হাড়কিপটে

গোদাবর গ্রামে বাস করত রূপায়ন ঘোষ নামে এক ধনী। ধনী হলে কি হবে , ছিল হাড়কিপটে । গ্রামের মানুষরা রূপায়ন ঘোষের বাড়িকে “কিপটে বাড়ি” বলেই ডাকে। প্রচলিত আছে রূপায়ন ঘোষের হাতের আঙ্গুলের ফাঁক গলে নাকি পানিও পড়ে না । বলতে গেলে হাড়কিপটের কারণে রূপায়ন ঘোষ সমাজছাড়া । কেউ তার সাহায্য এগিয়ে আসে না ।
একদিন তার বউ অসুস্থ হয়ে পড়ল । গায়ে ভীষণ জ্বর । দিন যায় কিন্তু জ্বর কমে না । উপায়ন্তর না দেখে বউয়ের পীড়াপীড়িতে গেলেন ডাক্তারের চেম্বারে । ডাক্তারের সহকর্মীর সাথে বাইরে দাঁড়িয়ে বাড়ি অবধি ডাক্তার নিয়ে গেলে ডাক্তারের পরিশ্রামিক কত হতে পারে একটা ধারনা নেওয়ার চেষ্টা করলেন , ডাক্তারকে রিকসা করে নিয়ে গেলে ভাড়া সহ ডাক্তারের পারিশ্রমিক এসে দাড়ায় কমপক্ষে তিনশত পঞ্চাশ টাকা। গ্রামের কারো সাথে তেমন ভাল সম্পর্ক না থাকায় কেউ রূপায়নকে ছাড় দিতে চায় না । মহা ফাঁসরে পড়ে গেল রূপায়ন । বউয়ের উপর ভীষণ রাগ হল তার । টাকা খরচ করার একটা না একটা পথ বের করে । অথচ কত কষ্টে সে টাকা সঞ্চয় করে। এটা কেউ বুঝে না ।
ডাক্তারের বদলে রূপায়ন চলে গেলে ঔষধের দোকানে । ঔষধের দোকানদারদের নানা ঔষধের গুণাবলি জানা থাকে । কোন ঔষধ কোন রোগের জন্য প্রযোজ্য তাদের মোটামুটি ধারনা আছে। ঔষধ সংগ্রহের জন্য চলে গেলেন অন্যগ্রাম । হাড়কিপটে স্বভাবের কারণে নিজের গ্রামের দোকানদাররা তার কাছে ঔষধের দাম একটু বেশিই চেয়ে বসে। খুঁজতে খুঁজতে পেলেন এক ঔষধের দোকান । দোকানির কাছে জ্বরের ব্যাপারটা খুলে বললেন । দোকানি এক রাতের জন্য কিছু ঔষধ দিলেন তবে সকালেই যেন রোগীকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায় তার পরামর্শ দিলেন । দোকানির পরামর্শের আমল না দিয়ে ঔষধ নিয়ে বাড়ি ফিরেই সব কটি ঔষধ বউকে সেবন করিয়ে দিলেন । মাঝরাতে বউয়ের জ্বর ভীষণ বেড়ে গেল । প্রচণ্ড জ্বরে বউ ঘুমের ঘোরে আবোলতাবোল বলতে লাগল । ভয়ে রূপায়নের শরীর শীতল এবং গলা শুকিয়ে কাট হয়ে গেল । বউয়ের মাথায় হাত দিয়ে দেখে আগুণের মতন টগবগ করে জ্বলছে কপাল । তাড়াতাড়ি দৌড়ে এক বালতি পানি নিয়ে এল ।
মগ দিয়ে বউয়ের মাথায় পানি ঢালতে লাগলেন আর মনে মনে করজোড়ে ভগবানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন । ” হে ভগবান , তুমি আমার বউকে ভাল করে দাও । তার বিনিময়ে আমি তোমাকে পূজা দেব , দশজন ব্রাহ্মণ কে ভোজন করাব । পানি ঢালছেন আর ভগবানের উদ্দ্যেশ্য বলেই চলেছেন । পানি শেষ হয়ে এলে মাথা মুছিয়ে বউকে আবার বিছানায় শুয়ে দিলেন । কিছুক্ষণ পর মাথায় হাত রেখে দেখেন কপালের তাপ অনেক কমে গেছে । মনে একটু সাহস পেলেন । কিন্তু ভয়ে ভগবানের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার কথা মনে পড়ল। জ্বর এখন কম । তাই ভগবানের উদ্দেশ্য বললেন – “ভগবান , অপ্রস্তুত অবস্থায় কি বলতে কি বলে ফেললাম, আপনজনের এই অবস্থায় মাথা ঠিক ছিল না , আপনি মনে কিছু নিয়েন না । তবে আপনাকে কথা যখন দিয়েছি তখন দশজন ব্রাহ্মণ না-হোক অন্তত পাঁচ জন ব্রাহ্মণকে ভোজন করাব । এই কথায় রইল। ” সারারাত জেগে বউয়ের পাশে বসে রইলেন রূপায়ন। ভোরের দিকে মাথায় হাত দিয়ে দেখেন জ্বর একদম নেই । ভাল হয়ে গেছে তার বউ । হঠাৎ আবার শেষরাতের প্রতিজ্ঞার কথা মনে পড়ে গেল । ভগবানের উদ্দেশ্য আবার বললেন – ” ভগবান আমি তোমার সন্তান। আমার যা কিছু সবইতো আপনার দান । অশিক্ষিত মানুষ না বুঝে আবেগে একটা কথা বলে ফেলেছি তবে কথা যখন দিয়েছি তখন পাঁচজন নয় অন্তত একজন ব্রাহ্মণকে আমি ভোজন করাবই । এই আমার শেষ প্রতিজ্ঞা তোমার কাছে।”
সকালে বউকে রাতের সব ঘটনা খুলে বললেন । বউ শুনে অবাক , বলে কি তার স্বামী ! ব্রাহ্মণ ভোজন !
