প্রথম চোখে পড়েছিল অর্ণবের। গাড়ির পিছনের সিটে মা’র থেকে অল্প তফাতে জানলার কাচে মুখ চেপে বসে বাইরের দৃশ্য দেখছিল—খানিক আগে পর্যন্ত ‘এটা কী, ওটা কী’ বলে প্রশ্ন করলেও লোকালয় পেরিয়ে আসার পর দিদির বকুনি খেয়ে চুপচাপ হয়ে গেছে একটু। হঠাৎই সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘বাবা, হরিণ—হরিণ—’
অনন্ত অন্যমনস্ক ছিল। যেতে যেতে তারা যে একটা মেলা পেরিয়ে যাচ্ছে তা নজরে পড়লেও কী দেখছে তা খেয়াল করেনি। অর্ণবের কথা শুনে খেয়াল হল। এবং দেখল, রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা দূরে খুঁটিতে বাঁধা একটা হরিণশিশু ছেলেবুড়োর জটলার মধ্যে ঘাসপাতা মুখে চরে বেড়াচ্ছে। কেউ কিছু দিলে খাচ্ছে বা খাচ্ছে না, কখনও বা ভয় পেয়ে সরে যাচ্ছে দূরে। চেহারায় বড় নয়; একটা মাঝারি সাইজের ছাগলের মতো। এত দূর থেকে ঠিকঠাক বোঝা না গেলেও গায়ে যে রঙ ধরতে শুরু করেছে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। দু-এক মিনিটের মধ্যে পাশের তাঁবুর ভিতর থেকে আরও বড় সাইজের একটা হরিণকে টেনে এনে একটা গাছের গুড়িতে বেঁধে রাখছে একটা পাগড়ি-পরা লোক।
মেলাটা বেশ বড়। কোথাও ডুগডুগি, কোথাও ঢোল বাজছে সাঁওতালি নাচের ছন্দে, যদিও নাচতে দেখল না কাউকে। নানা রকম পসরা নিয়ে কম লোক বসেনি! ভিড়ও জমেছে কিছু, দু’জন চার জন করে রাস্তা পেরিয়ে নেমে আসছে আরও কিছু লোক।
বাবুরা দেখছে অনুমান করে ইতিমধ্যেই গাড়ির গতি শ্লথ করে দিয়েছিল ড্রাইভার রামু সিং।
‘এ তো দেখছি বেশ বড় মেলা!’ অনন্ত বলল, ‘রামু, ইয়ে মেলা ইতনা বড়া কব সে হুয়া?’
‘পিছলে সাল বি বড়া থা। আপ তো নহি আয়া।’ রামু বলল, ‘হর সাল বাড়তে যা রহা হ্যায়। বহুৎ লোক ভি আসে সওদা নিয়ে। সওদা ভি করে অনেকে—’
‘বাবা দেখছ, হরিণছানাটা কেমন লাফাচ্ছে!’ কথা শেষ হতে না হতেই অর্ণব বলল, ‘রামুদাকে বলো না, গাড়িটা থামাতে। আমরা একটু ঘুরে আসি—’
‘এখন এ সব বায়না নয়’, সতর্ক করা গলায় অঙ্গনা বলল, ‘এগারোটা বাজে, একটার মধ্যে পৌঁছতে হবে।’
‘কতক্ষণ লাগবে!’ অখুশি মুখে বলল অর্ণব। তার পর সামনে ঝুঁকে অনন্তর শার্ট টেনে বলল, ‘বাবা, যাবে?’
