এক ঠকের পাল্লায় তিন ঠক —জসিম উদ্দিন– ষষ্ঠ পর্ব

অন্যদিকে ঠক পীর সাহেব আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন যে এবার তারা একটু রেগে মেগেই আসবে। তাই আমাকে প্ল্যানটাও করতে হবে একটু জটিল ধরনের। অনেক ভেবে চিন্তে ঠক তার বউকে নিয়ে একটি একটি বুদ্ধি গড়ল। ঠক একয় ধারালো ছুড়ি, একটি মাছের ফুলকা আর কিছু লাল রং এসে তার বউকে বলল, শোন এবার তারা একটু ক্ষেপে আসবে। আমি এই মাছের ফুলকার ভেতরে লাল রং ঢুকিয়ে দিব, তার তুমি সেটা তোমার গলায় বেঁধে রাখবে। তারা এলে আমি যখন তোমাকে তাদের জন্য রান্না করতে বলব তখন তুমি আমার সাছে ঝগড়া করবে। আর তখন আমি ধারালো সেই ছুরিটা দিয়ে তোমাকে উঠোনে ফেলে দিয়ে তোমার গলায় বাঁধা ফুলকাটি কেটে দিব, তখন তুমি মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরানোর অভিনয় করে ছটফট করতে করতে মরে যাওয়ার ভান করবে। তারপর আমি সেই ছুড়িটা পানিতে ধুয়ে যখন তোমার গলায় ফেলব তখন তুমি তারাতারি উঠেই রান্না বান্না করতে বসে যাবে। ঠকের বউ তাই হবে বলে সম্মতি জানাল।
পরদনি সকালেই যদু মধু আর ভাদু এসে হাজির হলো ঠকের বাড়িতে। তারা বাড়ির বাইরে থেকেই জোরে জোরে চিৎকার করতে লাগল পীরবাবা পীরবাবা বাইরে আসেন, তারাতারি বাইরে আসে আপানর সাথে আমাদের কথা আছে।
ঠক বাইরে এসে তাদেরকে বলতে লাগল তোমরা আগে শান্ত হয়ে বসো তারপর তোমাদের সব কথা শুনছি।
ভাদু কর্কশ গলায় বলতে লাগল, না আমরা আপনার এখানে বসতে আসিনি। আপনি পরপর দুটি জিনিস আমাদের দিয়েছেন। তার কোনোটিই আমাদের কাজ লাগেনি। আপনি আমাদের ঠকিয়েছেন। এই বলে তারা তিনজনই চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগল।
– শোন বাছারা, এমনটি যে হবে তা আমি আগেই অনুমান করেছিলাম। তোমরা একটি সাধারন নিয়মও পালন করতে পারো না। তোমরা বার বার ভুল কর। তবে শোন আমার কাছে যখন এসেছো তখন আমি সব ঠিক করে দেব। আগে তোমরা বাড়ির ভিতের এসে বসে বিশ্রাম করো। এই বলে পীর বাবা তাদেরকে সাথে নিয়ে বাড়ির ভিতর গেলেন।
ঠকের বউ আগে থেকেই লাল রং ভর্তি মাছের ফুলকা গলায় বেঁধে রেখেছিল। পীর বাবা বাড়িতে ঢুকেই তার বউকে বলতে লাগল এই শোনো আমার বাছারা এসেছে, তাদের জন্য তারাতারি রান্না বান্নার আয়োজন কর।
এই কথা শুনেই ঠকের বউ বলে উঠল, আমি যার তার জন্য রান্না করতে পারব না। পীর বাবা বলল, যারতার মানে ওরা আমার সাগরেদ আমার ছেলের মতো। তুমি এখনি গিয়ে রান্না কর। ঠকের বউ গলা চড়িয়ে বলতে লাগল, আমি বলেছি রান্না করতে পারব না তো পারব নাই। তোমার দরকার হলে তুমি নিজে গিয়ে রান্না কর। এইসমস্ত কথা বলে পীর বাবার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিল। পীর বাবা তখন রেগে মেগে বলল, রান্না করতে পারবি না, দারা দেখাচ্ছি মজা বলেই তার বউকে টেনে এনে তাদের তিনজনের সামনে এনে উঠোনে ফেলে দিল। আর সেই ধারালো ছুরিটা এনে তার গলায় বাঁধা ফুলকাটি কেটে দিল। ফুলকা কাটার সাথে সাথে ফুলকার ভেতরের রং বেরিয়ে পড়ল। আর ঠনের বউ যন্ত্রনা পাওয়ার অভিনয় করে ছটফট করতে করতে মরে যাওয়ার ভান করে পড়ে রইল।
এই দৃশ্য দেখে তারা দিনজনই লাফি দিয়ে উঠে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, বাবা আপনি এ কি করলেন! পীর মাকে আপনি মেরে ফেললেন?
