রাতের সমুদ্র। বিশাল বিশাল গাঢ় কালচে নীল রঙের ঢেউ একের পর এক এসে আছড়ে পড়ছে, তারপর সাদা হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। চারদিক নিঃশব্দ, ফাঁকা, শুধু ঢেউয়ের গর্জন আর বাতাসের শোঁ শোঁ।
মাঝে মাঝে তীক্ষ চিৎকার করে উড়ে যাচ্ছে দু একটা নিশাচর সামুদ্রিক পাখী।
সমুদ্রের রঙ যেখানে আরও ঘন, প্রায় অন্ধকারের সাথে মিশে গেছে, সেই দূরে খুব তীক্ষè চোখে তাকালে দেখা যায় একটা আরও অন্ধকার ঢিবির মত কিছু। আসলে ওটা ঢিবি নয়, একটা দ্বীপ, আইল্যান্ড। স্থানীয় লোকেরা বলে ‘ম্যাড আইল্যান্ড’।
দূর থেকে খুব ছোট দেখালেও আসলে তা নয়, ঘন জঙ্গল আর ছোট খাটো টিলাতে ভর্তি ‘ম্যাড আইল্যান্ড’ এর আয়তন একটা গ্রামের মত।দ্বীপটায় মানুষের বসবাস তেমন না থাকলেও হিংস্র প্রাণী ও সাপখোপ যথেষ্ট। কিন্তু এখন এই গভীর রাতে দ্বীপটা যেন ঘুমিযে পড়েছে। চারপেয়ে জন্তুর গর্জন বা বুকে হাঁটা সরীসৃপদের চলাফেরার কোন শব্দই হচ্ছে না। বিরাট বিরাট গাছের একটা পাতাও দুলছে না। সব যেন কি এক অজানা ভয়ে হঠাৎ চুপ করে গেছে।শুধু সমুদ্রের ঢেউ মাঝে মাঝেই বেপরোয়ার মত গর্জন করে আছড়ে পড়ছে দ্বীপের গায়ে। আকাশের বুকে ঝকঝক করছে গোল চাঁদ। চাঁদের আলোয় দ্বীপের চেহারা যেন আরও রহস্যময়। এমন সময কোাথা থেকে একটুকরো মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিল। মুহূর্তের জন্য চারদিক অস্পষ্ট হয়ে গেল, আর ঠিক সেই সময় সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে ‘ম্যাড আইল্যান্ডের’ বুক কাঁপিয়ে জেগে উঠল এক রক্ত জল কারা চিৎকার-ক্রি- য়াঁ- য়াঁ- য়াঁ- য়াঁ- য়াঁঙ্ক। পর পর তিনবার তারপর সব চুপচাপ হয়ে গেল।
সমুদ্রের বুকে যারা লঞ্চে মাছ ধরতে বেরিয়েছিল তারা আতঙ্কে কাঠ হয়ে শুনল সেই চিৎকার। কিন্তু চিৎকারের উৎসটা কি তা কেউ বুঝল না।
দুই
খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা প্রফেসারের অভ্যেস। তবে গতকাল সারারাত তিন দুচোখের পাতা এক করতে পারেন নি। সকাল হতেই কফির কাপ হাতে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন জানালার ধারে। চোখ তাঁর দূরে নীল সমুদ্রের দিকে। মাঝে মাঝে কফিতে চুমুক দিচ্ছেন তারপর খুব চিন্তিত মুখে আবার তাকাচ্ছেন সমুদ্রের দিকে।
‘গুড মর্নিং প্রফেসর’! পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে ফিরে তাকালেন তিনি। ঘরে ঢুকেছে তাঁর বিশ্বস্থ সেক্রেটারী মারিয়া।
-‘এসো মারিয়া। বোসো।’
মারিয়া দু’এক পলক তাকিয়ে থাকে প্রফেসারের দিকে। প্রফেসারের মুখ তখন আবার ঘুরে গেছে সমুদ্রের দিকে। কপালে ফুটে উঠেছে চিন্তার ছাপ। মারিয়া বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে এক মুর্হর্ত কি ভাবল, তারপর নিচু গলায় বলল- ‘স্যার, আমি কি পরে আসবো?’
মারিয়ার প্রশ্নে প্রফেসার ফিরে দেখলেন, তারপর লজ্জিত গলায় বললেন-‘না, না, আমি দুঃখিত মারিয়া, আমার তোমাকে এখনই দরকার। ইয়ে মানে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। স্যার। তোমার কাগজপত্র রেডি আছে তো?’
