে ব্যথায় ককিয়ে উঠল। সে বুঝল তাদের দুজনেরও এই একই অবস্থা হয়েছে। সে পরিমরি করে সেখান থেকে বাড়ির পথে ছুটে পালালো। কান রেখে পালানোর পর আর কখনো তারা ঠক পীরের বাড়ি মুখো হয়নি।

গল্পের প্রথম পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দুঃখিত!