হযরত আবু বকর ওয়াসেতী (রঃ) – পর্ব ২
হযরত আবু বকর ওয়াসেতী (রঃ) – পর্ব ১ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হযরত আবু বকর ওয়াসেতী (রঃ) একবার এক শেকলে বাঁধা বদ্ধ পাগলকে দেখলেন, বড় চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, আমার হাত-পা বাঁধা আছে ঠিকই। কিন্তু হৃদয় আর মুখ তো খোলা। সুতরাং এ অবস্থা কে ঠকাবে!
একবার এক কবর স্থানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, এ সম্প্রাদায় তো বাধকতামুক্ত এবং মাজুর। তাঁর এ কথা শুনে লোকজন তাঁকে বন্দি করে কাজীর কাছে নিয়ে গেল। কাজী অনেক কথাই বললেন। কিন্তু তিনি বললেন, স্বয়ং আল্লাহ ঘোষণা করছেন, এরা মাধ্যবাধকতামুক্ত ও মাজুর। এ জন্য আমিও তাই বলেছি। তাঁর এক শিষ্য তাড়াতাড়ি স্নান সেরে জুমআর নামায পড়তে মসজিদে যাচ্ছেন। হঠাৎ আছাড় খেয়ে পড়লেন। সারা গায়ে ধুলোবালি লেগে গেল। আর আঘাতেও পেলেন খুব। ঘটনা শুনে হযরত আবু বকর ওয়াসেতী (রঃ) বললেন, এতে তোমার খুশি হওয়া উচিৎ। কেননা, এ কষ্ট দেয়া হয়েছে এ জন্য যে আল্লাহ তোমার ওপর খুশি থাকবেন। আর এমনটি না হলে মনে করা যেত, তিনি তোমাকে গ্রাহ্য করছেন না। হযরত আবুল খায়ের আবু সাঈদ (রঃ) তাঁর শিষ্যদের নিয়ে মার্ভে যাবেন হযরত ওয়াসেতী (রঃ) –এর সঙ্গে দেখা করতে। শিষ্যদের এস্তেঞ্জোর কুলুখ সঙ্গে নিয়ে নিতে বললেন, মুরিদরা বললেন, কেন, ওখানে কি কুলুখের মাটি নেই? না অন্য কারণ রয়েছে তিনি বললেন, মার্ভ হল হযরত আবু বকর ওয়াসেতী (রঃ)-এর বাসভূমি। তিনি এমন এক তওহীদ যে যার কারণে মার্ভের মাটি জীবন্ত। কাজেই এস্তেঞ্জা করে জীবন্ত মাটি অপবিত্র করা যায় না।
হযরত আবু বকর ওয়াসেতী (রঃ)-এর জ্ঞানগর্ভ উপদেশবাণীসমূহঃ
(১) সত্যের পথে মানুষ নেই। আর মানুষের তৈরি পথেও সত্য নেই।
(২) যে নিজের দিকে মুখ করে, সে ধর্মের দিকে পিঠ দেখায়।
(৩) তওহীদের গতি নবুয়তের নদীর দিকে। তওহীদের সত্য যেন গভীর সমুদ্র। আর শরীয়তের পথ যেন চোখ, কান ও কথা উপলব্ধি করা।
(৪) তওহীদ শিরক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আল্লাহর ওপর ঈমান আনা সবচেয়ে সেরা কাজ। শিরক অপছন্দীয় কাজ। মানুষ সৃষ্টির সমুদ্রে নিমজ্জিত। নবী-রাসূলগণের হাত ধরলে তাঁরা সৃষ্টির সেই সমুদ্র থেকে উদ্ধার পায় এবং ক্রমশঃ একত্বাবাদের সমুদ্রে এমনভাবে ডুবে যায় যে, কেউ তাঁদের খোজ পায় না।
(৫) একত্ববাদের বাইরের রুপ হল একটি প্রদীপের মতো আর বাস্তব রুপ সূর্য সদৃশ। সূর্য যখন প্রদীপ্ত, প্রদীপের আলো তখন অদৃশ্য। তখনও প্রদীপ কিন্তু বিদ্যমান। কিন্তু তাঁর থাকা না থাকা দুইই সমান। তেমনি শরীয়তের বিধি-বিধান কখনও পরিবর্তিত হলেও একত্ববাদী সত্য অপরিবর্তনীয়।
(৬) জাহেরী জিহ্বার পরিবর্তন করতে হয়, কিন্তু বাতেনী জিহ্বার পরিবর্তন নেই। কাজেই মানুষ যখন যিকির করতে অন্তরে পৌঁছে যায়-যে অন্তরে তওহীদ ছাড়া কিছুই থাকে না, তখন তাঁরা জিহ্বা বাগযন্ত্রটি অচল ও বোবা হয়ে যায়। তখন সে যা কিছু করে তা আল্লাহর তরফ থেকেই হয়।
(৭) আল্লাহর অস্তিত্বের একত্ব এক দুর্বোধ্য ব্যাপার, যে প্রান্তরে পা বাড়াবার কারও সাধ্য নেই। বহু জ্ঞান লোক বলেন, একত্ব প্রমাণ করতে যাওয়া আর একত্বের মধ্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করা প্রায় একই কথা। একজন দরবেশ বলেন, যুক্তি-প্রামাণের মাধ্যমে প্রতিপালককে চিনতে যাওয়া পাপ কর্ম বলে আমি মনে করি। কেননা, নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে তুলনা করে তাঁর অস্তিত্বের কথা বলা শিরকের পরিচায়ক। তেমনি তাঁর অস্তিত্বের দ্বারা নিজের অস্তিত্বের দাবী করাও শিরক ছাড়া আর কিছু নয়। যে ব্যক্তি প্রভুর অস্তিত্ব নিজ অস্তিত্বে দেখে, সে কাফের আর যে নিজ অস্তিত্বে প্রভুর অস্তিত্ব খুঁজতে যায়, সে মূর্খ, প্রভুকে সে চিনতেই পারেনি। বস্তুতঃ যে নিজেকে দেখেছে, সে প্রভুকে দেখেনি। আর যে প্রভুকে দেখেছে সে নিজেই দেখেনি। আর যে নিজেকে ভুলে প্রভুর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে, সে-ই মর্যাদার উচ্চাসনে আরোহণ করেছে।
সূত্রঃ তাযকিরাতুল আউলিয়া