-‘হ্যাঁ স্যার!’ মারিয়া আগের মতই শান্ত কন্ঠে বলে।
-‘ বেশ! তাহলে আমি বলছি, তুমি লিখে যাও।
প্রফেসার জানালার কাছ থেকে সরে সোফায় এসে বসেন। কফির কাপটা নামিয়ে রাখেন সেন্টার টেবিলের ওপরে। তারপর চোখ বুজে ধীরে ধীরে মারিয়াকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে আরম্ভ করেন। মারিয়া তার অভ্যস্ত হাতে চটপট লিখে চলে। লিখতে লিখতে মারিয়া লক্ষ্য করল প্রফেসার মাঝে মাঝেই থেমে যাচ্ছেন। তার কথার খেই হারিয়ে যাচ্ছে। থেকে থেকেই জানালা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকাচ্ছেন আর অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন। একসময় সে আর থাকতে পারল না। বলে উঠল-‘কি হয়েছে স্যার?’ তার প্রশ্নে প্রফেসার চমকে ওঠেন,‘অ্যাঁ! ইয়ে-কই-কিছু-না তো!’
‘আপনাকে তো কখনও এত অন্যমনস্ক দেখি নি। আজ আপনি বারবার চুপ করে যাচ্ছেন। একই কথা দুবার তিনবার রিপিট করছেন আামকে! নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। কি হয়েছে স্যার। আমাকে বলুন। আমি তো আপনার মেয়ের মতো। আমাকে বলা যায় না?’
প্রফেসার বিষণœ চোখে তার দিকে তাকালেন। তারপর মুখ নীচু করে অনেকক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একসময় ক্লান্ত গলায় ধীরে ধীরে বললেন, ‘তুমি ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের নাম শুনেছো?’
‘ভিক্টর-ফ্রাঙ্কেন-আ-হ্যাঁ-হ্যাঁ, শুনেছি স্যার! যিনি একজন মৃত মানুষের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন তো?’ প্রফেসার ঘাঢ় নাড়েন আস্তে আস্তে। ‘শুধু প্রাণের সঞ্চার নয়, বরং বলা যায় তিনি একটি পূর্ণবয়ব মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন।’
’কিন্তু স্যার, সে তো একটা গল্প, নিছক কল্পনা!’
‘হতে পারে, কিন্তু তার ট্রাজিডিটা মিথ্যে নয়, কল্পনা নয়। কারো নিজের হাতে তৈরী করা কোনো জিনিস যদি ভয়ংকর হয়, কুৎসিৎ হয় যদি তা শেষে নষ্ট করে ফেলতে বাধ্য হতে হয় তবে তার চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে? বলো?’ প্রফেসার চুপ করে চেয়ে থাকেন মারিয়ার দিকে।
মারিয়া বুঝে উঠতে পারে না তিনি এসব কথা হঠাৎ কেন বলছেন, হঠাৎ একটা গল্পের চরিত্র প্রফেসারকে এভাবে নাড়া দিল কেন? তবু সে সিনিয়রের কথায় বাধা না দিয়ে বলে, ‘সেকথা খুবই সত্যি স্যার।’
প্রফেসার বলে ওঠেন, ‘কিন্তু এতে সেই স্রষ্টার তো কোন দেষ নেই, সে তো আর চায়নি যে তার সৃষ্টি ভয়ংকার হয়ে উঠুক, তাকে সবাই ভয় পাক, সবাই তাকে ধ্বংস করে ফেলতে চাক। বলো? বলো মারিয়া? চুপ করে আছো কেন? একি সেই স্রষ্টার দোষ?’ প্রফেসারকে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠতে দেখে মারিয়া থতমত খেয়ে যায়। সে ব্যস্ত হয়ে বলেÑ‘না, না, স্যার কোনমতেই তার দোষ নয়। তিনি তো ভাল ভেবেই
‘ঠিক, ঠিক ঠিক এইখানেই আমার কষ্ট মারিয়া। ওফ! আমিও তো ভালই চেয়েছিলাম, চেয়েছিলাম আমার সৃষ্টি আমার আবিষ্কার জগতের কল্যাণে লাগুক, কিন্তু তা না হয়ে আজ যা হতে চলেছে, তাতে আমার সেই সৃষ্টির ভবিষ্যৎ আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি মারিয়া, ওফ!’ দুহাতে মুখ ঢেকে শিশুর মতো কাঁদতে থাকেন বয়স্ক মানুষটা। হতভম্ব মারিয়া কি করবে বুঝতে না পেরে উঠে এসে তাঁর পিঠে হাত রাখে। তারপর নরম গলায় বলে ‘স্যার! ছেলেবেলায় বাবা মাকে হারিয়েছি। রাস্তায় পড়েই হয়তো মরে যেতাম যদি না আপনার গাড়ীর সামনে এসে পড়তাম। সেদিন থেকে আপনাকেই বাবা-মা সব বলে জেনেছি। যা শিক্ষা পেয়েছি তাও আপনার কাছ থেকেই পেয়েছি। এককথায় আমি আপনারই সৃষ্টি। আমি কি খুবই অযোগ্য হয়েছি স্যার!’ প্রফেসার এবার প্রায় কেঁদে ওঠেন ‘না, মারিয়া না, তুমি ইউলিয়াম, তোমাদের মতো আরও চার পাঁচজন শিশুকে আমি কুড়িয়ে এনে মানুষ করেছি, তারা কেউই আজ আর কারো দয়ার পাত্র নয়, বুদ্ধিতে, প্রতিভায় তারা অনেককে ছাপিয়ে গেছে। কিন্তু !’
