এক ঠকের পাল্লায় তিন ঠক —জসিম উদ্দিন– পঞ্চম পর্ব

এদিকে ছদ্মবেশী ঠক পীরবাবা বাড়িতে বসে ভাবতে লাগল কি করা যায়। কারণ তিনি জানতেন যে ঘোড়ার মলের সাথে পয়সা না পেয়ে তারা তিন জন অবশ্যই আসবে। ঠক পীরবাবা তার বাড়ির পেছনে জঙ্গলে বসে বসে ভাবতে লাগলেন এখন কি করা যায়। তিনি ভাবতে লাগলেন যে, এবারো একটি অলৌকিক কিছু করে দেখাতে হবে। যাতে তার প্রতি তাদের বিশ্বাস আরো বেড়ে যায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সে একটি গাছের দিকে লক্ষ্য করল। গাছের মগডালে একজোড়া কবুতর বাসা বেঁধেছিল। কবুতর দুটিকে দেখেই তার মাথায় একটি বুদ্ধির উদয় হলে সে তৎক্ষনাত গাছে উঠে কবুতরের বাসা হতে এক জোড়া কবুতর নামিয়ে আনল। কবুতর জোড়া বাড়িতে এনে সে তার বউকে বলল শুনো আমার খোজেঁ তিনজন লোক আসবে। তারা এখানে এলে আমি একটি কবুতর নিয়ে বাড়ির পেছনে লুকিয়ে থাকব। আর একটি কবুতর খাঁচার ভেতরে থাকবে। তারা এসে যখন আমার খোঁজ করবে তখন তুমি তাদের সামনে এই কবুতরটিকে এনে বলবে যে যাও তো বাবা তোমার পীরবাবাকে ডেকে নিয়ে এসো। এই বলে তুমি কবুতরটি ছেড়ে দেবে। আর কিছুক্ষণ পরই আমি অন্য কবুতরটি নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসব। ঠকের বউ মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে ঠক একটি কবুতরকে খাঁচায় ভরে বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখল আর অন্যটি সে হাতে করে নিয়ে বাড়ির পেছনে লুকিয়ে থাকল।
এদিকে যদু মধু আর ভাদু তিনজনেই পীরসাহেবের বাড়িতে এসে উপস্থিত। বারান্দায় দাড়িয়েঁ তারা ডাকতে লাগল, পীর বাবা বাড়িতে আছেন? তাদের ডাক শুনে ঠকের বউ বাইরে এসে তাদেরকে দেখেই বুঝতে পারল যে তাদের কথাই তার স্বামী বলে গিয়েছে। সে তাদেরকে বলল তোমরা বারান্দায় এসে বসো। আমি এখনি ওকে দিয়ে ডাকতে পাঠাচ্ছি। তারা তিন জন দেখল যে সেখানে তারা ছাড়া আর কেউ নেই। তাই মধু জানতে চাইল, পীর মা, কাকে দিয়ে ডাকতে পাঠাবেন? ঠকের বউ বলল, কেন এই কবুতরটি ডেকে নিয়ে আসবে। তারা তিনজনই অবাক হয়ে বলল, কবুতর কিভাবে ডেকে নিয়ে আসতে পারে?
ঠকের বউ মুচকি হেসে বলল, তোমার পীরবাবা হচ্ছেন একজন কামিল মানুষ। তার কথা সব পশুপাখিই শুনে। এই বলে ঠকের বউ খাঁচা হতে কবুতরটিকে এনে তাদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলল, যাও তো সোনা তোমার পীর বাবা কোথায় আছে উনাকে ডেকে নিয়ে এসো। আরো বলবা যে উনার তিনজন সাগরেদ উনার সাথে সাক্ষাত করতে এসেছে। এই বলে ঠকের বউ কবুতরটিকে ছেড়ে দিল। কবুতরটি ছাড়া পেয়ে বনের কবুতর উড়ে বনের ভিতর চলে গেল।
যদু, মধু আর ভাদু একজন আরেকজনের দিকে বিস্ময়ে চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। যদু বলল, এই পায়রা যদি সত্যিই পীরবাবাকে ডেকে নিয়ে আনতে পারে তবে উনি যে সত্যিই একজন কামিল পীর তা আমার বিশ্বাস হয়ে যাবে।