‘ঠিক আছে। রামু গাড়ি থামাও। খোকাবাবুর শখ হয়েছে—
বিনীতার মাথা ধরেছে। পিছনের সিটে অঙ্গনার ডান দিকে চোখ বন্ধ করে বসেছিল এতক্ষণ। অনন্তর গলা শুনে বলল, ‘ইউজুয়াল থিং। আমি যাচ্ছি না।’ অঙ্গনাও গাড়িতেই থাকল। রোদ লাগলে তার সাইনাসের সমস্যা বাড়ে। বাবুর্চি তসলিমকে সঙ্গে নিল অনন্ত। অঙ্গনা ছেলেকে সাবধান করে বলল, ‘রোদ লাগিও না, অর্ণব। তোমারও সর্দি হয়েছে।’
রোদ অবশ্য নেই তেমন। হালকা রোদ এবং ছায়া ক্বচিৎ হাওয়ার স্পর্শে জায়গা বদল করছে যেন। রাস্তা থেকে মাঠে নেমে হরিণশিশুটা যেখানে, অনন্তর সঙ্গে সে দিকেই হাঁটতে হাঁটতে অর্ণব বলল, ‘বাবা, হরিণটা বাড়ি নিয়ে গেলে হয় না? রামুদা যে বলল, মেলায় সব কিছুই বিক্রি হয়!’
‘বাড়ি নিয়ে গিয়ে কী হবে?’
‘পুষব।’
‘হরিণ কি কুকুর, যে পুষব বললেই পোষা যায়!’ অনন্ত একটু থামল এবং বলল, ‘জঙ্গলের জীব, ওরা জঙ্গলেই ঠিক থাকে. তা ছাড়া, একা থাকতে পারে না, দলের সঙ্গে থাকে। সিনেমায় দেখিসনি?’
ঠিক তখনই হরিণশিশুটি মিঁ-মিঁ করে দু’বার ডেকে এ দিক-ও দিক ছুটোছুটির মতো করতে অর্ণবও কিছুটা চঞ্চল হয়ে পড়ায় অনন্ত দেখল তাদের পিছন দিকে মাঠের মধ্যে ঘোড়া ছোটাচ্ছে একটা লোক— হরিণশিশুটি নিশ্চিত তাই দেখে ভয় পেয়েছে। ঘোড়াটাকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে নিয়ে যেতে ধুলো উড়তে লাগল চার দিকে। ঢোলের শব্দটা এ বার বেশ জোরাল হয়ে উঠেছে। অনন্ত নিজেও এ সব দৃশ্য আগে কখনও দেখেনি।
ওরা হরিণকে ঘিরে জটলার কাছে এসে পৌঁছল। হরিণশিশুটি ফিরে এসেছে আবার, সঙ্গে বড় হরিণটাও। যারা পাতা সমেত গাছের ডাল বাড়িয়ে ধরেছিল, তাদের হাত থেকে সেগুলো টেনে নিতে গিয়েও পিছিয়ে গেল আবার। ওরা দেখল, আগের চেয়ে দ্রুত গতিতে আবার ছুটে আসছে ঘোড়াটা। হরিণশিশুটি ডেকে উঠল আবার।
আশপাশ অশান্ত হতে বাবার হাত চেপে ধরেছিল অর্ণব। সেই ভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘোড়ার দৌড় আর হরিণের ছুটোছুটি থেমে যাওয়ার পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, তুমি কি হরিণের মাংস খেতে ভালবাসো?’
‘হঠাৎ এ প্রশ্ন? কেউ কিছু বলেছে?’
‘দিদি বলেছিল এক দিন।’
‘বিনি?’
অর্ণব মাথা নাড়ল। এখন তার চোখ আর হরিণশিশুর ওপর নিবদ্ধ নেই।
‘কী বলেছিল?’