কিন্তু কি স্যার? বলুন?’ মারিয়া আর নিজেকে সংযত করতে পারে না।
কান্নাভেজা ভাঙা গলায় প্রফেসার বলেন, ‘তোমরা কেউই আমার সৃষ্টি-নও মারিয়া, তোমাদের স্রষ্টা অন্য কেউ। আমি তোমাদের পালন করেছি মাত্র। আর সে, সে যে আমার সাধনার ফসল, আমার পঞ্চান্ন বছরের স্বপ্নের পরিণতি, আমার একান্ত আপনার, সে শুধুই আমার । বলতে বলতে তাঁর কথা আটকে যায় কান্নায়। মারিয়ার ভেতরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করতে থাকে। যে প্রফেসারকে সে এতকাল কাছ থেকে দেখে আসছে, এই পৃৃথিবীতে একমাত্র আপনজন বলে যাকে জানে, আঘাত পেলে যার কাছ গিয়ে সান্ত্বনা খুঁজতে ইচ্ছে করে সেই তিনিও কিনা এমন একজনকে মন দিয়ে রেখেছেন যাকে তাঁর একান্ত আপন বলে মনে হয়? কে সে, প্রফেসারের সাথে তার কিসের সম্পর্ক? যদি তেমন কেউ থাকেই তবে এতদিন তার কথা মারিয়া জানতে পারেনি কেন? সে তো প্রফেসারতে কিছুই লুকোয় না, তবে তার সাথে এমন গোপনীয়তা কেন করতে চাইছেন তিনি? আর হঠাৎ তার জন্য এত আতঙ্কিত হয়ে ওঠারই বা কি হল?
প্রশ্নের ছুঁচ মারিয়ার ভেতরটাকে বার বার বিঁধে চলে! কিন্তু কান্নায় ভেঙে পড়া ঐ মানুষটাকে এই মুহূর্তে খোঁচাতে তাঁর প্রবৃত্তি হয় না। সেচুপ করে বসে থাকে।
প্রফেসার নিজেই এক সময় সামলে ওঠেন। বিষণ হেসে ধরা গলায় বলেন, স্যরি মারিয়া। আমি একটু বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু না হয়ে উপায় ছিল না। বিশেষতঃ আমি যখন খুব ভাল করেই তাকে জানি। তার স্বভাব, চরিত্র তার চলাফেরা সবই আমার কাছে নিজের হাতের তালুর মত চেনা। তাই আমি তার পরিণতিও জানি। তার আয়ু বেশিদিন নয়। বেশিদিন সে এই পৃথিবীতে থাকতে পারে না, পারবে না।
মারিয়া এবার জিজ্ঞাস করে-‘কেন স্যার? তার কি খুব শরীর খারাপ? সে কি দুর্বল?
-‘দুর্বল?’ প্রফেসার ম্লান হাসেন। ‘তাঁর চেয়ে সবল এই মুহূর্তে পৃথিবীতে কাউকে আমার জানা নেই। না চেহারায় না শক্তিতে।
‘তবে আপনার এত টেনশনের কারণ কি স্যার? অবশ্য যদি আমাকে বলতে অসুবিধে না থাকে।’ মারিয়ার গলায় এবার অভিমানের সুর ফুটে ওঠে।
‘সে অন্যের চেয়ে অনেক অনেক গুণ শক্তিশালী, আর এইটেই আমার সবচেয়ে বেশী দুশ্চিন্তার কারণ। যে জন্য আমি তাকে বহুদূরে, নির্জনে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও রাখা গেল না। সে লোকালয়ে আসতে চাইছে, কাল রাতে আমি তার ইঙ্গিত পেয়েছি। বোকা, বোকা, জানেনা ও যাই চাইছে তা ওর পক্ষে শুভ নয়্ নির্জনতাই ওর পক্ষে মঙ্গলজনক। আমারই ভুল মারিয়া, আমি ওকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি, সময়ও পাইনি, এত তাড়াতাড়ি ও বড় হয়ে গেল যে’
‘সে কে স্যার? তাঁর নাম কি?’ উত্তেজনায় মারিয়ার দম বন্ধ হবার জোগাড়। প্রফেসারের মুখে এই‘সে’ ‘তার’ শুনে শুনে সে অস্থির হয়ে উঠেছে। মারিয়ার প্রশ্নে প্রফেসার চমকে ওঠেন। তারপর নিস্তেজ কন্ঠে উচ্চারণ করেন‘নাম? হ্যাঁ, নাম তাঁর একটা দিয়েছিলাম বটে, তবে সে নাম ধরে ডাকার সুযোগ আর হল কই?’
‘কি নাম স্যার? কি নাম তাঁর? মারিয়া সহ্যের শেষ সীমায় পৌছেছে। ধীরে ধীরে প্রফেসার জানালা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকান , তারপর দীর্ঘশ্বাসের মতো উচ্চারণ করে ন,‘তার নাম গডজিলা।’
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।