পীর বাবা মুচকি হেসে বলল, তোমরা ভয় পেয় না, আরাম করে বস। এখনি সব ঠিক হয়ে যাবে।
তারা কাঁপতে কাঁপতে বলল, কি বলছেন বাবা, আপনি পীর মাকে মেরে ফেলেছেন এখন কি করে সব ঠিক হয়ে যাবে? পীর বাবা তখন মধুকে বলল, যাও এই বাটিটিতে করে এক বাটি পানি নিয়ে এসো। মধু বাটিতে করে পানি নিয়ে আসলে পীর বাবা তার ছুরিটিতে লেগে থাকা রং বাটির পানিতে ধুয়ে ফেললেন। এবং সেই বাটির পানি তার বউয়ের গলায় ছিটিয়ে দিলেন। আর সাথে সাথেই তার বউ ধরফর করে লাফ দিয়ে উঠে পড় এবং উঠেই বলল, আমি এখনিই রান্না বসাচ্ছি বলেই সে রান্না ঘরে চলে গেল।
এই ঘটনা দেখে যদু মধু আর ভাদু একেবারে থ হয়ে গেল। কি বলতে তারা কিছুই বুঝতে পারছে না। তারা যে পীর বাবার কাছে এসেছিল তাদের ঠকানোর কথা বলতে তা তারা বেমালুম ভুলেই গেলা। মধু বলল, বাবা এটা কি করে সম্ভব? আপনি মরা মানুষকে কি করে জীবিত করে তুললেন?
– তবে শোন বাছারা, এই যে ছুরিটি তোমরা দেখছ, এটি দেখতে সাধারন লোহার একটি ছুরি হলেও এটি কিন্তু মোটেই কোন সাধারন ছুরি নয়। এই ছুরি যদি তোমাদের কাছে থাকে তবে তোমরাও এই কারিসমাতি দেখাতে পারবে। মোট কথা যার হাতে এই ছুরি থাকবে সেই এই কারিসমাতি করতে পারবে। তারা তিনজনেই অনেক আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল সেটা কিরকম বাবা?
– পীর বাবা বললেন, এটা হচ্ছে অবাধ্যকে বাধ্য করার ছুরি। এই ছুরি আমি অনেক তন্ত্র মন্ত্রের বিনিময়ে বানিয়েছি। তোমার পীর মা যখন তখনই আমার কথা শুনতো না। তাই তাকে শায়েস্তা করার জন্য আমি এই ছুরি বানিয়েছি। এটার বিশেষ্যত্ব হলো কেউ যদি তোমার অবাধ্য হয় তবে তুমি এই ছুরি দিয়ে তার গলা কেটে ছুরিতে লেগে থাকা রক্ত পানিতে ধুয়ে সেই পানি যদি তার কাটাস্থানে লাগিয়ে দাও তবে সে ভালো তো হবেই সেই সাথে তোমার বাধ্য হয়ে যাবে। কখনো তোমার সাথে দ্বিমত পোষন করবে না।
যদু মধু আর ভাদু একে অন্যকে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগল শোন পীর বাবার কেরামতি দেখে তাকে আর কিছু বলার সাহস আমার হচ্ছে না। ভাদু বলল তবে একটি কথা পীর বাবার এই ছুরিটি যদি আমরা কোনো রকমে নিয়ে যেতে পারতাম তবে আমাদের অবাধ্য বউ গুলোকেউ আমরা বাধ্য করতে পারতাম। যদু বলল, কিন্তু পীর বাবা তো এটা দিয়ে পীর মাকে শায়েস্তা করেন, তিনি কি তা আমাদেরকে দিবেন? মধু বলল, আজ পর্যন্ত পীর বাবার কাছে যা চেয়েছি তার সবই তিনি আমাদের দিয়েছেন এবারো তিনি নিশ্চই আমাদের কথা রাখবেন। চল আমরা একবার চেয়েই দেখিনা, বলেই তারা তিনজনই পীরবাবার নিকটে গিয়ে বলতে লাগল, বাবা আমরা না বুঝে আপনাকে অনেক কটু কথা বলে ফেলেছি। আপনি আমাদের ক্ষমা করে দেবেন। আর বাবা আপনার কাছে আমাদের আর একটি আরজি আছে, যদি অনুমতি দেন তো বলি?
