আগাছা

রমেশ শেষ বিকেলে বাগানটায় নিড়ানি দিচ্ছে। দেখা যায়, কয়েকদিন পর পর আগাছা জন্মে, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না,এর মাঝে পরিস্কার করতে হয়। এবার সবজিগুলো ভালোই হয়েছে। অভাবের কারণে মাঝে মাঝে ভাতের সাথে শুধুই আলুসিদ্ধ খেতে হয়,এবার কিছু সবজিও খাওয়া যাবে, দিনের পর দিন মাংস পাতে পরে না। পাশের বাড়িতে যখন মুরগী রান্না হয়,গন্ধ শুনলে জিভে জল আসে। কেন এমন হয় জানে না, জিভ জিনিসটা ভগবানের কথা শুনে না ইদানিং। কারও সাথে দেখা হলে বলে, ভগবানের কৃপায় দিন চলে যায়, আসলে যায় না। সকালে ঘুম থেকে উঠে অন্যের ক্ষেতে বর্গা খাটতে হয়, সারাদিন খেটে বিকালে একটু বের হয় এদিক ওদিক করতে। সন্ধ্যাবেলা পাশের মন্দিরে প্রার্থনা শেষে চা খেটে যায়, চা টা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলে আর করার কিছুই থাকে না,তাই বড় আস্তে আস্তে চা টা খায় আর দোকানের টিভির দিকে তাকায় থাকে হা করে। সে দেশের বড় বড় সমস্যাগুলো বুঝে না, বুঝতে চেষ্টাও করে না, যদিও চা দোকানের মালিক করিম এসব ভালোই বুঝে। মাঝে মাঝে সে বলে ও রমেশ দা।রমেশ বলে,হু। ও বলে দেশের অবস্থা তো ভালো না। রমেশ আবার বলে,হু। করিম বলে, কেমনে যে কি। নির্বাচন কি হইব? রমেশ আবার মাথা নাড়ায়। সে এর কিছুই জানে না, সে কি বলবে। রহিম মাথা নাড়ে, খুব খারাপ অবস্থা।
ঘেমে গেছে অনেক রমেশ। পানি খাওয়া দরকার। বয়স হয়েছে, অল্পতে বড় ক্লান্ত লাগে। হতাথ করেই উত্তর থেকে চিৎকার এর শব্দ আসে।এটা হিন্দু পল্লী,এ পাড়ার সব ঘর ই হিন্দুদের। চিৎকার, আর্তনাদ, ভাংচুর। রমেশের মনে আচমকা একাত্তর চলে আসে। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে দেখে পুরো পাড়ায় আগুন আর গুলি। পাকিস্তানীরা হিন্দুদের
বড় ঘৃণা করতো। লুঙ্গী খুলে দেখে মারত। কিন্তু এখন তো একাত্তর না! ব্যাপারটা হতাথই চোখে পড়ল। কিছু অল্প বয়সী ছেলে এই পাড়ারই ঘরে ঘরে আগুন দিচ্ছে,সামনে যাকে পাচ্ছে,তাকেই লাথি ঘুসি মারছে। পাশের বাড়ির রামের বউ দেখে একটা ছেলের পা জড়িয়ে আছে, ছেলে তাও লাথি মারছে। রমেশকে যেন অসাড়তার ভূতে পেয়েছে,তার পা চলে না,কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। ওরা মন্দিরে ঢুকে,মূর্তি ভাঙ্গে,বাকি যা থাকে লুট করে। গতকালও তো ঐখানে প্রার্থনা হল,কি করছে এরা,কেন করছে,এতাই বুঝতে পারে না রমেশ। এ পাড়ার লোকেরা তো কারোর সাতে-পাঁচে নেই! কেন? কত মিনিট দাড়িয়ে ছিল রমেশ বুঝতেও পারে না, একটা ছেলে যখন চিৎকার করে উঠে,ঐ মালাউনের বাচ্চা চু*র ভাইকে পাইছি,ধর ওরে…রমেশ সম্বিৎ ফিরে পায়।সে বাড়ির দিকে দৌড়াতে থাকে,কিন্তু তার পা টা যেন চলে না,দুঃস্বপ্নের মত সে কোন গতি পায় না।তার ছেলেকে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে সে দৌড়াতে থাকে,মনে মনে সে শ্রী কৃষ্ণের নাম স্মরণে নেয়,ভগবান রক্ষা করবেন। কিন্তু কাউকেই পায় না সে,না তার ছেলে,না ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। এবার সে পাশের বনের দিকে দৌড়াতে থাকে, ঐ ছেলেগুলো তার বাড়ির দিকে যাচ্ছে। বনের গাছের পিছনে লুকিয়ে সে দেখতে পায়,আগুনে তার বাড়ি পুড়ছে। চোখের জল তার বাধ মানে না, এই ছেলে গুলো তাদের পাশের গ্রামের শরীফ,নান্নু চেয়ারম্যান,জসীমের ছেলে…কিন্তু তারা আগুন দিচ্ছে তাদের পাড়াতে,কেন?
একসময় সব পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়।রাতের আঁধার নামে। আস্তে আস্তে পাড়ার যারা পালিয়ে গিয়েছিলো,একত্রিত হয়…রমেশের ছেলে তাকে দেখে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে।এতকিছু হল,কারণ তারা হিন্দু।ছেলে বলে,বাবা আর এই দেশে থেকে কি হবে…ওরাতো আমাদের থাকতে দিতে চায়না…রমেশ বলে,হু। ওর কোন উত্তর জানা নেই। দেশ নিয়ে তেমন কোন ধারনা নেই তার,দেশের পতাকা দেখলে মনে হতো,রঙ দুটো ভিন্ন দুই ধর্মকে বুঝায়। আসলে কিছুই না,দেশ নিয়ে তার এই ছোট্ট ধারনাও ভুল।
রমেশরা যখন দেশ ছেড়েছিল,ততদিনে ওর ক্ষেতে আগাছা তেমন জন্মায় নি।জন্মে যাবে অচিরেই,এটা নিশ্চিত বলা যায়।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!