‘আমি তখন ছোট। দিদি বলল, মামা-দাদুর বাড়িতে কাকা হরিণের মাংস খুব পছন্দ করত। হরিণের মাংস শুনলে লাফাত। সাঁওতালরা জঙ্গল থেকে ধরে এনে বিক্রি করত। ওরাই কেটেকুটে দিয়ে যেত। পিছনের দিকের ঘরে রান্না হত—’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল অর্ণব। তার আগেই মনঃসংযোগ হারিয়েছিল অনন্ত। ছেলে তার দুর্বলতার সেই জায়গাটাই স্পর্শ করল, চাপা ক্ষতের ব্যথার মতো আজও যা তাকে মাঝে মাঝেই দিশেহারা করে রাখে। হুরায় এলে ছোটভাই রেবন্তর সঙ্গে দেখা হবে— কিংবা হবে না, কিন্তু দেখা হলেও কথাবার্তা হবে না, এই চিন্তাটা তার সমস্ত জ্বালা নিয়ে এক বার শুরু হলে সহজে যেতে চায় না মন থেকে, মাথা থেকে। দু’জনের সম্পর্কের তিক্ততা কী করলে ঘুচবে কিছুতেই বোধগম্য হয় না। এ নিয়ে বেশি ভাবলে একটা ডিপ্রেশন মতো হয়, তার জের চলে অনেক ক্ষণ, কখনও বা দিন পেরিয়ে অন্য দিন পর্যন্ত।
আগে বছরে দু’বার অনন্তর সপরিবার আসা হত এখানে। বিরোধের পরও এসেছে এক বার; কিন্তু গত দু’বছরে মা’র মৃত্যু ছাড়াও কোনও না কোনও অজুহাতে আসেনি; অঙ্গনা বা বিনির প্রশ্নের উত্তরে এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। এ বছরও আসবে না ভেবেছিল; কিন্তু ঘটনাটা পারিবারিক সন্দেহের দিকে যাচ্ছে অনুমান করে নিজেই উদ্যোগী হয়ে ওঠে। এই সময়টা ভাল, মেয়ের কলেজ এবং ছেলের স্কুল ছুটি, তারও আদালত বন্ধ; তা ছাড়া হেমন্তর এই সময়টা এই অঞ্চলের আবহাওয়াও থাকে মনোরম। সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়নি। যদিও আজ গাড়ি অনেকটা এগিয়ে আসার পর চিন্তাটা ফিরে এল আবার। তার পর যা হয়, ছেঁকে ধরল অন্যমনস্কতা। অর্ণব ‘হরিণ— হরিণ’ করে চেঁচিয়ে ওঠার পর আচমকাই ফিরে পেল নিজেকে।
মেলার মাঠে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে অনন্ত প্রায় একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল। সঙ্গে আসা তসলিমকে এক বার জিজ্ঞেস করবে ভাবল, তার পর ভাবল সে তার আজ্ঞাবহ মাত্র। মতামতের কোনও দাম নেই। এক বার হিপ-পকেট চেপে মানিব্যাগটা অনুভব করল। দেখল, ধুলো উড়িয়ে ঘোড়াটা আবার ফিরে আসছে, তা দেখে সচকিত হরিণশিশুটি আবার ছুটে গেল তার মায়ের দিকে।
পাগড়ি-পরা যে লোকটা হরিণগুলোর তদারকি করছে তাকে ঝাঁকায় ঢাকা কয়েকটি মুরগি নিয়ে ফিরতে দেখে তসলিমকে ডেকে নিচু গলায় অনন্ত বলল, ‘বাচ্চাটা নেব ভাবছি। দরদাম করো তো।’
তসলিমকে এগোতে দেখে অর্ণবও তার সঙ্গী হল। যেটুকু রোদ্দুর ছিল হঠাৎই আড়াল হয়ে গেল যেন। চার দিকে ছড়িয়ে পড়া ছায়ার কিছুটা ঢুকে পড়ল অনন্তেরও বুকে।
কলকাতা থেকে যত দূরই হোক, হুরা পর্যন্ত এই রাস্তা অনন্তের অপরিচিত নয়। সেই ছোট বয়স থেকে বাহান্ন-তিপ্পান্ন বছর বয়স পর্যন্ত যাতায়াত কম হয়নি। ট্রেন কী বাস থাকলেও রাস্তা চওড়া ও নদীর উপর ব্রিজ হওয়ার পর গাড়িতে যাতায়াত অনেক সুবিধের— মসৃণ রাস্তায় যথেচ্ছ যাওয়া। যখন ইচ্ছে থামা ও নামা যায়, গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে স্টেট এক্সপ্রেসে কয়েক টান দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছনো বেশ মনের মতো হয়।