– ঠক পীর বাবা মনে মসে হাসতে হাসতে বললেন, আমি তো জানি তোমরা কি বলবে, তিনি একটু গম্ভির হয়ে শান্ত স্বরে বললেন, আমি আগেই বলেছি তোমরা আমার ছেলের মতো। আমি তোমাদেরকে আমার সাগরেদ বানিয়েছি। আমার কাছে যদি কোনো জিনিস থেকে থাকে আর সেটা যদি তোমরা চাও তবে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে দিব। বল তোমাদের আরজি কি?
– ভাদু বলল, বাবা আপনার বউমারা মানে আমাদের বউয়েরা কিন্তু আমাদের কথা ঠিকমতো শুনে না। তাদের ডানে যেতে বললেন বামে যায়, তারা একেবারেই আমাদের অবাধ্য। মধু এবার মিনতি ভরা কণ্ঠে বলল, তাই বলছিলাম যে আপনার এই ছুরিটি যদি আমাদের দিতেন তবে আমরা খুব উপকৃত হতাম। আমাদের বউগুলো আমাদের বাধ্য করতে পারতাম।
পীর বাবা একটু অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, দেখ এটা আমি তোমাদের পীর মায়ের জন্য বানিয়েছিলাম। তবে আমি সব সময়ই চাই যে তোমরা সুখে থাক। তাই তোমাদের এই আবদারো আমি রাখলাম, বলে পীর বাবা তাদেরকে সেই ছুরিটা দিয়ে দিল।
ছুরি পেয়ে তারা তিনজনই খুশিতে ডগমগ হয়ে বলতে লাগল সত্যিই বাবা আপনি একজন দয়ার মানুষ। আপনার মতো একজন পীর বাবা পেয়ে আমাদের জীবন ধন্য হয়ে গেল। ঠক সাহেব মনে মনে হাসতে হাসতে বলতে লাগলেন, জীবন ধন্য হলো না পুরে ছাই হলো তা পরে বুঝতে পারবে। তিনি বলে উঠলেন, শোন বাছারা আমি সর্বদাই তোমাদের মঙ্গল চাই। এই বলে তিনি হাত উঠিয়ে তাদের তিনজনের জন্য জোরে জোরে দোয়া করে দিলেন।
সেই ছুরিটি হাতে নিয়ে তারা একজন একজন করে নেরে চেরে দেখতে লাগল। আর বলতে লাগল, পীর বাবা কি চমৎকার জিনিসই না বানিয়েছেন মানুষকে বাগে আনার জন্য। বাড়ি ফেরার পথে সবার বড় ভাদু বলল শোন আমি তোমাদের সবার বড় আর আমার বউটা একটু বেশিই বেয়াদপ। সে কথাই কথাই আমার সাথে ঝগড়া করে তাই আমিই প্রথমে এই ছুরি নিয়ে যাব। যদু আর মধু সায় দিলে বলল, ঠিক আছে ভাই আগে তুমিই ব্যবহার কর।
সেদিন রাতে ভাদু বাড়ি ফিরেই কথা অকথায় তার বউয়ের সাথে শুধু শুধু ঝগড়া আরম্ভ করে দিল। তারপর এক পর্যায়ে সে বলল, বেয়াদপ, দ্বারা এখনি তোকে মজা দেখাচ্ছি বলেই সে তার বউকে ফেলে দিয়ে ধারালো ছুরিটি দিয়ে তার বউয়ের গলায় চালিয়ে দিল। আর সাথে সাথে গলা থেকে লাল রক্ত পড়তে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বড় মারা গেল। ভাদু তখন একটু জিরিয়ে নেই একটি বাটিতে করে পানি এনে ছুরির রক্ত ভালো করে ধুয়ে তার বউয়ের গলায় সেই পানি ছিটাতে লাগল। কিন্তু মরা মানুষ কি করে বেচেঁ উঠতে পারে। এদিকে ভাদু বাটির সমস্ত পানি শেষ করেও যখন তার বউ উঠে না তখন সে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে দৌড়ে গিয়ে এক বালতি পানি এনে সেই ছুরি ধুয়ে তার বউয়ের গলায় এবং সারা গায়ে খুব করে ছিটাতে লাগল। শেষমেষ পুরো বালতির পানি বউয়ের শরীরে ঢেলে দিয়েও যখন সে উঠল না তখন ভাদু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। সে বুঝতে পারলো যে তারা মস্ত বড় ঠকের পাল্লায় পড়েছে। সে তাদেরকে আচ্ছা করে ঠকিয়েছে। সে বউয়ের শোকে কাঁদতে লাগল।