অন্যদিকে ঘরের পিছনে লুকিয়ে থাকা ঠক সব শুনছিল। সে কিছুক্ষণ বিলম্ব করে তার কাছে থাকা অন্য কবুতরটি কোলে করে তার মাথায় আদর করতে করতে বাড়িতে এসে ঢুকল। তারা তিনজন এই কান্ড দেখে অবাক্য হয়ে গেল। ঠক পীরবাবা তার কোল থেকে কবুতরটিকে নিয়ে খাঁচার ভেতরে রেখে বলল তোমরা যে এসেছো তা আমার কবুতরটি আমাকে গিয়ে বলেছে। নইলে আমি আরো দেরি করে আসতাম। তোমাদের কথা শুনেই আমি খুব তারাতারি এসে পড়েছি। আর তোমরা যে সমস্যার মধ্যে আছ তাও আমি বুছতে পেরেছি। তবে শুনো আমার দেয়া নিয়মের অনিয়ম করলে তার সমাধান তো পাওয়া যাবেই না তার উপর আরো বড় কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তা বাবারা তোমরা এসেছো, বিশ্রাম নাও। আমি তোমাদের খাবাবার দাবারের ব্যবস্থা করি গে। এই বলে ঠক তার বউকে রান্নাবান্না করার জন্য বলল।
এদিকে তারা তিন জন ফিসফিসিয়ে বলতে লাগল শোন, আমরা নিশ্চই ঘোড়ার সাথে কোনো অনিয়ম করে ফেলেছি। তাই হয়তো ঘোড়া আমাদের কাঁচা পয়সা দেয়নি। ভাদু বলল, ঠিকবলেছিস। যে মানুষের কথা পশুপাখি মান্য করে তিনি কখনোই আমাদের ঠকাতে পারে না। মধু বলল, তা ঠিক আছে কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।
– কি কথা ভাদু আর যদু জানতে চাইল।
মধু বলল, বাবা বললেন যে, তার নিয়মের অনিয়ম করলে সমাধানের বদলে উল্টো আরো বেশি ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই আমাদের ঘোড়ার বিষয়টি বাবাকে জানানো ঠিক হবে না। তবে আমার মাথায় আরো একটি বুদ্ধি এসেছে। তারা দু’জন জানতে চাইল কি বুদ্ধি? মধু বলল শোন, এই কবুতরটিকে যদি আমরা কোন রকমে আমাদের সাথে করে নিয়ে যেতে পারি তবে আমাদের অনেক লাভ হবে।
– সে কিরকম?
– আমরা তো কাজে কর্মে অনেক সময় অনেক দূরে চলে যায় তখন এই কবুতরটি জরুরি প্রয়োজনে আমাদের যে কোনো জায়গা হতে ডেকে আনতে পারবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো ঘোড়াটি কিনে আমরা যে ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছি, এই কবুতরটি যদি আমরা নিয়ে যেতে পারি তবে তা উশুল হয়ে যাবে।
ভাদু বলল, কিন্তু পীরবাবা কি কবুতরটি দিতে রাজি হবেন?
– আমরা সবাই জোড় দিয়ে মিনতি করে বললে তিনি অবশ্যই দিবেন। এই ভেবে তারা তিনজনই পীরবাবার সামনে গিয়ে বলল, বাবা আপনার দোয়াই আমাদের আর কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এত দূর হতে আমরা এসেছি আপনার কাছে শুধু আপনার দোয়া নিতে। আর বাবা আপনার কাছে আমাদের আরেকটি ছোট আবদার রয়েছে, যদি অনুমতি দেন তো বলি?
পীরবাবা বলল, বাবারা তোমরা আমার সন্তানের মতো। এতো দূর হতে এসে আমার কাছে তোমরা কিছু একটা আবদার করলে আমি অবশ্যই রাখব। বল তোমরা কি চাও?
মধু বলল, বাবা আমরা অনেক সময় কাজে কর্মে বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে যাই। তখন আপনার বউমারা আমাদের জরুরি কোন খবর তারাতারি পাঠাতে পারে না। আপনি দয়া করে যদি আপনার এই পায়রাটা আমাদেরকে দিতেন তবে আমরা খুব উপকৃত হতাম।
পীরবাবা তখন হেসে উঠে বলতে লাগলেন, এই কথা! ঠিক আছে বাবারা তোমরা আমার এই পায়রা নিয়ে যাও। আমি বন জঙ্গল হতে অন্য কোন পশুপাখি এনে আবার বস মানিয়ে নেব।
তারা তিনজনই আনন্দে লাফিয়ে উঠল। আপনার অনেক শুকরিয়া বাবা। তাহলে আমরা আজকে যাই। পীরবাবা বললেন, খাওয়া দাওয়া করে যাও। তারা খুশিতে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল বাবা অন্য কোনো দিন এসে খেয়ে যাব আজ আমরা আসি। এই বলে তারা খাঁচাসহ কবুতরটি নিয়ে লাফাতে লাফাতে বাড়িতে ফিরে এলো।
