হযরত আবু ওসমান সাঈদ ইবনে সালাম মাগরেবী (রঃ) – শেষ পর্ব

আবদুর রহমান সুলাখী হযরত ওসমানের সেবায় উপস্থিত ছিলেন। এক লোক চরকার সাহায্য কুয়া থেক পানি তুলছিল। তাতে একটা শব্দ হচ্ছিল। তিনি আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞেস করলেন, চরক কী শব্দ করছে জান? তিনি বললেন, না। তখন হযরত ওসমান (রঃ) বললেন, সেটি আল্লাহ শব্দ করছে। তারপর তিনি বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাওয়ালী শোনার গর্ব করে অথচ পাখির কূজন, পত্রের মর্মর ও বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের মর্ম বোঝে না, তার ঐ অহঙ্কার বৃথা।

একবার হযরত আবু ওসমান (রঃ) ভাবোন্মত্ত অবস্থায় নির্জন সাধনালয় থেকে বাইরে ছুটে এসে পাগলের মতো বলতে থাকেন, তাপসের উচিত তিনি যেন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ সচেতনভাবে উচ্চারণ করেন। আর তার মনে ভাল মন্দ যা কিছু উদয় হয়, যেন এই মহাকাব্যের শক্তি ও তেজ দ্বারা তা দূরীভূত করেন।

তিনি বলতেন-

১. পাপী, অহঙ্কার অপেক্ষা শ্রেয়। কেননা, পাপী নিজের পাপ স্বীকার করে। কিন্তু অহঙ্কারী অহমিকার কারণে বন্দী থাকে।

২. দরবেশের সান্নিধ্য ত্যাগ করে যে ধনীর সঙ্গ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার অন্তরকে মৃত ও অহঙ্কার করে দেন।

৩. যে ব্যক্তি শুধু আল্লাহর ভয়ের ওপরেই থাকে, সে একেবারে নিরাশ হয়ে পড়ে। অতএব আমল থেকেও বিরত হয়। আর যে ব্যক্তি কেবল আল্লাহর রহমতের আশায় থাকে, সেও একেবারে অলস হয়ে আমল থেকে উদাসীন থাকে। অতএব দরবেশের কাজ হল, কখনও আল্লাহর ভয়ে অস্থির হওয়া, কখনও রহমতের আশা করা, কখনও মধ্য পথ অবলম্বন করা।

৪. অন্তিমকালে মৃত্যু প্রেম অধিক অনুরাগের নিদর্শন।

৫. খাঁটি দরবেশ যখন আল্লাহর যিকির করেন তখন তার দৃষ্টান্ত হল নদী, আল্লাহর হুকুমে যা থেকে নবজীবনের স্রোতধারা চার দিকে প্রবাহিত হয়। তিনি আল্লাহর যিকির থেকে যে জ্যোতি লাভ করেন, তা সাহায্যে সব কিছু অবলোকন করেন। প্রকৃত তওহীদ যখন পূর্ণ হয়, তখন দরবেশ ক্রমে যিকিরে ও এবাদতে এরূপ স্বাদ পান যে, সেই আমিয় স্বাদে তিনি মাতোয়ারা হয়ে যান। এমনি আত্মহারা হয়ে মৃত্যু কামনা পর্যন্ত শুরু করে দেন।

৬. যিকিরে ও মারেফাতে আসক্তি জন্মালে মৃত্যুর পরও তা নষ্ট হয় না। বরং বহু গুণ বৃদ্ধি পায়।

৭. আল্লাহর নৈকট্যে যাওয়ার উপায় দুটি। একটি হল নবুয়ত অর্থাৎ রাসূল (সাঃ)-এর সাহচর্য। দ্বিতীয়টি হল পবিত্র হাদিস। প্রথমটি নেই। কিন্তু দ্বিতীয়টি আছে। অতএব আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার সহজতম উপায় হল, ধযানে-সাধনায় আত্মনিয়োগ করে রাসূল (সাঃ)-এর হাদিসের অনুসরণের দ্বারা জীবনকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা।

৮. জনসমাজ থেকে বিছিন্ন হয়ে যিনি আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হন, তাঁর উচিত, মন থেকে সব কিছু দূর করে দেওয়া। আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কিছু লক্ষ্য না করা। তাছাড়া তাঁর ধ্যান-ধারণা শুধুমাত্র আল্লাহর দিকেই নিবদ্ধ রাখা উচিত। না হলে নির্জনতা কেবল ধ্বংসের কারণ ছাড়া আর কিছু নয়।

৯. রিপুর তাড়নায় ধনীদের সান্নিধ্যলাভে যে লালায়িত, তার আত্মা কখনও মুক্তি পায় না। তার কোন ওজরআপত্তিও গ্রাহ্য হয় না। অবশ্য বিপন্ন অবস্থায় ধনীর সাহায্য নেয়া দোষের কথা নয়।

১০. অন্যের দোষ খুঁজতে যাওয়া নিজের আত্মার ক্ষতি করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

১১. কাউকে যদি কোন গাছ শিকড়সমেত উপড়ে ফেলতে বলা হয়, তবে প্রথম অবস্থায় তা অল্প চেষ্টায় করা যায়। দেরী হলে গাছ দৃঢ় হয়। তখন তার মূলোৎপাটন করা কষ্টকর। মনের পাপের অবস্থাও ঐ গাছের অনুরূপ।

১২. নির্দেশ পালনই দাসত্বের প্রকৃত পরিচয়।

হযরত ওসমান (রঃ)-এর বিদায়মুহুর্তে আসন্ন হয়ে উঠল চিকিৎসকদের ডাকা হয়। তিনি বললেন, চিকিৎসকদের ডেকে আনা হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর ভাইদের চেষ্টার অনুরূপ। বহু চেষ্টা তাঁর মান-মর্যাদা ও নবুয়তকে আটকাতে পারেনি। তেমনি কোন চিকিৎসকই তাঁর মৃত্যু ঠেকাতে পারবে না। একথা শুনতে শুনতে তিনি ধরাধম ত্যাগ করেন।

সূত্রঃ তাযকিরাতুল আউলিয়া  

হযরত আবু ওসমান সাঈদ ইবনে সালাম মাগরেবী (রঃ) – প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।