এ সব সময়েই মনে পড়ে কথাটা— মামারা গত হলেও তার একটা মামাবাড়ি ছিল। নিঃসন্তান মামা মারা যাওয়ার তিন বছর আগে মামিও মারা যান, তখন মামার সম্পত্তির ওয়ারিশান হন তাদের মা, অলকা। বছর চারেক আগে ছোট ভাই রেবন্তর সঙ্গে তুমুল মনোমালিন্য ও প্রায় হাতাহাতি হওয়ার পরে মাকে বুঝিয়ে সম্পত্তি দু’ভাইয়ের নামে উইল করিয়ে নেয় অনন্ত। দু’ভাই দুই অংশের মালিক। অনন্তের ভাগে একটু বেশিই থাকে। তার দুই সজীব ও সুস্থ ছেলেমেয়ে, কিন্তু রেবন্তর একমাত্র ছেলেটি একটু বিকৃত মস্তিষ্ক, সম্পত্তি সামলাতে পারবে না। অলকা ব্যাপারটা বুঝে নেন সহজে। রেবন্তও কোনও আপত্তি করেনি।
পুরনো বিরোধ মিটে গেলেও দু’ভাইয়ের সম্পর্কের টানাপোড়েনটা থেকে গেছে এখনও। অনন্ত তার অংশে আলাদা দরজা ও গেট লাগিয়েছে। নীচের দুটি ঘরের একটিতে পুরনো মালিকে কেয়ারটেকার করে বসিয়েছে। অন্য ঘরটা তসলিমের। সব ঠিকঠাক আছে কি না দেখার জন্য প্রতি মাসে এক বার বা দু’বার পাঠায় তসলিমকে। লোকটি বিশ্বস্ত। কলকাতা বা শ্রীরামপুর যেখানেই থাকুক না কেন, হুরার বাড়ি নিয়ে অনন্তের সব যোগাযোগ তসলিমের সঙ্গে।
রেবন্তের সঙ্গে চিঠিপত্র বা টেলিফোনে কোনও যোগাযোগ নেই। মা বেঁচে থাকতে তাঁর পীড়াপীড়িতে অঙ্গনা, বিনীতারা বিজয়ার চিঠি লিখলে সঙ্গে দু’লাইন দায়সারা শুভেচ্ছা জানাত অনন্ত। মা চলে যাওয়ার পর দু’বছর সেটাও বন্ধ রয়েছে। রেবন্তদের চিঠি কিন্তু ঠিকই এসে যায়। এ বছরও এসেছে।
সে গা না করায় ক্ষুব্ধ বিনি এক দিন বলেছিল, ‘তোমার আবার বেশি-বেশি। এত রাগ, অভিমান কার জন্যে জমিয়ে রাখছ! একটাই তো ভাই!’ জবাব না দিয়ে সরে গিয়েছিল অনন্ত। ইদানীং মনে হয় মা থাকতে থাকতেই সম্পর্কটা জোড়া লাগলে ভাল হত। চাপটা কখনও কখনও পাষাণভারের মতো চেপে বসে বুকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিল অনন্ত। এক জন মানুষের মধ্যে ক’জন মানুষ থাকে? এক জন যে অন্যায় করে, আর এক জন যে অনুশোচনা করে! নাকি আরও এক জনও থাকে যে আড়াল করে রাখে বিবেকটাকে! এ সব চিন্তা কোথাও নিয়ে যায় না।
হরিণের মালিক সঙ্গে লোক দিয়েছিল। তার কাঁধে চড়ে পা-বাঁধা হরিণশিশু চলল অনন্তর গাড়ির ডিকিতে উঠতে। মাঝে মাঝে ডাকছে মিঁ-মিঁ করে। তবে সে-ডাক তেমন স্বতঃস্ফূর্ত নয়। জলভরা দৃষ্টি, কেমন হকচকিয়ে গেছে যেন। তসলিম যাচ্ছে হরিণশিশুর বাহকের সঙ্গে সঙ্গে। খানিক দূর ওদের সঙ্গে হেঁটে তাল রাখতে না পেরে অর্ণব এখন পিছিয়ে হাঁটছে অনন্তর সঙ্গে। যেতে যেতেই বলল, ‘বাচ্চাটাকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু ওর মা-টাকে দ্যাখো, কোনও কান্নাকাটি, ডাকাডাকি নেই! গোড়ায় ফ্যাল ফ্যাল করে দেখল একটু, ডাকল এক বার, তার পর আবার যে-কে-সেই, নিজের মনে পাতা চিবুচ্ছে!’