এদিকে সে মনে মনে আরো একটি বিষয় ভাবতে লাগল যে, আমার বউ একলা মরবে কেন? তাদের বউও মরুক তারপর আমরা তিনজন মিলে এর প্রতিশোধ নিব। এই বলে সে ছুরিটি নিয়ে ভালো করে ধুয়ে রেখে দিল।
পরদিন সকালে যদু ভাদুর বাড়িতে এসে জানতে চাইল কি ব্যাপার ভাই ছুরি দিয়ে কি কাজ হয়েছে কেমন? ভাদু তার মনের দুঃখ মনে চেপে রেখ বলল হ্যারেঁ যদু খুব কাজে দিয়েছে। কাল রাত থেকে তোর ভাবি এমন সোজা হয়েছে যে আমার সাথে আর টু শব্দটি করে না। আমার সাথে একদম ঝগড়া করে না। কোনো বিষয় নি আমার সাথে ঝগড়া করে না।
এই কথা শুনে যদুর যেন তার তর সইছিল না। সে বলল, ভাই তারাতারি আমাকে ছুরিটি দাও। আমি আগে আমার বউকে বাধ্য করি গে। ভাদু ছুরিটি এনে দিলে যদু ছুরি পেছনে লুকিয়ে ছুটে চলল তার বাড়ির দিকে। বাড়িতে এসেই তার বউয়ের সাথে শুধু শুধু ঝগড়া বাধিয়ে দিল। আর কিছুক্ষণই পরই সে তার বউকে ফেলে দিয়ে তার গলায় ছুরি দিয়ে তাকে জবাই করে দিল। তারপর বাটিতে করে পানি এনে ছুরি ধুয়ে সেই পানি তার বউয়ের গলায় দেওয়ার পরও যখন উঠে বসল না তখন সে ভাবতে লাগল, কি ব্যাপ্যার আমার কি কোথায় কোনো ভুল হলো নাকি! এই ভেবে সে তারাতারি ছুটে চলল ভাদুর বাড়ির দিকে। ভাদুকে দেখেই সে ব্যস্ত ও চিন্তিত হয়ে বলতে লাগল, ভাই আমি বোধহয় কোনো ভুল করে ফেলেছি। ছুরি পানি গলায় ঢালার পরো আমার বউ জীবিত হচ্ছে না।
ভাদু তখন মনের দুঃখে বলতে লাগল ভাই তুই কোনো ভুল করিস নি। আমরা সবাই ঠকেছি। ওই ব্যাটা পীর নয়। সে একটা ভন্ড। সে আমাদের সবাইকে ঠকিয়েছে।
যদু চোখ বড় বড় করে বলতে লাগল কি বলছিস ভাই, তারমানে তোর বউও মরে গেছে?
– হ্যাঁ, তবে শোন আমাদের বউযে মরেছে তা মধুকে বলিস না। আমাদের দুজনের বউ কেন শুধু শুধু মরবে? তারটাও মরুক।
তাদের গল্পের মাঝেই মধু চলে এলো। এসেই বলল, কি ব্যাপার ভায়েরা তোমাদের বউকে কি বাধ্য করতে পেরেছো? তারা দুজনই বলে উঠল আরে বাধ্য মানে একেবারে বাধ্য। এখন তারা কোনো কথার প্রতিই দ্বিরুক্তি করে না। আমরা যা বলি তাই মেনে চলে।
এই কথা শুনে মধু বলল, আমার আর তর সইছে না তারাতারি ছুরিটি দাও এবার আমার বউকে একটু শায়েস্তা করে আসি।
মধু ছুরি নিয়ে গিয়ে তার বউকেও একি অবস্থাই জবাই করে ছুরি ধোয়া পানি ঢেলে যখন ভালো হচ্ছে না তখন সে তাদের দুজনের কাছে ছুটে এলো। ভাদু সব ঘটনা খুলে বললে, মধু বলল, ওই ব্যাটার এতো বড় সাহস। সে আমাদের তিন ভাইকে এরকম করে ঠকায়। মধু রাগে গড় গড় করতে করতে বলল ভাই চল, আর কোনো কথা নয় এবার গিয়ে ঐ ব্যাটার কোনো কথা শুনব না। যদুও উত্তেজিত হয়ে ঘর হতে লাঠি এনে বলল, চল আজ গিয়ে ওর ঘরবাড়ি সব জ্বালিয়ে পুরিয়ে ওকেও শেষ করে দিয়ে আসব। বলেই তারা তিনজনই বড় বড় লাঠি সোটা নিয়ে চলল ঠক পীরের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
গল্পের সপ্তম পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দুঃখিত!