বাড়িতে এসেই তাদের বউদের ডেকে এনে বলতে লাগল, শুনো আমরা যখন বাড়ির বাইরে থাকবো তখন যদি তোমাদের জরুরি কোন প্রয়োজন হয় তবে এই কবুতরটি বলবে যে যাও সোনা তোমার বাবাকে ডেকে নিয়ে এসো। তখন সে আমাদের ডেকে নিয়ে আসবে।
বউয়েরা এই কথা শুনে হেসে উঠে বলল, তাই কোনোদিন হয় নাকি।
তারা ধমক দিয়ে বলল, এটা যেমন তেমন কবুতর নয়। এই কবুতর আমাদের পীরবাবা আমাদেরকে দিয়েছে।
পরদিন সকালে তারা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই লাঙ্গল-জোয়াল কাধেঁ নিয়ে রেডি মাঠে যাওয়ার জন্য। যাওয়ার আগে তাদের বউদের বলে গেল শোন দুপুরে রান্না হয়ে গেলে কবুতরটিকে বলবে আমাদের ডেকে আনার জন্য। এই বলে তারা তিনজনই মাঠে চলে গেল। তারা বাড়ির আশে পাশে না থেকে সেদিন খুব দুরের জমিতে কাজ করার জন্য গেল। তিন বউ তখন এই মজার বিষয়টি জানার জন্য কৌতুহলী হয়ে উঠল। অন্যদিন তারা একটু বেলা করে রান্না বান্না বসায় কিন্তু সেদিন তারা তিনজনই একত্রে মিলে খুব সুস্বাদু আর অনেক রকমের রান্না তারাতারি রেডি করে ফেলল। তারা তিনজনই তখন কবুতরের খাঁচা হতে কবুতরটি বের করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগল, যাও সোনা তোমাদের বাবাদের ডেকে নিয়ে এসো। এই বলে তারা কবুতরটিকে ছেড়ে দিল। বন্য কবুতর ছাড়া পেতেই উড়ে চলে গেল বনের ভেতরে। বউয়েরা কবুতরটিকে ছেড়ে দিয়ে সব কিছু রেডি করে পরিপাটি করে সাজিয়ে নিয়ে বসে বসে অপেক্ষা করতে লাগল স্বামীদের জন্য।
ওদিকে যদু, মধু আর ভাদু মহা আনন্দে জমিতে হাল চাষ করতে লাগল। অন্যদিনের তুলনায় তারা আজ বেশি বেশি করে পরিশ্রম করছে। দুপুর হয়ে আসতেই তারা আগ্রহের সহিত অপেক্ষা করতে লাগল যে, এই বুঝি কবুতরটি এসে তাদের খবর দেবে যে, রান্না বান্না শেষ আপনাদের খাবার জন্য ডাকছে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাওয়ার পরো যখন কবুতর এলো না তখন যদু বলল, কি ব্যাপার বল তো, তারা কি এখনো রান্না বান্না শেষ করেনি। মধু বলল ভাই আমার মনে হয় তারা রান্না বান্না ছেড়ে গল্প গুজবে মেতে উঠেছে। ভাদু বলল, চল আজকে বাড়িতে গিয়ে তাদেরকে একটা উচিৎ শিক্ষা দিব। এই বলে তারা তিনজনই খুব রাগান্বিত হয়ে বাড়িতে ফিরে এসেই দেখল যে, তাদের তিন বউ উঠোনে পাটি বিছিয়ে আলাপ করছে। দেখেই তাদের মাথা গরম হয়ে গেল। কোনো কথা না বলেই তারা এসে তাদের বউকে মারধর করতে লাগল। বউয়েরা খুব অবাক হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, কি ব্যাপার তোমরা আমাদের মারছ কেন?
– মারছি কেন? ভাদু রাগে গড় গড় করতে করতে বলল, আমরা সারাদিন রোদে পুরে মাঠে গিয়ে কাজ করছি আর তোমরা আমাদের কথা ভুলে গিয়ে রান্না বান্না ছেড়ে দিয়ে এখানে বসে গল্প করছ?
বউয়েরা তখন বলতে লাগল, কি বলছ তুমি, আমরা আজ অন্যদিনের চেয়ে তারাতারি রান্না বান্না শেষ করে সেই কখন দুপুরের আগেই কবুতরটিকে ছেড়ে দিয়েছি তোমাদের ডেকে আনার জন্য।
এই কথা শুনে তাদের মাথা আরো খারাপ হয়ে গেল। বলে কি? কবুতরকে ডাকতে পাঠিয়েছে, তবে আমরা কোনো খবর পায়নি কেন? মধু বলল ভাই এবার আমার সন্দেহ নাই যে, পীর বাবা আমাদের ঠকিয়েছে। ভাদু বলল, তাই যদি হয় তবে উনার কপালে খারাপি আছে। চল আমরা কাল সকালেই যাব পীর বাবার কাছে গিয়ে সব উসুল করে নিয়ে আসব।

গল্পের ষষ্ঠম পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দুঃখিত!