অনন্ত এক বার পিছনে তাকিয়ে বলল, ‘তাই তো! মানুষের মা হলে এতক্ষণে কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দিত। হয়তো তুই সঙ্গে যাচ্ছিস দেখে ভরসা পাচ্ছে—’
‘ধ্যুৎ, হরিণ কি মানুষের মতো ভাবে নাকি!’ বাবার দিকে তাকিয়ে সামান্য ভুরু কুঁচকে অর্ণব বলল, ‘তুমি হাসছ। আমার কিন্তু দুঃখই হচ্ছে—’
এতক্ষণ ছড়িয়ে থাকা ছায়াটা দপ্ করে সরে গেল হঠাৎ। নতুন করে ফিরে এল রোদ্দুর। আলোয় হাত পাতলে তাপ ছুঁয়ে যায়। ছেলের মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে আবার সমান করতে করতে অনন্ত বলল, ‘এই ভাবে রোদে ঘুরলে মা বকাবকি করবে। তাড়াতাড়ি চলো।’ ওরা পৌঁছে গেল। মাঠ ছেড়ে রাস্তায় উঠতে উঠতেই অনন্ত দেখল হরিণটাকে ডিকিবন্দি করছে রামু সিং।
গাড়ি চলতে শুরু করার পর অঙ্গনা জিজ্ঞেস করল, ‘আবার হরিণছানাটা ধরে আনলে কেন?’ পাশ-কাটানো গলায় অনন্ত বলল, ‘ছেলের ইচ্ছে হয়েছিল— পুষব বলছিল— দামও তেমন কিছু নয়—’
অঙ্গনা জানে, দায়টা অর্ণবের ঘাড়ে চাপানো হলেও অনন্তের সায় না থাকলে এত সহজে হরিণশিশুটি গাড়িতে উঠত না। তখন ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফ্ল্যাটবাড়িতে হরিণ পোষা! একটা কুকুর পুষতেই যা হিমসিম খেতে হল! শেষে লোক ডেকে দিয়ে দিতে হল! বলিহারি কাণ্ডজ্ঞান তোমাদের!’
ঈষৎ বিরক্ত গলায় অনন্ত বলল, ‘পুষব না কী করব, সেটা হুরায় পৌঁছে ভাবা যাবে।’
‘তা হলে কি কেটে মাংস খাবে?’
অনন্ত জবাব দিল না। একটা সিগারেট ধরাবে ভেবে প্যাকেটটা বের করেছিল, অঙ্গনার অস্বস্থি হতে পারে ভেবে নিরস্ত করল নিজেকে। মায়ের আচমকা জবাব শুনে কৌতুক এড়াতে পারল না বিনি। প্রায় হাততালি দিয়ে বলে উঠল, ওহ্ মা! তুমি যে কী ইনটেলিজেন্ট হয়েছ!’
মেয়ের রসিকতায় কান না দিয়ে অঙ্গনা বলল, ‘জীবহত্যা না করলেই নয়!’
‘থামো তো!’ রাগ দেখাল অনন্ত, ‘এ সব হিপোক্রিসি ছাড়া কিছু নয়। পাঁঠার মাংস খাও, মুরগি খাও, সেগুলো জীবহত্যা নয়! কত লোক গরু, শুয়োর খাচ্ছে— সেগুলো কী! শুধু হরিণ হলেই দোষ!’