রূপায়ন জানাল সে এমন এক ব্রাহ্মণ খুঁজে বের করবে যে খায় কম । গোদাবর গ্রাম বাদ দিয়ে অন্য গ্রামের ব্রাহ্মণ খুঁজতে বের হলেন । পেয়েও গেলেন । ব্রাহ্মণ পূজার কাজে বাইরে থাকায় ব্রাহ্মণীকে বলে এলেন বাড়ির ঠিকানা । ব্রাহ্মণ খুঁজতে খুঁজতে চলে এল রূপায়নের বাড়ি । সমস্ত কথা রূপায়নের বউয়ের কাছে শুনে- দিন ঠিক করলেন কোনদিন আসবেন । কত পদের রান্না এবং কত টাকা দক্ষিণা দিতে হবে তাও জানালেন। ব্রাহ্মণ নিদিষ্ট দিনে রওয়ানা হওয়ার আগে বউয়ের মাথা থেকে একটা চুল ছিঁড়ে নিলেন । রূপায়নের বাড়িতে খেতে বসে ব্রাহ্মণ সুযোগ বুঝে শাকের মধ্যে চুল মিশিয়ে দিলেন । উত্তেজিত হয়ে বাটি ছুড়ে মারলেন এবং ধমকের সুরে বলে উঠলেন – “ব্রাহ্মণকে অপমান , খাবারে চুল মিশিয়ে ব্রাহ্মণকে মেরে ফেলার চেষ্টা । অমঙ্গল হবে – অমঙ্গল । ” ভয়ে রূপায়নের বউ ঘাবড়ে গেলেন এবং অমঙ্গল থেকে বাঁচার জন্য আবার রান্না করতে রাজি হলেন কিন্তু ব্রাহ্মণ কিছুতেই খাবার গ্রহণ করবেন না বলে জানালেন তবে উপায় হিসাবে , অমঙ্গল থেকে বাঁচার জন্য দক্ষিণা স্বরূপ এক হাজার টাকা দিতে হবে । রূপায়নের বউ অন্যুপায় হয়ে রাজি হয়ে গেলেন ।

এদিকে রূপায়ন কাজ থেকে ফেরার পথে ব্রাহ্মণ ভোজনের জন্য বাড়িতে গিয়েছে কিনা জানার জন্য ব্রাহ্মণের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন । ব্রাহ্মণের বাড়ি এসে দেখেন , উঠানে বসে অঝোরে কাঁদছে ব্রাহ্মণের বউ । তিনি কাছে গিয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করলেন এবং শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন । ব্রাহ্মণ রূপায়নের বাড়িতে ভোজনের পর হাসপাতালে শয্যাশায়ী । খাবারে বিষ দিয়ে ব্রাহ্মণকে হত্যার চেষ্টার জন্য থানায় মামলা এবং গোদাবর গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছে এইব্যাপারে নালিশ করবে বলে জানালেন ব্রাহ্মণীর বউ । মহাবিপদে পড়ে গেল রূপায়ন বুঝতে পারলেন এবং ব্রাহ্মণের চিকিৎসার খরচ বাবদ তিন হাজার টাকা ব্রাহ্মণীকে দিয়ে এলেন । বাড়ি যেতে যেতে ভাবতে লাগলেন তিনশত টাকা বাঁচাতে গিয়ে হাজার টাকা খরচ করে ফেললেন।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!