অনন্তের ধমক শুনে সকলেই চুপ করে গেল। নৈঃশব্দ্যের মধ্যে অনেক ক্ষণ পরে অর্ণব শুধু বলল, ‘হরিণটাকে সত্যি-সত্যি মেরে ফেলবে, বাবা?’
অঙ্গনার সুবিধে-অসুবিধের কথা না ভেবে অনন্ত একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। দু’টান দিয়ে জ্বলন্ত টুকরোটা জানলা গলিয়ে রাস্তায় ছুড়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘জানি না।’
আর কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে শান্ত হয়ে গেল সব তাপ-উত্তাপ। অনন্ত খুশি হল এই কুড়ি-পঁচিশ মিনিট সময় সে নিজের মতো করে ভাববার সুযোগ পেয়েছে। অঙ্গনার কথা থেকেই তার খেয়াল হয়েছিল, যতই তর্ক করুক, হরিণ পাঁঠা কিংবা গরু কি শুয়োর নয়, আইন দ্বারা সংরক্ষিত বন্যপ্রাণী। বহু লোক এখনও সংরক্ষিত প্রাণী মেরে খায়। সেই ভাবে যারা জঙ্গল থেকে ধরে এনে বিক্রি করে তারাও আইন ফাঁকি দেয়। যারা কেনে তারাও। তা হলেও লোক জানিয়ে এ সব করায় ঝুঁকি আছে। পুলিশ জানলে ব্যবস্থা নিতে পারে।
অনন্ত সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইল না। গেট পেরিয়ে গাড়ি ভিতরে ঢোকার সময়েই দেখেছিল ও দিকের বাড়ির বারান্দায় পায়চারি করছে রেবন্ত। তাদের দেখেই, সম্ভবত, দরজার পর্দা সরিয়ে ঢুকে গেল ভিতরে।
অনন্ত তসলিমকে বলল মঙ্গলকে খবর দিতে। চেনা সাঁওতাল বুঢ়া— যেমন দরকার তেমনি কেটেকুটে দেবে হরিণটা। সে জন্যে শুধু টাকাই পাবে না, চামড়া, মুণ্ডু, নাড়িভুঁড়ি— সব নিয়ে যাবে। আজকের কোনও চিহ্ন কাল পর্যন্ত রাখতে চায় না অনন্ত। রান্না- মাংস বাঁচলে, কাল নিয়ে যাবে।
এ দিকটা ম্যানেজ করার পর বিনীতাকে বলল, ‘সন্ধের পর একতলায় গিয়ে কাকাকে নেমন্তন্ন করে আসিস। ছেলেকে ছেড়ে কাকিমা আসবে না। তবু বলিস এক বার। আটটার আগেই যেন আসে। বুঝিয়ে বলবি।’
‘হ্যাঁ রে বাবা, হ্যাঁ।’ তামাশা করার ধরনে বিনি বলল, ‘এত বড় একটা অকেশন! তা মহাভোজটা কবে হবে?’
হাসি চেপে অনন্ত বলল, ‘খুব ফাজিল হয়েছিস!’
বিনি চলে যাওয়ার পর আড়ালে পেয়ে অঙ্গনা বলল, ‘হরিণের মাংস না খাওয়ালে বুঝি ভাইয়ের সঙ্গে ভাব করা যেত না!’
অনন্ত ভাবতে পারেনি কথাটা এই ভাবে তুলবে অঙ্গনা। সময় নিয়ে থতমত ভাবটা কাটিয়ে বলল, ‘আজই শেষ। এ বাড়িতে আর কখনও হরিণের মাংস ঢুকবে না।’
অঙ্গনা বুঝতে পারে এর পর কিছু বললে অশান্তি বাড়বে। সুতরাং চুপ করে থাকল।
‘অর্ণব কোথায়?’
‘ওর বোধহয় জ্বর এসেছে। গা গরম।’ অঙ্গনা বলল, ‘শুয়ে শুয়ে খালি চোখের জল মুছছে। বলে দিয়েছে ওকে যেন হরিণের মাংস খেতে বলা না হয়।’
–